Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

কবন্ধ সময় | নাহার তৃণা

গল্পটি শোনার জন্য ইউটিউবের লিঙ্কে ক্লিক করুন।



বিয়ে বাড়ির রান্নার সুগন্ধে গোটা মনেশ্বর রোড ম ম করছে। গন্ধ, তা সেটা ভালো কিংবা মন্দ যাহোক গণ্ডি কেটে রুখে দেবার সুযোগ নেই তেমন একটা। তাই দাওয়াত-বঞ্চিত ভাড়াটে পরিবারগুলোর নাসারন্ধ্রে বাতাস স্বপ্রণোদিত হয়ে সে সুগন্ধ পৌঁছে দেয়। এ পাড়ায় অলিখিত একটা নিয়ম চালু রয়েছে, বাড়িওয়ালা পক্ষ ভাড়াটেপক্ষকে তাদের কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। অবশ্য শোকাবহ অনুষ্ঠান যেমন মৃতের জন্য দোয়া, চল্লিশা ইত্যাদিতে ভাড়াটিয়াদের সামিলের মহত্ত্ব দেখাতে কুণ্ঠা দেখান না বাড়িওয়ালাগণ। আনন্দ আর শোক বণ্টনে বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়ার মধ্যে এই অদ্ভুত সীমারেখা কাকলিরা আর কোথাও দেখেনি।


ভাড়া বাড়ির অভিজ্ঞতা ওদের পরিবারের কম নেই। অনেক বাড়িওয়ালার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়েছে, ভাড়ার সেই বাড়ি ছেড়ে এলেও অনেকের সাথে এখনও যোগাযোগ বর্তমান। সেরকম একজনকে নানা ডাকতো ওরা। যিনি আদতে মা-বাবার বিয়ের পর পর নতুন ভাড়াটে হিসেবে ওঠা বাড়ির বাড়িওয়ালা ছিলেন, মা-কে তিনি মেয়ে বানিয়েছিলেন। সে সূত্রে কাকলিরা তাঁকে নানা ডাকত, অবশ্য কাকলি তাঁকে বেশিদিন দেখেনি। বছর কয়েক হল সেই নানা মারা গেছেন।

অথচ এই এলাকার কেমন অদ্ভুতুড়ে নিয়ম। সুগন্ধে পাড়া মাত করে লোভ জাগানো হবে, কিন্তু তার স্বাদ নেবার বেলায় যত বাধা। ভালো ভালো খাওয়ার প্রতি কাকলির নিদারুণ দুর্বলতা। তার ছা-পোষা চাকুরে বাবার পক্ষে প্রতিদিন মাছ মাংসের যোগান দেওয়া সম্ভব হয় না। কচুঘেঁচুই প্রায় সারা বছর মুখ বুজে খেয়ে যেতে হয়। মুখের স্বাদ পালটানোর জন্য এরকম বিয়ে বাড়ির সুখাদ্য খাওয়ার লোভে মন আঁকুপাঁকু করলে খুব দোষ দেওয়া যায় না। কাকলি উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে বড় আপার হাতের কাজ শেষ হল কিনা। আপার কাজ শেষ হলে কাকলির দুঃখী ভাব কিছুটা কমে। আপা এসে দারুণ খেলাটা শুরু করবে। কাকলি খুব মজা পায় খেলাটা খেলে।

কাকলিরা তিন ভাইবোন। বড় আপা বকুল, ভাইয়া কমল, আর কাকলি। বয়সের তুলনায় কাকলির বুদ্ধি কিংবা শরীর কোনোটাই তেমন পাকেনি। চোদ্দ পেরিয়ে পনেরোতে পড়ল এ মাসে। টেনেটুনে কোনোরকমে ক্লাস সেভেনে ওঠেছে। পড়ালেখা সে করে ঠিকই, কিন্তু সব কেমন গুলিয়ে যায়। কিছুই মনে রাখতে পারে না। এই বয়সী একটা মেয়ের শরীরে নারী হয়ে ওঠার লক্ষণগুলো আরো আগেই জানান দেবার কথা। কাকলির শরীরে সে রকম কোনো জোয়ারের লক্ষণ নেই। অপুষ্টির ভাটায় সেটা আটকে গেছে, নাকি ওর শারীরিক কোনো সমস্যা আছে, সে ব্যাপারে পরিবারের কারো তেমন মাথা ব্যথা নেই। সামর্থ্য না থাকায় উদাসীনতার কাছে নতিস্বীকার করে নিতে হয়েছে। কারণ সেরকম চিকিৎসার জন্য যার শরণাপন্ন হলে একটা বিহিতের সম্ভাবনা ছিল, তেমন একজন ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর মতো রসদ কাকলির বাবার পকেটে থাকে না। যে বেতন পান কাকলির বাবা, তার বেশির ভাগটাই বাড়িভাড়ার পেছনে ব্যয় হয়। পকেটে অতি সামান্য যেটুকু থাকে তা দিয়ে সারা মাসের সংসার তেল ফুরিয়ে যাওয়া কুপিবাতির মতো পিটপিট করে চলে। অভাবের সঙ্গে কাকলিদের জন্মের সখ্য।

