মার্কারের সঙ্গে বিলিয়ার্ডস খেলতে খেলতে প্রিন্সিপাল সাহেব দারুণ একটা ‘ব্রেক’ করলেন৷ কিন্তু এর জন্যে তাঁকে বাহবা দেবার জন্যে সন্ধ্যাবেলা ক্লাবে মার্কার ভিন্ন আর কেউ ছিল না৷
‘শাবাশ, হুজুর! শাবাশ! বহুৎ ফাস কিলাস!’’ মার্কার তাঁকে হাস্যমুখে অভিনন্দন জানাল৷ তাঁর কাছ থেকে তাঁর কিউ চেয়ে নিয়ে চক ঘষতে লাগল ও-র ডগায়৷
‘‘কিন্তু আজ জজ সাহেবের এত দেরি হচ্ছে কেন?’’ প্রিন্সিপাল সাহেব তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দ্বিতীয় কি তৃতীয়বার এই প্রশ্ন করলেন৷
মার্কার বলল, ‘‘শায়দ মালুম হোতা কি জজ সাব আজ নেহি আওয়েঙ্গে হুজুর৷’’ পরবর্তী প্রশ্নের জন্যে অপেক্ষা না করেই উত্তর দিল, ‘‘বড়া জবর খুনী মামলা, হুজুর৷’’
খুনী মামলা শুনে প্রিন্সিপাল বিস্মিত হলেন না, কিন্তু জজ সাহেব আসবেন না শুনে খেলা থেকে তাঁর মন উঠে গেল৷ মার্কারের সঙ্গে কাঁহাতক খেলা যায় যেন সে তাঁকে জিতিয়ে দেবে বলে বদ্ধপরিকর৷ ওই ‘ব্রেক’টা তা বলে মার্কারের অনুগ্রহ নয়৷ কিন্তু মজা হচ্ছে এই, জজ সাহেবের সঙ্গে খেলবার সময় এত বড় একটা ‘ব্রেক’ হয় না৷
এবার মার্কারের পালা৷ সে ওস্তাদ লোক৷ ছেলেবেলা থেকে এই কর্ম করে আসছে৷ একবার আস্তে আলগোছে কিউ ছুঁইয়ে দেয় অমনি খেলার টেবিলের সবুজ মসৃণ আস্তরণের উপর দিয়ে সাদা বল গড়িয়ে যায় ধীর মন্থর গতিতে৷ অব্যর্থ তার টিপ৷ পট করতে চায় পট হয়, ইন অফ করতে চায় ইন অফ, ক্যানন করতে চায় ক্যানন৷ কিন্তু ইচ্ছে করেই সে পয়েন্টের সংখ্যা বাড়তে দেয় না৷ প্রিন্সিপালকে হারিয়ে দেওয়া তার পলিসি নয়৷ সে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে পেছিয়ে থাকে৷
মার্কারের সঙ্গে খেলে প্রিন্সিপাল সাহেব জয়ী হন, কিন্তু জয়গৌরব পান না৷ সেদিন আরো কিছুক্ষণ খেলে তিনি কিউ ফেরত দিলেন৷ মার্কার একটু সকাল সকাল বাড়ি যাবার তালে ছিল৷ একগাল হেসে হাসি চেপে বলল, ‘‘বড়ি আফসোসকি বাত হুজুর৷ জজ সাব আজ আনেওয়ালা নেহি হ্যায়৷’’
তারপর সেলাম ঠুকে পুছল, ‘‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’’
প্রিন্সিপাল নিজেই নিজেকে পান করাচ্ছেন৷ হুকুম করলেন ‘‘পানি৷’’
‘‘বহুৎ খুব’’ বলে মার্কার সেলাম ঠুকে অদৃশ্য হলো৷
এমন সময় শোনা গেল বাইরে মোটরের আওয়াজ৷ মার্কার সেই দিকেই ছুটল৷
‘‘হ্যালো প্রিন্সিপাল৷’’
‘‘হ্যালো জজ৷’’
দু’জনে দু’জনের দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন৷ দু’জনেই উৎফুল্ল৷ কিন্তু সব চেয়ে উৎফুল্ল হলো মার্কার৷ যদিও সব চেয়ে দুঃখিত৷ হয়েছে এখন তার বাড়ী যাওয়া৷ জজ সাহেব আর প্রিন্সিপাল সাহেব একসঙ্গে খেলতে শুরু করলে রাত ন’টার আগে ছুটি মিলবে না৷ একটু সরে দাঁড়িয়ে থেকে একবার এঁকে ‘‘শাবাশ’’ ও একবার ওঁকে ‘‘বাহ বাহ’’ দিতে হবে৷ মাঝে মাঝে কিউ হাতে নিয়ে চক মাখিয়ে দিতে হবে৷ ডাকলে খেলা দেখিয়ে দিতে হবে৷ ঝগড়া বাধলে আমপায়ার হতে হবে৷ আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর পুছতে হবে ‘‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’’ নেপথ্যে থেকে নিয়ে আসতে হবে ফরমাসী পানীয়৷
জজ আর প্রিন্সিপাল দু’জনে দুটো কিউ বেছে নিয়েই হাঁক ছাড়লেন, ‘‘মার্কার৷’’ তা শুনে মার্কার সেলাম ঠুকে হাজির হতেই এক কণ্ঠে বললেন, ‘‘পুছো৷’’
বেচারা পড়ে গেল উভয়সঙ্কটে৷ যদি জজ সাহেবকে পহিলে পোছে তা হলে তার সামনে দাঁড়ায় সে প্রিন্সিপাল সাহেবের হুকুম পহিলে মানে৷ আর যদি প্রিন্সিপাল সাহেবকে আগে প্রশ্ন করে তবে তার কাছে জজ সাহেবের আদেশ অগ্রগণ্য৷ বহুকালের মার্কার৷ চাকরিটা এক কথায় যাবে না৷ তবু কাজ কী কাউকে চটিয়ে? সাহেবসুবোদের মেহেরবানীতে তার ছেলে ভাইপো ভাগনে জামাই কেউ বসে নেই৷ শীতের এই ক’মাস পরে হুজুরদের আপিসে ‘‘পাঙখা পুলার’’ দরকার হবে৷ তখন জ্ঞাতিদের জন্যে দরবার করতে হবে তো৷
মার্কার জানত যে প্রিন্সিপাল সাহেব যদিও বিদ্বানশ্রেষ্ঠ ও বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে তবু জজ সাহেব হলেন দণ্ডমুণ্ডের মালিক৷ চাইকি ফাঁসী দিতে সমর্থ৷ স্বএলাকায় তাঁকেই পূজা করতে হয়৷
‘‘হুজুরকা ওয়াস্তে?’’ সে প্রিন্সিপাল সাহেবকেই আগে পুছল৷
তিনি হেসে ফেললেন৷ যা ভেবেছিলেন তাই৷ বললেন, ‘‘নেম্বু পানী৷’’
জজ বললেন, ‘‘জিন৷’’
এর পর দু’জনে খেলায় মেতে গেলেন৷ তাঁদের মুখে কেবল খেলার বুলি৷ মতভেদ হলে মার্কারকে ডাকেন৷ সেক্ষেত্রে তার বাক্যই আপ্ত বাক্য৷ সে তখন কারো মুখ চেয়ে রায় দেয় না৷ তারও একটা কোড আছে৷ তার দিকে তাকালেই বোঝা যায় সে তার মর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন৷ জান গেলেও সে তার মহিমা থেকে বিচ্যুত হবে না৷ অন্যায় করে জজ সাহেবকে জিতিয়ে দেবে না৷ যদিও তার মাইনে হয়তো জজের মাইনের শতাংশ৷ সাহেবরাও তাকে চটাতে সাহস পান না৷ সে যদি চাকরি ছেড়ে দেয়, আর ও-রকম ওস্তাদ পাওয়া যাবে না৷
সেদিন খেলা কিন্তু জমল না৷ জজ অন্যমনস্ক ছিলেন৷ তাঁর কিউ বার বার বল ছুঁতে গিয়ে কুশন ছোঁয় কিংবা তাঁর বল অপর বলকে ছুঁতে না পেয়ে ভ্রষ্ট হয়৷ মার্কার পয়েন্টের হিসেব রাখে৷ বোর্ডের দিকে নজর পড়লে তিনি শিউরে ওঠেন৷ মাইনাস টোয়েন্টি৷ তিনি হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘‘নো লাক৷’’
‘‘ব্যাপার কি, সুর?’’ প্রিন্সিপাল বললেন, ‘‘তুমি যে একেবারেই খেলছ না?’’
‘‘আর বল কেন, মৈত্র!’’ জজ বললেন পাংশুমুখে, ‘‘যেখানে একজনের প্রাণ নিয়ে টানাটানি সেখানে আরেকজন খেলা করবে কোন সুখে? খেলতে পারো তোমরা মাস্টাররা৷ তোমরাই ভাগ্যবান৷’’
প্রিন্সিপাল প্রতিবাদ করলেন৷ বললেন, ‘‘মানুষকে ফাঁসী দিতে সকলেই পারে, কিন্তু মানুষের ছেলেকে মানুষ করে দিতে পারে ক’জন! অথচ মজুরী কিনা তাদেরই সবচেয়ে কম!’’
