Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

অঙ্গার | প্রবোধকুমার সান্যাল

বছর আষ্টেক হলো দিল্লীতে আমি চাকরি করছি৷ কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক কম৷ কোনো কোনো বছরে কলকাতায় এক-আধবার আসি, ঘুরে বেড়িয়ে সিনেমা দেখে আবার ফিরে চলে যাই৷ নইলে, ইদানীং আর আসা হয়ে ওঠে না৷

বছর তিনেক আগে ফরিদপুর থেকে শোভনা আমাকে চিঠি লিখেছিল—ছোড়দাদা, তুমি নিশ্চয় শুনেছ আজ ছ’মাস হ’তে চললো আমার কপাল ভেঙেছে৷ ছেলেটাকে নিয়ে কিছুদিন শ্বশুরবাড়ীতে ছিলুম, কিন্তু সেখানেও আর থাকা চললো না৷ তোমার ভগ্নিপতি এক আধশো টাকা যা রেখে গিয়েছিলেন, তাও খরচ হয়ে গেল৷ আর দিন চলে না৷ তুমি আমার মামাতো ভাই হলেও তোমাকে চিরদিন সহোদর দাদার মতন দেখে এসেছি৷ ছেলেটাকে যেমন ক’রে হোক মানুষ ক’রে তুলতে না পারলে আমার আর দাঁড়াবার ঠাঁই কোথাও থাকবে না৷ এদিকে যুদ্ধের জন্য সব জিনিসের দাম ভীষণ বেড়ে গেছে৷ নুটু পাস ক’রে চাকরি খুঁজছে, এখনো কোথাও কিছু সুবিধে হয় নি৷ মা ভেবে আকুল৷ ইস্কুলের মাইনে দিতে না পারায় হারুর পড়া বন্ধ হয়ে গেল৷ বাবার কোম্পানীর কাগজ ভেঙে সব খাওয়া হয়ে গেছে৷ তুমি যদি এ অবস্থায় দয়া করে মাসে মাসে দশটি টাকা দাও, তা’হলে অনেকটা সাহায্য হতে পারে৷ ইতি—

দিল্লীতে আমার এই চাকরির খোঁজ প্রথম পিসেমশাই আমাকে দেন, সুতরাং শোভনার চিঠি পেয়ে স্বর্গত পিসেমশায়ের প্রতি আমার সেই আন্তরিক কৃতজ্ঞতাটা হৃদয়াবেগের সঙ্গে ঘুলিয়ে উঠলো৷ সেই দিনই আমি পঁচিশটি টাকা পাঠিয়ে দিলুম এবং শোভনাকে জানালুম, তোর ছেলে যতদিন না উপার্জনক্ষম হয়, ততদিন প্রতি মাসে আমি তোর নামে পনেরো টাকা পাঠাবো৷

সেই থেকে শোভনা, পিসিমা, নুটু, হারু,—সকলের সঙ্গেই আমার চিঠিপত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল৷ পুজোর সময় এবং নতুন বছরের আরম্ভেও আমি কিছু কিছু টাকা তাদের দিতুম৷ তিন বছর এইভাবেই চলে এসেছে৷

ইতিমধ্যে যুদ্ধের গতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের কি-প্রকার অবস্থা দাঁড়িয়েছে, অথবা শোভনারা কি ভাবে তাদের সংসার চালাচ্ছে, এর পুঙ্খানুপুঙ্খ খোঁজখবর আমি নিইনি, দরকারও হয়নি৷ মাঝখানে বোমার ভয়ে যখন কলকাতা থেকে বহু লোক মফঃস্বলের দিকে এখানে ওখানে পালিয়েছিল, সেই সময় শোভনার চিঠিতে কেবল জানতে পেরেছিলুম, ফরিদপুরে জিনিসপত্রের দর খুব বেড়ে গেছে৷ অনেক লোক এসেছে—ইত্যাদি৷ কিন্তু টাকা আমি নিয়মিত পাঠাই, নিয়মিতই প্রাপ্তি স্বীকার এবং চিঠিপত্রও আসে৷ যা হোক এ রকম ক’রে শোভনাদের দিন কাটছে৷

কিন্তু প্রায় ছ’মাস আগে মাসিক পনেরো টাকা পাঠাবার পর দিনকয়েক বাদে টাকাটা দিল্লীতে ফেরৎ এলো৷ জানতে পারলুম ফরিদপুরের ঠিকানায় পিসিমারা কেউ নেই৷ কোথায় তারা গেছে, কোথায় আছে, কিছুই জানা যায়নি৷ চিঠি দিলুম, তার উত্তর পাওয়া গেল না৷ আর কিছুকাল পরে আবার মনি-অর্ডারে টাকা পাঠালুম, কিন্তু, সে টাকাও যথাসময়ে ফেরৎ এলো৷ ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ ক’রে গিয়েছিলুম৷ ভাবলুম, টাকার দরকার হ’লে তারা নিজেরাই লিখবে, আমার ঠিকানা ত’ আর তাদের অজানা নয়৷

কিন্তু আজ প্রায় তিন বছর পরে হঠাৎ কলকাতায় যাবার সুযোগ হলো এই মাত্র সেদিন৷ আমাদের ডিপার্টমেন্টের সাহেব যাচ্ছেন কলকাতায় তদ্বির-তদন্তের কাজে৷ আমাকেও সঙ্গে যেতে হবে৷ ভাবলুম, এই একটা সুযোগ৷ সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে কোনো একটা শনিবারে যাবো ফরিদপুরে, সোমবারটা নেবো ছুটি—দিন দুয়েকের মধ্যে দেখাশোনা করে ফিরবো৷ একটা কৌতূহল আমার প্রবল ছিল, যাদের বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতে কোনো সংস্থান হবার কোন আশা নেই, সেই দরিদ্র পিসিমা আর শোভনা পনেরো টাকা মাসোহারার প্রতি এমন উদাসীন হলো কেন? শুনেছিলুম, ফরিদপুর টাউনে ইতিমধ্যে কলেরা দেখা দিয়েছিল, তবে কি তাদের একজনও বেঁচে নেই? মনে কতকটা দুর্ভাবনা ছিল বৈ কি৷

সাহেবের সঙ্গে কলকাতায় এলুম এবং এসে উঠলুম পাঁচগুণ খরচ দিয়ে এক হোটেলে৷ এসে দেখছি এই বিরাট মহানগর একদিকে হয়ে উঠেছে কাঙ্গালীপ্রধান ও আর একদিকে চলছে যুদ্ধ-সাফল্যের প্রবল আয়োজন৷ ফলে, যারা অবস্থাপন্ন ছিল তারা হয়ে উঠেছে বহু টাকার মালিক, আর যারা গরীব গৃহস্থ ছিল, তারা হয়ে এসেছে সর্বস্বান্ত৷ দেশের সবাই বলছে, দুর্ভিক্ষ গবর্নমেন্ট বলছেন, না, এ দুর্ভিক্ষ নয়, খাদ্যাভাব৷ দুটোর মধ্যে তফাৎ কতটুকু সে আলোচনা আপাতত স্থগিত রেখে সপ্তাহখানেক ধরে আমার কর্তব্যস্রোতে গা ভাসিয়ে দিলুম৷ এর মধ্যে আর কোনোদিকে মন দিতে পারিনি৷ এইভাবেই চলছিল৷ কিন্তু ছোট পিসির মেজ ছেলে টুনুর সঙ্গে একদিন শেয়ালদার বাজারের কাছে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতেই কথাটা আবার মনে পড়ে গেল৷ একটা ফুলকাটা চটের থলেতে সের পাঁচেক চাল আর বাঁ-হাতে ডাঁটাশাক নিয়ে সে বিকেলের দিকে পথ পেরিয়ে যাচ্ছিল৷ দেখা হতেই সে থমকে দাঁড়াল৷ বললুম, কিরে টুনু?