কাকলির ভাইটা একটা চাকরির তাগিদে সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে বেশ রাত করে বাড়ি ফিরে। মা সংসার বিষয়ে ছেলের এমন আলগা ভাব দেখে গজগজ করেন প্রায়। সারাক্ষণ সংসারের সাথে সেঁটে থাকার কারণে তাদের যেভাবে হামুখো অভাবের মুখনাড়া দেখতে হয়, ছেলে তার বাইরে থাকলেও সংসারের নড়বড়ে অবস্হাটা যে বুঝে না, তা তো না। উপার্জনের রাস্তায় গিয়ে কবে সে বাবার ভরসা হবে তারও কোনো কূল কিনারা নেই। টিউশনির বেতনের অতি সামান্য কিছু মাঝে মধ্যে কমল মায়ের হাতে দেয় বটে। কিন্তু সে মরুভূমিতে একফোঁটা পানি যেন।

কাকলির বড় আপার হাতের কাজের বেশ সুনাম। আশেপাশের অনেকেই তার কাছে সেলাই ফোঁড়াই করায়। তা থেকে মোটামুটি আয় হয়। পালা পার্বণে প্রচুর সেলাইয়ের অর্ডার আসে, রোজগারও সেসময় বেশ ভালো হয়। রোজগারের প্রায় সবটাই আপা মায়ের হাতে তুলে দেয়। মাসে টাকা থেকে সামান্য কিছু সরিয়ে একটা দুধের কৌটায় জমায়। নিজেরা সারা মাস কচুঘেঁচু খেয়ে টাকা জমানোর মানে বুঝে না কাকলি। ওই টাকায় দিব্যি পোলাওয়ের সুগন্ধী চাল, গোশত্ হয়ে যাবার কথা। ঈদ ছাড়া তাদের বাড়িতে পোলাও গোশত্ রান্না হয় না। একদিন একবেলা উৎসব ছাড়াই পোলাও কোর্মা খেলে কী ক্ষতি হয়! কিন্তু সে কথা মাকে বলতে গেলেই বিপদ। হয় কিল চড় খাবে, নয়তো গালাগালির চূড়ান্ত। বিয়ে বাড়িতে কতসব মজাদার রান্না হচ্ছে, অথচ ভাগে পাবে না, সে দুঃখে মুখ চুন করে বারান্দায় ঘুরঘুর করতে থাকা কাকলি অযাচিতভাবেই মায়ের বকুনি খেয়ে বসে, “গতরখাকির আর কিছু না থাকুক নোলা আছে ঠিকই। বই নিয়ে একটু পড়তে বসলে কী হয় তোর?”

মা এত গালাগালি করতে পারে বাবা রে বাবা! এমন এমন গালি দেয় যার সবটার অর্থও জানে না কাকলি। আশ্চর্যের কথা পরিবারের আর কারো প্রতি মায়ের এতটা ক্ষোভ ঝরতে দেখে না। মায়ের যত রাগঝাল সব যেন তার প্রতি। কাকলি কী করে বুঝবে, সংসারের ঘায়ে নাস্তানাবুদ অসহায় মা তার চেয়েও আরো খানিক অসহায় অবস্হানে থাকা মেয়ের উপর নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়ে মনকে শান্ত রাখার ছুতো খোঁজেন!

