Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

দুইবার রাজা | অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

বাজে-পোড়া ঠুঁটো তালগাছটা উঠোনের পাশে দাঁড়িয়ে, যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আকাশকে ঠাট্টা করছে৷ অথচ ম্রিয়মাণ, বিষণ্ণ৷

বুকের মধ্যে যেন একটা হাপর আছে, উঁচু তাকিয়াটায় ঘাড় গুঁজে উবু হয়ে শুয়ে অমর হাঁপানির টান টানছে৷ ডাক্তার খানিকটা ন্যাকড়ায় কি একটা ঝাঁঝালো ওষুধ ঢেলে দিয়ে বলে গিয়েছিল শুঁকতে৷ তাতে টান কমা দূরে থাক, রগ দুটো বাগ না মেনে একসঙ্গে টনটন করে উঠেছে৷ বন্ধু সরোজ কতগুলি দড়ি পাকিয়ে মাথার চারপাশটা সজোরে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিল৷ এখন ভীষণ লাগছে তাতে৷ কিন্তু দড়িগুলি খুলে ফেলতে পর্যন্ত জোরে কুলোয় না৷

বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ জাগাতে ইচ্ছে করছে না—পরিক্লান্ত ঘুমন্ত করুণ মুখখানি৷

প্যাঁকাটির মতো লিকলিকে দেহ,—একটা টিকটিকি যেন৷ এই একটুখানি টিঁকে থাকার বিরুদ্ধে সমস্তটা দেহ ষড়যন্ত্র করছে৷ তার কী আর্তনাদ! যেন একটা ভূমিকম্প বা বন্যা!

মার বিষাদস্নিগ্ধ মুখখানির পানে চেয়ে অমরের মনে পড়ল, হঠাৎ কবে কার মুখে গান শুনেছিল—‘জানি গো দিন যাবে, এদিন যাবে’ শেলিও এ কথা বিশ্বাস করে সমুদ্রে ডুব দিয়েছিল—তারপর একশ বছর এক এক করে খসেছে৷ দিন আর এল না৷ বসন্ত যদি এলই,—মহামারী নিয়ে এল, নিয়ে এল চৈত্রের চোখ ভরে রৌদ্রের রোদন৷

‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’—৷ সেদিনো পল্লবমর্মরে কোটি কোটি ক্রন্দন অনুরণিত হবে৷ প্লেটোও তো কত আগে স্বপ্ন দেখেছিল, বার্নার্ড শ’ও দেখেছে৷ ‘সে কবে গো কবে?’

অমরের হঠাৎ ইচ্ছে করল একটা কবিতা লিখতে—সমস্ত বিশ্বাসকে বিদ্রুপ করে৷ ভুয়ো ভগবান আর ভুয়ো ভালবাসা৷ যেমন ভুয়ো ভূত৷—মনে পড়ে বায়রন, মনে পড়ে শোপেনহাওয়ার৷

যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে অমর বেরিয়ে এল উঠোনে৷ সেই ঠুঁটো তালগাছটার গুঁড়ি ধরে হাঁপাতে লাগল৷ দুজনে যেন মিতা একসঙ্গে আকাশের তারাকে মুখ ভেঙচে ভয় দেখাচ্ছে৷

সমস্ত আকাশে কিন্তু নিস্তরঙ্গ ঔদাসীন্য৷

ঝড়ের পর যেমন অরণ্য—টানটা পড়েছে৷

মা বললেন—নাই বা গেলি কলেজে আজ৷ একটা ছাতাও তো নেই৷ যে রোদ—

অমর বললে—হাজিরা থাকবে না৷ তা ছাড়া মাইনে না দেওয়ার দরুন কি দাঁড়িয়েছে অবস্থাটা দেখে আসি৷

—অবস্থা আর এর বেশি কি সঙ্গীন হবে? দুমাসের মাইনে দেবার শেষ তারিখ উতরে গেছে দেখে নাম লাল কালিতে কেটে দিয়েছে৷

সরোজ বললে—তুমি ফ্রি না?

দু হাত দিয়ে বুকের ঘাম মুছে অমর বললে—তা হলে সুপারিশ লাগে,—ঐ যে মোড়ের তেতলা বাড়ির বারান্দায় বসে যিনি মোটা চুরুট টানেন তাঁর৷ তিনি আর প্রিন্সিপ্যাল তো আমার মার এই ছেঁড়া কাপড়, বন্ধক দেওয়া দু-খানি সোনার বালা, এই ঝুল-ঝোলা নোংরা দাঁত-বের-করা খোলার ঘরটা দেখতে আসেন নি৷ আরজি একটা করেছিলাম বটে, সুপারিশ ছিল না বলে বাতিল হয়ে গেল৷ সোজা হয়ে আজো যেন দারিদ্র্য তার সত্য পরিচয় দিতে শেখে নি৷ আর মহীনকে চেন তো?—বাইকে যে আসে—ফ্রি৷ বাড়ি থেকে মাইনে বাবদ যা টাকা আসে, তা দিয়ে ‘পিকাডিলি’ টিন কেনে, সেলুনে বসে দাড়ি কামায়৷

মা হতাশ হয়ে বললে—উপায় কি হবে তবে?

যেন হঠাৎ একটা বাড়ির ভিত খসে গেল কাদায় বসে গেল চলন্ত গাড়ির চাকা!

অমর বললে—ভিজিট পাবে না জেনে ডাক্তার যখন ন্যাকড়ায় ভোঁটকা-গন্ধওলা খানিকটা নাইট্রিক অ্যাসিডের মতো কি ফেলে বলে গিয়েছিল ও রোগে কেউ মরে না, তখন আশ্বস্ত হয়ে আমাকে তোমার বুকে নিয়ে কি বলেছিলে? বলেছিলে—ঠাকুর তোকে বাঁচিয়ে রাখুন, এইটুকুই শুধু চাই৷ বেশ তো, আবার কি! কাল যদি ফের টান ওঠে, তোমার এ ভূতুড়ে হাতুড়ে ডাক্তার না ডাকলেও বেঁচে উঠব৷

পরে ঢোঁক গিলে ফের বললে—তোমার সেই ঠাকুর উড়ে ঠাকুরদের মতোই বাজে রাঁধুনে, মা৷ হয় খালি ঝাল, নয় খালি নুন৷ পরিবেশন করতে পর্যন্ত ভালো শেখে নি৷

জামাটা খুলে ফেললে৷ ছাব্বিশ ইঞ্চি বুক, কঞ্চির মতো হাত-পা, পিঠটা কুঁজো, মাথার চুলে চিরুনি পড়ে না,—তবু মনে হয় যেন একটা উদ্ধত তর্জনী৷

মা পাখা করে ঘামটা মেরে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন৷ যেমন করে পুরুত তার নারায়ণ-শিলা গঙ্গাজলে ধোয়—ততখানি যত্নে৷