চমকে সে ওঠেনি, কিছুতেই বোধ হয় সে আর চমকায় না৷ কেবল তার অবসন্ন চোখ দুটো তুলে সে শান্তকণ্ঠে বললে, কবে এলে ছোড়দা?

তার হাত ধরে বললুম, তোদের খবর কি রে?

খবর?—ব’লে সে পথের দিকে তাকালো৷ মিলিটারি কসাইখানার মৃত্যুপথযাত্রী রুগণ গাভীর মতো দুটো নিরীহ তার চোখ যেন এই শতাব্দীর অপমানের ভারে সে-চোখ আচ্ছন্ন৷ মুখ ফিরিয়ে বললে, খবর আর কি? কিছু না৷

হাসিমুখে বললুম, এ কি তোর চেহারা হয়েছে রে? পঁচিশ বছর বয়স হয়নি, এরই মধ্যে যে বুড়ো হয়ে গেলি?

আমার মুখের দিকে চেয়ে টুনু বললে, বাংলা দেশে থাকলে তুমিও হতে ছোড়দা—

কথাটায় অভিমান ছিল, ঈর্ষা ছিল, হতাশা ছিল৷ বললুম, চাল কিনলি বুঝি?

টুনু বললে, না, অফিস থেকে পাই কনট্রোলের দামে৷ চারজন লোক, কিন্তু সপ্তাহে ছ’সেরের বেশী পাইনে৷ এই ত’ যাবো, গেলে রান্না হবে৷ তোমার খবর ভালো, দেখতেই ত’ পাচ্ছি৷ বেশ আছো৷—আচ্ছা চলি, যুদ্ধ থামবার পর যদি বাঁচি আবার দেখা হবে৷

বললুম, শোভনাদের খবর কিছু জানিস? তারা কি ফরিদপুরে নেই?

না—ব’লে একটু থেমে টুনু পুনরায় বললে, তাদের খবর আমার মুখ দিয়ে শুনতে চেয়ো না ছোড়দা!

কেন রে? তারা থাকে কোথায়?

বৌবাজারে, তিনশো তেরোর এফ নম্বরে৷ হ্যাঁ, যেতে পারো বৈ কি একবার৷ আসি তা হ’লে—এই বলে টুনু আবার চললো নির্বোধ ও ভারবাহী পশুর মতো ক্লান্ত পায়ে৷

টুনুর চোখে মুখে ও কণ্ঠস্বরে যেরকম নিরুৎসাহ লক্ষ্য করলুম, তাতে শোভনাদের সঙ্গে দেখা করতে যাবার রুচি চলে যায়৷ কলকাতায় এসে তারা যদি শহরতলীর আনাচে কানাচে কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো তাহ’লে একটা কথা ছিল৷ কিন্তু বৌবাজার অঞ্চলের বাসাভাড়াও ত’ কম নয়৷ একটা কথা আমার প্রথমেই মনে হলো, নুটু হয়ত ভালো চাকরি পেয়েছে৷ আজকাল অন্ন দুর্লভ, চাকরি দুর্লভ নয়৷ যারা চিরনির্বোধ ছিল, তারা হঠাৎ চতুর হয়ে উঠলো এই সম্প্রতি৷ একশো টাকার বেশী মাসিক মাইনে পাবার কল্পনা যাদের চিরজীবনেও ছিল না, তারা যুদ্ধ সরবরাহের কনট্রাক্টে সহসা হয়ে উঠলো লক্ষপতি এবং দুর্ভিক্ষকালে চাউলের জুয়াখেলায় কেউ কেউ হলো সহস্রপতি৷ হয়ত নুটুর মতো বালকও এই যুদ্ধকালীন জুয়ায় ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলেছে৷ এ যুদ্ধে কী না সম্ভব?

ওদের খবর নেবো কি নেবো না এই তোলাপাড়ায় আর কাজের চাপে কয়েকটা দিন আরো কেটে গেল৷ হঠাৎ আফিসের সাহেব জানালেন, আগামী কাল আমাদের দিল্লী রওনা হতে হবে৷ এখানকার কাজ ফুরিয়েছে৷

আমারও এখানে থাকতে আর মন টিঁকছিল না৷ আমার হোটেলের নীচে সমস্ত রাত ধরে শত শত কাঙ্গালীর কান্না শুনে বিনিদ্র দুঃস্বপ্নে এই ক’টা দিন কোনমতে কাটিয়েছি—আর পারিনে৷ দুর্গন্ধে কলকাতা ভরা৷ তবু এখান থেকে যাবার আগে একবারটি পিসিদের খবর না নিয়ে যাওয়ার ভাবনায় মন খুঁৎ খুঁৎ করছিল৷ বিশেষ ক’রে যাবার আগের দিনটা ছুটি পেলুম জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার জন্য৷ একটা সুযোগও পাওয়া গেল৷

বৌবাজারের ঠিকানা খুঁজে বার করতে আমার বিলম্ব হল না৷ মনে করেছিলাম তারা যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, হঠাৎ গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা চমক দেবো৷ কিন্তু বাড়ীটা দেখেই আমি দিশেহারা হয়ে গেলুম৷ সামনে একটা গেঞ্জি বোনার ঘর, তার পাশে লোহার কারখানা, এদিকে মনিহারি দোকান, ভিতরে ভূষিমালের আড়ত৷ নীচেকার উঠোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি, নীচের তলাটায় কতকগুলি লোক শোণদড়ির জাল বুনচে ক্ষিপ্রহস্তে৷ উপরতলাটা লক্ষ্য ক’রে দেখি, বহু লোকজন৷ ওটা যে মেসবাসা, তা বুঝতে বিলম্ব হলো না৷ একবার সন্দেহক্রমে বাড়ীর নম্বরটা মিলিয়ে দেখলুম৷ না, ভুল আমার হয়নি—টুনুর দেওয়া এই নম্বরই ঠিক৷

এদিক ওদিক দু-চার জনকে ধরে জিজ্ঞেস পড়া করতে গিয়ে যখন গণ্ডগোল পাকিয়ে তুলেছি, দেখি সেই সময়ে বছর বারো তেরো বয়সের একটি মেয়ে সকৌতুকে উপরতলাকার সিঁড়ি বেয়ে মেসের দিকে যাচ্ছে এবং তাকে দেখে চার পাঁচটি লোক উপর থেকে নানারঙ্গে হাতছানি দিচ্ছে৷ আমি তাকে দেখেই চিনলুম, সে পিসিমার মেয়ে৷ তৎক্ষণাৎ ডাকলুম, মিনু?

মিনু ফিরে তাকালো৷ বললুম, চিনতে পারিস আমাকে?

না৷

তোর মা কোথায়?

ভেতরে৷

বললুম, আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল দেখি? এ যে একেবারে গোলকধাঁধাঁ! আয় নেমে আয়৷

মিনু নেমে এলো৷ বললে, কে আপনি?

পোড়ারমুখি! ব’লে তার হাত ধরলুম,—চল ভেতরে, তোর মা’র কাছে গিয়ে বলব, আমি কে? মুখপুড়ি, আমাকে একেবারে ভুলেছিস?

আমাকে দেখে উপরতলাকার লোকগুলি একটু স’রে দাঁড়ালো৷ বেশ বুঝতে পাচ্ছিলুম, আমার হাতের মধ্যে মিনুর ছোট্ট হাতখানা অস্বস্তিতে অধীর হয়ে উঠেছে৷ উপরে উঠতে গিয়ে সে বাধা পেয়েছে, এটা তার ভালো লাগেনি৷ তার দিকে একবার চেয়ে আমি নিজেই তার হাতখানা ছেড়ে দিলুম৷ মিনু তখন বললে, ওই যে, চৌবাচ্ছার পাশে গলির ভেতর দিয়ে সোজা চ’লে যান, ওদিকে সবাই আছে৷

এই ব’লে সে উপরে উঠে গেল৷ চোখে মুখে তা’র কেমন যেন বন্য উদভ্রান্ত ভাব৷ এই সেদিনকার মিনু—পরণে একখানা পাতলা সস্তা ডুরে, চেহারায় দারিদ্র্যের রুক্ষ শীর্ণতা—কি এরই মধ্যে তারুণ্যের চিহ্ন এসেছে তার সর্বাঙ্গে৷ তার অজ্ঞান চপলতার প্রতি ভীত চক্ষে তাকিয়ে আমি একটা বিষণ্ণ নিশ্বাস ফেলে ভিতর দিকে পা বাড়ালুম৷

বিস্ময়-চমক দেবার উৎসাহ আমার আর ছিল না৷ সরু একটা আনাগোনার পথ পেরিয়ে আমি ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলুম, পিসিমা?