সে রাতে ঘুমাতে গিয়ে বড় আপাকে জিজ্ঞেস করে, “আপা গতরখাকি মানে কী রে?” ওর প্রশ্ন শুনে হাসতে হাসতে বড় আপার চোখ ভরে গিয়েছিল পানিতে। কেউ দেখলে ভাবতো বড় আপা বুঝি কাঁদছে। বড় আপাটা সময় অসময়ে হাসিখুশিতে ভরে ওঠতে পারে। ও যেন নিজের ভেতরে সুখ নামের একটা নদী বয়ে বেড়ায়। বড় আপার কাছাকাছি থাকলে কেমন শান্তি শান্তি লাগে। মন খুশিতে ভরে ওঠতে সময় লাগে না। কাকলি বড় আপাকে মায়ের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। বড় আপা কখনও মনে দুঃখ দেবার মতো কথা বলেনা ওকে। গালি কী জিনিস জানেই না হয়তো।

কাকলির গালে টুকুশ করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে বড় আপা জানতে চায়, “এটা মা বলেছে বুঝি? হা হা… এর মানেটা না খুব মজার জানিস পুট্টুশ!” বড় আপা কাকলিকে পুট্টুশ নামে ডাকে। নামটা খুব পছন্দ কাকলির। ওর কাকলি নামটা পচা! ক্লাসশুদ্ধ সবাই কাকলি নামটা ছোটো করে কা কা ডেকে মজা করে। ওর সব কিছু নিয়ে মজা করতে ক্লাসের সবার ভারি আনন্দ। কাকলির তাই স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। স্কুলে ওর কোনো বন্ধু নেই।

“যাহ! গালি আবার মজার হয় নাকি!” “খুব হয়। ওর মানে হচ্ছে আলসে কুঁড়ে। এটা মজার না বল?” আলসে কুঁড়ে বিষয়টাকে এমন বিদঘুটে শব্দে মুড়ে দেওয়া হলো কেন মাথায় আসে না কাকলির। “মা তবে খুব ভুল কিছু বলেনি, বলো আপা? আমি তো আলসেই…” কেমন এক মায়া নিয়ে বোনকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বড় আপা বলে, “তোর মাথায় বিলি কেটে দেই আয়, আরামে ঘুম আসবে।” বড় আপা বোনের মনের মেঘ উড়িয়ে দিয়ে চোখ ভরে ঘুম নামিয়ে দেবার জন্য মাথায় বিলি কাটা শুরু করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় কাকলি। ছোটো বোনের ঘুমন্ত মুখ চুঁইয়ে অপার্থিব এক মায়ার খেলা দেখতে দেখতে, কান্নায় দু’চোখ ভরে ওঠে বকুলের। পৃথিবীর জটিলতা কুটিলতা সম্পর্কে অজ্ঞাত, অপুষ্ট শরীর-মনের বোনটার প্রতি অসীম ভালোবাসায় বড় বোন বকুল নিঃশব্দে কাঁদে। সারাদিন যে মেয়ের মুখের হাসি সরে না, রাতের এই একান্তে এঁটে রাখা হাসিখুশির মুখোশটা খুলে খানিক হাঁফ ছাড়ে বুঝি। এ সময়ে, সে প্রায় নিজের দুঃখ, বোনের দুঃখ, সংসারের দুঃখ, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে আর কেঁদে আকুল হয়।


২.