সরোজ বললে—তা কি হয়? সামান্য কটা টাকার জন্য কেরিয়ার মাটি করার কোন মানে নেই৷ আমি দেব টাকা, মাইনে দিয়ে দিয়ো ফাইনসুদ্ধু৷

মার বুকের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে অমর বললে—কিছু লাভ নেই তাতে৷ তা ছাড়া পার্সেন্টেজও নেই৷ হপ্তায় দু বার করে টান ওঠে৷ বানান ভুল নিয়ে ঘোষমাস্টারের সঙ্গে তর্ক করা অবধি প্রক্সিও চলে না আর, খালি আমাকে জব্দ করার চেষ্টা৷ ‘গোস্ট’কে যদি অনবরত ‘ঘোস্ট’ বলে চলে একঘণ্টা ধরে,—তা আর যার সহ্য হোক, আমার হয় না, ভাই৷ বিনয় সহকারে প্রতিবাদ করলাম, মাস্টার তো রেগেই লাল৷ প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে নালিশ—আমি নাকি অপমান করেছি৷ আমি বললাম—‘উনি ‘গোস্ট’কে বলেন ‘ঘোস্ট’, ‘পিয়ার্স’কে বলেন ‘পায়ার্স’—তাই শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম ও উচ্চারণগুলি কি ঠিক?

সরোজ বললে—প্রিন্সিপ্যাল কি বললেন?

—বললেন, প্রোফেসার তোমার চেয়ে ঢের বেশী জানেন৷ তাঁকে করেক্ট করবার তোমার রাইট নেই৷ ফের এমন বেয়াদবি কর তো ফাইন করব৷ অদ্ভুত! তা ছাড়া, আমি বিরক্ত হয়ে গেছি, সরোজ৷

একটু থেমে বললে—আমি কী বিরক্ত হয়ে যে গেছি, তুমি তা ভাবতেও পারবে না৷ আমাদের যিনি পয়েট্রি পড়ান, তিনি আবার উকিল৷ চাপকান পরে ছুটতে ছুটতে হাজির, এক গাদা পানে মুখটা ঠাসা,—কীটসের ‘নাইটিঙ্গল’ পড়াবেন৷ ডাক্তার যেমন ছুরি দিয়ে মড়া কাটে ভাই, তেমনি করে কবিতাটা দলে পিষে দুমড়ে চটকে একেবারে কাদাচিংড়ি করে ছাড়লেন৷ ওঁর ব্যাখ্যা শুনে এত ব্যথা লাগল যে, মনে হল বেচারা কীটস যদি ছাত্র হয়ে শুনত ওঁর পড়া, তো বেঞ্চিতে কপাল ঠুকে ঠুকে আত্মহত্যা করত৷ কী সে চেঁচানি, পানের ছিবড়ে ছিটকে পড়ছে,—ভয়ে নাইটিঙ্গেলের প্রাণ থ হয়ে গেছে৷ ‘রুথ’-এর কথা যেখানে আছে, সেখানটায় এসে ওঁর কী বিপুল হাত ছোঁড়া—ও জায়গাটা মুখস্থ করে এসেছিল নিশ্চয়ই৷ ‘রুথ’-এর গল্প কি, বাইবেলের সঙ্গে কোথায় তার অমিল এই নিয়ে তুমুল তর্ক, তুমুল আস্ফালন৷ ‘খুব সোজা’ বলে বই মুড়ে কৌটোর থেকে গোটা চার পান মুখে পুরে প্রায় দৌড়েই বেরিয়ে গেলেন আলপাকার পাল তুলে৷ বোধ হয় অনেক দিন বাদে একটা মোকদ্দমা পেয়েছিলেন৷ —তখনো ভালো ছাত্রেরা বইয়ের ধারে মাস্টারের শব্দার্থ টুকে রাখছে ও পরস্পরে রুথের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে পরামর্শ করছে৷ ভাই সরোজ, আর জ্যোৎস্নারাতে কীটস পড়া চলবে না কোনোদিন৷

পরে মাকে দুই বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললে—তুমি ভাবছ মা যে তোমার ছেলে বি.এ. পাশ করতে পারল না বলেই বয়ে গেল? নয় মা নয়৷ জান? —যারা খুব বড় হয়েছে তাদের শব্দের অর্থ জানতে মার গয়না বন্ধক দিয়ে কলেজে পড়তে আসতে হয় নি৷ এ দিন যাবে, এ কথা তো তুমিই বেশি বিশ্বাস কর৷ দিন যাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু যদি তার পর কালো ঝড়ো রাত্রিই আসে, তাতেও ভড়কাবার কিছু নেই৷ আমাকে জন্ম থেকে এমন পঙ্গু পক্ষাহত করে বানিয়েছেন বলে জবাবদিহি দিতে হবে বিধাতাকেই৷

মা মিছরির জল ছেঁকে দুই কাঁচের গ্লাসে করে দুই বন্ধুকে ভাগ করে দিলেন৷ বললেন—আর একটা গয়নাও তো নেই—

—খবরদার, মা৷ আমার কলেজে পড়া এইখেনে খতম৷ আমি একটা ফাটা ফুসফুস নিয়েই লড়ব৷ তুমি আমার মা, আর ঐ তালগাছটা আমার ছেলেবেলার বন্ধু—কতকালের চেনা৷

সরোজ জিজ্ঞেস করলে—কি করবে তা হলে এখন?

—কবিতা লিখব৷ তুমি হেসো না, সরোজ৷ কথাটা ভারি বেতালা শোনাচ্ছে, জানি৷ কিন্তু আমি সত্যিই লিখব এবার৷ আমার সমস্ত প্রাণ চেঁচিয়ে উঠতে চাইছে৷

সরোজ হেসে বললে—তা হলে আর কবিতা হবে না৷

—না হোক৷ সোজা সত্য কথা বুক ঠুকে আমি খুলে বলে দিতে চাই৷ সৌন্দর্যের আবরণ দিয়ে কুৎসিত নগ্নতাকে ঢেকে রাখার জন্যেই না তোমরা ভগবান বানিয়েছ৷ যে কথা বায়রন, সুইনবার্ন বা হুইটম্যান পর্যন্ত ভাবতে পারে নি—

—তেমন আবার কি কথা আছে?