কে?—ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে সাড়া এলো এবং তখনই একটি স্ত্রীলোক এসে দাঁড়ালো৷ বললে, কাকে চান?

অপরিচিত স্ত্রীলোক৷ রং কালো, নাকে নাকছাবি, মুখে পানের দাগ, পরণে নীল কাঁচের চুড়ি৷ এই প্রকার স্ত্রীলোকের সংখ্যা বৌবাজারেই বেশী৷ বললুম, তুমি কে?—এই ব’লে অগ্রসর হলুম৷

স্ত্রীলোকটি বললে, আমি এখানকার ভাড়াটে৷

এমন সময় একটি ছেলে বেরিয়ে এলো৷ দেখেই চিনলুম, সে হারু৷ হাসিমুখে বললুম, কি হারু, চিনতে পারিস? তোর মা কোথায়?

সে আমাকে চিনলো কিনা জানিনে, কিন্তু সহাস্যে বললে, ভেতরে আসুন৷ মা রাঁধছে৷

অগ্রসর হয়ে বললুম, তোর দিদি কোথায়?

দিদি এখুনি আসবে, বাইরে গেছে৷ আসুন না আপনি?

বেলা বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু এ বাড়ির বাসিপাট এখনো শেষ হয়নি৷ দারিদ্র্যের সঙ্গে অসভ্যতা আর অশিক্ষা মিলে ঘর দুয়ারের কেমন ইতর চেহারা দাঁড়ায়, এর আগে এমন ক’রে আর আমার চোখে পড়েনি৷ ছায়ামলিন দরিদ্র ঘর-দুখানার ভিজা দুর্গন্ধ নাকে এলো,—এ পাশে নর্দমা ও পাশে কুৎসিত কলতলা৷ একধারে ঝাঁটা, ভাঙা হাঁড়ি, কয়লা আর পোড়া কাঠকুটোর ভিড়! ছেঁড়া চটের থলে টাঙিয়ে পায়খানা ও কলতলার মাঝখানে একটা আবরু রক্ষার চেষ্টা হয়েছে৷ পিসিমাদের মতো শুদ্ধাচারিণী মহিলারা কেমন ক’রে এই নরককুণ্ডে এসে আশ্রয় নিলেন, এ আমার কাছে একেবারে অবিশ্বাস্য৷ একটা বিশ্রী অস্বস্তি যেন আমার ভিতর থেকে ঠেলে উপরে উঠে এলো৷ 

রান্নার জায়গায় এসে পিসিমাকে পেলাম৷ সহসা সবিস্ময়ে দেখলাম, তিনি চটাওঠা একটা কলাইয়ের বাটি মুখের কাছে নিয়ে চা পান করছেন৷ আমাকে দেখে বললেন, একি, নলিনাক্ষ যে? কবে এলে?

কিন্তু আমি নিমেষের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলুম তাঁর চা খাওয়া দেখে৷ পিসিমা হিন্দুঘরের নিষ্ঠাবতী বিধবা, স্নান আহ্নিক পূজা গঙ্গাস্নান, দান ধ্যান—এই সব নিয়ে চিরদিন তাঁকে একটা বড় সংসারের প্রতিপালিকার আসনে দেখে এসেছি৷ সদ্যস্নাতা গরদের থান-পরা পিসিমাকে পূজা-অর্চনার পরিবেশের মধ্যে দেখে কতদিন মনে মনে প্রণাম ক’রে এসেছি৷ কিন্তু তিন বছরে তাঁর এ কি পরির্বতন? আমিষ রান্নাঘরে ব’সে ভাঙা কলাইয়ের বাটিতে চা খাচ্ছেন তিনি?

বললুম, পিসিমা, প্রণাম করবো পা ছুঁতে দেবেন?

পা বাড়িয়ে দিয়ে পিসিমা বললেন, কলকাতায় আমরা ক মাস হলো এসেছি, তোমাকে খবর দেওয়া হয়নি বটে৷ আর বাবা, আজকাল কে কার খবর রাখে বলো! চারিদিকে হাহাকার উঠেছে!

আমি একটু থতিয়ে বললুম, পিসিমা—আপনাদের মাসোহারার টাকা আমি নিয়মিতই পাঠাচ্ছিলুম...কিন্তু আজ ছ’মাস হ’তে চললো আপনাদের কোনো খোঁজখবর নেই!

খবর আর আমরা কাউকে দিইনি, নলিনাক্ষ৷

পিসিমার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ঔদাসীন্য আর অবহেলায় ভরা৷ একদিন আমি তাঁর অতি স্নেহের পাত্র ছিলুম, কিন্তু আজ তিনি যে আমার এখানে অপ্রত্যাশিত আবির্ভাবে খুশী হননি, এ তাঁর মুখ চোখ দেখেই বুঝতে পারি৷

হ্যাঁগো, দিদি—? বলতে বলতে সেই আগেকার স্ত্রীলোকটি হাসিমুখে চাতালের ধারে এসে দাঁড়ালে৷ পিসিমা মুখ তুললেন৷ সে পুনরায় বললে, তুমি বাজারে যাবে গা? বাজারে আজ এই এত বড় বড় টাটকা তপসে মাছ এসেছে...একেবারে ধড়ফড় করছে!

তার লালাসিক্ত রসনার দিকে তাকিয়ে পিসিমার মুখখানা কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে এলো৷ তিনি বললেন, তুমি এখন যাও, বিনোদবালা৷

এমন উৎসাহজনক সংবাদে ঔৎসুক্য না দেখে ম্লানমুখে বিনোদবালা সেখান থেকে স’রে গেল৷ পিসিমা বললেন, তোমার কি খুব তাড়াতাড়ি আছে, নলিনাক্ষ?

বিশেষ কিছু না৷—ব’লে আমি হাসলুম—আজকের দিনটা আপনাদের এখানে থাকবো বলেই আমি এসেছিলুম, পিসিমা৷

তা বেশ ত’, বেশ ত’—তবে কি জানো বাবা, খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট কিনা—বলতে বলতে পিসিমা চা খেয়ে বাটি সরিয়ে দিলেন৷ আমার থাকার কথায় তাঁর দিক থেকে কিছুমাত্র আনন্দ অথবা উৎসাহ দেখা গেল না৷

বললুম, শোভনা কোথায়, পিসিমা?

সে আসছে এখুনি, বোধহয় ও-বাড়ি গেছে৷

ঈষৎ অসন্তোষ প্রকাশ ক’রে আমি বললুম, সে কি আজকাল একলা বাসা থেকে বেরোয়?

পিসিমা বললেন, না, তেমন কই? তবে তেলটা, নুনটা মধ্যে মাঝে দোকান থেকে আনে বৈকি৷ বিনোদবালা যায় সঙ্গে৷

পিসিমা তাঁর কথার দায়িত্ব কিছু নিলেন না, কেমন একটা মনোবিকারে আমার মাথা হেঁট হয়ে এলো৷ বললুম, শোভনার ছেলেটি কোথায়? কত বড়টি হয়েছে?

পিসিমা বললেন, তার খুড়ো-জ্যাঠা আমাদের কাছে ছেলেটাকে রাখলো না, নলিনাক্ষ৷ তাদের ছেলে তারা নিয়ে গেছে৷

সে কি পিসিমা, অতটুকু ছেলে মা ছেড়ে থাকতে পারবে? শোভনা পারবে থাকতে?