কাটছাঁটে বেঁচে যাওয়া দামি কাপড়ের টুকরোগুলো যারা সেলাই করতে দেন, তাদের কাছ থেকে চেয়ে জমিয়ে রাখে বকুল। টুকরোগুলো জুড়ে জুড়ে চমৎকার ডিজাইনের একটা ফ্রক বানিয়ে দেবে কাকলির জন্য। ওরকম কাপড়ের একটা জামা পেলে বোনটা কত খুশি হবে ভাবতেই ভালো লাগে। অর্ডারে আসা সেরকম কাপড় দেখিয়ে, বকুলকে প্রায় জিজ্ঞেস করে কাকলি, “এগুলোর খুব দাম না রে আপা?” কাকলির জামা কাপড় সব বকুল তৈরি করে দেয়। সস্তা ছিট কাপড়, বা মায়ের পুরনো শাড়ি কেটে তৈরি হয় সেগুলো। ঈদের জন্য তৈরি সস্তা কাপড়ের জামাতে ফুল তুলে দেয় যত্ন করে। সামান্য সেসব আয়োজনে বোনের আনন্দ দেখে বকুলের মনে হয়, পৃথিবীর সবাই যদি ওরকম অল্পে সন্তুষ্ট হতে জানতো, তবে প্রচুর চাহিদার লোভে পড়ে কিছু মানুষ হয়তো অমানুষে পরিণত হতো না। সামনের ঈদে কাকলির জন্য দুটো জামা বানাবে বকুল। এখনই সেটা জানাবে না বোনকে। ঈদের আগের দিন কাকলির জন্মদিন। সে উপলক্ষে বোনটাকে নতুন এক জোড়া জুতো কিনে দেওয়া যায় কিনা সেটাও ভাবছে। এক জুতো পরেই স্কুল কিংবা বাইরে যাওয়া আসা করতে হয়। অবশ্য ওরা বেড়াতে সেরকম যায় আর কোথায়। কুটুম্বিতা রক্ষা করাটা ওদের মতো প্রায় হতদরিদ্রদের জন্য বিলাসিতার নামান্তর। কদাচিৎ এবাড়িতে আত্মীয় স্বজনের আগমন ঘটে।

কালো চামড়ার একজোড়া জুতোর কী রকম দাম, কমলের পক্ষে সম্ভব হলে জেনে আসতে বলবে। বাবার জন্যও একজোড়া স্যান্ডেল স্যু কেনা খুব জরুরি। বাবা তো নিজের দিকে একদমই তাকান না। বছর তিন আগে কেনা জুতো জোড়ায় তাপ্পি মেরে মেরে চলছে। গ্রীষ্ম বর্ষা সব ঋতুতেই ওই এক জুতো পরে বাবাকে কাজে যেতে হয়। বকুল নিজে গিয়েও জেনে আসতে পারে। কিন্তু গাওছিয়া যেতেও তো বাড়তি খরচ, পায়ে হাঁটা দূরত্বে জুতোর কোনো[5] দোকান নেই আশেপাশে। কিন্তু ভাইটার চেহারাই তো দেখা যায় না আজকাল। চাকরির চেষ্টায় সুবিধা করতে না পেরে, কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে। কমলের সেরকম পুঁজি দেবার সামর্থ্য নেই, কায়িক শ্রমে সেটা পুষিয়ে দিচ্ছে।

মা জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হবার সমূহ সম্ভাবনা। বকুল তার সোনার চেনটা বিক্রি করে, আর প্রতিবেশী পারুল ভাবির কাছ থেকে হাজার পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে, কমলের ব্যবসার জন্য সামান্য কিছু টাকার ব্যবস্হা করে দিয়েছে। পারুল ভাবির পাঁচ হাজার পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, যাবতীয় কাপড় এখন থেকে বিনা পয়সায় সেলাই করে দেবে, এমন শর্তে টাকাটা ধার নিয়েছে। ভাইয়ের ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলে টাকাটা তার আগেও দিয়ে দিতে পারে। পারুল ভাবির অত তাড়া নেই অবশ্য। স্বামী স্ত্রী দু’জনে ভালোই উপার্জন করেন তারা। কমলেরা কয়েকজন বন্ধু মিলে ঢাকার বাইরে ফলের বাগান লিজ নিয়েছে। সেখানে থেকে ফল এনে ঢাকার বাজারে সাপ্লাই দেবে। লাভ নাকি বেশ ভালো এ ব্যবসায়। সে কাজে ভাইটা দিনরাত প্রচুর খাটছে। ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে সংসারেও কিছু দিতে পারবে কমল।



***

দরজায় আসা মাছওয়ালার কাছ থেকে নরম হয়ে আসা পাঁচ মিশালি মাছের একটা ভাগ বেশ সস্তায় কিনে মাজেদা বেগম বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যান। শেষ বিকেলের এ সময়ে প্রায় নষ্ট হতে বসা মাছ বিক্রির আর তেমন আশা নেই দেখে, মাছওয়ালাকে যে দাম বলা হয়েছে তাতেই সে রাজী হয়ে যাবে ভাবেননি মাজেদা বেগম। তেল মশলা আর একটু বেশি ঝাল দিয়ে চচ্চড়ি রান্ধবেন। বকুলের বাবা খুব পছন্দ করেন ছোটো মাছের চচ্চড়ি। অবশ্য স্ত্রীর হাতের যে কোনো রান্নাই তার পছন্দের। এখন মানুষটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। আগে তার তুচ্ছ সব রান্নারও উচ্ছ্বিত প্রশংসা করতো। ভালো পদ আর রান্না হয় কোথায়।