—দেখো৷ যে কথা ভেবেছিলাম খালি চ্যাটারটন৷

সরোজ ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সহসা পাংশু হয়ে বললে—খবরদার, অমর! ও রকম মারাত্মক ঠাট্টা কোরো না৷

অমর উদাসীনের মতো বললে—মারাত্মক ঠাট্টাই বটে৷ জান, বিধাতা যদি তোমাদের প্রকাণ্ড কবি হন তো এই পৃথিবীটা তাঁর ছন্দপতন৷

কিন্তু না, সত্যি সত্যিই সে রাতে অমর কালি কলম আর কাগজ নিয়ে বসল কবিতা লিখতে৷ মেটে মেঝের ওপর ছেঁড়া মাদুর বিছিয়ে মা ঘুমিয়ে পড়েছে, ম্লান বাতির আলোয় সেই মুখখানির যেন তুলনা নেই৷ ঐ মার মুখখানি নিয়েই একটা কবিতা লেখা যায় হয়তো৷

সলতে ধীরে ধীরে পুড়ে যাচ্ছে,—কিন্তু একটা লাইনও কলমের মুখে উঁকি মারছে না৷ ‘বিট’-এর পুলিশ খানিক আগে চেঁচিয়ে পাড় মাৎ করে জুতোর ভারী শব্দ করে চলে গেছে৷ আবার সেই নিঃশব্দতা,—প্রকাশ করতে না পারার ব্যথার মতোই অপরিমেয়৷

অমরের মনে হল, ভাষা ভারি দুর্বল, খালি ভেঙে পড়ে৷ লিখতে চাইছিল—এই জীর্ণ পৃথিবী, এই দানবী সভ্যতা,—সব কিছুই প্রকাণ্ড ভুল বিধাতার,—এঁচড়েপাকা ছেলের ছ্যাবলামি৷ এঞ্জিন-ড্রাইভার যেমন ভুল পথে গাড়ি চালিয়ে হায় হায় করে ওঠে,—তেমনি অকারণে ভুল করে খেলাচ্ছলে এই পৃথিবীটা বানিয়ে ফেলে ভগবান তারায় তারায় চীৎকার করে উঠেছেন,—অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছেন৷

এত বড় যে ব্যবসাদার,—সেও দেউলে হল বলে৷ কবে লালবাতি জ্বলবে—প্রলয়ের৷ তারই কবিতা৷

লেখা যায় না৷ খালি সলতেটা পুড়ে পুড়ে নিঃশেষ হলে দীপ নিবে যায়৷

বিকেলের দিকে অমর সরোজের বাড়ি গেল৷ পাশেই বাড়ি,—লাগাও টিনের ঘরে একটা গাড়ি পর্যন্ত আছে৷

শ্বেতপাথরের মেঝে,—দুটো দেয়াল প্রায় বইয়ে ভরা,—ছবি খান তিন চার, শেক্সপীয়র, শেলি আর বার্নার্ড শ’র৷ একটা চেয়ারের ওপর বই গাদা করা, মেজেতে কাত হয়ে শুয়ে সরোজ একজামিনের পড়া পড়ছে৷ আর ঘরের এক কোণে স্টোভ জ্বালিয়ে তার বোন চায়ের জল গরম করছে আর দাদাকে বকছে সিগারেট খায় বলে৷

অমরকে ঘরে ঢুকতে দেখে মেয়েটি আরো খানিকটা জল কেটলিতে ঢেলে দিয়ে বললে—যাই বল দাদা, বোহিমিয়াটা আর যাই হোক, আমাদের বহরমপুরের মতোই খানিকটা৷ নইলে—

সরোজ উঠে পড়ে বললে—এস অমর, বসো৷ তুই লক্ষ্মী দিদি, পরোটা ভেজে দিবি আমাদের? দেখ না চট করে—

বোন চলে গেলে সরোজ তাড়াতাড়ি দরজার পরদাটা টেনে দিয়ে শুধোল—এমনিই কি এসেছ, না কোনো কাজ আছে?

অমর সোজা হয়ে বললে—আমাকে কয়েকটা টাকা দাও,—এই গোটা কুড়ি৷

সরোজ হাতের বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল—লুসাই, লুসাই, ও লুসী!

বোন দুহাতে ময়দার ড্যালাটা নিয়ে এসে পর্দার ফাঁকে চোখ রেখে বল্লে—কি হুকুম মশাইয়ের?

সরোজ বললে—চাবিটা দিয়ে দেরাজ থেকে কুড়িটে টাকা বার করে দে তো শিগগির৷

ঘরে ঢুকে ময়দা চটকাতে চটকাতে লুসী বল্লে—কিসের জন্যে শুনি?

—উড়োতে৷ তুই দে খুলে৷ ফফড়দালালি করিস নে৷

দেরাজ খুলতে খুলতে লুসী বললে—দাঁড়াও না৷ দিচ্ছি এবার৷ ঠিক মতো হিসাব দিতে না পারলে রাত্রে ঘুম থেকে উঠে কে চা করে দেয়, দেখব৷

বলে চলে গেল৷ পর্দাটা খানিক দুলে স্থির হল৷

টাকা দিয়ে সরোজ বললে—যদি আবার বিপদে পড় বলতে সঙ্কোচ কোরো না৷—

চা খেতে খেতে অমর ভাবছিল সংসারে এ একটা কি চমৎকার ব্যাপার! উজ্জ্বল স্বাস্থ্য,—সচ্ছল অবস্থা,—কল্যাণী বোন! নাম তার লুসী!

পেছন থেকে কে অতি কুণ্ঠিত কণ্ঠে বলছিল—একটা নতুন কাগজ বেরিয়েছে, যদি নেন—

সরোজ মুখ ফিরিয়ে দেখলে—অমর৷ খালি পা, যে ন্যাকড়া দিয়ে কালি-পড়া লণ্ঠন মোছে তেমনি কাপড় পরনে,—হাঁপানি টানে ঝরঝরে পাঁজর দুটো ঝেঁকে উঠেছে,—কথা কইতে পারছে না৷

সরোজ তক্ষুনিই কাগজটা নিয়ে দাম দিল, কথা কইল না কোনো৷ বরঞ্চ ভারি লজ্জা করতে লাগল ওরই৷

ট্রাম চলল৷ চলন্ত গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে অমর পা পিছলে পড়ে যেতেই সবাই রোল করে উঠল৷ হাঁটুটা চেপে ধরে ‘কিছু-না’ বলে অমর কাগজের বাণ্ডিলটা নিয়ে কাশতে লাগল৷ পরে ভিড়ের মধ্যে কোথায় উধাও হয়ে গেল৷ সরোজ নেমে আর খোঁজ পেলে না তার৷

ফুসফুসটা যেন কে চুষে শুষে ফেলেছে৷

অমর একটা গাছতলায় দুটো হাত মাটিতে চেপে টান হয়ে বসে আকাশের বাতাস নেবার জন্যে গলাটা উঁচু করে ধরেছে৷ কে যেন ওর টুঁটিটা টিপছে, ভিজা গামছার মতো ফুসফুসটা চিপে ফেলছে৷

কাগজের বান্ডিলটার ওপর মাথা রেখে শুতে যেতে দেখে—পাশাপাশি দুটো বিজ্ঞাপন৷ একটা এক ছাত্র পড়াবার জন্যে, আরেকটা কোন অরক্ষণীয়া পাত্রীর জন্যে পাত্র চাই—যেমন-কে-তেমন হলেই চলে—ঠিক এই কথা লেখা আছে৷

টানটা যদি একটু পড়ে বিকেলের দিকে,—অমর ভাবছিল,—তবে কোথায় গিয়ে আগে আরজি পেশ করবে? টিউশানির খোঁজে, না পাত্রীর?