‘‘ফাঁসী দিতে সকলেই পারে!’’ জজ আশ্চর্য হলেন৷ ‘‘বাইশ লাখ লোকের এই দুই জেলার মাত্র একজনকেই সে-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে৷ আমি হলুম ওয়ান ইন টু মিলিয়ানস৷’’
মাথায় চুল চামরের মতো সাদা আর নরম৷ কিন্তু বয়স এমন কিছু হয়নি৷ সবে চল্লিশের কোঠায় পড়েছে৷ আঁট-সাঁট মুখমণ্ডল৷ ঠোঁট জবাফুলের মতো রাঙা৷ সিভিলিয়ান মানুষ পান খান না৷ এ রঙ কৃত্রিম নয়৷ চেহারাও বাঙালীর পক্ষে অসাধারণ ফরসা৷ তিন চার বছর অন্তর অন্তর বিলেত ঘুরে আসা অভ্যাস৷ বিয়ে করেননি৷ জিজ্ঞাসা করলে জবাব দেন, ‘‘হাতে কিছু জমলে তো বিয়ে করার কথা ভাবব৷’’
ওদিকে প্রিন্সিপাল হচ্ছেন গ্রাস উইডোয়ার৷ তাঁর স্ত্রী থাকেন কলকাতায় ছেলেমেয়ে নিয়ে৷ ভদ্রলোক প্রেসিডেন্সী কলেজে দীর্ঘকাল থাকার পর এই প্রথম প্রিন্সিপাল পদ পেয়ে মফঃস্বলে বদলি হয়েছেন৷ যদি ভালো না লাগে তবে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাবেন৷ নাই বা হল প্রমোশন৷ আর যদি ভালো লাগে তা হলে সবাইকে নিয়ে আসবেন৷ একদা লন্ডনে পড়েছেন৷ সে সময় জজ ছিলেন তাঁর সমকালীন ছাত্র৷
‘‘তোমার অত মাথাব্যথা কিসের?’’ প্রিন্সিপাল বললেন জজের শুক্ল কেশের উপর কটাক্ষ করে, ‘‘সিদ্ধান্তটা তো তুমি করতে যাচ্ছ না হে৷ করবে জুরি৷ জুরি যদি বলে আসামী ৩০২ ধারা অনুসারে অপরাধী আর তুমি যদি একমত হও তাহলে আইনে বলে দিয়েছে তুমি তাঁকে ফাঁসী দেবে৷ যদি না তুমি তার অপরাধ লাঘব করার মতো কোনো অবস্থা দেখতে পাও৷ সেক্ষেত্রে তুমি দ্বীপান্তরের আদেশ দেবে৷ এই পর্যন্ত তোমার স্বাধীনতা৷ যেখানে স্বাধীনতা নেই সেখানে দায়িত্ব নেই৷ যেখানে যতটুকু স্বাধীনতা সেখানে ততটুকু দায়িত্ব৷’’
মৈত্র কিছুদিন ব্যারিস্টারি করেছিলেন৷ পসার জমেনি৷ ধাতটা পণ্ডিতের৷ ভালো ডিগ্রী ছিল৷ ভি পি আই’র সঙ্গে দেখা করতে না করতেই অমনি নিযুক্তি-পত্র এলো৷ সিদ্ধান্তটা তিনি সরকারী চাকরির বয়স পেরিয়ে যাবার আগেই নিয়েছিলেন৷ নইলে তাঁর মুখেও শোনা যেত—‘‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু, হায়’’ মাইকেলের মতো৷
তর্ক করতে করতে তাঁরা টেবিল ছেড়ে কিন্তু কিউ হাতে করে অদূরে উঁচু বেঞ্চিতে গিয়ে বসলেন৷ মার্কার ধরে নিল যে তাঁরা একটু পরে নেমে এসে খেলা চালিয়ে যাবেন৷ কাশতে কাশতে সে বাইরে গেল জজসাহেবের শোফারের সঙ্গে গল্প করতে৷
‘‘হায়, বন্ধু!’’ জজ বললেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ‘‘যদি অত সহজ হতো—কী করে আমি তোমাকে বোঝাব যে বিচারের পরিণামের জন্যে জুরির চেয়ে আমারই দায়িত্ব বেশী! তোমার কথায় মনে পড়ল আর একজনের কথা৷ তিনি আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যাকে মারবার তাকে শ্রীভগবান স্বয়ং মেরে রেখেছেন৷ হে অর্জুন, তুমি শুধু তাঁর হাতের অস্ত্র৷ নিমিত্তমাত্রো ভব সব্যসাচী৷’’
‘‘ওই গীতার বচনই শেষ কথা৷ সমস্ত দায় ওই ব্যাটা ভগবানের৷ তোমার আমার কিসের দায়! অত বেশী সিয়েরিয়াস হতে যাই কেন আমরা! প্রতিদিন এ জগতে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরছে৷ একটা মানুষ বেশী মরলে কী আসে যায়!’’ প্রিন্সিপাল উদাসীন ভাবে বললেন৷
‘‘মরবে মরুক৷ কিন্তু আমার হাত দিয়ে কেন মরবে? কপালের দোষে মরতে পারে৷ কিন্তু বিচারের দোষে কেন মরবে? একজনও নির্দোষ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়, এই আমাদের ধর্মাধিকরণের মূলনীতি৷ আমি সেই মূলনীতির সংরক্ষক৷ মাথাব্যথা আমার হবে না তো কার হবে? আমি এটাকে সিয়েরিয়াস ভাবে নিই৷’’ জজ নাছোড়বান্দা৷
‘‘বেশ, তোমার ভাবনা তোমার৷ মাঝখান থেকে আমারই সন্ধ্যাটা মাটি৷ মার্কার! মার্কার ব্যাটা ভাগল কোথায়?’’ প্রিন্সিপাল হাঁক দিলেন৷
মার্কার পাগড়ি খুলে রেখে আরাম করছিল৷ পাগড়ি বাঁধতে বাঁধতে ছুটে এলো৷ তখন প্রিন্সিপাল বললেন, ‘‘পুছো৷’’
‘‘না, না—এবার তোমার পালা নয়, আমার পালা৷ মার্কার!’’ জজ ইঙ্গিত করতেই মার্কার তাঁর আদেশ মান্য করল৷ প্রিন্সিপালের পাশে সেলাম ঠুকে দাঁড়াল৷
মৈত্র বললেন, ‘‘নারঙ্গী!’’
আর সুর চাইলেন ছোটা পেগ৷
দু’জনে দু’জনকে ‘চীয়ারিও’ জানিয়ে পানীয় তুলে মুখে ছোঁয়ালেন৷ কিন্তু সেই উচ্চাসন থেকে নামবার নাম করলেন না৷ মার্কার বেচারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়৷
হঠাৎ মার্কারের মুখের উপর নজর পড়ায় অন্তর্যামী জজ অনুমানে বুঝলেন তার মনের ভাষা৷ ডান হাত উঠিয়ে বললেন, ‘‘ব্যাস৷’’
সে তখন সাহেবদের হাত থেকে কিউ দুটি নিয়ে প্রাচীরে লগ্ন করল৷ আর টেবিলের উপর বলগুলোকে সাজিয়ে রাখল৷ আর টেবিলের উপরকার কড়া আলোর বাতির সুইচ টিপে নিবিয়ে দিল৷ তা সত্বেও সে বিদায় নিতে পারে না, যতক্ষণ সাহেবরা ক্লাবে থাকেন ও পানীয় ফরমাস করেন৷ ন’টা এখনও বাজেনি৷ তবু মনে হয় গভীর রাত৷ নিঝুম শহর৷
তার দশা দেখে জজ বলেন, ‘‘মৈত্র, এখন এ বেচারাকে আটকে রেখে আমাদের কী লাভ? ক্লাবে তো আজকাল কেউ আসতেই চান না টেনিসের পরে৷’’ ইংরেজীতে যোগ করলেন, ‘‘কিসের টানে আসবেন? মোহিনী শক্তি কোথায়? স্টেশনে উপস্থিত মহিলারা সকলেই পর্দা৷ ইন্ডিয়ানাইজেশনের পরিণাম৷’’
‘‘এবং ইসলামাইজেশনের৷’’ মৈত্রও বললেন ইংরেজীতে৷ ‘‘কিন্তু সেই একমাত্র কারণ নয়, সুর৷ তুমি বিয়ে করনি৷ সিভিল সার্জনও চিরকুমার৷ তোমরাও যদি ও-ভাবে শত্রুতা কর, তাহলে ক্লাব উঠে যেতে কতক্ষণ? আমি তো মনে করি সমাজও উঠে যাবে৷’’
জজ হেসে বললেন, ‘‘হা হা! আমরা করছি শত্রুতা! চল হে চল৷ আমার ওখানে চল৷ খেতে খেতে গল্প করা যাবে৷ ডিনারে আজ তুমি আমার অতিথি হলে ধন্য হব৷’’
মার্কারকে ছুটি দিয়ে দুই বন্ধু মোটরে উঠে বসলেন৷
দুই
খেতে খেতে বিস্তর আজেবাজে কথা হলো৷ তারপর কফির পেয়ালা হাতে করে দু’জনে গিয়ে বসলেন ফায়ারপ্লেসের ধারে৷ শীত পড়ছিল সেকথা ঠিক, কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা সুর সাহেবের বৈলাতিক অভ্যাস৷ আগুন পোহাতে পোহাতে তিনি রেডিওতে বি বি সি’র সঙ্গীত শুনতে ভালোবাসেন৷ তাঁর পায়ের কাছে তাঁর প্রিয় কুকুর জলি৷
‘‘আচ্ছা মৈত্র,’’ সুর পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, ‘‘তুমি নিজে ফাঁসী দিতে পারো? মানে জজ হলে তুমি ফাঁসীর হুকুম দিতে পারবে?’’
