শ্রাবণ মাসের পরিষ্কার ঝকঝকে দিন। শ্রাবণ মাসের ঝকঝকে দিন বলতে যা বোঝায় আর কী। আকাশে ছড়ানো সাদা গম্বুজ মেঘ। দেখলে বোঝা যায় এ সব মেঘে বেশ জল আছে। দেবীপুরের এই নদীতীরে বর্ষা এবং শরৎ ছাড়া বছরের আর কোনও সময়েই আকাশ এত নীল দেখা যায় না। শীতের মাঝামাঝি থেকেই নদীর চরায় হাওয়া উঠতে থাকে। হাওয়া পাঁচ-ছ’ কিলোমিটার বিস্তৃত বালি ও পলির চরকে পুরোপুরি নিজের দখলে নিয়ে যায়। ক্রমে বাড়ি ও পলির কণা সারা আকাশ, বলা ভাল, সারা আবহ ঢেকে ফেলে। আকাশ কেন, তখন দশ-বারো হাত দূরের মানুষকেও পরিষ্কার দেখা যায় না।
আর তখন এ রাস্তাটা প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে গিয়ে নৌকায় উঠতে হয় আমাদের, এ কথা বলল সুরঞ্জিত। বলল, এখন অবশ্য এই দেড় ঘণ্টা হাঁটতে হবে না। আষাঢ়-শ্রাবণে নদী দেবীপুরের গাছতলা পর্যন্ত এগিয়ে আসে। ফলে নৌকা এ পর্যন্ত আসতে পারবে।
আমরা তিনজন, আমি, সুরঞ্জিত আর ছেদিলাল মোহনপুরা যাচ্ছিলাম। আমাদের তিনজনের কাঁধে তিনটে মাঝারি আকারের ভারী ব্যাগ, তাতে তিন-চারে বারো লক্ষ টাকা আছে। মোহনপুরাতে আমাদের ব্যাঙ্কের শাখায় আগামী কাল থেকে ঋণ দাদন আছে, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের বেতন দেওয়া আছে। সেই কারণেই মালদা শহর থেকে এত টাকা নিয়ে আসা। আধ ঘণ্টা আগে ব্যাঙ্কের গাড়ি আমাদের এইখানে নামিয়ে দিয়ে ভালুকাবাজার চলে গেছে। সেই শাখার ছেলেরাও এই একই গাড়িতে মালদা থেকে টাকা নিয়ে এসেছে।
দেবীপুরের গাছতলায় আমাদেরকে নিয়ে জনাতিরিশেক লোক দাঁড়িয়ে, বসে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছিল। এই জনাতিরিশেকের মধে দুজন বেশ্যাও ছিল, ছিল তাদের সঙ্গে বছর তিনেকের একটি শিশু। একটু পরেই বুঝলাম পর পর তিন প্রজন্ম। শিশুটি কন্যা সন্তান। পৃথিবীতে একমাত্র বেশ্যারাই বোধহয় কন্যা সন্তান অধিক পছন্দ করে, এ কথা শিশুটির সাজ-পোশাক, তার দিদিমার তাকে নিয়ে আহ্লাদ দেখে আমার মনে হল।
সুরঞ্জিতের ওই কথার উত্তরে ছেদি বলল, কাকে বলছেন? সেই আশি-বিরাশি সালে উনি তো এ ব্র্যাঞ্চে তিন বছর কাটিয়ে গেছেন।
সুরঞ্জিতের চাকরি বেশি দিনের নয়, আর এদিকে এসেছেও এই প্রথম। তার এ সব জানার কথা নয়। হেড অফিস কিংবা রিজিওনাল অফিসের কাউকে হাতের কাছে পেলে দূরবর্তী কিংবা অসুবিধাজনক জায়গায় যাদের বদলি হয়, নানাভাবে তাদের ক্ষোভ বেরিয়ে পড়ে।
গাছতলায় লোকের সংখ্যা বাড়ছিল। এদের মধ্যে কাউকে কাউকে আমার চেনাও লাগছিল। দু-তিন জনের নামও যেন মনে করতে পারছিলাম। সে রকম এক ব্যক্তি দ্বারকা ত্রিবেদী এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ম্যানেজারবাবু না? কতকাল পরে এলেন! কেমন আছেন?
ভাল, আপনি ভাল আছেন? ছেলেরা?