আগে ভাবত—একমুঠো ভাত, একখানি কুঁড়েঘর, আর একটি নারী৷ এখন মনে পড়ছে আরো কত কথা৷ হাঁপানিতে ভুগবে না, ঝড়ে কুঁড়ের চাল উড়ে যাবে না, ভাতে রোগের বীজ থাকবে না, নারীর ঠোঁটে কালকূট থাকবে না৷ এত! তবে—

ক্লান্ত কাক ককায়, আর ককায় ও কাশে মাটির ওপর মায়ের ছেলে৷

পাঁজরা দুটো খানিক জিরোলে তারপর কষ্টে পথ চলে৷ চলতে চলতে প্রথম ঠিকানাটাতেই ঠিক করে এল—যেখানে মাস্টার চায়৷

বাড়ির কর্তা ঘাড় বাঁকিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে শুধোলেন—কদ্দূর পড়া হয়েছে?

অমর বললে—বি.এ. পড়ছি৷

—কালকে আই.এ.-র সার্টিফিকেটটা নিয়ে এস৷ দেখা যাবে৷

একদিন খুব জোরে হাঁপানি উঠলে মা রাগ করে অমরের গলার সবগুলি মাদুলি ছিঁড়ে ফেলেছিল, আর অমর রাগ করে ছিঁড়ে ফেলেছিল—ম্যাট্রিক আর আই.এ.-র সার্টিফিকেট দুটো৷

মাদুলিগুলির মধ্যে একটা সোনার ছিল বলে মা তাড়াতাড়ি সেটা কুড়িয়ে বাক্সে রেখে দিয়েছিল, অমরও ভালো হয়ে এক সময়ে সার্টিফিকেট দুটোর ছেঁড়া খণ্ডগুলি কুড়িয়ে রেখে দিয়েছিল একটা চৌকো লেফাফায়৷ আঠা দিয়ে সেই সার্টিফিকেট আজ জোড়া দিতে বসল৷

কর্তা বহুক্ষণ সার্টিফিকেটটা নেড়ে নেড়ে দেখে জাল নয় প্রতিপন্ন করে বললেন—কিসে ছিঁড়ল? 

—একটা ছোট্ট দুষ্টু বোন আছে,—নাম লুসাই—দুষ্টুমি করে ছিঁড়ে ফেলেছে৷

কর্তা ঘাড়টা বার চারেক দুলিয়ে বললেন—আচ্ছা বাপু, বানান কর তো থাইসিস৷

পরে বললেন—বেশ৷ বল তো ডেনমার্কের রাজধানীর নাম কি? আকবর কত সালে জন্মেছিল? এখান থেকে কি করে ডিব্রুগড় যেতে হয়?

অমর বললে—আমি তো পড়াব ইংরিজি আর অঙ্ক৷ আমাকে এ সব প্রশ্ন করছেন?

কর্তা খাপ্পা হয়ে বললেন—আজকালকার ছেলেগুলো দু-পাতা মুখস্থ করেই পাশ মারে৷ আমাদের সময় আমরা কত বেশি জানতাম৷

কর্তার ছেলে পাশেই ছিল৷ একটা বেয়াড়া রকমের৷ বললে—যা যা জানতে তাই বুঝি জিজ্ঞেস করছ, বাবা? মাস্টারদের যে প্রশ্নটা ভালো করে জানা থাকে, সেইটেই পরীক্ষায় দেয়, আমি বরাবর দেখছি৷ যেন কাগজ দেখবার সময় অসুবিধায় পড়তে না হয়৷

বাপ, একটু দমে গিয়ে বললেন—আচ্ছা, একটা ইংরিজি রচনা লেখ তো,—দেখি তোমার ইংরিজির কত দৌড়৷ একটা কাগজ-পেন্সিল নিয়ে আয় তো, টুনু৷

অমর বললে—কি লিখব? ক পাতা?

কর্তা বললেন—লেখ, মাতা-পিতার প্রতি ভক্তি৷ এক শ শব্দের বেশি নয়৷ এ রকমই আসে পরীক্ষায়৷ 

টুনু একটু হেসে বললে—বাবা, ষোলো ‘থিয়োরেম’ থেকে একটা ‘এক্সট্রা’ দাও না কষতে৷

বাপ চটে বললেন—যা, ওসব কি দেব? দেব মানসাঙ্ক৷

টুনু জোরে হেসে বললে—ওটা বুঝি তুমি জান৷ না?

কর্তা রচনার কি বুঝলেন, তিনিই জানেন,—তবে দেখলেন হাতের লেখাটা বেশ পরিষ্কার৷ বললেন—বেশ, তবে কি জান, ইতিমধ্যে একজন বহাল হয়ে গেছে৷ নইলে তোমাকে নিতুম৷

টুনু অস্ফুটস্বরে বললে—কিন্তু বাবা, ইনি ভালো, এঁকে আমার—

অমর শুধু বলতে পারলে—এ সব কেন লেখালেন তবে?

কর্তা বললেন—লেখা তোমাদের অভ্যেস হয়েই আছে৷ কালে তো জীবনের পেশাই হবে৷ বরঞ্চ সাবেক কালের এন্ট্রান্স পাশ করা বুড়োর কাছে একটা রচনা দেখিয়ে নিয়ে তোমার লাভই হল৷ একটু প্র্যাকটিস হল লেখার৷ তা ছাড়া রচনার ‘সাবজেক্ট’টা তো খুবই ভাল,—কি বল? জান হে বাপু, সে-কালের এন্ট্রান্স তোমাদের এ-কালের পাঁচটা এম.এ.-র সমান,—সেটি মনে রেখো৷

অমর বললে এবার—উনি কততে পড়াবেন?