‘‘আলবৎ৷’’ মৈত্র সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘‘আমি তো দিচ্ছিনে—দিচ্ছে আইন! দেশের সরকার যদি ক্যাপিটাল সেনটেন্স রহিত করে আমিও দেব না৷’’
‘‘কিন্তু সেই তিনিও, যিনি আমাকে নিমিত্তমাত্র হতে উপদেশ দিয়েছিলেন, তিনিও দেখলুম আমার প্রশ্ন শুনে পিছিয়ে গেলেন৷ বললেন, না আমি পারিনে৷ তারপর আমাকে এক কাহিনী শোনালেন৷ তাঁর নিজের জীবনের কাহিনী৷’’ এই বলে জজ আবার অন্যমনস্ক হলেন৷ তাঁর স্মৃতি ফিরে গেল জজিয়তীর প্রথম দিনগুলিতে৷
‘‘মামলাটা তো আমার কোর্টের নয়, খুঁটিনাটি আমার মনে নেই৷’’ তিনি একটু একটু করে স্মরণ করে বলতে থাকলেন থেমে থেমে, এখানে ওখানে শুধরে দিতে দিতে, নিজেই নিজের প্রতিবাদ করতে করতে৷ মোটামুটি দাঁড়াল এই রকম৷
নিয়োগী সাহেব যখন রাজশাহী জেলার দায়রা জজ তখন তাঁর আদালতে এক খুনী মামলা আসে৷ ইংরেজ মোল্লা খুন হয়েছে৷ আসামী আর কেউ নয়, তার বেটা গোপাল মোল্লা৷ গোপালের বয়স আঠারো-উনিশ হবে৷ মা নেই৷ আদুরে দুলাল৷ সে যা চায় তাই পায়৷ কখনো বাপের মুখে ‘‘না’’ উত্তর পায়নি৷ মহা শৌখীন ছোকরা গোপাল৷ গ্রামে এক আলকাপ দল গড়েছে৷ এক রকম যাত্রার দল৷ রাতদিন ওই নিয়ে থাকে৷ তার সুন্দর রূপ আর সুন্দর কণ্ঠ কত মেয়েকে যে আকর্ষণ করে! তাদের স্বামীরা শত্রু হয়, কিন্তু গোপাল ছেলেটা সৎ৷ কেউ তাকে দোষ দিতে পারে না৷
এমন যে গোপাল সে একদিন বায়না ধরল নিকা করবে৷ কাকে? না সোনাভানকে৷ অসমবয়সিনী রসবতী বিধবা৷ চারদিকে দুর্নাম৷ কিন্তু বহু সম্পত্তির মালিক৷ তাই তার প্রার্থীও অনেক৷ প্রস্তাবটা শুনে ইংরেজ বলল, ‘‘না৷’’ গোপাল বিগড়ে গেল৷ ইংরেজ তখনো দিব্যি জোয়ান৷ তারও প্রচুর সম্পত্তি৷ ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার৷ গোপালকে বাঁচানোর জন্য গোপালের বাপ করে বসল সোনাভানকে নিকা৷ ভেবেছিল গোপাল তার কপালকে মেনে নিয়ে আর একটি লক্ষ্মী মেয়েকে বিয়ে করবে৷ কিন্তু গোপাল বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে ভিন্ন গাঁয়ে গিয়ে দেওয়ানা হলো৷ আলকাপের ভার নিল তার ইয়ার কালু৷
সুখেই ঘর করছিল ইংরেজ মোল্লা৷ আর একটি বেটাও হয়েছিল তার৷ একদিন অন্ধকার রাত্রে কে একজন তার ঘরে ঢুকে তাকে হেঁসো দিয়ে মেরে খুন করে৷ ইংরেজ চেঁচিয়ে ওঠে, গোপাল, তুই? চিৎকার শুনে পাড়ার লোক ছুটে আসে৷ দেখে ইংরেজ অজ্ঞান৷ একটু পরেই সে মারা যায়৷ গোপালকে তারা কেউ দেখেনি, কিন্তু তারাও শুনেছিল ইংরেজের চিৎকার, ‘‘গোপাল, তুই?’’ সোনাভান সেসময় ছিল না৷ আলকাপ শুনতে গেছল৷ গোপালকে গ্রেফতার করা হয় পরের দিন আলকাপ দলের আখড়ায়৷ সে বলে, আমি তো ও-বাড়ি চিরদিনের মতো ছেড়েছি, আমি কেন যাব? কিন্তু অবস্থা-ঘটিত প্রমাণ তার বিরুদ্ধে৷ একখানা রুমাল কুড়িয়ে পাওয়া গেল, সেখানা গোপালকে দিয়েছিল সোনাভান৷ তাতে রক্তের দাগ ছিল৷
খুনী মামলায় জুরি সাধারণত ঝুঁকি নিতে চায় না৷ একেবারে খালাস দিতে ইচ্ছে বোধ করলে ৩০২ ধারাকে দাঁড় করায় ৩০৪ ধারার ক’তে কিংবা খ’তে৷ মামলায় জুরি ইচ্ছা করলে অপরাধের গুরুত্ব কমিয়ে আনতে পারত, কিন্তু ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করল৷ পাবলিক প্রোসিকিউটার তাদের ভালো করে ভজিয়েছিলেন যে, বৌ মারা গেলে বৌ হয়, ছেলে মারা গেলে ছেলে হয়, কিন্তু বাপ মারা গেলে বাপ আর হয় না৷ পিতৃহত্যার মতো দুষ্কর্ম আর নেই৷ গোপাল যদি সৎমাকে পাবার আশায় এমন গর্হিত কাজ করে না থাকে, তবে আপনারা তাকে খালাস দিন, যদি আপনাদের মনে যুক্তি- সঙ্গত সন্দেহ থাকে তবে সন্দেহে সুফল দিন৷ কিন্তু পাবলিক প্রোসিকিউটার নাটকীয় ভঙ্গীতে বলেছিলেন, ইংরেজ মোল্লাকে যে হত্যা করেছে সে যদি তার পুত্র গোপাল ভিন্ন আর কেউ না হয়ে থাকে, তাহলে—তিনি চোখে জল এনে ফেলে জুরির সামনে চোখ মুছতে মুছতে বলেছিলেন, আপনাদের কর্তব্য অতি কঠোর৷ কোনো রকম কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেবেন না৷ গোপাল গেলেও ইংরেজের বংশলোপ হবে না৷ আপনারা শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমান৷ বিজ্ঞের কাছে একটি শব্দই যথেষ্ট৷
মৈত্র আর ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না৷ বললেন, ‘‘তারপর বিচারক নিশ্চয় তার বয়স বিবেচনা করে তাঁকে ফাঁসী দিলেন না—দ্বীপান্তর দিলেন!’’
‘‘না, বন্ধু৷ গোপাল আর গোপাল নয়৷ সে সাবালক হয়েছে৷ সাবালকের ছাড় নেই—মাফ নেই৷ নিয়োগী জুরির সঙ্গে একমত হয়ে গোপালকে চরম দণ্ড দিলেন৷ ভালো উকীল দিলে হয়ত ছেলেটা বেঁচে যেত, কিন্তু আসামীর মামা গরীব লোক, সে সরে দাঁড়ায়৷ সরকারী ডিফেন্স প্যানেল থেকে যথারীতি একজন উকীল দেওয়া হয়৷ সরকারী খরচে৷ সামান্য ফী৷ ভালো উকীলরা কেউ সে প্যানেলে নাম দেন না৷ যাঁকে উকীল দেওয়া হয়েছিল তিনি পাবলিক প্রোসিকিউটারের সামনে দাঁড়াবার অযোগ্য৷ নিয়োগী কি করতে পারেন? ফাঁসীই দিলেন৷’’ সুর বললেন করুণ সুরে৷
‘‘আহা, ফাঁসী!’’ মৈত্র শিউরে উঠলেন৷ ‘‘হাইকোর্ট কনফার্ম করল?’’