ত্রিবেদীর বাড়িতে আমি ভাড়া থাকতাম। সে তখন সুদের কারবার করত, এখনও নিশ্চয়ই করে। জানাল, তার বড় ছেলেটা ডাক্তার হয়েছে, ছোটটা শিলিগুড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
কারও ছেলেমেয়ে কৃতী হয়েছে শুনলে সে যদি সুদের কারবারিও হয়, আমার খুব ভাল লাগে। বললাম, বাঃ বাঃ। কোথায় পোস্টিং রাকেশের?
মেদিনীপুরের ঘাটালে, সে বলল, ভাবছি এবার তদবির করে মালদাতে নিয়ে আসব।
আমি বললাম, বাঃ, সে খুব ভাল হবে। মালদা ডাক্তারদের খুব পসারের জায়গা।
ত্রিবেদী আমার ব্যাগের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, এখনও বোঝা বইতে হচ্ছে?
বললাম, গাধা তো, সারাজীবনই বইতে হবে। উত্তরে ত্রিবেদী লজ্জা পেলে বললাম, আসলে তা নয়, এ ব্র্যাঞ্চটা আমার পরিদর্শনের তালিকায় আছে। এদের পেয়ে গেলাম একসঙ্গে আসার জন্য। একা আসা তো— বুঝতেই পারছেন, আপনাদের দেশে তো সভ্যতা এখনও এসে পৌঁছাল না।
ত্রিবেদী হেসে বলল, না আসাই ভাল। এই বেশ আছি।
বেশ্যা দুজন ছাড়া আর কোনও স্ত্রীলোক এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। সম্ভবত, এরা এ রাস্তায় একেবারে অপরিচিত যাত্রী নয়। ফলে অনেকেই বারবার তাদের দিকে তাকাচ্ছিল। ছেদি এক সময় আমার কানে কানে বলল, ওই মেয়েটা দারুণ নাচে, দারুণ গান করে। গতবার চৌরঙ্গি মিঁয়ার ছেলের বিয়েতে এসেছিল। হিন্দি গানের ক্যাসেটের সঙ্গে নাচ করে, নিজে গান গেয়ে মোহনপুরাকে একেবারে মাতিয়ে গেছে।
আমি স্ত্রীলোক দুটিকে ভাল করে দেখলাম এবার। বেশি বয়সের মেয়েলোকটির বয়স মনে হয় চল্লিশ ছুঁইছুঁই। সর্বাঙ্গে তার পেশার অভিজ্ঞতা। কপালে, দুই হাতের বাজু থেকে কবজি পর্যন্ত এবং বুকের উপরে উঁকি দেওয়া উলকি দেখলে বোঝা যায় বস্ত্রান্তরালে অন্যত্রও চতুর উলকি আরও আছে। সে ভগ্নস্বাস্থ্য কিন্তু ভাবভঙ্গিতে খুব আত্মবিশ্বাসী।
অল্পবয়সী মেয়েটিকে অবশ্য এক ঝলক দেখাই যথেষ্ট নয়। তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সী মেয়েটি দীর্ঘাঙ্গী, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য। সিঁথিতে ঠেসে হলুদ রঙের মেটে সিঁদুর। কপালে টিপও সেই রঙের। প্রতি হাতে ডজন খানেক করে নানা রঙের বেলোয়ারি চুড়ি। একখানা বুটিদার নীল রঙা ছাপা শাড়িতে আচমকা মেয়েটিকে ঝলমলে দেখালেও তার আশ্চর্য সুন্দর দীঘল চোখ দুটিতে আকুল-বিহ্বল-শূন্যতা আমার নজর এড়াল না।
নদীর নাম ফুলহার, অথবা মহানন্দা কোথাও। কাটিহারির আমদাবাদের পাশ দিয়ে মালদার মানিকচকের কাছে গঙ্গায় পড়েছে। নদী এই শ্রাবণেই উপচে পড়ছে।