—পনেরো টাকা৷

—আমাকে দশটা টাকা দেবেন না হয়৷ দরকার হয় দু বেলা এসেই পড়াব দু ঘণ্টা করে৷

টুনু বললে—হ্যাঁ বাবা, এঁকেই—

কর্তা বললেন—বেশ, আসবে কাল৷ আর শোনো, এ ফোর্থ ক্লাসে পড়লে কি হবে, এদের ইংরিজিটা বেশ একটু দাঁত-কামড়ানো৷ বাড়ি থেকে একটু পড়ে আসবে রোজ৷ আর আমি কাল সকালবেলাই একটা রুটিন করে রাখব,—কবে আর কখন কি পড়াতে হবে৷ বুঝলে? একটু ঝিমিয়ো কম৷

রোজ শেষ রাত্রেই টানটা ঠেলে আসে৷ তাই নিয়েই অমর বেরিয়ে পড়ল তাড়াতাড়ি, পাছে আগের ঠিক করা মাস্টার চেয়ার বেদখল করে নেয়,—দশ টাকা থেকে ন টাকা বারো আনায় নেমে৷

কেওড়া-কাঠের একটা থুত্থুরো তক্তপোশ,—ওপরে একটা চাটাই পর্যন্ত নেই৷ ফাঁকে ফাঁকে ছারপোকাদের বৈঠকখানা বসেছে৷

কর্তা একটা জলচৌকি টেনে নিয়ে কাছে বসে বললেন—এই রুটিন করে দিয়েছি, দেখে নাও৷ ঐ চারঘণ্টা করেই রইল,—সকালে দুই, বিকেলে দুই৷ নইলে তো সেই মাস্টারকেই রাখতাম,—দিব্যি চেহারা, দেখলেই মনে হয় ছেলে মানুষ করতে পারবে৷ এম.এ. পাশ৷

পরে বিড়বিড় করে বললেন—এখুনিই এসে পড়বে হয়তো৷ একটা ভাঁওতা মেরে দিতে হবে৷

দরজা ঠেলে যে এল,—অমর তাকে দেখে একেবারে অবাক হয়ে গেল,—মহীন৷ বোধ হয় বেচারা অনেকদিন আউটরাম ঘাটে গিয়ে চা খেতে পারে নি, তাই বুঝি এ চাকরিটা বাগাতে চেয়েছিল৷

অমর প্রশ্ন করলে—তুই কবে এম.এ. পাশ করলি, মহীন?

মহীন সিল্কের রুমাল বার করে ঘাড়ের ঘাম মুছে বললে—তুই পাশ করিস নি নিশ্চয়৷ পনেরো তা হলে আর জোটে নি৷ ‘থাইসিস’ বানান পেরেছিলি তো?

বলেই বাইক করে ছুট দিলে৷

কর্তা বললেন—দেখলে কাণ্ডটা৷ ভাঁড়িয়ে জোচ্চুরি করে ঠকাতে এসেছিল,—ভাগ্যিস রাখিনি৷ পরে চৌকিটা আরো একটু কাছে টেনে বললেন—পড়াও তো বাপু শুনি৷

ছেলে বললে—তুমিও আমার সঙ্গে পড়বে নাকি, বাবা?

কর্তা বললেন—দেখি না কেমন পড়ায়,—মানেগুলো সব ঠিক বলতে পারে কি না৷ হ্যাঁ, আরম্ভ করে দাও,—

অমর বললে—কি ভাবে আরম্ভ করব, তাও যদি বলে দেন৷

কর্তা ঘাড় চুলকে বললেন—তা হলে আর তোমাকে মাস্টার রেখেছি কেন!

—কি হলে আপনার মনোমত হবে, তাও তো একান্ত জানা দরকার দেখছি৷ নইলে—

ছেলে রেগে বললে—আজ কিছুতেই পড়ব না বাবা, তুমি এরকম করলে৷ তুমি যাও চলে৷

তৃতীয় পক্ষের ছেলে৷ বাপ জলচৌকিটা নিয়ে চলে গেলেন৷ যাওয়া মাত্রই ছেলে উঠে দরজায় খিল এঁটে একটা বালি-কাগজের ছেঁড়া খাতা বার করে বললে—একটা কবিতা লিখেছি, মাস্টার মশাই৷ শুনবেন? একটা হাঁস দুই সাদা ডানা মেলে জলে ভাসছিল,—কতগুলি পাজি ছেলে তাকে ধরে কেটেকুটে কাটলেট বানাচ্ছে—

সুকুমার ছেলে—দুটি কালো চোখে সুগভীর সুদূর কৌতূহল, যেন দুটি মণির প্রদীপ জ্বেলে অন্ধকারে কি অনুসন্ধান করছে৷

অমর শুধু বললে—এখন ও সব থাক৷ এবার পড়ি এসো৷

ছেলে অবাক হয় বললে—কেন বলুন তো, —বাবা কবিতার নাম শুনে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খড়ম নিয়ে তেড়ে আসেন, মা পড়ে পড়ে কাঁদেন,—আর আপনিও কবিতা ভালোবাসেন না? তবে আমাদের বইয়ে এত কবিতা লেখা কেন,? শুনেছি, আমাদের দেশে এক প্রকাণ্ড কবি আছেন, তিনি নাকি ছেলেবেলায় আমার মতো ইস্কুল পালাতেন৷ আমার ইস্কুল একটুও ভালো লাগে না,—যেন খানিকটা কুইনিন৷

গায়ে খাকি রঙের শার্ট, পরনে ফিনফিনে কাপড়, কুচকুচে কালো পাড়,—খালি পা,—চোখের পাতার ওপরে বড় একটা তিল৷

অমর জিজ্ঞাসা করলে—তোমার নাম কি, ভাই?

—কিশলয়৷ বড়দি রেখেছিল৷ বড়দিই তো আমাকে কবিতা লিখতে শিখিয়েছিল৷ ওর মরার পর আমি একটা লিখেও ছিলাম,—দেখবেন সেটা? উনি দেখে গেলে কত সুখী হতেন যে, অন্ত নেই৷

—তুমি কি আজ পড়বে না?

—রোজই তো পড়ি৷—দেখুন, ছেলেবেলায় একটা কবিতা পড়েছিলাম,—তারার বিষয়, ইংরিজিতে, আমার ভালো লাগে নি৷ তারাকে আমার কি মনে হয়, জানেন? যেন কারা অনেকগুলি বাতি জ্বালিয়ে নীচের মানুষদের খুঁজছে, যারা বড়দির মতো কেঁদে কেঁদে মরে গেল৷ আমার এক এক সময় মনে হয় ঐ বড় তারাটা যেন বড়দি৷ এখান থেকে একজন যায়, আর আকাশে একটি করে বাড়ে৷ আমি ঐ তারাটাকে নিয়ে কতদিন একটি কবিতা লিখব ভাবছি, পারি না৷ হয় না৷

অমর অঙ্কের খাতাটা মুড়ে রেখে বললে—নিয়ে এসো তো ভাই তোমার কবিতার খাতাটি৷

পুরো মাস গুজরানো হয় নি,—দিন বারো পড়ানো হয়েছে মাত্র৷ পয়লা তারিখ অমর হাত পাতলে মাইনের জন্য৷

কর্তা বললেন—সাত তারিখের আগে হবে না৷

হতে হতে সতেরো তারিখে এসে ঠেকল৷

অমর অবাক হয়ে বললে—বারো দিনের মাইনে এই তিন টাকা সাড়ে তিন আনা?