‘‘শোন তারপর কী হলো! আসামী কাঁদল না, কাটল না৷ নীরবে দণ্ড গ্রহণ করল৷ শুধু একবার সামনের দিকে হাতজোড় করে তাকাল৷ এর পরে আরম্ভ হলো বিচারকের বিচার৷ তিনি বাংলোয় ফিরে গিয়ে অন্য কাজে মন লাগাতে পারলেন না৷ তাঁর আহারে রুচি নেই৷ তিনি দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠেন, আর ঘুমোতে পারেন না৷ তাঁর নিজের শান্তির জন্যে তিনি দিনকয়েক পরে জেলখানা পরিদর্শনের ছলে গোপালের সঙ্গে কথা বলতে যান৷ বলেন, গোপাল, তোমার জন্য আমি আন্তরিক দুঃখিত৷ কিন্তু কী করব বল, আমারও তো ধর্মভয় আছে৷ গোপাল বলে, ধর্মাবতার, কেয়ামতের দিন খোদাতালা আমার বিচার করবেন৷ সাক্ষীদেরও, জুরি সাহেবানেরও, ধর্মাবতারেরও৷ নিয়োগী ভড়কে গিয়ে বলেন, তুমি আপীল কর৷ গোপাল বলে, নিজের বাপ যাকে মেরে রেখেছে, সে কি আপীলে বাঁচবে, ধর্মাবতার! আর মরতেই আমি চাই৷ যে মেয়ে আমার সৎমা হয়েছে, তার সঙ্গে কি নিকে বসা যায়! খালাস হলেও আমি মুখ দেখাতে পারতুম না, ধর্মাবতার৷ লোকে বিশ্বাস করত যে সৎমাকে নিকা করবার জন্যে আমিই আমার বাপজানকে মেরেছি৷’’
মৈত্র কণ্ঠক্ষেপ করলেন, ‘‘এরই নাম ঈডিপাস কমপ্লেক্স!’’
সুর বলতে লাগলেন, ‘‘ছেলেটির কথাবার্তায় এমন একটা সত্যের ঝঙ্কার ছিল যে নিয়োগীর মনে হলো, আর সকলে অভিনয় করে গেছে, শুধু গোপাল তা করেনি৷ তিনি স্থানকাল ভুলে তাকে মিনতি করে বললেন, গোপাল, তুমি একবার শুধু বল আসলে কী হয়েছিল৷ গোপাল বলল, খোদায় মালুম৷ আমি তো সেখানে যাইনি৷ রুমালটা সোনাভান আমাকে দিয়েছিল নিকার আগে, আমি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসি নিকার পরে৷ তাতে রক্ত কী করে এলো খোদা জানেন! এরপরে গোপাল চুপ করে৷ নিয়োগীও আর তাকে খোঁচান না৷ কিন্তু সেই যে তাঁর মাথায় পোকা ঢুকল সে পোকা সেইখানেই থেকে গেল৷ তিনি সরকারকে চিঠি লিখলেন যে তিনি ছুটি নিতে চান৷ ছুটির পর আর যেন তাঁকে জজ না করা হয়৷ করলে তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন করা হবে৷’’
মৈত্র বললেন, ‘‘তার মত লোকের জজ না হওয়াই ভালো৷ যে যা বলে, তাই তিনি বিশ্বাস করবেন! আরে, ফাঁসীর কয়েদী তো অমন কথা বলবেই৷’’
‘‘ফাঁসীর কয়েদী,’’ সুর বললেন, ‘‘আপীল করে না কোথাও শুনেছ এ কথা?’’
‘‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে বল—গোপাল আপীল করেনি?’’ মৈত্র পাল্টা শুধালেন৷
‘‘না, বন্ধু৷ গোপাল আপীল করেনি৷ এটা এমন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার যে কেবল নিয়োগী কেন, অনেকের মনেই ধোঁকা লেগেছিল৷ পাবলিক প্রোসিকিউটারও পরে স্তম্ভিত হয়েছিলেন৷ কিন্তু শোন, তারপরে কী হলো৷ নিয়োগী ছুটি পেলেন, কিন্তু ছুটির পরে তাঁকে সেই জেলারই কলেক্টর পদে অফিসিয়েট করতে বলা হলো৷ তিনি তার সুযোগ নিয়ে টুর ফেললেন বদলগাছি থানায়৷ পাহাড়পুরের স্তূপ পরিদর্শন করবেন৷ সরেজমিনে গিয়ে হারুনল রশিদের মতো ছদ্মবেশে অনুসন্ধান করতে লাগলেন৷ দফাদার চৌকিদারদের মুখেই শুনলেন যে, হালিম মির্ধা এক ঢিলে দুই পাখী মেরেছে৷ বাপকে আর বেটাকে, সোনাভান আর তার সম্পত্তির লোভে৷ কাজিয়া একটা অনেক দিন থেকে চলছিল৷ নিকার আগে সোনাভানের জমিজমা তারই হেফাজতে ছিল৷ তার বিবি না থাকলে সোনাভান তার সঙ্গেই নিকা বসত৷ তার মুখের গ্রাস কেড়ে নিল ইংরেজ মোল্লা৷ তলে তলে ফন্দী আঁটছিল৷ একদিন অন্ধকার রাত্রে ‘বাপজান’ বলে ঘরে ঢুকে ইংরেজকে নিকাশ করল৷ ঘুমের ঘোরে ইংরেজ চেঁচিয়ে উঠল, ‘গোপাল, তুই!’ সোনাভান ছিল না৷ সাক্ষীরা আসবার আগে হালিম অন্তর্ধান!’’
মৈত্র ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘‘গাঁজা, গাঁজা! বদলগাছিতে তো গাঁজার চাষ হয় শুনেছি, নিয়োগীকে গাঁজা খাইয়ে দিয়েছে৷ তারপর?’’
‘‘হালিম অনেকদিন নিরুদ্দেশ ছিল৷ গোপালের সাজা হওয়ার পর সে আবার গ্রামে ফিরে এসেছে৷ কিন্তু গ্রামের লোক তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে৷ সে খুব সাবধানে চলাফেরা করছে৷ গোপালের ফাঁসী হয়ে গেলে পরে সোনাভানকে নিকা করবে৷ নিয়োগী সাহেব যখন সদরে ফিরলেন, তখন তাঁর ১০২ ডিগ্রী জ্বর৷ সেই জ্বর নিয়েই তিনি নতুন জজের বাড়ি গিয়ে দেখা করলেন৷ বললেন, ‘এখনো সময় আছে, ছেলেটার যাতে ফাঁসী না হয় তার জন্যে আসুন আমরা চেষ্টা করি৷ নতুন জজ ম্যাকগ্রেগর কি রাজী হন? বললেন, কেসটা আমি করিনি৷ আমার কোনো লোকাস স্টান্ডই নেই৷ আর আপনিও এখন জজ নন৷ আপনি ফাংটাস অফিসিও৷ কাগজপত্র হাইকোর্টে চলে গেছে৷ প্রাণদণ্ড তাঁরা হয়তো কনফার্ম করবেন না৷ তাহলেও তো ছেলেটা মরছে না৷ তা শুনে নিয়োগী বললেন, যদি কনফার্ম করে, তখন যে খুব দেরি হয়ে গিয়ে থাকবে৷ ম্যাকগ্রেগর বললেন, তখন গভর্ণরের কাছে করুণা ভিক্ষা করলে তিনি তার বয়স বিবেচনা করে প্রাণদণ্ড মকুব করবেন৷ এর নজির আছে৷ নিয়োগী বললেন, যে মানুষ আপীল করল না, সে কি মার্সি পিটিশন দেবে? তাহলে তো স্বীকার করে নেওয়া হয় যে সেই তার বাপকে খুন করেছে! ম্যাকগ্রেগর বললেন, স্বীকার তাকে করতেই হবে—যদি প্রাণে বাঁচতে চায়৷ চৌদ্দ বছর দেখতে দেখতে কেটে যাবে৷ জীবন নতুন করে আরম্ভ করার পক্ষে তেত্রিশ বছর এমন কিছু বেশী বয়স নয়৷ চাষীর ছেলে—অন্য কোনো গ্রামে গিয়ে বাস করলে কেই বা তাকে সমাজে ঠেলবে!’’
‘‘হ্যাঁ, ম্যাকগ্রেগরই জজ হবার যোগ্য৷’’ মৈত্র তারিফ করে বললেন, ‘‘তারপর?’’
‘‘তারপর যা হবার তাই হলো৷ হাইকোর্ট দেখল, গোপাল আপীল করেনি, কেউ তার হয়ে একটি কথাও বলবার জন্যে দাঁড়ায়নি—প্রাণদণ্ড কনফার্ম করল৷ তা শুনে নিয়োগী আবার গোপালের সঙ্গে জেলখানায় গিয়ে কথা বললেন৷ সে মার্সি পিটিশন দিতে নারাজ হলো৷ যে দোষ করেনি সে কেন করুণা ভিক্ষা করবে? তখন নিয়োগী একটা অভূতপূর্ব কাজ করলেন৷ জুডিসিয়াল সেক্রেটারীকে চিঠি লিখে সব কথা জানালেন৷ উত্তর এলো, আদালতের বাইরে ভূতপূর্ব জজ যদি কিছু শুনে থাকেন, তবে সেটার উপর কোনো অ্যাকশন নেওয়া যায় না৷ মার্সি পিটিশন না দিলে ধরে নেওয়া হবে যে দণ্ডিত ব্যক্তি অনুতপ্ত৷ সুতরাং করুণার অযোগ্য৷ নিয়োগী হাল ছেড়ে দিলেন৷ ফাঁসীর আগেই তাঁর অস্থায়ী কার্যকাল শেষ হয়ে যায়৷ তিনি অন্যত্র বদলি হন৷ তারপর তিনি মদ ধরলেন, রেস ধরলেন৷ উপরন্তু গীতা ধরলেন৷ আশা করলেন, এইসব করলে তিনি বাঁচবেন৷’’
মৈত্র বিস্মিত হয়ে শুধালেন, ‘‘কেন? তিনি কি বাঁচলেন না?’’