একখানা বেশ বড় আকারের নৌকা প্রায় শ’খানেক যাত্রী নিয়ে এগিয়ে এল। মোটর চালানো কাঠের নৌকা। যাত্রীরা নামলে আমরা উঠে পড়লাম। নৌকায় বসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেই। বাঁশের মোটা বাতা দিয়ে তৈরি নৌকার এক পাশের তার, অন্য পাশে অবশ্য কাঠের পাটাতন আছে। এই দুই অংশের মাঝখানে ফাঁকের মধ্যে মোটর বসানো। কাঠের পাটাতনের দিকে নামমাত্র খানিকটা ছই। সেখানে বোধহয় মাল্লাদের রান্নাবান্নার সরঞ্জাম ছিল। মেয়ে দুটি সেই ঢাকা অংশের বেড়ার গা ঘেঁষে বসল তাদের শিশুটিকে নিয়ে।
সবাই উঠলে একজন মাল্লা হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে মোটর চালু করতেই দূর থেকে ‘হো-ই-ই’ শব্দ করে কেউ জানান দিল। মোটর আবার বন্ধ হল। একটু পরে দুজন লোক দ্রুত, প্রায় ছুটে এসে নৌকায় উঠল। তাদের মধ্যে একজনকে আমার বেশ চেনা মনে হল। ছেদি তার মুখ পিঠের দিকে সরিয়ে নিয়ে বলল, সিকান্দার মিঁয়া, মনে আছে? চৌরঙ্গি মিঁয়ার ভাই।
মনে আছে। আমি যখন এই ব্র্যাঞ্চে ছিলাম কী একটা ঋণ নিয়ে এই লোকটির সঙ্গে আমাদের একটা ঝামেলা হয়েছিল। সেই ঝামেলায় বেশ কিছুদিন আমরা খুব সন্ত্রস্ত ছিলাম। লোকটি দুর্দান্ত এবং এ সব জায়গায় দুর্দান্তরা সবাই ডাকাতি, রাহাজানি এবং তোলা আদায়ের সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ কিংবা প্রশাসনের নাগাল থেকে বহু দূরে এই নদীদ্বীপ এবং দিয়াড়া অঞ্চলে এই সব পেশা একটা সাধারণ বৃত্তি। কিন্তু এও আশ্চর্য, আমরা যে এ ভাবে কোনও সুরক্ষা ছাড়াই টাকা নিয়ে আসি, তাতে এখন পর্যন্ত কোনও ঝামেলা হয়নি।
সিকান্দার নৌকায় ওঠার আগেই স্ত্রীলোক দুজনকে দেখেছিল। উঠে সটান তাদের কাছে চলে গেল সে। বেশ রইসি ভঙ্গিতে বলল, আর্রে লছমনাবাঈ, কঁহাস্যাতি আলি? কঁহা ফির যাবি? কেক্রা ঘরমে মুজরা হ্যাউন?
উদ্দিষ্টা স্ত্রীলোকটি, যার নাম জানা গেল লছমনা, বলল, ইংলিশবাজারসে আইলি, যায়েগি দেয়াসিনি কি পাস।
তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে লাগল। পনেরো-বিশ বছর আগে আমিও কয়েকবার এই দেয়াসিনির কাছে গিয়েছিলাম। তার নাম লক্ষ্মীতারা। সে সময় সে যুবতী। প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রায়ান্ধকার একটা ঘরের মধ্যে তার প্রোফাইল দেখে আমার মনে হয়েছিল একটি মাত্র প্রদীপের পাশে চোল কিংবা অন্ধ্রভৃত্যদের কোনও দেবদাসীকে দেখছি আমি। লক্ষ্মীতারা তার বংশের আচরিত একটা বিশেষ প্রথাকে লালন করে। সপ্তাহের একটি দিন সে দেবদাসী বেশে সমাগত ভক্তদের আবেদন শোনে। তার কাছে মানুষের আবেদন বিচিত্র, তার নিদানও বিচিত্র। মানুষ তার কাছে সন্তান কামনায় নয়, দুরারোগ্য রোগমুক্তির জন্য নয়, আসে ভোলার জন্য।
কী কী ভুলতে চায় মানুষ? সেই বিশ বছর আগে আধা মৈথিলি আধা বাংলায় সে আমাকে বলেছিল: পাপ পাপ! জিয়া তারস্যাল্যা শোক! ভিনসরুয়া সে রাত, রাত সে ভিনসরুয়া ন্যহি ভুলে অইসান পরন্তাপ!