তা পারবে না কেন বলো? এক টাকায় দু’সের দুধও পাওয়া যায় না, ছেলেকে খাওয়াবে কি? নিজেদেরই হাঁড়ি চড়ে না কতদিন! অসুখ হ’লে ওষুধ নেই৷ শাড়ীর জোড়া বারো চোদ্দ টাকা৷ চাল পাওয়া যায় না বাজারে৷ আর কতদিন চোখ বুজে সহ্য করবো, নলিনাক্ষ? ভিক্ষে কি করিনি? করেছি৷ রাত্তিরে বেরিয়ে মান খুইয়ে হাত পেতেছি৷—বলতে বলতে পিসিমা নিঃশ্বাস ফেললেন৷ পুনরায় বললেন, কই, কেউ আমাদের চালডালের খবর নেয়নি, নলিনাক্ষ!

অনেকটা যেন আর্তকণ্ঠে বললুম, পিসিমা, টুনুদেরও এই অবস্থা৷ সবাই মরতে বসেছে আজ, তাই কেউ কারো খবর নিতে পারে না৷ টুনুর কাছেই আপনাদের ঠিকানা পেলুম৷ 

পিসিমা এতক্ষণ বসে ছিলেন, অতটা লক্ষ্য করিনি৷ তিনি এবার উঠে দাঁড়াতেই তাঁর ছিন্নভিন্ন কাপড়খানার দিকে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালুম৷ তিনি বললেন, এ বাড়ির ঠিকানা তুমি আর কাউকে দিও না বাবা৷

এমন সময় মীনু এসে দরজার কাছে চঞ্চল হাসিমুখে দাঁড়ালো৷ বললে, মা, মা শুনছ? এই নাও একটা আধুলি—হরিশবাবু দিল—

মীনুর মাথার চুল এলোমেলো, পরণের কাপড়খানা আলুথালু৷ মুখখানা রাঙা, গলার আওয়াজটা উত্তেজনায় কাঁপছে৷ অত্যন্ত অধীরভাবে পুনরায় সে বললে, যোগীন মাস্টার বললে কি জানো মা, আজ রাত্তিরে গেলে সেও আট আনা দিতে পারে৷

পিসিমা অলক্ষ্যে আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললেন, বেরো—বেরো হারামজাদি এখান থেকে৷ ঝেঁটিয়ে মুখ ভেঙে দেবো তোর৷

মীনু যেন এক ফুৎকারে নিবে গেল৷ মায়ের মেজাজ দেখে মুখের কাছ থেকে স’রে গিয়ে সে অনুযোগ ক’রে কেবল বললে, তুমি ত’ বলেছিলে!

হারু ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, ফের মিছে কথা বলছিস, মীনু? এখন তোকে কে যেতে বলেছিল? মা তোকে রাত্তিরে যেতে বলেছিল না?

পিসিমা ব্যস্তভাবে বললেন, নলিনাক্ষ, তুমি বড্ড হঠাৎ এসে পড়েছ, বাবা৷ এখন ভারি আতান্তর, তুমি ঘরে গিয়ে বসো গে৷

ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর এসে তক্তার মলিন বিছানাটার ওপর বসলুম৷ গলার ভিতর থেকে কি যেন একটা বারম্বার ঠেলে উঠছিল, সেটার প্রকৃত স্বরূপটা আমি কিছুতেই বোঝাতে পারবো না৷ আমি এই পরিবারে মানুষ, আমি এদেরই একজন, এই আত্মীয়-পরিবারেই আমার জন্ম৷ অথচ আজ মনে হচ্ছে এখানে আমি নবাগত, অপরিচিত ও অনাহূত একটা লোক৷ যারা আমার পিসিমা ছিল, ভগ্নী ছিল, যাদের চিরদিন আপনার জন্য ব’লে জেনে এসেছি—আর তারা নয়, এরা বৌবাজারের বিনোদবালাদের সহবাসী, এরা সেই আগেকার সম্ভ্রান্ত পরিজনদের প্রেতমূর্তি!

মনে ছিল না জানালাটা খোলা৷ বৌবাজারের পথের একটা অংশ এখান থেকে চোখে পড়ে৷ যেখানে অসংখ্য যানবাহনের জটলা—ট্রাম, বাস, মোটর, গরুর গাড়ি আর মিলিটারী লরির চাকার আঁচড়ানির মধ্যে শোনা যাচ্ছে অগণ্য মৃত্যুপথযাত্রী দুর্ভিক্ষ-পীড়িতদের আর্তরব৷ জঞ্জালের বালতি ঘিরে ব’সে গেছে কাঙ্গালীরা, পরিত্যক্ত শিশুর কঙ্কাল গোঙাচ্ছে মৃত্যুর আশায়, স্ত্রীলোকদের অনাবৃত মাতৃবক্ষ অন্তিম ক্ষুধার শেষ আবেদনের মতো পথের নালার ধারে প’ড়ে রয়েছে৷

জানলাটা বন্ধ ক’রে দিয়ে এদিকে মুখ ফিরাবো, এমন সময় শুনি হারু আর মীনুর কান্না—পিসিমা একখানা কাঠের চেলা নিয়ে তাদের হঠাৎ প্রহার আরম্ভ করেছেন৷ উঠে গিয়ে বলবার ইচ্ছে হলো, তাদের কোনো অপরাধ নেই—নিরপরাধকে অপরাধী ক’রে তোলার জন্য দিকে দিকে যেসব ষড়যন্ত্রের কারখানা তৈরী করা হয়েছে, ওরা সেই ফাঁদে পা দিয়েছে, এইমাত্র৷ কিন্তু উঠে বাইরে যাবার আগেই, বাইরে শোনা গেল কলকণ্ঠের সম্মিলিত খলখলে হাসি৷ সেই হাসি নিকটতর হয়ে এলো৷

ঘরের কাছাকাছি আসতেই দেখি, বিনোদবালার সঙ্গে শোভনা৷ আমি তাকে ডাকতেই সে যেন সহসা আঁৎকে উঠলো৷ দরজার কাছে এসে শোভনা শিউরে উঠে বললে, একি, ছোড়দাদা? তুমি ঠিকানা পেলে কেমন করে?

বললুম, এমনি এলুম সন্ধান ক’রে৷ কেমন আছিস তোরা শুনি?

নিজের চেহারা এতক্ষণে শোভনার নিজেরই চোখে পড়লো৷ জড়সড় হয়ে বললে, আমি আশা করিনি তুমি আমাদের ঠিকানা খুঁজে পাবে৷

বললুম, কিন্তু আমাকে দেখে কই একটুও খুশী হলিনে ত?

শোভনা চুপ ক’রে রইলো৷ পুনরায় বললুম, এতদিন বাদে তোদের সঙ্গে দেখা৷ কত দেশ বেড়ালুম, দিল্লীতে কেমন ছিলুম—এইসব গল্প করার জন্যেই এলুম রে৷ তোর ছেলেকে পাঠিয়ে দিলি, থাকতে পারবি?

না পারলে চলবে কেন ছোড়দা?

এদিক ওদিক চেয়ে আমি বললুম, কিন্তু এ বাড়িটা তেমন ভালো নয়, তোরা এখানে আছিস কেন শোভা?

এখানে আমাদের ভাড়া লাগে না৷

সবিস্ময়ে বললুম, ভাড়া লাগে না? অমন দয়ালু কে রে?

শোভনা বললে, যাঁর বাড়ি সে ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা দেখে দয়া ক’রে থাকতে দিয়েছেন৷ 

আজকালকার বাজারে এমন দয়া দুর্লভ!

শোভনা বললে, তাঁর কেউ নেই, একলা থাকেন কিনা, তাই—

বোধ হয় বিনোদবালা আড়াল থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, সেই দিকে মুখ তুলে চেয়ে শোভনা সরে গেল৷ মিনিট পাঁচেক পরে আবার সে যখন এসে দাঁড়ালো, দেখি পাতলা জালের মতন শাড়ীখানা ছেড়ে শোভনা একখানা সরুপাড় ধুতি প’রে এসেছে৷

বললুম, শোভনা, তোর ঠিকানা বদলালি, আমাকে চিঠি দিতে পারতিস!