‘‘আহা, শোনই না সবটা!’’ সুর বলতে লাগলেন, ‘‘আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম আলাপ তখন তিনি কমিশনার পদে অফিসিয়েট করছেন৷ না বাঁচলে কি কেউ এতদূর উন্নতি করতে পারে? আমি যখন তাঁকে বলি যে জজের কাজ আমার ভালো লাগে না, অথচ কলেক্টর পদ হচ্ছে দিল্লীকা লাড্ডু —যা খেয়ে আমি পসতাচ্ছি, তখন তিনিই আমাকে উপদেশ দেন, নিমিত্তমাত্রো ভব সব্যসাচী৷ কিন্তু তাঁর নিজের জবানীতে তাঁর জজিয়তীর গল্প শুনে আমার মনে ভয় ঢুকল যে আমিও হয়তো তাঁরই মতো কোন নিরপরাধীকে ফাঁসী দিয়ে আজীবন পসতাব৷ তাই ফাঁসীর মামলা আমার কোর্টে এলেই আমি গীতা খুলে বসি৷ কিন্তু তাতে কোনো শান্তি বা সান্ত্বনা পাইনে৷ ঈশ্বর বলে কেউ আছেন কিনা তর্কের বিষয়৷ তাঁর হাতের অস্ত্র বলে নিজেকে ঘুম পাড়াতে পারিনে৷ জজকে সমস্তক্ষণ হুঁশিয়ার থাকতে হয়, পাছে কোনো নির্দোষের সাজা হয়৷ প্রাণদণ্ড দূরের কথা, কারাদণ্ডই বা কেন হবে? বিচারটা যতদিন চলে ততদিন আমার সোয়াস্তি নেই৷ যেন বিচারটা আসামীর নয়, আমার নিজের! বিচার শেষ হলে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি৷ কিন্তু মনে একটা সংশয় থেকে যায়৷ কে জানে প্রকৃত সত্য কী? পাইলেট যা জিজ্ঞাসা করেছিলেন যীশুর বিচারের সময়৷ পাইলেটের মতো আমি অজ্ঞেয়বাদী৷ কই, সাক্ষাৎ ভগবানের পুত্রকে দেখেও তিনি তো ভগবদবিশ্বাসী হননি! আসলে কী হয়েছিল তা আমার জানবার উপায় নেই৷ আমি অসহায়৷ তাই যদি না জানতে পেলুম তো কেবল দণ্ডমুণ্ডের নিমিত্ত হয়ে আমার কী লাভ?’’
‘‘তোমার লাভ না হোক, সমাজের লাভ!’’ মৈত্র সে বিষয়ে সুনিশ্চিত৷
‘‘হাঁ, একদিক থেকে সেটা ঠিক৷ বিচারের একটা ঠাট বজায় না রাখলে লোকে আইনকে নিজেদের হাতে নেবে৷ প্রত্যেকেই হবে এক একজন দণ্ডদাতা ও জল্লাদ৷ কিন্তু আমি চাই নিশ্চিতি৷ শতকরা একশ’ ভাগ নিশ্চিতি৷ যাকে সাজা দিলুম সে যে আরেকজন গোপাল নয় এই নিশ্চিতি৷ অবশ্য গোপালের মতো আমি আর একজনকেও দেখিনি যে আপীল করবে না, মার্সি পিটিশন দেবে না, কেয়ামতের উপর বিচারের ভার ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্বেগে মরবে৷ তোমাকে বলতে ভুলে গেছি যে জেলা থেকে বিদায় নেবার আগে নিয়োগী আরো একবার জেলখানায় গিয়ে গোপালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন৷ এবার তাকে কাতর কণ্ঠে বলেছিলেন, গোপাল, আমাকে তুমি ক্ষমা কর৷ আমিও সামান্য একজন ভ্রান্তিশীল মানুষ৷ ভুলচুক তো মানুষমাত্রেরই হয়৷ গোপাল বলে, ধর্মাবতার, আপনার কী দোষ যে ক্ষমা করব? রাখে আল্লা মারে কে? মারে আল্লা রাখে কে? খোদা আপনাকে দোয়া করুন৷ আপনি লাটসাহেব হোন!’’
‘‘ছেলেটা সত্যি বড় ভালো বলতে হবে৷’’ স্বীকার করলেন মৈত্র৷
‘‘কোয়াইট রাইট৷’’ সুর অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘‘কিন্তু কী ট্র্যাজিক! কেন এ রকম হয়? মানুষ কী করতে এ জগতে আসে? কী করে? কেন শাস্তি পায়? সে শাস্তি কি ইহজন্মের কর্মফল? না পরজন্মের জের? না পরবর্তী জন্মের প্রস্তুতি? যারা পরজন্ম বা পরকাল মানে না, তাদের তুমি বুঝ দিচ্ছ কী বলে?’’
তিন
মৈত্র মৌন হয়ে বসে রইলেন৷ তখন সুর বললেন, ‘‘আজ খুব ভালো মিউজিক আছে হে! বি বি সি ধরব?’’
মৈত্র হাত নেড়ে বললেন, ‘‘না, থাক৷’’
থমথমে পরিস্থিতি৷ কিছুক্ষণ পরে মৈত্র নীরবতা ভঙ্গ করলেন, বললেন, ‘‘সুর, তুমি এইবার একটা বিয়ে কর৷’’
‘‘কেন বল দেখি? তোমাকে কেউ ঘটকালি করতে বলেছে?’’
‘‘না হে, তোমার ভালোর জন্যেই বলছি৷ চুল পেকে শন হয়েছে বটে, কিন্তু শরীর শক্ত আছে৷ এ বয়সে কত লোক বিয়ে করছে—করে সুখী হচ্ছে৷’’
‘‘হা হা! তোমাকে বলিনি, মিসেস নিয়োগী আমাকে কী বলেছিলেন?’’
মৈত্র থতমত খেয়ে শুধালেন, ‘‘কী বলেছিলেন?’’
‘‘বলেছিলেন, অভিলাষ, আমাকে দিদি বলে যখন ডেকেছ তখন সেই সুবাদে একটা কথা বলি—বিয়ে কোরো না, বৌটা বাঁচবে৷’’
‘‘অ্যাঁ, তাই নাকি?’’
‘‘শুধু এই নয়, পরে একদিন তিনি সোজা আমার বাংলোয় এসে হাজির৷ বললেন, অভিলাষ, তোমার কাছে লীগ্যাল অ্যাডভাইস চাইতে এসেছি৷ উকিলবাড়ি যেতে লজ্জা করে—তাছাড়া তুমি আমার ভাই, ভাইয়ের কাছে লজ্জা কিসের? তোমার আপন দিদিকে তুমি এ অবস্থায় যা করতে বলতে, আমাকেও তাই করতে বলবে আশা করি৷’’
‘‘কী ব্যাপার!’’ মৈত্র চঞ্চল হয়ে উঠলেন৷
‘‘গুরুতর৷ মিসেস নিয়োগী বললেন, অভিলাষ, ওঁর পরিবর্তনের জন্যে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি৷ এতদিনে বুঝতে পেরেছি, আমি ফেল৷ মদ আর রেস হলেও ক্ষমা করা যায়, কিন্তু নিজের দেশকে উনি ইংরেজের পায়ে বিকিয়ে দিচ্ছেন৷ ওঁর সরকারী নথিপত্র আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েছি৷ ওঁর প্রশ্রয় পেয়ে অধীনস্থরা অবাধে দমন-নীতি চালিয়ে যাচ্ছে৷ আমি বললে উনি রাগ করেন৷ আমি জানতে চাই, ডিভোর্সের এটা একটা গ্রাউন্ড হতে পারে কিনা?’’
মৈত্র চমকে উঠলেন৷ বললেন, ‘‘না না, এ হতেই পারে না৷ এ অসম্ভব৷’’
‘‘আমিও তাঁকে সেই কথাই বোঝাই, বরং একটু ভয় দেখিয়ে দিই৷ স্বামীর সরকারী নথিপত্র লুকিয়ে লুকিয়ে পড়াও একটা গ্রাউন্ড হতে পারে৷’’ সুর মুচকি হাসলেন৷
মৈত্রর মুখ শুকিয়ে গেল, ‘‘কা-কাজটা খু-খুবই খারাপ! কি-কিন্তু তা বলে ডি-ডিভোর্স হতে পারে নাকি? না, তুমি আমায় লেগ পুল করছ! তুমি জানো, আমি ডিভোর্সের শত্রু!’’
সুর বললেন, ‘‘আমার উদ্দেশ্য ধরতে পারোনি, মৈত্র৷ আমি চাইনি যে আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন পরামর্শদাতার জীবন আরো দুরূহ হয়৷ ডিভোর্সের আমি লেশমাত্র প্রশ্রয় দিইনি৷ তোমার সমাজ আমার হাতে নিরাপদ৷’’
‘‘আমি হলে কী করতুম বলি৷’’ মৈত্র কথার সূত্র নিজের হাতে নিলেন, ‘‘আমি ভদ্রমহিলার মনোবিশ্লেষণ করতুম৷ কেন তিনি তাঁর স্বামীর উপর এতদূর বিরক্ত যে পরের কাছে যান বিবাহবিচ্ছেদের পরামর্শ চাইতে? এর মূলে কী আছে? দেশঘটিত পরস্পরবিরোধী চিন্তা, না অন্য কিছু ঘটিত সন্দেহ?’’
