Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

দ্রষ্টা | দেবর্ষি সারগী

গল্পটি শোনার জন্য ইউটিউবের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

 


গত দেড়শো বছর ধরে লোকালয়টায় কোনও ধর্মই পালন করা হয় না। এখানে কোনও দেবালয় নেই। মধ্যরাতে আরতির নিনাদ, প্রার্থনার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বা নানা ধর্মীয় কোলাহল এখানে শোনা যায় না। মানুষের তৈরি অধিকাংশ শব্দই তো ধর্মীয় উৎসব থেকে উদ্ভূত। সেটা এখানে অনুপস্থিত বলে লোকালয়টা অধিকাংশ সময়ই শান্ত থাকে। ফলে অন্যান্য দেশের লোকেরা এই লোকালয় সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ অনুভব করে না। অথচ এখানকার মানুষ অধার্মিকও নয়। কিংবা এমনও নয় যে, এখানে কোনও কালেই কোনও প্রজ্ঞাবান মানুষ বাস করেননি। বা নিজের প্রজ্ঞা দান করে মানুষকে আলোকিত করেননি। তা সত্ত্বেও এখানে শেষ পর্যন্ত ধর্ম ভূমিষ্ঠ হয়নি, প্রায় দেড় শতাব্দী আগে এক বার আন্তরিক, অসহায় চেষ্টা করা সত্ত্বেও।যাঁকে ঘিরে চেষ্টাটা হয়েছিল, তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। তাঁর নাম আমি অনেক চেষ্টা করে জানতে পেরেছি। কিন্তু কর্তব্য বোধের চাপে বা বলা যেতে পারে আধ্যাত্মিক অপরাধের ভয়ে আমি তাঁর নাম উল্লেখ করব না। বেছে নেব একটা মনগড়া নাম। ধরা যাক তাঁর নাম ছিল নিশামণি। লোকালয়টায় তিনি আসেন এক জন অচেনা মানুষ হিসেবে, প্রায় আটান্ন বছর বয়সে। মৃত্যুশয্যায় যখন শায়িত হন, তখন তাঁর বয়স একাশি। এখানে আমার আগে তিনি কোথায় থাকতেন, কী করতেন কেউ জানে না। আমিও জানি না। মূলত এ ব্যাপারেই কিছু তথ্য আবিষ্কার করতে আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কয়েক বার লোকালয়টায় গিয়ে কিছু বৃদ্ধের সঙ্গে কথাও বলেছি। তিনি যখন মারা যান, তখন এই বৃদ্ধদের কেউই অবশ্য জন্মায়নি। তবু আমার মনে হল নিজেদের বাপ-ঠাকুরদার কাছ থেকে নিশামণির অতীত সম্পর্কে যদি কিছু শুনে থাকে। কিন্তু ওরা কিছু বলতে পারেনি। শুধু তাই নয়, ওরা নিশামণির আসল নামটাও আমাকে বলতে চায়নি, যদিও ওটা জানতাম বলে আমিও জানতে চাইনি। তবে লোকালয়ের যে লোকটার একটা ঘটনার জন্য নিশামণির জীবনের শেষ অধ্যায় আরও আলোকিত হয়ে ওঠে তার সম্পর্কে আমি নির্ভুল জেনেছি। তার নাম গঙ্গেশ। তার বংশধররাই আমাকে কিছু কিছু কথা বলে। সে নিশামণির একনিষ্ঠ অনুগামীদের এক জন ছিল। এই লেখাটার শেষের দিকে আমি ওই ঘটনাটা সম্পর্কেই দু’চার কথা বলব।
 