একঘেয়ে শাকপাতা আর সবজির ঘন্ট, এই তো তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকা। সেসব সামান্য রান্না মাজেদা বেগমের হাতের গুণে স্বাদ পায়। সামান্য তেল মশলায় মাজেদা বেগম বেশ গুছিয়ে রাঁধতে পারেন। তিনি নিশ্চিত, ছোটো মেয়ে কাকলি আজ রাতে এক হাতা ভাত অতিরিক্ত খাবে। ভালো মন্দ খাওয়ার প্রতি এত লোভ মেয়েটার! ভাবনাটা ওর ঠোঁটে মৃদু কাঁপন ধরিয়ে মিলিয়ে যায়... বিলাপের সময় নেই। ভাত বসাতে হবে। মানুষটা সারাদিন শেষে জ্বলেপুড়ে বাড়ি ফিরবে। অফিস থেকে ফেরার পর সামান্য রং চা আর দুটো টোস্ট বিস্কুট দিলেও আজকাল আর খেতে চায় না। কাকলিকে ডেকে পাশে বসিয়ে খাওয়ায়। মেয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে এমন ভাবে খায়, যেন অমৃত খাচ্ছে। দু’চোখ ভরে এদৃশ্য দেখতে দেখতে বুকটা ভারী হয়ে ওঠে মাজেদা বেগমের। আজ আর চা হবে না, একেবারে ভাত দেবেন। দ্রুত হাতে ছোটো মাছগুলো বাছতে থাকেন। বকুল এসে মায়ের সাথে হাত লাগায়। মা মেয়ে হাত লাগানোয় দ্রুত মাছ বাছা হয়ে যায়। বকুল রান্না ঘরে আসবার সময় উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে, কাকলি ঘুমাচ্ছে। ঘুমালে ওর অসহায়ত্ব যেন আরো বেশি ফুটে ওঠে। কিংবা ওর খামতিটা জানে বলেই হয়তো সেরকম মনে হয়। বকুল ওর স্বভাবসুলভ খুশি হওয়া গলায় মাকে বলে, “পুট্টুশটা রাতে খেতে বসে আজ তেমন ঘ্যান ঘ্যান করবে না দেখো।” বড় মেয়ের কথায় মুখ টিপে হাসেন মাজেদা বেগম।

রাতের খাবারটা সবাই বেশ চেটেপুটে খেল। মাজেদা বেগম তৃপ্তির সাথে সবার পাতে একটু বেশি বেশি মাছের তরকারি তুলে দিলেন। খেতে বসে রহিম সাহেব ফুরফুরে মেজাজে অনেক দিন পর স্ত্রীর হাতের রান্নার প্রশংসা করলেন। সামান্য আয়োজনের এই আনন্দ বাড়ির সবগুলো মানুষকে ছুঁয়ে থাকে কেমন। মাজেদা বেগমকে এত বলার পরও বকুলদের সাথে তিনি খেতে বসেননি। তিনি কমলের জন্য অপেক্ষা করবেন। ছেলেটা সেই কোন রাতে আসে, তার জন্য ঢাকা দেওয়া ঠান্ডা ভাত একা বসে খায়। আজ মা ছেলে দু’জনে একসঙ্গে খাবেন। ছেলের তৃপ্তি নিজ চোখে দেখবার লোভেই তিনি সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বকুল টুকটাক কিছু সেলাই করে। পাশে শুয়ে শুয়ে কাকলি দেখে। ও ঘরে মা বাবা কী কথায় ব্যস্ত। আজ বাবা মায়ের মন কেমন ভারহীন ফুরফুরে। বাবার একটা প্রমোশনের কথা চলছে। প্রমোশনটা হলে বেতন কিছু বাড়বে। চিরদিন তো আর সবার কষ্টে যায় না, সুদিন দেরিতে হলেও আসে। কমলদের ব্যবসাটাও দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে যাবে। তখন ওদের পক্ষে কাকলিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। মনুষ্য স্বভাবই বুঝি এমন, সুদিনের পায়ের আওয়াজ শুনল কী শুনল না, নানান সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে বলেই হয়তো শত যন্ত্রণা উজিয়েও বেঁচে থাকে।