‘‘ঐ যাঃ, পণ্ডিতী আরম্ভ হলো!’’ সুর হেসে উঠলেন, ‘‘একজন বিপন্ন হয়ে এসেছেন মুক্তির উপায় খুঁজতে, আমি বসে মনোবিশ্লেষণ করব পাণ্ডিতিক সত্য নির্ণয় করতে! আমি যদি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতে যেতুম, তাহলে হয়তো কত কী জট আবিষ্কার করতুম৷ ওই যেমন একটু আগে বলেছিলে ঈডিপাস কমপ্লেক্স, তেমনি তোমাদের ফর্দে আর কী কী কমপ্লেক্স আছে জানিনে৷ হয়তো জুপিটার কমপ্লেক্স৷’’
দু’জনেই হাসতে লাগলেন৷ হাসি থামলে সুর বললেন, ‘‘তা ছাড়া সত্য বলতে আমি যা বুঝি তা অন্য জিনিস৷ গোপালের হয়তো ঈডিপাস কমপ্লেক্স ছিল—যদি যে আদৌ খুন করে থাকে৷ কিন্তু আমি যদি তার বিচারক হতুম, আমি তোমার মতো মনোবিশ্লেষণ করতুম না৷ আমার সত্যনির্ণয়ের পদ্ধতি নয় ওটা৷ আমার জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, সিচুয়েশনটা কী? সিচুয়েশনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা কী? এক একটা সিচুয়েশন এমন যে তার পরিণতি ট্র্যাজিক না হয়ে পারে না৷ তার থেকে উদ্ধারের অপর কোনো পন্থা নেই৷ মানুষ অনেক সময় খুন করে ফাঁসী যায়, উদ্ধারের আর কোনো পন্থা খুঁজে না পেয়ে৷ সিচুয়েশনটা কী তা তো জজকে বিশ্বাস করে কেউ বলবে না, বলতে জানেও না৷ তাদের চোখে আমি কালান্তক যম৷ আসলে আমি মানুষের বন্ধু৷ যাকে ফাঁসী দিই তাকে মনে মনে বুকে জড়িয়ে ধরি৷ ওর চেয়ে ভয়ঙ্কর দণ্ড তো নেই, তবু ওই দণ্ড আমি প্রেমের সঙ্গে উচ্চারণ করি৷ আমার চোখে সব খুনীই গোপাল৷ কেয়ামতের দিন তার প্রকৃত বিচার হবে৷ এ যা হল তা সমাজের প্রয়োজনে—সমাজবিহিত পদ্ধতিতে৷’’
মৈত্র আবেগে আপ্লুত হয়ে সুরের হাতে চাপ দিলেন৷ কিছুক্ষণ দু’জনে চুপচাপ৷ তারপর চটকা ভাঙল, মৈত্র শুধালেন, ‘‘শেষ পর্যন্ত হলোটা কী? ডিভোর্স না সেপারেশন?’’
‘‘কোনটাই না৷’’ সুর একটু থেমে বললেন, ‘‘আরো বছরসাতেক তাঁরা এক সঙ্গেই কাটালেন৷ তার পরে’’—সুরের সুর বিকৃত হয়ে এলো৷
‘‘বল, বল—বলেই ফ্যাল!’’ মৈত্রর কৌতূহল উদগ্র৷
‘‘ভদ্রলোক একদিন মাঝরাত্রে রাস্তার ধারে নর্দমায় পড়ে মারা যান৷ শুনেছি মদের নেশায়৷’’ বলতে বলতে কণ্ঠরোধ হলো সুরের৷
‘‘আহা, মারা যান!’’ মৈত্র অভিভূত হলেন৷ মনে হলো তন্দ্রায় অভিভূত৷
বন্ধুকে এক ধাক্কা দিয়ে সুর বললেন, ‘‘তাহলে দেখতে পাচ্ছ, বিবাহ সর্বরোগহর নয়? নারীও পুরুষকে রক্ষা করতে পারে না—গীতাও না৷ আমি চিন্তা করে এর একটিমাত্র সমাধান পেয়েছি—এ রকম বিপজ্জনক কাজ না করা৷ এর চেয়ে কয়লার খনিতে নানা কম বিপজ্জনক৷ কিন্তু আমি যদি কয়লার খাদে নামি, আমার হাত ধরতে কোনো ভদ্রলোকের মেয়ে রাজী হবেন না৷ অমন একটি হাতি পুষতে আমিই বা কেমন করে পারব! তোমার ভদ্রারা আমাকে খনিতে নামতে দেবেন না৷ কিন্তু তার চেয়েও যা বিপজ্জনক, সেই জজ কলেকটরের কাজে নামতে দিয়ে পরে মই কেড়ে নেবেন৷ জজ হয়ে আমি হয়তো দশটা অপরাধীর সঙ্গে একটা নিরপরাধীকেও জেলে পাঠাব বা ফাঁসীতে ঝোলাব৷ কলেকটর হয়ে আমি হয়তো দুরন্ত জনতার উপর গুলী চালানোর হুকুম দেব৷ মরবে কয়েকটা পাজী লোকের সঙ্গে এক-আধটি নিরীহ ছেলে কি মেয়ে৷ অমনি আমার সহধর্মিণী বাম হবেন৷ কী করে তাঁকে বোঝাব যে আমি মানুষটা খারাপ নই, আমার পেশাটাই খারাপ! পারলে আমি ইস্তফা দিয়ে সরে যেতুম৷ তার পরে যদি ফকিরের সঙ্গে ফকিরণী হয়ে গাছতলায় বাস করতে কেউ রাজী হতেন, তাহলে বিয়ে করা যেত৷’’
চার
মৈত্র তন্ময় হয়ে শুনছিলেন৷ ওদিকে ফায়ার প্লেসের আগুন নিবু-নিবু করছিল৷ সুর তার উপর আরো কয়লা চাপিয়ে তাকে তেজী করে তুললেন৷ ও যেন তাঁর নিজের জীবনের প্রতীক৷
‘‘এখন তোমার কথাই শোনা যাক৷ যদি তোমার কোনো কাজে লাগতে পারি৷’’ বললেন মৈত্র তাঁকে আবার স্থির হয়ে বসতে দেখে৷
‘‘থ্যাঙ্ক ইউ, মাই ফ্রেন্ড৷ কিন্তু আমি ছাড়া আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না৷ গীতার সব কথা না হোক, একটি বচন আমি মানি৷ উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ৷’’
এর পরে দু’জনেই অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ৷ কখন এক সময় সুর আপন মনে বলতে আরম্ভ করলেন তাঁর আত্মকাহিনী৷ মৈত্র শুনতে লাগলেন বিনা কণ্ঠক্ষেপে৷
‘‘লন্ডনে যখন তোমার সঙ্গে পড়তুম তখন কি সংসারের খবর কিছু জানতুম! তখন আমার একমাত্র ধ্যান ছিল ভালো পাশ করে ভালো চাকরি নিয়ে দেশে ফিরতে হবে৷ বুড়ো বাপকে রেহাই দিতে হবে৷ আমার জন্যে কি তিনি শেষে ফতুর হবেন? তখন অত খতিয়ে দেখিনি কোন চাকরিতে মনের শান্তি, কোনটাতে অবসাদ৷ আই সি এস হয়ে যেদিন বাবাকে পুত্রদায় থেকে অব্যাহতি দিই সেদিন এই ভেবে আমার আনন্দ হয়েছিল যে, এখন থেকে আমি স্বাধীন৷ যথাকালে দেশে ফিরে চাকরিতে যোগ দিই৷ ভালোই লাগে৷ একমাত্র কাঁটা রাজনৈতিক মনোমালিন্য৷ ওদের পলিসি আমি ক্যারি আউট করতে কুণ্ঠিত দেখে ওরাই আমাকে জজ করে দেয়৷ আমি তার ফলে আরো স্বাধীন৷
‘‘কিন্তু ক্রমেই আমার প্রতীতি হতে থাকে যে আমি আমার মনের স্বাস্থ্য হারিয়ে ফেলছি৷ রাতদিন যাদের নিয়ে আমার কারবার তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা খুন কিংবা ডাকাতি কিংবা নারীধর্ষণ করেছে৷ সমাজের সবচেয়ে পঙ্কিল স্তরের জীব তারা৷ তাদের মামলা হাতে নিয়েছে যারা তারাও হাতে পায়ে সারা গায়ে পাঁক মেখেছে৷ এক এক সময় মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেখেছি৷ কোনটা ক্রিমিনালের আর কোনটা পুলিসের তা নিয়ে ধাঁধায় পড়েছি৷ জেলখানায় গিয়ে দেখেছি জেল ওয়ার্ডদের মুখও জেল কয়েদীর মতো৷ উকিলের মুখ দেখেও ধোঁকা লেগেছে৷ পোশাক ভিন্ন৷ মুখ অভিন্ন৷ ক্রাইম যাকেই ছোঁয় তাকেই ক্রিমিনালের চেহারা দেয়৷ এই সর্বব্যাপী পাঁকের মধ্যে আমি কেমন করে পাঁকাল মাছ হব? আমার নিজের চেহারা দেখি আয়নায়—ভয় পেয়ে যাই৷