এটা সত্যি যে নিশামণিকে ওই অঞ্চলের লোকেরা এক জন ধর্মীয় নেতার মর্যাদা দিতে চেয়েছিল। ওদের আসল ইচ্ছে অবশ্য ছিল তাঁকে অবতার হিসেবে ঘোষণা করা। কিন্তু এ সবে বাধ সাধতেন স্বয়ং নিশামণিই, কারণ তাঁর মতে কোনও মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকে নির্ভুল ভাবে বোঝাই সম্ভব নয়, তা নিজে ঈশ্বর রূপে জন্মগ্রহণ করা তো দূরের কথা, ঈশ্বরের মুখ কেউ কখনও দেখেনি, কারণ কাউকেই তিনি তাঁর মুখ দেখাননি। মহত্তম উপাসকও শেষ বিচারে যা লাভ করেন, সেটা তাঁর একটা আভাস মাত্র। ওটা এতই আকস্মিক ও সংক্ষিপ্ত যে, মনে হবে গভীর স্বপ্নে যেন দ্রুত বয়ে যাওয়া বাতাসে কোনও স্ফুলিঙ্গ দেখলাম। স্বপ্ন ভাঙার পর ওটার স্মৃতিও অনেক সময় মিলিয়ে যায়। ঈশ্বরদ্রষ্টারা ওই স্ফুলিঙ্গটাই মাঝে মাঝে দেখে থাকেন। নিজের সম্পর্কে ঈশ্বর শুধু ওটুকুই আভাস দেন। কিন্তু নিশামণি বলতেন, ওই অস্পষ্ট, স্বপ্নদৃষ্ট, অপসৃয়মাণ স্ফুলিঙ্গের স্মৃতিটুকুই গোটা জীবনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ওটুকুই কারও কারও চেতনাকে অবিরাম পুড়িয়ে দিতে পারে। এর ফলে তার জীবন পাল্টে যায়, সে বিবশ হয়ে যায়, স্থবির হয়ে যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। জগতে আমাদের ক্ষণিক আসা ও চিরস্থায়ী বিদায়কে একটু বুঝবার জন্য, একটু উপলব্ধি করার জন্য, একটু অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্য ওই ক্ষীণ আভাসটুকুও মূল্যবান। নইলে অস্তিত্ব নামক আশ্চর্য ধাঁধা তো আমাদের উন্মাদ করে দিত।
 
লোকালয়ের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে আমি নিশামণির এ সব চিন্তাধারা সম্পর্কে সামান্য জানতে পারি। আর জানতে পারি, তিনি মনে করতেন আমাদের একমাত্র উপাসনা হওয়া উচিত মাঝে মাঝে, হয়তো জাগরণে, হয়তো স্বপ্নে শুধু ওই আভাসটুকু পাওয়ার চেষ্টা করা। অন্য সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান সময়ের অপচয়, মিথ্যা! অন্য সব মতবাদ মিথ্যা! অন্য সব প্রচেষ্টা মিথ্যা! অন্য সব দাবি মিথ্যা!
 
প্রচুর ডোবা, ঘন বাঁশঝাড়, ধু ধু মাঠ ও ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা পাকা ও খড়ের বাড়ি নিয়ে চুপ করে পড়ে থাকা দেড়শো বছর আগের বাংলার গ্রামটায় নিশামণি যে দিন গভীর রাতে আসেন, সে দিন আকাশে ভাদ্রের পূর্ণিমা। একটা ডোবার জলে তিনি দেখেন কয়েকটা ব্যাঙ মুখগুলো ওপরে তুলে হাঁ করে ভাসছে। ওদের পিঠে পিছলে যাচ্ছে চাঁদের আলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি ওদের দেখতে লাগলেন। চার পাশে স্তব্ধ রাত্রি ও শূন্য প্রান্তর। কোনও মানুষ তখনও তাঁর চোখে পড়েনি। প্রাণী বলতে শুধু ওই কয়েকটা ব্যাঙ, যারা চাঁদের গনগনে আলোয় নিঃশব্দে ভাসছে। ওদের নির্বোধ, আবিষ্ট চেতনা যেন জগতের রহস্য ও সৌন্দর্যে বিভ্রান্ত হয়ে ওই বিভ্রান্তিটুকুকেই উপভোগ করছে। ভেজা দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশামণির মনে হল সব জীবেরই তো একই দশা। চার পাশ বুঝতে চেয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা ভাল করে না বুঝতে পারার বিভ্রান্তিকেই শ্রান্ত ও প্রসন্ন মনে উপভোগ করি। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি ওই জলাশয় ও মাঠের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকলেন। তার পর সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামবাসীদের আপত্তি না থাকলে বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দেবেন। গ্রামবাসীরা তাঁকে আস্তে আস্তে গ্রহণ করে নিল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে নিজের মাটির ঘর থেকে একা বেরিয়ে চাঁদের আলোয় ব্যাঙদের জলে ভেসে থাকা দেখতে যেতেন। গ্রামটাকে বেছে নিতে ওরাই তো তাঁকে সাহায্য করেছিল। এই কথাটা তিনি হাসতে হাসতে প্রায়ই শোনাতেন গ্রামবাসীদের।
 