ঠিকানা ইচ্ছে ক’রে দিইনি ছোড়দা৷

কিন্তু মাসোহারার টাকাটা নেওয়া বন্ধ করলি কেন রে?

একটু থতিয়ে শোভনা বললে, ছেলের জন্যেই নিতুম তোমার কাছে হাত পেতে৷ কিন্তু ছেলে ত’ নেই, ছেলে আমার নয়, তাই নেওয়া বন্ধ করেছি৷

প্রশ্ন করলুম, তোদের চলছে কেমন ক’রে?

শোভনা বললে, তুমি আজ এসেছ, আজই চ’লে যাবে—তুমি সে কথা শুনতে চাও কেন ছোড়দা?

চুপ ক’রে গেলুম৷ একথা শোনবার অধিকার আমার নেই, খুঁচিয়ে জানবারও দরকার নেই৷ বললাম, নুটু কোথায়?

সে লোহার কারখানায় চাকরি করে, টাকা পঁচিশেক পায়৷ সপ্তাহে সপ্তাহে কিছু চাল-ডাল আনে৷ আজকাল আবার নেশা করতে শিখেছে, সবদিন বাড়িও আসে না৷

বললুম, সে কি, নুটু অমন চমৎকার ছেলে, সে এমন হয়েছে? হারুর পড়াশুনোও ত বন্ধ৷ ও কি করে এখন?

শোভনা নত মুখে বললে, এই রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকানে হারুর কাজ জুটেছিল, কিন্তু সেদিন কতকগুলো খাবার চুরি যাওয়ায় ওর কাজ গেছে৷ এখন বসেই থাকে৷

স্বভাবতই এবার প্রশ্নটা এসে দাঁড়ালো শোভনার ওপর৷ কিন্তু আমি আড়ষ্ট হয়ে উঠলুম৷

কথা ঘুরিয়ে বললুম, কিন্তু একটা ব্যাপার আমার ভালো লাগেনি, শোভা৷ মীনুটা এখন যাই হোক একটু বড় হয়েছে, ওকে যখন তখন বাইরে যেতে দেওয়া ভালো নয়৷ বাড়িটায় নানা রকম লোক থাকে, বুঝিস ত!

বাইরে জুতোর মসমস শব্দ পাওয়া গেল৷ চেয়ে দেখলুম, আধময়লা জামাকাপড় পরা একটি লোক এক ঠোঙা খাবার হাতে নিয়ে ভিতরে এল৷ মাথায় অল্প টাক, খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফ—লোকটির বয়স বেশী নয়৷ চাতালের ওপর এসে দাঁড়িয়ে বললে, কই, বিনোদ কোথা গেলে? এক ঘটি জল দাও আমার ঘরে৷ আরে কপাল, খাবারের ঠোঙা হাতে দেখলে আর রক্ষে নেই! নেড়ি কুকুরের মতন পেছন পেছনে আসে মেয়ে-পুরুষগুলো কেঁদে কেঁদে৷ ছোঁ মেরেই নেয় বুঝি হাত থেকে৷ পচা আমের খোসা নর্দমা থেকে তুলে চুষছে, দেখে এলুম গো৷ এই যে, এনেছ জলের ঘটি, দাও৷ এ-দুর্ভিক্ষে চারটি অবস্থা দেখলুম, বুঝলে বিনোদ? আগে ঝুলি নিয়ে ভিক্ষে, যদি দুটি চাল পাওয়া যায়৷ তারপর হলো ভাঙা কলাইয়ের থালা, যদি চারটি ভাত কোথাও মেলে৷ তারপর হাতে নিল হাঁড়ি, যদি একটু ফ্যান কেউ দেয়৷ আর এখন, কেবল কান্না,—কোথাও কিছু পায় না! আরে পাবে কোত্থেকে—গেরস্থরা যে ভাত গুলে ফ্যান খাচ্ছে গো! যাই, দু’খানা কচুরি চিবিয়ে প’ড়ে থাকি৷—বলতে বলতে লোকটি ভিতর দিকে চ’লে গেল৷

আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লক্ষ্য করে শোভনা বললে, উনি ছিলেন এখনকার কোন ইস্কুলের মাস্টার৷ এখন চাকরি নেই৷ রান্নাঘরের পাশে ওই চালাটায় থাকেন৷

একলা থাকেন, না সপরিবারে?

না৷ ওঁর সবাই ছিল, যখন উপার্জন ছিল৷ তারপর বড় মেয়েটি কোথায় চলে যায়, স্ত্রী তার জন্যে আত্মহত্যা করেন৷ ছেলে দুটি আছে মামার বাড়ী৷ ছোড়দা, বলতে পারো আর কত দিন এমনি ক’রে বাঁচতে হবে? এ যুদ্ধ কি কোন দিন থামবে না?

উত্তর দেওয়া আমার সাধ্যের অতীত, সান্ত্বনা দেবারও কিছু ছিল না৷ চেয়ে দেখলুম শোভনার দিকে৷ চোখের নীচে তার কালো কালো দাগ, মাথার চুলগুলো রুক্ষ ও বিবর্ণ, সরু সরু হাত দুখানা শির-ওঠা, রক্তহীন ও স্বাস্থ্যহীন মুখখানা৷ যেন যুদ্ধের দাগ তার সর্বাঙ্গে, যেন দেশজোড়া এই দুর্ভিক্ষের অপমানজনক চিহ্ন মুখেচোখে সে মেখে রয়েছে৷ তার কথায় ও কণ্ঠস্বরে কেমন যেন আত্মদ্রোহিতার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখতে পাচ্ছিলুম৷ সেদিনকার শান্ত ও চরিত্রবতী শোভনা—আমার ছোট বোন—আজ যেন অসন্তুষ্ট অগ্নিশিখার মতো লকলকে হয়ে উঠেছে৷ আমার কোন সান্ত্বনা, কোন উপদেশ শোনবার জন্য সে আর প্রস্তুত নয়৷ কিন্তু আমার অপরিতৃপ্ত কৌতূহল আমাকে কিছুতেই চুপ ক’রে থাকতে দিল না৷ এক সময়ে বললুম, শোভা, এটা ত’ মানিস, সামনে আমাদের চরম পরীক্ষার দিন৷ চারিদিকে এই ধ্বংসের চক্রান্তের মধ্যে আমাদের টিঁকে থাকতেই হবে৷ যেমন করেই হোক নিজেদের মান-সম্ভ্রম বাঁচিয়ে—

মান-সম্ভ্রম?—শোভনা যেন আর্তনাদ ক’রে উঠলো—কোথায় মান-সম্ভ্রম, ছোড়দা? আগে বুকের আগুন নিয়ে ছিলুম সবাই, এবার পেটের আগুনে সবাই খাক হয়ে গেলুম! কে বলেছে প্রাণের চেয়ে মান বড়? কোন মিথ্যাবাদী রটিয়েছে, আমাদের বুক ফাটে ত’ মুখ ফোটে না? ছোড়দা, তুমি কি বলতে চাও, যদি তিল তিল করে না খেয়ে মরি, যদি পোড়া পেটের জ্বালায় ভগবানের দিকে মুখ খিঁচিয়ে আত্মহত্যা করি, যদি তোমার মা-বোনের উপবাসী বাসি মড়া ঘর থেকে মুদ্দোফরাসে টেনে বা’র করে, সেদিন কি তোমাদেরই মান-সম্ভ্রম বাঁচবে? যারা আমাদের বাঁচতে দিলে না, যারা মুখের ভাত কেড়ে নিয়ে আমাদের মারলে, যারা আমাদের বুকের রক্ত চুষে-চুষে খেলে, তাদের কি মান-সম্ভ্রম পৃথিবীর ভদ্রসমাজে কোথাও বাড়লো? যাও, খোঁজ নাও, ছোড়দা, ঘরে-ঘরে গিয়ে৷ কাঙ্গালীদের কথা ছাড়ো, গেরস্থ বাড়ীতে ঢুকে দেখে এসো৷ কত মায়ের বত্রিশ নাড়ী জ্বলে-পুড়ে গেল দুটি ভাতের জন্যে, কত দিদিমা-পিসিমা-খুড়িমা-বোন-বৌদিদিরা আড়ালে বসে চোখের জল ফেলছে একখানি কাপড়ের জন্যে৷ অন্ধকারে গামছা আর ছেঁড়া বিছানার চাদর জড়িয়ে কত মেয়ে-পুরুষের দিন কাটছে, জানো? বাসি আমানি নুন গুলে খেয়ে কত লাজুক মেয়ে প্রাণধারণ করছে, শুনেছ? মান-সম্ভ্রম নিজের কাছেই কি রইলো কিছু, ছোড়দা?