এমন কোনও ফেইথ হিলিং বা বিশ্বাস আরোগ্যর কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। যদি সত্যিই কোথাও থাকত! সন্তান কিংবা ভালবাসার মানুষের বিচ্ছেদ, মৃত্যুজনিত দুঃখ, যদি কিছুতেই না ভোলা যায়, অনুশোচনায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস দগ্ধ হলেও কৃতকর্মের স্মৃতি কিংবা বিবেকের দংশন যদি তোমাকে ছেড়ে না যায়, অপরাধবোধ, পাপবোধ, নিষেদের গণ্ডি পেরোনো কৃতকর্মের কারণে পশ্চাত্তাপ যদি কোনও হতভাগ্যের নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়— মানুষ লক্ষ্মীতারার কাছে আসবে। আধো অন্ধকার ঘরে একাকী লক্ষ্মীতারার সামনে বসে স্বীকারোক্তি করবে সে। দেয়াসিনি লক্ষ্মীতারা তাকে বলবে, ভুলে যাও, বিস্মরণ তোমার স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করুক! প্রাপ্তি তোমাকে পুনর্জীবন দান করুক। তোমার অনুশোচনার কাল পূর্ণ হয়েছে। তুমি স্নিগ্ধ হও, তুমি উজ্জ্বল হও, তুমি আনন্দিত হও! শুধু এর পরে তিনবার ‘ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিঃ, ওঁ শান্তিহি’র বদলে দেয়াসিনি লক্ষ্মীতারা নিমগাছের ছড়ি দিয়ে তিনবার ‘ভুলো, ভুলো, ভুল যাও’ বলে বিস্মৃতিকামীর নগ্ন পিঠের উপরে সজোরে তিনবার আঘাত করবে।
ভুলে যাবে সে অনভিপ্রেত স্মৃতির ত্রাস। বহু দিন ঘুম না হওয়া যন্ত্রণার অবসান হবে। নতুন জীবন ফিরে পাবে সে মানুষ। ফিরে যাবে নতুন জীবনে।
যাত্রীদের মধ্য থেকে কে একজন বলল, দেড় ঘণ্টা চলবে নৌকা, সিকান্দার ভাই, একটো গান তো হোক।
হাঁ হাঁ গান হোক, লছমনাবাঈ, বেটিকে বল, গান করুক একটা। এই নদীর মাঝখানে, এমন ঝলমলা দিনে গান খুব জমবে। সেকেন্দার সোৎসাহে বলল।
লছমনার বাঈ খ্যাতি প্রাপ্য কি না জানি না, কিন্তু সিকান্দারের বারবার ‘বাঈ’ সম্বোধন, তাকে বোধহয় মনে মনে উত্তেজিত করেছিল। সে তবুও বলল, মন উদাস হামারা বেটিয়ার। হাঁ সুনালি, গানা গা-ই এক্কোঠা?
সুনালি সত্যিই ভারী উদাস দৃষ্টিতে নদীর অন্যপারের দিকে তাকিয়ে ছিল। গানের কথা শুনতেই তার চমক ভাঙল। বলল, নাহি! তার পরে মেয়েকে মায়ের কাছ থেকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল, শুত্— শুতেল যো— শুত্তি—
মেয়ে খুব বাধ্য তার, সঙ্গে সঙ্গে নৌকার পাটাতনে শুয়ে পড়ল। সম্ভবত, সে ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গানের কথাটা তার কানে গিয়েছিল। বলল, গীত শুনা।
আমি এত সময়ের মধ্যে এই প্রথমবার সুনালির কণ্ঠস্বর শুনলাম। ভারী, পুরুষালি গলা। সে মেয়ের পিঠের উপর একটা চাপড় মেরে বলল, নাহি, গীত নাহি, নিন্— শুত্যাল রহেল।
পিঠে চাপড় খেয়ে জোরে কেঁদে উঠতেই সুনালি মেয়েকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরল। স্পষ্টতই বিহ্বল সে। মুখে বলল, হাম্মার ববুয়া! না না রো মত্ ববুয়া— হা, শুন— গীত শুনাতানি ববুয়— শুন গীত শুন—মেয়েকে কোলের উপর শুইয়ে সে গান শুরু করল। প্রথমে আস্তে আস্তে, পরে স্বর উঁচু করে। প্রথম তিন পংক্তি যেহেতু ঘুরে-ফিরে আসছিল, কানে আটকে গেল আমার:
মড়্যালকে বাড়িমে রোপানু বৈগনুয়া
সেহোরে ব্যাইগন আধিয়া গেল শুক্কি
অ্যাঁখিয়া নিনো নহী।
হায় রাম—
মেয়ের পিঠে চাপড় দিতে দিতে বারমাস্যার ঢঙে একটা দীর্ঘ গান সুনালি গেয়ে যেতে লাগল। ঘুরে-ফিরে ভারী করুণ এক ধুয়া ‘অ্যাঁখিয়া নিনো নহী!’ দেবীপুরের দিকের নদীর পাড় প্রশস্ত। মোহনপুরার দিকে অনেকটা দৈর্ঘ্য জুড়ে উঁচু বাঁধ আছে। সুনালির প্রায় পুরুষালি গলা নদীর উপর দিয়ে যে অনির্বচনীয় সুর লহরী ভাসিয়ে দিল, ওই পরিবেশে তাতে মুগ্ধ না হয়ে কারও থাকার কথা নয়। প্রতি স্তবকের শেষে ‘অ্যাঁখিয়া নিনো নহী’র ছেদ ওপারের বাঁধে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিতে গুমরে কেঁদে উঠছিল ‘অ্যাঁখিয়া নিনো নহী!’
মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুনালি ওপারের দিকে মুখ রেখেই হঠাৎ মুখে আঁচল চাপা দিল। ত্রিবেদী আর আমি মুখোমুখি বসে ছিলাম। সুনালির মুখে আঁচল চাপা দেওয়া সে দেখেনি, কেননা সে তার পিছন দিকে। আমি সুনালির গান গাওয়ার সময়ও সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সুন্দরী মেয়েটি ‘অ্যাঁখিয়া নিনো নহী’র শরীরী প্রতিমূর্তি যেন। ত্রিবেদী বলল, খুব ভাল গায়, খুব ভাল, অন্য রকম।
আমি চুপ করে রইলাম। প্রশস্ত নদীর ঢেউয়ের উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া ঈষৎ পুরুষালি গলার ‘অ্যাঁখিয়া নিনো নহী’ বহু কালের মতো আমার মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে থাকল।
কিন্তু সবাই তো এমন উদাস হয় না। যে ব্যক্তি উদ্যোগ করে সিকান্দারকে দিয়ে গানের প্রস্তাব করেছিল, সেই আবার বলল, আরে সিকান্দার ভাই, কী সব ঠাণ্ডা গান হচ্ছে, এক-আধঠো গরম পকৌড়ি শুনাও। ‘জ্যারা হুয়ে দে জওয়ান, পিয়াউয়া হমারা কে—’ কি ‘অবহিঁ তো নন্যাদো মোরা জোয়ানি নাদান’ এইসান অক্কঠো হোয়, তব না!
ত্রিবেদী আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকাল। এ অঞ্চলের গরম গীত কী বস্তু, আমার জানা ছিল। আমি ঘুরে লোকটিকে দেখলাম। নৌটংকির আসরের পরিচিত চেহারা, পান-জরদায় ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, মুহুর্মুহু সিটি বাজাতে ওস্তাদ মগহি দিওয়ানা বছর পঁয়ত্রিশের একটি লোক।
কথাটা শুনে লছমনা জ্বলে উঠল যেন। সরোষে বলল, বড়া আয়া গরম শুনাল, ম্যায় মরি খেংরিকে কারাণ, বেটা দুর্গাদাস! চল পুরাটোলি, কেত্তা গরম মালুম করাব তোহারেকে!
এতক্ষণে বুঝলাম বেশ্যাদের সঙ্গে একজন অভিভাবকও আছে। এত সময় সে গুপ্ত ছিল। এবার লছমনার শরীর স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, চুপ যা, ছোড় দে, ই সব দিয়াড়াকে আদমি—
লছমনা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিল। এ ব্যক্তি যথার্থ বেশ্যার ভাত খায়। পূর্বেকার মতোই সে আবার চুপ করে গেল। এমন কী পূর্বোক্ত মগহি দিওয়ানা লছমনার কথার প্রতিক্রিয়ায় যখন হুই-হুই করে সিটি বাজাল, তখনও চেতল না।
সবাই হাসল, লছমনার খিস্তিতেও, দিওয়ানার সিটিতেও। আমি গানটির সুরমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তখনও সুনালির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সে হঠাৎ চোখ তুলে আমাকে দেখল। ঘন নীল বুটিদার শাড়ি পরা মেয়েটি পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার দীর্ঘপল্লব টলটলে চোখ দুটি রক্তাভ। এমন দুটি চোখে ঘুম নেই কেন? বেশ্যার মেয়ের তো এমন হওয়ার কথা নয়!