কর্তা ঘাড় বেঁকিয়ে বললে—কেন, হিসেবের এক চুলও ভুল বার করতে পারবে না৷ নিয়ে এসো তো কাগজ, একটা রুল অফ থ্রি কষে ফেল৷ দুদিন আস নি,—তা ছাড়া এক দিন সাত মিনিট আর দুদিন সাড়ে চার মিনিট লেট করে এসেছিলে—

অমরের ইচ্ছা হল মারে ছুঁড়ে টাকা তিনটা৷ কিন্তু মার পরনের কাপড়টা একেবারে ছিঁড়ে গেছে—পুরোনো বইয়ের দোকানে সস্তায় একটা খুব ভালো বই দেখেছিল, যাবার সময় সেটাও কিনে নিয়ে যেতে পারে৷

সকাল বেলাতেই হাঁপানি উঠেছিল সেদিন৷ তবুও কুঁজো হয়ে ঢিকোতে ঢিকোতে পড়াতে চলল৷ কিশলয় বললে—আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে? বুকে হাত বুলিয়ে দেব?

—দাও৷

কতগুলি বই গাদা করে তার ওপর মাথাটা রেখে অমর শোয় আর কিশলয় বুকে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গল্প শোনে—

শেলিকে কলেজ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, বায়রনকে দেশ থেকে৷ ন্যুট হামসূন ট্রাম-কনডাক্টারি করত৷ ডস্টয়ভস্কিকে ফাঁসিকাঠে তুলে নামিয়ে দিয়েছিল,—গোর্কি থাকত উপোস করে—মুসোলিনি ভিক্ষা করত পোলের তলায় বসে—

কিশলয় উৎকর্ণ হয়ে শুনতে শুনতে বুকের আরো অনেক কাছে এগিয়ে আসে৷

অমর ঐ সুকোমল সুচারু বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানির পানে চেয়ে চেয়ে অনেক কথা ভাবে,—হয়তো এর মধ্যে ভবিষ্যতের ঋষি-কবি তন্ময় হয়ে আছেন৷

হঠাৎ দুজনে শিউরে আঁতকে উঠল—জানালায় কার পাকানো ঝাঁঝালো দুই চক্ষু দেখে৷

কর্তা বন্ধ দরজায় পা দিয়ে ধাক্কা মেরে বললেন—খোল দরজা শিগগির—

কিশলয় ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিলে৷

কর্তা এক ঝাঁকানিতে অমরের হাতটা টেনে শোয়া থেকে তুলে দিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে উঠলেন,—না পড়িয়ে শুয়ে শুয়ে উনি কবিতা শোনাচ্ছেন! গরচা পয়সা দেওয়া হয় কিসের জন্য শুনি? নবাবজাদার মতো তক্তপোশে গা ছড়িয়ে জিরোবার জন্য, নয়? যাও বেরিয়ে এক্ষুনি—

অমর বললে—তবে বাকি মাইনেটা দিয়ে দিন—

—মাইনে দেবে না আরো কিছু! যা বাকি ছিল, সমস্ত এই বেয়াদবির জন্য ফাইন,—কিচ্ছু পাবে না, যাও চলে৷

দেনা টাকাটা দিয়ে নিশ্চয় আরেকবার বিজ্ঞাপন দেওয়া যাবে৷

পশলা বৃষ্টির পর ঘোলা আকাশে চাঁদ উঠেছে,—মরা, মিয়নো—পথের পাঁককে ঠাট্টা করতে৷

হাঁপানির টানে কাঁকড়ার মতো কুঁকড়ে অমর নিঃশ্বাসের জন্য ফুসফুসের কসরত করছিল৷

চোখ বুজে খালি একটি ছবি আজ ও দেখছে—বিষণ্ণ অথচ একটি সুকোমল ছবি৷

বন্ধু মৃত্যুশয্যায়৷ অমর দেখতে গিয়েছিল৷ শেফালির মতো সাদা ধবধবে বিছানা,—তার ওপর এলিয়ে আছে ক্লান্ত তনুর কমনীয় কান্তি—ভাটায় জলস্রোত যেন জিরোচ্ছেন৷ চারপাশে রাশি রাশি ফুল স্তূপীকৃত হয়ে আছে,—বাতাস মন্থর হয়ে গেছে তাই৷ কারো মুখে একটি রা নেই, সবারই মুখে নম্র বেদনা-শীতল একটি ছায়া,—সমস্ত গৃহে বিষাদপূর্ণ একটি মহাশান্তি৷ শিয়রের ধারে খান কয়েক বই,—আত্মীয়ের মতো স্তব্ধ বেদনায় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে, আর কয়েকখানি পুরোনো চিঠি৷ নিষ্ঠুর ডাক্তার পর্যন্ত প্রতীক্ষা করে আছে—মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে৷

শুধু পায়ের ওপর দুটি হাত রেখে একটি দুঃখী মেয়ে বোবার মতো বসে আছে—যেন বিসর্জনের প্রতিমা৷ মুখখানি ভারি মলিন ও উদাস, তাইতে এত সুন্দর৷—মা নয়, বোন নয়, বউ নয়, যেন আর কেউ৷

অমরের সেদিন মনে হয়েছিল,—মৃত্যুও একটা বিলাসিতা৷ মেয়েটির বুকের ব্যথাটি যেন এক অমূল্য বিত্ত৷ এ তো মরা নয়, মিশে যাওয়া৷ যেমন মিশে যায় ফুলের গন্ধ বাতাসে,—যেমন গলে যায় সূর্যাস্তলালিমা অন্ধকারে৷

সন্ধ্যায় টানটা ফের পড়লে অমর বালিশের তলা থেকে দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনটি বার করে ঠিকানা ঠাহর করতে চলল৷

মা প্রশ্ন করলেন—কোথায় যাচ্ছিস?

—পাত্রীর খোঁজে৷ তোমার কত দিনের ইচ্ছা৷ অপূর্ণ রাখা অনুচিত মনে হচ্ছে৷

এক কালে অবস্থা ভালো ছিল, বাড়ির চেহারা দেখলে বুঝা যায়৷ এখন একেবারে গঙ্গাযাত্রী বুড়ি৷

এখনো পাত্র জোটে নি৷ অমরের যেন একটু আসান হল৷

বহু কথা-বার্তার পর শ্যামাপদবাবু বললেন—ছেলেটি কি করেন? কত চাহিদা?