কাজ গুছিয়ে বকুল বোনের পাশে শুয়ে শুয়ে তার প্রিয় খেলাটা শুরু করে। “শোন পুট্টুশ, বাবার প্রমোশন হলে আমাদের সামান্য একটু টাকা হবে। ভাইয়ের ব্যবসা ভালো মতো চলা শুরু করলে আরো একটু বেশি টাকা হবে আমাদের। তখন মাসে দু’ একবার মা তোকে পোলাও কর্মা রান্না করে দেবে। আমরা কোনোদিন কোনো রেস্তোরাঁয় খাইনি। একদিন সবাই মিলে খেতে যাবো। খুব মজা হবে।” আনন্দে কাকলি হাততালি দেয়। খলখল করে খানিক হাসে। ওর আনন্দ আরো একটু উসকে দিতে বকুল বলে, “চলন্ত সিঁড়িওয়ালা বড় বড় যে সব মার্কেট আছে না? তার একটাতে যাবো। তোর কী পছন্দ বল দেখি? মনে মনে ভাবতে থাক, আমরা এখন বসুন্ধরা সিটি শপিং মলে। ভয় পাচ্ছিস কেন! এই যে আমার হাতটা ধর। সিঁড়িতে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকবি চুপটি করে। কিস্যু হবে না বোকা।...এই তো! দেখলি কেমন তরতর করে ওপরে চলে এলাম। প্রথমে তোর জন্য চমৎকার একটা ড্রেস কিনবো, কেমন? কোন রং পছন্দ তোর?” আনন্দে আধবোজা গলায় কাকলি বলে, “কমলা।” “বাহ্! চমৎকার। ওই দেখ, কমলার মধ্যে সোনালী আর গাঢ় নীল জরি চুমকির নকশাদার ড্রেসটা, সুন্দর না?” “খুউব সুন্দর রে আপা!” “আইসক্রিম খাবি পুট্টুশ?” ‘খাবো তো।” “হুম চল, কোন ফ্লেভার খাবি?” মাথা চুলকে খানিক ভেবে নেবার ভান করে কাকলি। “চকোলেট। তুমি খাবে না আপা?” নিশ্চয়ই খাবো। বকুল গলায় খানিকটা গাম্ভীর্য এনে, যেন সত্যি সত্যি আইসক্রিমের অর্ডার দেয়, “এদিকে দুটো আইসক্রিম। একটা চকোলেট, আরেকটা স্ট্রবেরি, প্লিজ্।”

মনে মনে খাওয়া-বেড়ানোর মজার খেলাটা খেলতে খেলতে এক সময় দু’বোন ঘুমে তলিয়ে যায়।


৩.

গভীর রাতে ধাক্কা দিয়ে কেউ ঘুম ভাঙায় বকুলের। চমকে, ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখে মা। খুব নিচু স্বরে মা জানায়, “রাত তিনটে বাজলো, কমল তো এখনও এলো না বকুল?” ব্যবসার কাজ নিয়ে ভাইয়ের ব্যস্ততার কথা বকুলের জানা। প্রতিরাতেই দেরি হয় কমলের ফিরতে। কিন্তু এত রাত করেনি কখনও। ওঠে বসে মাকে আশ্বস্ত করে, “বুঝোই তো নতুন ব্যবসার কত রকমের কাজ থাকে। আজ হয়তো বাড়ি ফিরবে না কমল। তুমি শুয়ে পড়ো মা।” অন্ধকারে বকুলের দেখা হয় না মায়ের শুকনো মুখ। সারাদিন খাটাখাটুনিতেই যায়, তাঁর বিশ্রাম তো তেমন হয়না। ছেলেকে নিয়ে এক সাথে খাবেন বলে রাতের খাওয়াটাও হয়নি তাঁর। বারোটার দিকে খুব খিদে পেয়েছিল, এখন সেটা চাপা পড়ে গেছে। এখন আর খাওয়ার ইচ্ছেও নেই। বকুলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে, একগ্লাস পানি খেয়ে মাজেদা বেগম শুয়ে পড়েন।