লোকালয়টাকে ভালবেসে ফেলেছিলেন নিশামণি। ভালবাসতেন এখানকার মানুষদেরও। শুনলাম এখানে একটা উঁচু তোরণ ছিল। ওটা তিনি খুব পছন্দ করতেন। ওটার ধ্বংসাবশেষ আমি দেখলাম। যেন ক্রমশ কোনও মেঘের মতো ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ওটার ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেখে। কিন্তু ওরা কখনওই ওটা সংরক্ষণের চেষ্টা করেনি, কারণ তাঁর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কোনও জিনিসকেই আলাদা গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করতে নিশামণি মানা করতেন। পোড়া ইটের তোরণটিতে প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্যের চিহ্ন। চূড়ায় চালাঘরের ছাঁচে তিনটে দেউল, পাল্কির মতো। দু’পাশে লম্বা দালান, যেখানে বসা যায়। একটু দূরে একটা বড় আমবাগান এবং সারি সারি নারকোল গাছ। ওই দালানে একা একা বসে থাকতে নিশামণি ভালবাসতেন। বিশেষ করে গোধূলি থেকে অন্ধকার রাত পর্যন্ত। অনেক সময় গ্রামবাসীরাও বসে থাকত তাঁর কাছে। এমনিই। তাঁর কাছে বসে থাকতে ভাল লাগত বলে। নিশামণি যে সব সময় কথা বলতেন তা নয়। দ্রষ্টারা সাধারণত লম্বা চুল ও দাড়ি রাখতে ভালবাসেন। নিশামণির ওই দুটোই ছিল না। মুণ্ডিতমস্তকও ছিলেন না। পোশাক ধুতি ও চাদর। গরমে খালি গা। দেখে তাঁকে সাধারণ মানুষ বলেই মনে হত। তিনিও নিজেকে আলাদা মানুষ বলে ভাবতেন না। বলতেন সব মানুষই একই জিনিস। যে কোনও এক জন মানুষই পৃথিবীর সব মানুষের প্রতিনিধি। দু’জন মানুষের মধ্যে শুধু একটা জায়গাতেই একটা সূক্ষ্ম তফাত থাকতে পারে। ওটা ওই স্ফুলিঙ্গের আভাসে, যা কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি। এক জন দ্রুত বয়ে যাওয়া বাতাসে একটা সংক্ষিপ্ত স্ফুলিঙ্গের উদ্ভাসন এক মুহূর্তের জন্য কখনও দেখেছে, অন্য জন দেখেনি। তিনি নাকি হাঁটতেন আস্তে আস্তে। তাড়াহুড়োর কোনও ভাবই তাঁর মধ্যে দেখা যেত না। বলতেন, জগতে তো কোথাও কোনও তাড়াহুড়ো নেই। নিজের কক্ষপথে ঘোরাটা পৃথিবী এক দিনের জন্যও চব্বিশ ঘণ্টার আগে শেষ করেনি। সময় জগতে যত দ্রুত বয়, মানুষের মনে বয় তার চেয়ে অনেক বেশি গতিতে। বলতেন, সুখী মানুষের কাছে সময় বয় আস্তে আস্তে। আর বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্যই তো সুখী হওয়া।
 
‘তিনি নিজে নিশ্চয়ই খুব সুখী ছিলেন?’ আমি হঠাৎ গ্রামবাসীদের জিজ্ঞেস করলাম।

‘পেটে কর্কট রোগে মারা যান,’ এক জন বলল।

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
 
‘শেষ দিনগুলোয় নিজের মলমূত্রের মধ্যে শুয়ে থাকতে হত। যারা পরিষ্কার করতে যেত তাদের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইতেন। আর বলতেন, আমরা যে শরীরের চেয়ে বড়, সেটা প্রমাণ করার জন্যই শরীরে এ রকম পচন ধরে, শরীর এ ভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে থাকে।’

‘আপনারাও কি সেটা বিশ্বাস করেন?’