একদিন বাদ দিয়ে তার পরের দিন বেলা দুটো নাগাদ ফিরে যাওয়ার জন্য এসে নৌকায় উঠলাম। আমার পরিদর্শনের কাজ শেষ হয়েছে। ছেদি আমাকে উঠিয়ে দিতে এসেছিল। ফুলহারের জল আরও বেড়েছে। আকাশ তেমনি উজ্জ্বল নীল এবং তার মাঝে সাদা সাদা মেঘের গম্বুজ। নৌকায় আমাকে নিয়ে মাত্র জনাদশেক লোক হল। এই অবেলায় ওপারে যাওয়ার মানুষ বেশি নেই। মাল্লারা আরও কিছু লোকের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে বাঁধের উপর দিয়ে লছমনা, সুনালি এবং তাদের সঙ্গী লোকটি শিশুটিকে কোলে নিয়ে দ্রুত হেঁটে এল।
নৌকায় উঠে সুনালি দুই হাঁটুর ভিতর চিবুক ঢুকিয়ে সামনের দিকের চলমান জল দেখতে লাগল। তার শিশুটি লছমনার কোলের কাছে। ছেদিকে বিদায় জানিয়ে আমি এসে লছমনার কাছাকাছি বসলাম। গম্ভীর অসংখ্য লড়াই করা চেহারার লছমনা চোখ তুলে আমার দিকে তাকাতে আমি বললাম, বেটির মন ঠিক হয়েছে! দেয়াসিনি কৃপা করেছেন?
নৌকা ছেড়ে দিল। হাত বাড়িয়ে জল ছুঁয়ে কপালে বুকে হাত ঠেকাল লছমনা। বলল, জানেন আপনি দেয়াসিনিকে?
বললাম, জানি। খুব ভাল করেই জানি। ছিলাম তো এখানে তিন বছর। খুব শক্তিশালী দেয়াসিনি। অসহায় মানুষের কত বড় সহায়!
হ্যাঁ, সে তো ঠিক। সে বলল, কিন্তু—, চুপ করে গেল সে।
নৌকা মাঝ নদী দিয়ে মোটরের গতিতে দ্রুত দেবীপুরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে আবার বলল, ইংলিশবাজার যাবেন?
বললাম, হ্যাঁ।
আমরাও, সে বলল।
দেয়াসিনিকে গান শুনিয়েছে আপনার বেটি? কী যে ভাল গায়। আমি আমার মুগ্ধতা গোপন করলাম না।
লছমনা চুপ করে থাকল। শ্রাবণের ভরা নদীর চারধারে আর কোনও নৌকা, আর কোনও রকম ব্যস্ততা নেই। চারদিকের শান্ত জলরাশি, নীল আকাশ, সাদা গম্বুজাকৃতি মেঘ এবং লীলাময়ী বাতাস আশ্চর্য শান্তি ছড়িয়ে রেখেছে। এদিক থেকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে, অস্বস্তি এড়াবার চেষ্টা করতে করতে হতাশ হয়ে লছমনা বলল, বেটির মন ঠিক হচ্ছে না। দেয়াসিনি ওর সঙ্গে পুরো আধা দিন কথা বলেছেন, নাংগা পিঠের উপর তিন বারের জায়গায় নওবার নিমের ছড়ি দিয়ে আঘাত করেছেন। বেটি বলেছে, আউর মারো, জোরসে মারো মাঈ! কিন্তু আজ সকালে উঠে বুঝলাম কিছুই বদলায়নি। পরে দেয়াসিনি আমাকে বললেন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ইলাজ কর।
ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতো আচমকা সুনালি ছিটকে উঠল। উন্মাদের মতো বলতে লাগল, ই স্যব ঝুট হ্যায়! হ্যাম্মা কাঁহি নাই যাব— কাঁহি নাই যাব হ্যাম্মা! শেষে প্রায় ছেঁচড়ে মায়ের কোল থেকে মেয়েটাকে ছিনিয়ে নিল এবং মুহূর্তের মধ্যে নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
হাল ধরে যে মাঝি দাঁড়িয়ে ছিল সে হাল তির্যক করে নৌকাটাকে মাঝ নদীতে চক্রাকারে ঘোরাতে শুরু করল। অন্যজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কাছে দূরে মানুষ কিংবা নীল শাড়িখানার ভেসে ওঠা নজর করার চেষ্টা করতে লাগল। লছমনার সঙ্গী লছমনাকে জাপটে ধরে পাটাতনের সঙ্গে ঠেসে রাখল। অন্যদের সঙ্গে আমি এই ভয়ঙ্কর ট্রাজেডির নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকলাম। পাঁচ-সাত-দশ মিনিট কেটে গেল, সুনালির কোনও চিহ্ন আর দেখতে পেলাম না।
নৌকা ফের দেবীপুরের দিকে চলতে শুরু করল।
সৌজন্যে:
আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ শ্রাবণ ১৪১০ রবিবার ১০ অগস্ট ২০০৩
0 মন্তব্যসমূহ