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস মাজেদা বেগমের। আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। যদিও রাতে ঘুম ভালো হয়নি। গ্যাস্ট্রিকের পুরনো ব্যথার অস্বস্তিতে প্রায় সারা রাতই তাঁর নির্ঘুম কেটেছে। স্বামী নাস্তা খেয়ে অফিস চলে গেলে খানিকটা গড়িয়ে নেবেন। ছেলেটা রাতে বাড়ি ফেরেনি, সেটা নিয়েও চিন্তা হয়। নাস্তা তৈরি করে, টুকটাক কিছু কাজ সারেন স্বামী গোসল সেরে আসতে আসতে। সংসারে কাজের তো শেষ নেই। কাজের মানুষ রাখা খরচের ব্যাপার। সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়। বকুল মায়ের কাজে অনেক সাহায্য করে। মেয়েটা না থাকলে একা মাজেদা বেগমের পক্ষে কুলিয়ে ওঠা মুশকিল হত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে খানিক পথ চলতি মানুষ দেখেন অলস চোখে। সামনের চায়ের দোকানটায় রোজকার মতো জটলা। লোকজন ওখানে চা খায় আর সকালের পত্রিকা পড়তে পড়তে রাজনীতি থেকে শুরু করে হেন বিষয় থাকে না যা নিয়ে আলোচনায় মাতে না। কমলের মতে, ওই দোকানে চা খেতে যাওয়া মানে বাড়তি অনেক জ্ঞান নিয়ে বাড়ি ফেরা। বন্ধুরা আসলে ওখানে গিয়ে বসে কমল মাঝে মধ্যে।

গোসল সেরে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে খেতে বসেন রহিম সাহেব। নাস্তার আয়োজন খুব সামান্য। রাতের সবজি আর আটার রুটি। নাস্তার পর এককাপ রঙ চা। তাই খুব পরিতৃপ্তির সাথে খেয়ে অফিসে রওনা হন রহিম সাহেব। স্বামী চলে গেলে মাজেদা বেগম নিজেদের শোবার ঘরে আসেন, একটু গড়িয়ে নেবেন। মাত্রই বিছানায় গা এলিয়েছেন, এমন সময় দরজায় কারো ধাক্কার আওয়াজে ওঠে বসেন। মেয়েরা এখনও ওঠেনি কেউ। নিজেই ওঠে দরজা খুলে দেখেন, অচেনা এক লোককে নিয়ে এসেছে পাড়ার মুদী দোকানের ছেলেটা। অচেনা লোকটা বললেন, “আমি থানা থেকে এসেছি। আপনি কী আবুল হাসানের মা?”

মাজেদা বেগমের বুকটা ধড়াস করে ওঠে, গলাটা মুহূর্তে শুকিয়ে কাঠ। গলা দিয়ে স্বর না ফোটায় মাথা নেড়ে জানান, ‘না’। লোকটা পেছন ঘুরে হলুদ সবুজ ফুল লতা পাতার বাহারি নকশার শার্ট পরা মুদী দোকানের ছেলেটার দিকে তাকালে সে জানায়, “ইনিই আবুলের মা।”

অকস্মাৎ সম্বিত ফিরে পান যেন মাজেদা বেগম, কমলের ভালো নাম তো ওটাই! দরজায় মানুষের গলার আওয়াজে ততক্ষণে বকুল এসে দাঁড়িয়েছে মায়ের পাশে। মাজেদা বেগম এবার মাথা নেড়ে সায় দিলেন তিনিই আবুলের মা।

তারপর কী হয়েছে প্রশ্ন করার পর লোকটা যা বলল তার জন্য ওরা মোটেও প্রস্তুত ছিল না। মায়ের টলে যাওয়া শরীরটা কোনোভাবে আঁকড়ে ধরে বকুল প্রায় চিৎকার করে ওঠে, “অসম্ভব! আমার ভাই মোটেও মাদক ব্যবসায়ী না। মাত্রই ওরা কয়েক বন্ধু মিলে ফলের ব্যবসা শুরু করেছে।”

“ওইটা আইওয়াশ, তলে তলে মাদকের বিরাট ব্যবসা। অস্ত্রও পাওয়া গেছে তাদের কাছে। পুলিশের তালিকায় দলটার নাম ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খবর পেয়ে গতরাত আনুমানিক তিন ঘটিকায় তাদের আড্ডাখানায় উপস্হিত হয়। তখন তারা আইনের লোকদের ওপর গোলাগুলি চালিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। পুলিশ বাধ্য হয় গুলি চালাতে। দলের উপস্হিত তিনজন সদস্য ছিল। তিনজনই নিহত। দলে আর কে কে আছে, নামগুলো জানা প্রয়োজন। আপনারা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না, পুলিশ আসছে তল্লাশি চালাতে…’’


৪.