সপ্রতিভ লজ্জাবতী নিরীহ শোভনাকে এতকাল দেখে এসেছি৷ তার এই মুখের উত্তেজনায় আমার যেন মাথা হেঁট হয়ে এলো৷ আমি বললুম, কিন্তু কনট্রোলের দোকানে অল্প দামে চাল-কাপড় পাওয়া যাচ্ছে—তোমরা তার কোন সুবিধে পাও না?

শোভনা আমার মুখের দিকে একবার তাকালো৷ দেখতে দেখতে তার গলার ভিতর থেকে পচা ভাতের ফেনার মতো একপ্রকার রুগণ হাসি বমির বেগে উঠে এলো৷ শীর্ণ মুখখানা যেন প্রবল হাসির যন্ত্রণায় সহসা ফেটে উঠলো৷ শোভনা হা হা ক’রে হাসতে লাগলো৷ সে-হাসি বীভৎস, উন্মত্ত, নির্লজ্জ এবং অপমানজনকও বটে৷ আমার নির্বোধ কৌতূহল স্তব্ধ হয়ে গেল৷

পিসিমার কাছে মার খেয়ে মীনু ও হারু এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল৷ হঠাৎ তাদের দিকে চেয়ে শোভনা চেঁচিয়ে বললে, কেন, কাঁদছিস কেন, শুনি? দূর হয়ে যা সামনে থেকে—

বিনোদবালা যেন কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল, সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে বললে, দিদি, মাসি মেরেছে ওদের৷ ও-বাড়ীর হরিশবাবুর কাছ থেকে মীনু পয়সা এনেছিল কিনা—হারু কি যেন ব’লে ফেলেছিল, তাই—

শোভনার মাথায় বোধ হয় আগুন ধ’রে গেল৷ উঠে দাঁড়িয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বললে, মা? কেন তুমি ওদের মারলে শুনি?

পিসিমা কলতলার পাশ থেকে বললেন, মারবো না? কলঙ্কের কথা নিয়ে দুজনে বলাবলি করছিল, তাই বেদম মেরেছি৷ বেশ করেছি৷

কিন্তু ওদের মেরে কলঙ্ক ঘোচাতে তুমি পারবে?

পিসিমা চীৎকার ক’রে উঠলেন, ভারি লম্বা লম্বা কথা হয়েছে তোর, শোভা! এত গায়ের জ্বালা তোর কিসের লা? দিনরাত কেন তোর এত ফোঁসফেঁাসানি? কপাল পোড়ালি তুই, মান খোয়ালি, সে কি আমার দোষ? পেটের ছেলে-মেয়েকে আমি মারবো, খুন করবো, যা খুশি তাই করবো—তুই বলবার কে?

শোভনা গর্জন করে বললে, পেটের মেয়েরা যে তোমার পেটে অন্ন যোগাচ্ছে, তার জন্যে লজ্জা নেই তোমার? মেরে মেরে মীনুটার গায়ে দাগ করলে—তোমার কী আক্কেল? একেই ত’ ওর ওই চেহারা, এর পর ঘর-খরচ চলবে কোত্থেকে? লজ্জা নেই তোমার?

তবে আমি হাটে হাঁড়ি ভাঙবো, শোভা—এই বলে পিসিমা এগিয়ে এলেন৷ উচ্চকণ্ঠে বললেন, নলিনাক্ষ আছে তাই চুপ করে ছিলুম৷ বলি, ফরিদপুরের বাড়িতে ব’সে বিনোদবালার ঠিকানা কে যোগাড় ক’রেছিল? গাড়িভাড়া কা’র কাছে নিয়েছিলি তুই?

অধিকতর উচ্চকণ্ঠে শোভনা বললে, তাহলে আমিও বলি? মাস্টারকে কে এনে ঢুকিয়েছিল এই বাসায়? হরি-যোগেনদের কাছে কে পাঠিয়েছিল মীনুকে? আমাকে কেরানীবাগানের বাসায় কে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল? উত্তর দাও? জবাব দাও? হোটেলের পাঁউরুটি আর হাড়ের টুকরো তুমি কুড়িয়ে আনতে বলোনি হারুকে? নুটু বাড়ি আসা ছাড়লো কার জন্যে?

মুখ সামলে কথা বলিস, শোভা!

এমন সময়ে বিনোদবালা মাঝখানে এসে দাঁড়াল ঝগড়া মিটাবার জন্য৷ মারমুখী মা ও মেয়ের এই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য অধঃপতন দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারলুম না৷ উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালুম৷ বললুম, পিসিমা, আপনি স্নান করতে যান৷ শোভা, তুই চুপ কর, ভাই৷ এরকম অবস্থার জন্যে কা’র দোষ দিবি বল, তোর, আমার, পিসিমার, হারু-মীনুর,—এমন কি ওই বিনোদবালা, মাস্টারমশাই, হরিশের দলেরও কোন দোষ নেই৷ কিন্তু অপরাধ যাদের, তারা আমাদের নাগালের বাইরে শোভা৷ যাকগে, আমি এখন যাই, আবার একসময়ে আসবো৷

শোভনা কেঁদে বললে, আর তুমি এসো না ছোড়দা৷

আমি একবার হাসবার চেষ্টা করলুম৷ বললুম, পাগল কোথাকার!

পিসিমা বললেন, এত গোলমালে তোমার কিছু খাওয়া হলো না বাবা নলিনাক্ষ৷ কিছু মনে ক’রো না৷

বিনোদবালা বললে, চলো, ঢের হয়েছে! এবারে নেয়ে-খেয়ে তৈরী হও দিকি? গলাবাজি করলে ত’ আর পেট ভরবে না৷ পেটটা যাতে ভরে তার চেষ্টা করো৷ আমি কি আগে জানতুম তোমরা ভদ্রলোকের ঘর, তাহলে এমন ঝকমারি কাজে হাত দিতুম না!

অপমানিত মুখে পলকের জন্য বিনোদবালার দিকে চোখ তুলে অগ্নিবৃষ্টি ক’রে আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলুম৷ পাতালপুরীর সুড়ঙ্গলোকের কদর্য-কলুষ রুদ্ধশ্বাস থেকে মুক্তি নিয়ে এসে দাঁড়ালুম রাজপথের উপর দিগন্ত জোড়া মুমূর্ষুর আর্তনাদের মধ্যে৷ এ বরং ভালো, এই অগণ্য ক্ষুধাতুরের কান্না চারিদিকে পরিব্যাপ্ত থাকলেও কেমন একটা দয়াহীন সকরুণ ঔদাসীন্যে এদের এড়ানো চলে৷ কিন্তু যেখানে চিত্ত-দারিদ্র্যের অশুচিতা, যেখানে দুর্ভিক্ষপীড়িত উপবাসীর মর্মান্তিক অন্তর্দাহ, যেখানে কেবল নিরুপায় দুর্নীতির গুহার মধ্যে ব’সে উৎপীড়িত মানবাত্মা অবমাননার অন্ন লেহন করছে, সেই সংহত বীভৎসতার চেহারা দেখলে আতঙ্কে গলা বুজে আসে৷

কিন্তু এরা কে? সেই ফরিদপুরের ছোট বাড়িটিতে ফুলের চারা আর শাকসব্জী দিয়ে ঘেরা ঘরকন্নার মধ্যে আচারশীলা মাতৃরূপিণী পিসিমা, লাজুক একটি সদ্য-ফোটা ফুলের মত কুমারী ভগ্নী শোভনা, চাঁপার কলির মত নিষ্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক হারু, নুটু, মীনু—এরা কি সেই তারা? কেন একটি সুখী পরিবার ধীরে ধীরে এমন সমাজ-নীতিভ্রষ্ট হলো? কেন তাদের মৃত্যুর আগে তাদের মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু ঘটলো এমন ক’রে? কোন দয়াহীন দস্যুতা এর জন্যে দায়ী?