—বি.এ. পড়ে৷ এত দিন মার গয়না বাঁধা দিয়ে চলছিল—আর চলে না৷ চাহিদা,—পড়া-খরচ দু বছর,—আর নগদ হাজার খানেক টাকা৷

শ্যামাপদবাবু তাতেই স্বীকৃত ছিলেন৷ তার কারণ আছে,—দরাদরি করতে গিয়ে কেবলই দাঁও ফসকেছে৷ তা ছাড়া মেয়ের ইতিহাসও বড় ভালো নয় দেখতে তো নিতান্ত কুরূপাই,—এত কুৎসিত যে, ঘাটের মড়ার পর্যন্ত নাকি দাঁতকপাটি লাগে৷

অমর বললে—ছেলেটির কিন্তু এক ব্যারাম আছে,—হাঁপানি৷ প্রায়ই ভোগে৷

শ্যামাপদবাবু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বল্লেন—এমন আর কি শক্ত ব্যায়রাম! ওতে তো আর কেউ মরে না! বয়েসকালে সেরেও যেতে পারে৷ তা, আপনি কি ছেলের বন্ধু, মেয়ে দেখে যাবেন একেবারে?

অমর বললে—আজ্ঞে না, আমিই পাণিপ্রার্থী,—ওটা একেবারে বিয়ের রাতে সেরে ফেললেই চলবে৷ দিন ঠিক করে খবর দেবেন আমাদের, ঠিকানা রইল৷

শ্যামাপদবাবুর মনে অনেক প্রশ্ন ঘুলিয়ে উঠলেও কোনোটাই আমল দিলেন না৷ খালি মেয়ে পার করতে পারবেন,—তাও অবিশ্যি বাষট্টি বছরের বুড়োর কাছে নয়,—এই খবর গিন্নীর কানে দিতেই গিন্নী উলু দিয়ে উঠলেন৷ বাড়িতে সোরগোল পড়ে গেল৷ বাড়ির এক কোণে একটি কুৎসিত কালো মেয়ে দীপশিখার মতো কেঁপে উঠলো খানিক৷

মা বললেন—জানাশোনা নেই, কেমন না কেমন মেয়ে,—একেবারে কথা দিয়ে এলি?

অমর রাগ করে বললে—আর তোমার ছেলেই বা কি গুণধর মা, যে একেবারে পরী তার ডানা দুটো সগগে ফেলে রেখে ফার্স্ট ক্লাস ফিটনে চড়ে তোমার পদ্মবনে এসে দাঁড়াবেন! শাঁখ বাজাও মা৷ গুনে গুনে হাজারটি নগদ টাকা,—আর দু বচ্ছর পড়া-খরচ৷

মা অপর্যাপ্ত খুশী হয়ে গেলেন৷ বিয়ে হয়ে গেলে কাশী যাবেন, সঙ্কল্পও সম্ভব হল৷ 

অমর বললে—তোমার ছেলের এই তো চেহারা—একটা আরসুলার চেয়েও অধম৷ তার ওপর বুকের পাঁজরায় ঘুণ ধরেছে৷ যা পাও, তাই হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ো৷

মা বললেন—মেয়ে যদি খোঁড়া হয়?

—কি যায় আসে তাতে? তোমার ছেলে যে কুঁজো৷ টাকাগুলি তো চকচকে হবে৷

সরোজ বললে—কবে প্রেমে পড়লে হঠাৎ? ফরদা হাওয়ায় পর্দা বেঁফাস হয়ে গেল বুঝি?

লুসী সে ঘরে বসেই সেলাইর কল চালাচ্ছিল, বললে—কবে পড়েছেন উনি পাঁজি দেখে তারিখ লিখে রেখেছেন কি না! আর জন্মে পড়েছিলেন, এ জন্মে পেলেন৷

সরোজ বললে—পড়তে মন যাচ্ছিল না মোটেই, ঘুম পাচ্ছিল৷ লুসীকে বললাম,—কল চালিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দে, দিদি৷ এবার থামাতে পারিস, আমি অমরের সঙ্গে বেরোচ্ছি৷ দে তো চাবিটা৷

দুই বন্ধু বেরিয়ে গেল৷

পিঠের ওপর চুল মেলা, মান্দ্রাজি মেয়েরা যেমন করে শাড়ি পরে তেমনি ধরন শাড়ি পরার, দুটি হাতে সোনার কঙ্কণ, ছুঁচে সুতো পরাবার সময় চোখের কি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি৷ ললাটে আভা৷

ঘুরে ঘুরে অনেক জিনিসই সওদা করলে দুজন,—বাক্স বোঝাই করে৷ টোপর পর্যন্ত৷ তিনটে মুটে৷

ফেরবার মুখে আরেক বন্ধুর সঙ্গে দেখা৷ বয়সে কিছু বড়৷

অমরকে জিজ্ঞাসা করলে—কি করছ আজকাল?

—বিয়ে করছি৷ চূড়ান্ত৷ আর তুমি? টিউশানি পেলে?

—পেয়েছি একটা৷ যৎসামান্য৷ ঐ গলির বাঁকের লাল বাড়িটা৷

—ও! কত দেয়?

—কিঞ্চিৎ৷ ল-কলেজের মাইনে সাড়ে সাত টাকা৷

সরোজ চোখ বড় করে বললে—সাড়ে সাত টাকা?

লজ্জিত না হয়েই বললে বন্ধু—হ্যাঁ, তাই সই৷ মাইনেটা তো চলে যায়৷ আর কি বেয়াড়া এঁচড়ে-পাকা ছেলেই পড়াতে হয়, ভাই! এইটুকুন বয়স থেকেই পদ্য মেলাতে শিখেছে৷ ভাগ্যিস বাপ-মার ‘নাই’ নেই এতে, নইলে উচ্ছন্নে যাবার সুড়ঙ খোঁড়া হচ্ছিল আর কি৷ মা বলে দিয়েছেন, ফের পদ্য মেলালে বেত মারতে৷ তিনটে খাতা প্রায় ভরতি করে ফেলেছে, ভাই৷ সবগুলি পুড়িয়ে ফেলেছি কাল৷

অমর বললে—খুব কাঁদলে?

—বাপের চড়-চাপড়ও তো কম খায় নি৷ মা তার হাতের নোড়া নিয়ে পর্যন্ত তেড়ে এসেছিল৷ কবিতা লিখতে গিয়েই না ছেলেটা এবার অঙ্কে একেবারে গোল্লা পেলে!

অমরের মনে পড়ছিল, সেই খাকি রঙের শার্ট, কোমরে কাপড়ের সেই ছোট আলগা বাঁধুনিটি,—সেই তরল জ্যোৎস্নার মতো দুটি চোখ, সেই বালি-কাগজের ছেঁড়া-খোঁড়া খাতাটা, পেন্সিল দিয়ে লেখা কবিতা, নাম—‘‘বড়দি বা বড় তারা’’,—এক দিন ছোট্ট কচি হাতখানি দিয়ে বুকটা আস্তে একটু ডলে দিয়েছিল—

অমর ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললে—রোজ শেষ রাত্রেই হাঁপানিটা চেগে আসে৷ একটা ইনজেকশান দিয়ে দিন, যাতে অন্তত আজ রাতটা রেহাই পাই৷ আমার বিয়ে কি না৷

ডাক্তার বিস্মিত হলেন বটে৷ যাবার সময় অমর টেবিলের ওপর একটা নিমন্ত্রণপত্রও রেখে গেল৷

বউ-ভাতে তো কাউকে খাওয়াতে পারবে না, তাই যার সঙ্গে একটি দিনের জন্যেও প্রীতি-বিনিময় হয়েছিল তাকে পর্যন্ত নিমন্ত্রণ করলে৷ টাইম-অনুসারে একটা ঠিকা গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করতে কি সুখ!