তল্লাশির নামে কাকলিদের আড়াইখানা ঘর উলটেপালটে, সঞ্চিত সামান্য জিনিসপত্র ভেঙেচুরে, কিছু না পেয়ে পুলিশ বাহিনী চলে যায় বীরত্বের সাথে। যাবার সময় বলে যায়, নগদ টাকাপয়সা নিয়ে থানা থেকে লাশটা ছাড়িয়ে আনতে হবে।

খবর পেয়ে দুপুরের আগেই অফিস থেকে ফিরে এসে বিধ্বস্ত রহিম সাহেব থম মেরে বসে থাকেন। তাঁকে যে থানায় যেতে হবে সেটাও যেন ভুলে গেছেন। ঘরের বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছে পাড়ার অনেক মানুষ। তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেন কৌতূহলী মুখগুলো। ভেতরের ঘর থেকে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গীর বুকফাটা আর্তনাদ ভেসে আসছে, তিনি শুনতে পান। কিন্তু উঠে গিয়ে সান্ত্বনা দেবার শক্তিটুকু অবশিষ্ট না থাকায় নিথর বসে থাকেন।

কমল বিএ পাশ করে সুবিধা মতো চাকরি জুটাতে পারেনি। খামোখাই আড্ডাবাজিতে সময় ব্যয় না করে তিনটে টিউশনি শুরু করেছিল। কিন্তু কোনো দিন বাবার কাছে হাত পাতেনি। তাঁর নিজের মধ্যে বিন্দুমাত্র অসততা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু কমলের মধ্যে সেরকম আভাস কোনোদিন দেখেছেন বলে মনে পড়ে না। তাঁর ছেলেকে তিনি চেনেন না? আজকে হুট করে কিছু মানুষের বানোয়াট বয়ানে তাঁর জানাটা মিথ্যে হয়ে যাবে!

…আহা, কত নির্মমভাবে না জানি ওরা ছেলেটার বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা করেছে।

তাঁর বুকটা খালি হয়ে গেল। প্রতি ঈদে বাবা ছেলে নামাজ শেষে কোলাকুলির সময় রহিম সাহেব ইচ্ছে করে ছেলেকে বুকে জাপটে থাকতেন একটুবেশি সময় নিয়ে। কমলও বাবার বুকে নিজেকে সঁপে দিতো কেমন! ওর মুখে সব সময় মিটিমিটি একটা হাসি লেগে থাকতো। ছুটে আসা বুলেট যখন ওকে বিদ্ধ করেছিল, তখনও কি লেপ্টে ছিল ঠোঁটের হাসিটা? রহিম সাহেবের মনে হয় ডাক দিলেই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে, নিজের যোগ্যতা প্রমাণে ব্যর্থ মানুষের অবয়ব নিয়ে ছেলেটা ঠিক সামনে এসে দাঁড়াবে। যেন সেরকম একটা আশা নিয়ে, গলায় স্বর ফোটানোর চেষ্টা করেন তিনি। অদ্ভুত জান্তব একটা কিছু আছড়ে পড়ে তাঁর গলা ফুঁড়ে। সমবেত মানুষেরা বোবা দৃষ্টি মেলে দেখে, এক অসহায় বাবা হাঁটু মুড়ে ভেঙে পড়ছেন অসহ্য যন্ত্রণায়। কান্নার দমকে তাঁর শরীরটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে।

রহিম সাহেব কিছুতে থানায় যাবার শক্তি পাচ্ছেন না। কমলের মৃত চেহারা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। কীভাবে তাঁর প্রিয়তম পুত্রের নিথর দেহটা সহ্য করবেন তিনি জানেন না। তাঁর শরীরটা ক্রমশ অবশ হয়ে আসে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