এই কয়মাসের মাসোহারার টাকাটা আমি অনায়াসে খরচ করতে পারি বৈকি৷ অন্তত দিল্লী যাবার আগে ওদের এই অবস্থায় রেখে চুপ ক’রে চলে যেতে পারিনে৷ সুতরাং অপরাকালটা নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে কিছু কিছু খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করা গেল৷ শতকরা দশগুণ বেশী দামে চাল এবং পাঁচগুণ বেশী দামে আর সব খাবার জিনিসপত্র এখান ওখান থেকে কিনতে লাগলুম৷ কিনতে কিনতে সন্ধ্যা হয়ে গেল৷ সেটা মাত্র এই বিগত শ্রাবণের কৃষ্ণপক্ষ, টিপ টিপ ক’রে বৃষ্টি পড়ছে৷ স্বল্পালোক কলকাতার পথঘাট পেরিয়ে একখানা গাড়িতে জিনিসপত্র তুলে নিয়ে চললুম আবার শোভনাদের ওখানে৷ নিজের বদান্যতায় কোনো গৌরব বোধ করছিনে, বরং সমস্ত খাদ্যসামগ্রীগুলোকে ঘৃণ্য মনে হচ্ছে৷ খাদ্য আজ জীবনের সকল প্রশ্নকে ছাপিয়ে উঠেছে বলেই হয়ত খাদ্যের প্রতি এত ঘৃণা এসেছে৷ এসব পদার্থ আগে ছিল ভদ্রজীবনের নীচের তলাকার লুকানো আশ্রয়, সেটার কোনো আভিজাত্য ছিল না—আজ সেটা যেন মাথার ওপর চ’ড়ে বসে আপন জাতিচ্যুতির আক্রোশটা সকলের ওপর মিটিয়ে নিচ্ছে!

তবু দুর্গম পথঘাট পেরিয়ে সেগুলো নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হলুম বৌবাজারের বাড়ির দরজায়৷ বহু পরিশ্রম আর অধ্যবসায় ব্যয় ক’রে দু-তিনজন লোকের সাহায্যে সেগুলো নিয়ে গিয়ে রাখলুম সেই সরু আনাগোনার পথের এক ধারে৷ মাস তিনেকের মত খাদ্যসম্ভার কিনে এনেছিলুম৷ জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে লোকগুলোকে বিদায় করলুম৷

ভিতর দিকে কোথায় যেন একটা কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বলছিল, তারই একটা আভা এসে পড়েছিল আমার গায়ে৷ কলতলার ওপাশ থেকে শোনা গেল, নারী-কণ্ঠের সঙ্গে ইস্কুল-মাস্টারের কথালাপের আওয়াজ জড়ানো৷ তা ছাড়া নীচের তলাটা নিঃসাড়—মৃত্যুপুরীর মতো৷

আমি কয়েক পা অগ্রসর হয়ে গেলুম৷ ডাকলুম, মীনু? হারু?

কোনো সাড়া নেই৷ যে ঘরখানায় দুপুরবেলায় আমি বসেছিলুম, সে ঘরখানা ভিতর থেকে বন্ধ৷ বুঝতে পারা গেল, ক্লান্ত হয়ে পিসিমারা সবাই ঘুমিয়েছে৷ আবার আমি ডাকলুম মীনু, ও হারু?

বোধ করি বাইরের থেকে আমার গলার আওয়াজটা ঠিক বোধগম্য হয়নি, ঘরের ভিতর থেকে শোভনা সাড়া দিয়ে বললে, দিনরাত এত আনাগোনা কেন গা তোমার? মীনু ও-বাড়িতে গেছে, আজ তাকে পাবে না, যাও৷ হতভাগা, চামার!

আমি বললুম, শোভা, আমি রে, আর কেউ নয়, আমি—ছোড়দা৷ দরজাটা খোল দেখি?

ছোড়দা?—শোভনা তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে ব’সে পড়লো৷ অশ্রুসজল কণ্ঠে বললে, ছোড়দা, পেটের জ্বালায় আমরা নরককুণ্ডে নেমে এসেছি৷ তুমি আমাকে মাপ করো, তোমার গলা আমি চিনতে পারিনি৷

শোভনার হাত ধ’রে আমি তুললাম৷ বললুম, কাঁদিসনে, চুপ কর৷ তোরা ত’ একা নয় ভাই, লক্ষ লক্ষ পরিবার এমনি করে মরতে বসেছে৷ কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না, এমনি করেই এই অবস্থাকে পেরিয়ে যেতে হবে, শোভা৷ শোন, কালকেই আমি দিল্লী যাবো, তাই তাড়াতাড়িতে তোদের জন্যে চারটি চাল-ডাল কিনে আনলুম—ওগুলো তুলে রাখ৷

চাল-ডাল এনেছ? দুর্বল শরীরের উত্তেজনায় শোভনা যেন শিউরে উঠলো৷ যেন ভাবী ক্ষুধাতৃপ্তির কল্পনায় কেমন একটা বিকৃত উগ্র ও অসহ্য উল্লাস তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে কাঁপতে লাগলো৷ রুদ্ধশ্বাসে সে বললে, তুমি বাঁচালে—তুমি বাঁচালে, ছোড়দা৷ তোমার দেনা আমরা কোনদিন শোধ করতে পারবো না৷—এই বলে আমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে আমার চিরদিনকার আদরের ভগ্নী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো৷

বললাম, ওর সঙ্গে নতুন জামা-কাপড়ের একটা পুঁটলি রয়েছে, ওটা আগে তুলে রাখ, শোভা৷

শোভনা আমাকে ছেড়ে দিয়ে কেরোসিনের ডিবেটা নিয়ে এসে খাদ্যসামগ্রীর কাছে দাঁড়িয়ে একবার সব দেখলো৷ তারপর অসীম তৃপ্তির সঙ্গে কাপড়ের বস্তাটা তুলে নিয়ে ঘরের ভিতরে চৌকীর নীচে রেখে এলো৷ বললে, ছোড়দা, মনে আছে, কোরা জামা-কাপড় পরে লোকের সামনে এসে দাঁড়ানো আমাদের পক্ষে কী লজ্জার কথা ছিল? দোকান থেকে চাল-ডাল এলে লুকিয়ে সেগুলোকে সরিয়ে ফেলতুম—পাছে কেউ ভাবে, চাল কেনার আগে আমাদের বুঝি খাবার কিছু ছিল না! মনে আছে ছোড়দা?

হেসে বললাম, সব মনে আছে রে৷

শোভনা করুণকণ্ঠে বললে, তুমি বলতে পারো ছোড়দা, এ দুর্ভিক্ষ কবে শেষ হবে? সবাই যে বলছে, নতুন ধান উঠলে আমাদের আর উপোস করতে হবে না?