‘‘একদিন বোর্ড অফ রেভিনিউর মেম্বার ও’নীল এলেন আমার স্টেশনে৷ এককালে আমার ওপরওয়ালা ছিলেন৷ আবার দেখা হলো৷ কথায় কথায় বললেন, ‘সুর, জজিং তোমার ভালো লাগে? আমার ধারণা ছিল, তোমার অভিরুচি শাসনে৷ উত্তর দিলুম, আপনার অনুমান ঠিক, কিন্তু ফিরে যেতেও আমি চাইনে৷ ও’নীল চলে গেলেন৷ কিন্তু কথাটা আমার মন থেকে গেল না৷ শাসনবিভাগ থেকে সরে আসার পরও আমি তার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকতে কম চেষ্টা করিনি৷ ধাতটা আমার একজিকিউটিভ৷ কিন্তু চার বছরে একটা ছেদ পড়ে গেছল৷ ফিরে গেলে আমি জোড় মেলাতে পারতুম না৷ রাজনৈতিক মনোমালিন্য তো চরমে উঠেছিল৷ কেবল ইংরেজে বাঙালীতে নয়, হিন্দুতে মুসলমানে৷
‘‘তবু ক্রিমিনালদের সঙ্গে ক্রিমিনাল বনে যাবার চেয়ে ওই অশান্তির মধ্যে ফিরে যাওয়াও ভালো৷ চীফ সেক্রেটারীকে চিঠি লিখলুম একদিন৷ আমাকে কি চিরকাল জজিং করতে হবে? আমার রুচির বিরুদ্ধে? তিনিও আমার পুরোনো অতিথি৷ সহানুভূতির সঙ্গে উত্তর দিলেন, তোমার সম্বন্ধে কাগজপত্র আনিয়ে দেখলুম৷ আগে থেকেই ঠিক হয়ে রয়েছে যে তোমার স্থান জুডিসিয়ালে৷ তোমার নিজের পছন্দ হোক আর নাই হোক, এই হচ্ছে তোমার বরাদ্দ৷ ভালো জজেরও তো দরকার৷ আশা করি তুমি এটা স্বীকার করবে যে, ব্যক্তিগত অভিরুচির চেয়ে পাবলিক ইন্টারেস্ট বড়৷ তোমার সাফল্য কামনা করি৷
‘‘মনটাকে মানাতে আমার কতকাল যে লেগে গেল৷ কেমন করে যে পারলুম! একবার ভেবে দেখ, মড়ার মাথার খুলি পর্যন্ত কোনো কোনো কেসে আলামৎ হয়৷ শুক্র আর শোণিত মাখা কাপড় জামা তো আকসার৷ আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে হয় সেসব৷ নাড়াচাড়া করে পুলিসের লোক৷ ডাক্তার এসে বলে যান মৃতদেহের অঙ্গে কী কী জখম ছিল৷ ব্যবচ্ছেদের পর কোন কোন অর্গানে কী কী লক্ষণ দেখা গেল৷ কী কী বস্তু পাওয়া গেল৷ আমাকেই স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করতে হয়৷ বীভৎস সব খুঁটিনাটি৷ তার চেয়েও বীভৎস বলাৎকারের মামলায় স্ত্রী অঙ্গের রিপোর্ট! ডাক্তারের মুখে তবু সহ্য হয়৷ নারীর মুখে পাশবিক অত্যাচারের আদ্যোপান্ত বিবরণ! উকিলরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বার করে ৩৭৬ ধারার অত্যাবশ্যক উপাদান আছে কিনা৷ অন্তর্ভেদ ঘটেছে কিনা৷ আমার ইচ্ছা করে উকিলদের ধরে চাবকাতে৷ সতী মেয়েকেও তারা প্রতিপন্ন করতে চায় অসতী৷ যেন অসতী হলে তার অনিচ্ছা থাকতে মানা৷ যেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যে কোন পশু ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে৷ এর পিছনে ক্রিয়া করছে আমাদের বৈষম্যময় সামাজিক মূল্যবোধ৷ একবার যে অভাগিনীর পদলন হয়েছে, যে-কোনো দিন যে-কেউ তার উপর আক্রমণ করলেও সেটা হবে সম্মতিসূচক৷ পুরুষ কিন্তু হাজার পদলন সত্বেও আইনের দ্বারা সুরক্ষিত৷
‘‘এখন ওই সব হতভাগিনী মেয়েদের এই বৈষম্যময় সমাজে আমি ভিন্ন আর কে রক্ষক আছে? এই বাইশ লক্ষ লোকের মাঝে? শুধু ওদের নয়, যারা একবার চুরি করে দাগী হয়েছে কেউ কি তাদের বিশ্বাস করে স্বাভাবিক কাজকর্ম দেয়? অগত্যা আবার চুরি করতে হয় তাদের৷ দ্বিতীয়বার চুরি করলেই ডবল সাজা৷ অনেক সময় দেখা যায়, দ্বিতীয় অপরাধটা প্রথম অপরাধের তুলনায় লঘু৷ তবু আমাদের হাকিমরা চোখ বুজে প্রথম দণ্ডটাকে দ্বিগুণিত করে দেন৷ আপীলে আমি দণ্ড হ্রাস করি৷ বলি, লোকটার পাওনা যদি হয় ছ মাস, হাকিম তার পূর্ব অপরাধের কথা স্মরণ করে এক বছর দিতে পারেন—কিন্তু পূর্ব অপরাধের জন্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় ভিন্ন হাকিমের হাতে সে হয়তো পেয়েছিল দশ মাস, সেটাকে কলের মত নির্বিচারে দ্বিগুণিত করে বিশ মাস করলে বর্তমান অপরাধের সঙ্গে সামঞ্জস্য হয় না৷ হাকিমেরা করবেন কী! কোর্ট সাবইন্সপেক্টর তাঁদের তাই বুঝিয়েছেন৷ আমি যখনই সুযোগ পাই, সাজা কমিয়ে দিই আর পুলিসের অভিশাপ কুড়োই৷ একটা প্রতিষ্ঠানও খাড়া করি, কয়েদীদের জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বাভাবিক কাজকর্ম জোটানোর আশায়৷ দেখি কেউ ওদের কাজ দেবে না৷ দিলে পুলিস পিছনে লাগবে৷ তাছাড়া দাগী চোরকে বিশ্বাস কী! কোন দিন আবার চুরি করে পালাবে! তখন পুলিসে খবর দিলে পুলিস বলবে, কেমন? সাবধান করেছিলুম কিনা? সাহস করে আমিই মালী রাখি৷ কোন দিন আমাকে বোকা বানাবে! পুলিস সাহেব বলবেন, রাইটলি সার্ভড! আরে কুকুরের ল্যাজ কখনো সিধে হয়!
‘‘সমাজে ভালো জজেরও দরকার আছে৷ কিন্তু এই বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়৷ চাই আরো একটা বিশ্বাস৷ সেটা না থাকলে আমার মতো লোকের পক্ষে বেঁচে থাকাই এক যন্ত্রণা৷ জগতে যা কিছু কুৎসিত, যা কিছু মিথ্যা, যা কিছু কু তাই নিয়ে আমার কারবার৷ জগৎ সম্বন্ধে আমার ধারণা কি তা হলে এই যে, জগতে সুন্দর নেই, সত্য নেই, সৎ নেই? আমার এই নরকবাস থেকে অনুমান করা শক্ত যে, স্বর্গ বলে কিছু থাকতে পারে বা ঈশ্বর বলে কেউ থাকতে পারেন৷ মানুষ আছে তা তো প্রত্যক্ষ সত্য৷ কিন্তু মানুষের চেহারা দেখে কি বিশ্বাস হয় যে, ভগবান তাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর আপনার আদলে? তাঁর উপর পিতৃত্ব আরোপ করবার মতো কী এমন প্রমাণ আছে?