রাজা৷

কেন নয়? সবাইর চেয়ে উঁচু জায়গায় আসন, সামিয়ানা খাটানো, তাতে তিনটে ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, ফুলদানিতে বিস্তর ফুল, গলায় প্রকাণ্ড মালা, গায়ে সিল্কের দামী জামা, জীবনে এই প্রথম পরেছে, পায়ে চৌদ্দ টাকা দামের জুতো,—দু-মাস টিউশানি করে যা জোটে নি৷

ছেলেরা চেঁচামেচি করছে, মেয়েরা প্রজাপতির মতো উড়ছে ও বর্ষার জলধারার মতো কলরব করছে৷ বন্ধুরা এসে ঠাট্টা ইয়ার্কি করে যাচ্ছে৷ চিকের পেছনে বর্ষীয়সী মেয়েদের ভিড় লেগে গেছে—উলু দিয়ে দিয়ে গলা ভেঙে ফেলছে৷ উলু দিতে গিয়ে কণ্ঠস্বরটা বিকৃত হয়ে গেল, দেখে একটি মেয়ের স্রোতের মতে কি স্বচ্ছ হাসি!

এ বাড়িতে আজ যেখানে যা হচ্ছে সবই তো অমরের জন্য৷ খাবার নিয়ে আঁস্তাকুড়েতে কুকুরগুলি যে লড়াই বাধিয়েছে, তাও৷ যা কিছু বাজনা, যা কিছু হাসি, যা কিছু কোলাহল!

ঐ যে নিভৃতে দাঁড়িয়ে একটি কিশোরী দুটি হাত তুলে চুলের খোঁপাটা ঠিক করে গুছিয়ে নিচ্ছে, চুলের কাঁটাগুলি ফের ভালো করে গুঁজে দিচ্ছে—সেও তো তারই জন্য!—অমর ভাবছিল৷ নইলে আজ মেয়েটি কখনো এই নীল শাড়ীটি পরত না, মাথায় কখনো গুঁজত না ঐ শ্বেতপদ্মের কুঁড়ি৷

শুভদৃষ্টির সময় সবাই বললে বটে, কিন্তু অমর ঘাড় গুঁজে রইল, মুখ তুলে চাইল না৷ পাছে ভুল ভেঙে যায়৷ খালি একটি কথাই মনে পড়ছিল তখন৷

লুসী জিজ্ঞাসা করেছিল—কি নাম আপনার বউয়ের?

অমর বলেছিল—মনোরমা৷

লুসী খপ করে বলে ফেলেছিল—ওমা! আমারও ভালো নাম যে তাই৷ বলেই রাঙা হয়ে উঠে মুচকে হেসেছিল একটু৷

পাছে তেমনি রাঙা হয়ে উঠতে না পারে৷ পাছে—

মনোরমা নিজে কুৎসিত হলেও আশা করেছিল ছবির পাতায় রাজপুত্রের যে ছবি দেখেছিল, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়া না হলেও তেমনিই সুকান্ত হবে তার প্রিয়তম৷ ভাবলে—কড়ে আঙুল দিয়ে কপালে এক টোকা মারলেই ঘাড় গুঁজে পড়ে যাবে বুঝি৷

তবুও তো স্বামী৷ ডাক্তার এসে আর দড়ি দিয়ে কপাল বেঁধে দেয় না, সারারাত্রি মনোরমাই কপাল টিপে দেয়৷ কখনো অনাবশ্যক বলপ্রয়োগ করে বসে৷ রাগ করেই হয়তো৷

অমর সবচেয়ে ঘৃণা করত নিজের এই কদর্য ব্যাধিটাকে৷ আর ঘৃণা করে, যে মুখটা তার সত্যিই বত্রিশটা দাঁত আছে কি না অন্যকে গুনে দেখাবার জন্য সর্বদাই মেলে রয়েছে,—সেই মুখটাকে৷ মনোরমা নাম বদলে নাম রেখেছে তিলোত্তমা!

মা কেঁদেছিলেন বটে একটু, এক ফাঁকে এক এক করে নোটগুলি গুনেও নিয়েছিলেন বার চারেক৷

হঠাৎ একদিন কয়েকখানি আঁচলের খুঁটে বেঁধে কাশী চলে গেলেন৷ বলে গেলেন—বউ তো হয়েছে৷ রেঁধেও দেবে, বুকে মালিশও করবে৷ আমি দিন কতক ধর্ম করে আসি, জিরিয়েও আসি৷

শ্যামাপদবাবু এসে মেয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন৷ অমর আপত্তি করলে না৷ বললে—এ কদিন না হয় কোনো একটা মেসেই থাকব৷ কারো হাত বুলিয়ে না দিলেও চলবে৷ তবে শিগগিরই যেন আসে৷

বাড়ি ফিরে এসে শ্যামাপদবাবু মনে মনে বলছিলেন—বাবা, কাঁটাটা তো খসেছে গলা থেকে! বন্ধুদের বললেন—দুমণ বস্তাও পিঠে করে বওয়া যায়—কিন্তু এই কুৎসিত মেয়েটা কি হয়রানি করেই মেরেছিল! তবু যদি—

তারপরের ব্যাপারটা একটু আকস্মিক বটে, কিন্তু অস্বাভাবিক নয়৷

সন্ধ্যার দিকে রাস্তাতেই খুব জাঁক করে হাঁপানি উঠে গেল৷ একটা গাড়ি ঠিক করতে রাস্তার মধ্যে আসতেই বেহুঁশের মতো একটা মোটর অতি আচমকা একেবারে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল কাঁধের ওপর৷ তার পর ঘষড়াতে ঘষড়াতে—

শ্যামাপদবাবুর কাছে খবর গেল৷ মনোরমা একবার যেতেও চাইল কেঁদে৷ বাপ বুঝিয়ে বললেন—এখন গিয়ে কি আর এগোবে বল? গঙ্গায় না হোক কলতলাতেই শাঁখা ভাঙলে চলবে৷ পানটা আর চিবোস নি, মা৷

মার কাছে তার পৌঁছল না৷ ঠিকানা বদল করেছেন৷

আরো একবার রাজা৷ সবাইর কাঁধের ওপর৷

ওর জন্যই তো আজকের সূর্য অস্ত যাচ্ছে৷ ওর জন্যই তো লুসীর চোখে একবিন্দু অশ্রু!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