তার আর্তকণ্ঠ শুনে আমি চুপ করে রইলুম৷ কারণ, সরকারী চাকর হলেও ভিতরের খবর আমার কিছুই জানা ছিল না৷ শোভনা পুনরায় বললে, ফরিদপুরের সেই মস্ত মাঠ তোমার মনে আছে, ছোড়দা? ভাবো ত, সেই মাঠে আমনের সোনার শিষ পেকেছে, হাওয়ায় তারা ঢেউ খেলছে আনন্দে, মাঠে মাঠে চাষার দল গান গেয়ে কাটছে সেই ধান,—সেই লক্ষ্মীকে ভারে ভারে তারা ঘরে তুলে আনছে! মনে পড়ে?

শোভনার স্বপ্নময় দুটি চোখ হয়ত সেই সোনার বাঙলার মাঠে মাঠে একবার ঘুরে এলো, কিন্তু আমি কেরোসিন ডিবের আলোয় এই নরককুণ্ড ছাড়া আর কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না৷ কেবল নিঃশ্বাস ফেলে বললুম, মনে পড়ে বৈকি৷

কিন্তু এ কি শুনছি ছোড়দা? শোভনা আমার মুখের দিকে আবার ফিরে তাকালো৷ সভয়ে চক্ষু তুলে সে পুনরায় বললে, গোছা গোছা কাগজ বিলিয়ে আবার নাকি ওরা শুষে নিয়ে যাবে সেই আমাদের ভাঙা বুকের রক্ত? নবান্নর পর আবার নাকি ভরে যাবে আমাদের ঘর কাঙ্গালীর কান্নায়? বলতে পারো, তুমি?

কিছু একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলুম, সহসা বাইরে কা’র পায়ের শব্দ পেয়ে শোভনা সচকিত আতঙ্কে অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকালো৷ তারপর কম্পিত অধীরকণ্ঠে সে বললে, ছোড়দা, এবার তুমি যাও, তোমার অনেক রাত হয়ে গেছে৷ এখন নিশ্চয় ন’টা—আমার মনে ছিল না, নিশ্চয় ন’টা বেজেছে৷ এবার তুমি যাও, ছোড়দা!

এগুলো তুলে রাখ আগে সবাই মিলে?

রাখবো, ঠিক রাখবো—একটি একটি চাল-ডালের দানা গুনে গুনে রাখবো—কিন্তু এবার তুমি যাও, ছোড়দা, আলো ধরছি...তুমি যাও, একটুও দেরী ক’রো না...লক্ষ্মীটি ছোড়দা...

শোভনা চঞ্চল অস্থির উদ্দাম হয়ে এসে আমাকে যখন এক প্রকার টেনে নিয়ে যাবে, সেই সময় একটি লোকে চাল-ডালের বস্তার ওপর হোঁচট খেয়ে ভিতরে এসে দাঁড়ালো৷ একেবারে গায়ের উপর এসে প’ড়ে বললে, ওঃ, নতুন লোক দেখছি! চাল-ডাল এনে একেবারে নগদ কারবার!

লোকটার পরণে একটা খাকি সার্ট, সর্বাঙ্গে কেমন একটা নেশার দুর্গন্ধ৷ আমি বললুম, কে তুমি?

আমি কারখানার ভূত, স্যার৷ —এই ব’লে হঠাৎ শোভনার একটা হাত ধরে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে বললে, এসো, কথা আছে৷

কথা কিচ্ছু নেই, ছাড়ো৷ ব’লে শোভনা তার হাতখানা ছাড়িয়ে নিল৷

বটে!—লোকটি ভুরু বাঁকিয়ে বললে, আগাম একটা টাকা দিইনি কাল?

রুদ্ধশ্বাসে শোভনা বললে, বেরিয়ে যাও বলছি ঘর থেকে?

বাঃ—বেরিয়ে যাবো ব’লে বুঝি এলুম দেড় মাইল হেঁটে? বেশ কথা বলে পাগলি!

চীৎকার ক’রে শোভনা বললে, বেরোও বলছি শিগগির? চলে যাও—দূর হয়ে যাও ঘর থেকে—

লোকটা বোধ হয় তক্তাখানার ওপর বসবার চেষ্টা করছিল৷ হেসে বললে, আজ বুঝি আবার খেয়াল উঠলো?

শোভনা আর্তনাদ ক’রে উঠলো—ছোড়দা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছ তুমি? এ অপমানের কি কোনো প্রতিকার নেই?...দাঁড়াও, আজ খুন করবো—বঁটিখানা...

বলতে বলতে ছুটে সে বেরুলো—রান্নাঘরের দিকে চললো৷ লোকটা এবার উঠে বাইরে এলো৷ বললে, মশাই, এই নিয়ে মেয়েটা আমাকে অনেকবারই খুন করতে এলো, বুঝলেন? আসলে মেয়েটা মন্দ নয়, কিন্তু ভারি খেয়ালী! তবে কি জানেন স্যার, আমরা হচ্ছি ‘এসেনসিয়াল সার্ভিসের’ লোক, যুদ্ধের কারখানায় লোহা-লক্কড় নিয়ে কাজ করি—মেয়েমানুষের মেজাজ-টেজাজ অত বুঝিনে! এসব জানে ওই ‘আই-ই’ মার্কা লোকগুলো, ওরা নানারকম ভাঁড়ামি করতে পারে!

এমন সময় উন্মাদিনীর মতন একখানা বঁটি হাতে নিয়ে শোভনা ছুটে বেরিয়ে এলো৷ পিসিমা ধড়মড়িয়ে এলেন, হারু ছুটে এলো৷ লোকটি শান্তকণ্ঠে বললে, আচ্ছা, আচ্ছা, আর খুন করতে হবে না, দেখছি আজ খেয়ালের ভূত চেপেছে ঘাড়ে৷ আচ্ছা—এই যাচ্ছি স’রে৷

বিনোদবালা আর পিসিমা দৌড়ে এসে ধ’রে ফেললেন শোভনাকে৷

লোকটি পুনরায় নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললে, বেশ, সেই ভালো৷ বিনোদের ঘরে রইলুম এ-রাত্তিরটার মতন৷ কিন্তু মাঝরাত্তিরে আমাকে নিশ্চয় ডেকে ঘরে নিয়ো, নইলে কিছুতেই আমার ঘুম হবে না, বলে রাখলুম৷—আচ্ছা, বেশ, কাল নাহয় আড়াই সের চাল’ই দেওয়া যাবে৷ আয় বিনোদ, তোর ঘরে যাই৷ বলতে বলতে বিনোদের হাতখানা টেনে নিয়ে সেই কদাকার লোকটা ইস্কুল-মাস্টারের ঘরের দিকে চ’লে গেল৷

শোভনা সহসা আমার পায়ের ওপর লুটিয়ে প’ড়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো৷ বললে, কবে, কবে ছোড়দা, কবে এই রাক্ষুসে যুদ্ধ থামবে, তুমি ব’লে যাও! তুমি ব’লে যাও, কবে এই অপমানের শেষ হবে, আমাদের মৃত্যুর আর কতদিন বাকি?

আস্তে আস্তে আমি পা ছাড়িয়ে নিলুম৷ শোভনার হৃৎপিণ্ড থেকে আবার রক্ত উঠে এলো৷ বললে, তুমি যেখানে যাচ্ছ, সেখানে যদি কেউ মানুষ থাকে, তাদের ব’লো এ যুদ্ধ আমরা বাধাইনি, দুর্ভিক্ষ আমরা আনিনি, আমরা পাপ করিনি, আমরা মরতে চাইনি...

শোভনা কাঁদুক, সবাই কাঁদুক৷ আমি অসাড় ও অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা বাইরে এসে পথে নামলুম৷ অন্ধকারে কোথাও কিছু দেখতে পেলুম না৷ শুধু অন্ধকার, অনন্ত অন্ধকার৷ কেবল মনে হলো, অঙ্গারের আগুন যেমন পুড়ে পুড়ে নিস্তেজ হয়ে আসে, তেমনি মহানগরের ক্ষুধাশ্রান্ত কাঙ্গালীরা চারিদিকে চোখ বুজে পথে-ঘাটে নালা-নর্দমায় শুয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি কান পেতে শুনছে!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