‘‘অল্পবয়স থেকেই আমি সৌন্দর্যদেবীর অন্বেষক৷ বিউটি আমার কাছে কথার কথা নয়৷ ওকে আমি প্রথম যৌবনে সর্বঘটে দেখতে চাইতুম৷ আভাসও পেতুম ওর আঁচলের৷ ওর অলকের৷ কিন্তু এই নরকপুরীতে কোথায় ওর হাতছানি? কোথায় ওর চাউনি? আমার জজিয়তীর জীবনে প্রায়ই হা-হুতাশ করেছি৷ হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতে গেছি৷ দশ বছর পরে এই সম্প্রতি আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলেছে৷ এত দিনে আমার প্রত্যয় হয়েছে৷ ও আছে৷
‘‘ও আছে৷ ওর পথ গেছে এই ক্লেদের ভিতর দিয়ে৷ এই আঁস্তাকুড়ের উপর দিয়ে৷ এইসব মাজা-ভাঙা পুরুষদের, এইসব পড়ে-যাওয়া নারীর দ্বারা আচ্ছন্ন গিরিসঙ্কট দিয়ে৷ ওর পথ হচ্ছে এই পথ৷ এই পথে আমি ওর পথেরই পথিক হয়েছি৷ ওরই দর্শন পাব বলে৷ ও আমার আগে আগে চলেছে৷ উড়ে চলেছে মাটি না ছুঁয়ে ক্লেদ না ছুঁয়ে অন্তরীক্ষে৷ ও যেন সূর্যকন্যা তপতী৷ আর আমি ওকে ধরবার জন্যে মাটিতে পা ফেলে জলকাদায় নেমে ডাঙায় পা তুলে উঠে চলেছি ভূতলে৷ আমি যেন রাজা সংবরণ৷ দৃষ্টি আমার ঊর্ধ্বমুখীন৷ ওর আর আমার উভয়েরই পথ এই ভীষণ কুৎসিত অশুভ অমাবস্যার ছায়াপথ৷
‘‘ও যেন আমার চোখে ধুলো ছুঁড়ে মারে, যাতে আমি ওকে দেখতে না পাই, চিনতে না পারি৷ কিংবা ধুলো আপনি ওড়ে ওর গতিবেগের হাওয়ায়৷ আমি অন্ধকার দেখি৷ সেই অন্ধকারের নাম নিষ্ঠুর বাস্তব৷ যে বাস্তব আমাকে নিত্য অভিভূত করে নিত্য নূতন অপরাধে৷ এই তো সেদিন আমার কোর্টে এলো এক তরুণী জননী৷ নিজের হাতে নিজের শিশুর গলা টিপে মেরেছে৷ তার আগে এসেছিল এক বন্ধু৷ বন্ধুকে ভুলিয়ে নিয়ে যায় এক পোড়োবাড়ীতে৷ সেখানে তার নিদ্রিত অবস্থায় তাকে বলি দেয়৷ মুণ্ডুটা পুঁতে রাখে নদীর বালিতে৷ এবার যে এসেছে তার কথা বলব না৷ কেসটা সাব জুডিস৷ কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবেরই অভিনব প্রকাশ৷ স্তব্ধ হয়ে ভাবি এই তমসার অপর পারে কি ও আছে? ডাকলে কি ওর সাড়া পাব? চোখ মেলে আমি ওর দেখা পাইনে৷ তবু চোখ আমার ওর উপরেই৷ এর উপরে নয়৷
‘‘না৷ তোমার এই নিষ্ঠুর বাস্তব আমার দৃষ্টি হরণ করে না৷ দৃষ্টিকে পীড়া দেয় যদিও৷ আমার দৃষ্টি একে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করে৷ আমার মন একে ছাড়িয়ে যায়৷ আমার পা একে মাড়িয়ে যায়৷ এর সম্বন্ধে আমার মোহ নেই৷ আমি একে ভালোবাসিনে৷ একে ভালো বলিনে৷ শুধু একে মেনে নিই৷ একদা আমার পণ ছিল বিনা পরীক্ষায় কিছুই মেনে নেব না৷ না ঈশ্বর, না পরকাল, না পুনর্জন্ম৷ এখনো গীতার মূল তত্ব মেনে নিতে পারিনি৷ কিন্তু অর্জুনের মতো আমিও সভয়ে উচ্চারণ করি, দংষ্ট্রাকরালানি চ তে মুখানি দৃষ্টৈব কালানলসন্নিভানি দিশো ন জানে না লভে চ শর্ম৷ বাকীটুকু বাদ দিই৷
‘‘নিষ্ঠুর বাস্তব, তোমাকে আমি মানি৷ কিন্তু তুমিই শেষ কথা নও৷ তোমাকে আমার চোখের উপর ছুঁড়ে মেরেছে যে, আমার দৃষ্টি তারই প্রতি নিবদ্ধ৷ সে করালদশনা নয়৷ তার মুখ কালানলসন্নিভ নয়৷ ‘সে’ বললে কেমন পর-পর ঠেকে৷ তাই ‘সে’ না বলে আমি বলি ‘ও’৷ ও আমার একান্তই আপন৷ আমি ওর৷ ওর সঙ্গে আমার নিত্য সম্পর্ক৷ এমন দিন যায় না যেদিন আমি ওর উড়ে চলার ধ্বনি শুনতে না পাই৷ আদালতের চাপা কোলাহলকে ছাপিয়ে ওঠে ওর পলায়নধ্বনি৷ আমি এজলাস ছেড়ে উঠে যেতে পারিনে৷ আমার আসনের সঙ্গে আমি গাঁথা৷ আমার দুই কানই সাক্ষীর বা আসামীর দিকে৷ পাবলিক প্রোসিকিউটার বা আসামীর উকিলের দিকে৷ তবু কেমন করে কানে এসে বাজে অন্তরালবর্তিনীর নূপুর-শিঞ্জন৷ আছে, আছে৷ আরো একজন আছে৷ যে এদের সকলের প্রতিবাদরূপিণী৷ যে এদের কারো চেয়ে কম বাস্তব নয়, কম প্রমূর্ত নয়৷ যাকে ধরতে জানলে ধরা যায়৷ ছুঁতে জানলে ছোঁয়া যায়৷
‘‘নিয়োগীর উনি তাঁকে নর্দমার পাঁক থেকে বাঁচাতে পারেননি৷ আমার ও আমাকে কর্দম থেকে বাঁচিয়েছে৷ আমি যে বেঁচে আছি এটা ওরই কল্যাণে৷ বিয়ের বৌ যা পারে না ও তা পারে৷ কেন তাহলে আমি বিয়ের কথা ভাবতে চাইব! তোমরা এমন কী জিতেছ! আমি এমন কী হেরেছি! আমার শুভ্র কেশ আমার শ্বেত পতাকা নয়৷ আমি পরাজয় স্বীকার করিনি৷ নিষ্ঠুর বাস্তবের সঙ্গে আমার নিত্য সংঘর্ষ৷ তা সত্বেও আমি অপরাজিত৷ আপন ভুজবলে নয়৷ ওর রক্ষাকবচ ধারণ করে৷ পুরুষ চায় রণে অপরাজেয়৷ যে নারী তাকে অপরাজিত থাকতে সহায়তা করে সেই তার এষা৷ এ যদি পার্থিব নারী না হয় তাতে কী আসে যায়!
‘‘মৈত্র, তুমি হয়ত ভাবছ আমি কী হতভাগ্য! আমাকে চালতার অম্বল রেঁধে খাওয়াবার কেউ নেই৷ বাবুর্চিটা সুক্তো পর্যন্ত রাঁধতে জানে না৷ পাটনার লাটভবনে লর্ড সিনহার মতো আমি হাজার সাহেব সাজলেও আমার রসনাটি তো বাঙালীর৷ আমিও এককালে নিজেকে হতভাগ্য মনে করেছি৷ কিসে এ দশা থেকে পরিত্রাণ পাই তার উপায় অন্বেষণ করেছি৷ বিবাহের মধ্যে পরিত্রাণের কূলকিনারা পাইনি৷ মানুষ তো কেবল রুটি খেয়ে বাঁচে না৷ তেমনি পুরুষ তো কেবল বৌ পেয়ে বাঁচে না৷ তাকে তার জীবনের দুই দিক মেলাতে হয়৷ সুন্দরের সঙ্গে কুৎসিতের৷ শ্রেয়ের সঙ্গে প্রেয়ের৷ আমার জীবনে আমি কোনমতেই দুই দিক মেলাতে পারিনি৷ তাই ঐশ্বর্যের মধ্যেও জ্বলেছি৷ অবশেষে একপ্রকার পরিত্রাণের পন্থা পেয়েছি৷ এখন আমার সে জ্বালা নেই৷ আমি শান্ত৷ আমার পরিত্রাণের পন্থা পলায়নে নয়, পলায়মানার পশ্চাদ্ধাবনে৷’’
পাঁচ
রাত হয়েছিল৷ তন্দ্রায় জড়িত কণ্ঠে মৈত্র বললেন, ‘‘সুর, তুমি আজ আমাকে কী এক আজব রূপকথা শোনালে! এমন বানাতেও পারো!’’
সুর একটু হাসলেন৷ বললেন, ‘‘তা কাহিনীটা লাগল কেমন?’’
‘‘স্রেফ ফাঁকি দিলে৷’’ মৈত্র বললেন হাই তুলতে তুলতে, ‘‘আমি আশা করেছিলুম তোমার জীবনের প্রচ্ছন্ন করুণ রোমান্স শুনতে পাব৷ তার কথা, যাকে তুমি বিয়ে করতে চেয়েছিলে, পাওনি বলে অবিবাহিত রয়েছ৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে আছে৷ এদেশে না হোক ওদেশে৷ ‘সে’ একদিন ‘ও’ হবে কিনা জানিনে, কিন্তু তোমার ‘ও’ যাকে বলেছ ও তার বিকল্প নয়৷ আচ্ছা, আজ তবে আসি৷’’
‘‘হবে না৷ হবে না৷ ‘সে’ তার স্থান ছেড়ে দিয়েছে৷ ‘ও’ আমার নয়ন জুড়েছে ও জুড়িয়েছে৷ আচ্ছা, শুনতে চাও তো শোনাব আরেক দিন৷’’ এই বলে সুর তাঁকে মোটরে তুলে দিতে চললেন৷ শোফারকে হুকুম দিলেন, ‘‘প্রিন্সিপ্যাল সাবকা কোঠি৷’’
বেয়ারা এসে তাঁর সান্ধ্য পোশাক খুলে নিল৷ পরিয়ে দিল শোবার পায়জামা৷ এখন রাত জেগে মামলার নথি পড়া৷
0 মন্তব্যসমূহ