‘এমন কিছুই নেই, যা তিনি বলেছেন আর আমরা অবিশ্বাস করি।’

‘সব মানুষই তাদের উপাস্যের বাণীকে অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে ভালবাসে’, আমি হেসে বললাম, কোনও রকম তর্কে প্রবেশ করব বলে নয়, আমার জ্ঞানবুদ্ধিতে যা জানি সেটা থেকে।

‘কিন্তু তিনি এমন কিছু বলতেনই না, যা অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করতে হবে। বস্তুত তিনি কিছুই করতে বলতেন না। শুনেছি, যারা তাঁর সান্নিধ্যে থাকত, তাদের মাঝে মাঝে ধন্দ হত। এ কথা ভেবে যে, এমন সাধারণ ও স্বাভাবিক মানুষের সান্নিধ্য তাদের এত ভাল লাগে কেন।’

‘আর স্ফুলিঙ্গের আভাসের কথা? ওটা সম্পর্কে সব সময় বলতেন না?’
 
‘না। ওটা নিয়ে কোনও তত্ত্ব তিনি তৈরি করেননি। শুধু বলতেন ওটার জন্য নীরবে অপেক্ষা করলেই হল। তা হলেই কখনও না কখনও ওটার আভাস পাওয়ার জাদুকরী মুহূর্তটা চলে আসতে পারে। কোনও তত্ত্বের দরকার নেই, কোনও আচার পালন করার দরকার নেই। যেমন তত্ত্ব ও আচার পালন করা ছাড়াই রোজ সূর্য ওঠে, ফুসফুস নিঃশ্বাস নেয়, বাঘের গায়ে ডোরার দাগ পড়ে, পাখির ছানার চোখ ফোটে, এক দিন মৃত্যু এসে আলিঙ্গন করে, বিরহে মন বিষাদাচ্ছন্ন হয় আর মিলনে আনন্দিত, তিনটে কোণ মিলিত হলে ত্রিভুজ রচিত হয় এবং বর্ষার অলস দুপুরে গ্রন্থপাঠে আশ্চর্য আনন্দ হয়। বলতেন, ঈশ্বর নিয়ে আমাদের সব তত্ত্বই মনগড়া। সব আচারই কাল্পনিক।’

‘আর অলৌকিক ঘটনা? ওটা ছাড়া তো কোনও মহত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত হয় না।’

এ প্রশ্নে গ্রামবাসীরা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। কারও কারও মুখে ফুটে ওঠে বিষণ্ণ, সরল হাসি।
 
‘অন্যের প্রতি এক ধরনের কাতর, নির্বাক মমতা অনুভব করা ছাড়া আর কোনও ক্ষমতাই তিনি কখনও দেখাতে পারেননি’, এক জন বলল। ‘গোড়ার দিকে গ্রামবাসীদের মনে হত তিনি হয়তো নানা অলৌকিক শক্তির সাহায্যে এখানকার মানুষদের উপকার করবেন। এটা নিয়ে ওরা তাঁকে অনুরোধ ও পীড়াপীড়িও করত। এতে তিনি অসহায়ের মতো চুপ করে থাকতেন। কখনও কখনও নাকি বলতেন এটা কি তোমরা লক্ষ করছ না যে, আমরা দৈনন্দিন খাদ্য ও প্রয়োজনের জন্য আমি তোমাদের ওপরেই নির্ভর করি? আমাকে কিছু কাজ জুটিয়ে দেওয়ার জন্য আমি তোমাদেরই অনুরোধ করি? বর্ষায় যখন জ্বরে পড়ি, তখন তোমাদের ডেকে আনা বৈদ্যের ওষুধেই রোগমুক্ত হই? প্রতিটি অলৌকিক ঘটনাই এই দুর্বোধ্য জীবনজগতের নিয়মকে আরও দুর্বোধ্য করে তুলত। তাতে কোন দিক দিয়ে আমাদের ভাল হত? আমরা কি আরও বিভ্রান্ত হতাম না?’
 
এ বার আমি নিশামণির জীবনের ওই ঘটনাটা উল্লেখ করতে চাই, যা খুব নাটকীয় না হলেও তাঁর জীবনের বৃত্তকে একটা নিখুঁত আকার দিয়েছিল। রোগগ্রস্ত হলেও তখনও তিনি মুমূর্ষু হয়ে পড়েননি। চেতনা জাগ্রত ছিল। হাঁটাচলাও করতে পারতেন। গ্রামবাসীরা দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে। সেবা করার জন্য ওদের মধ্যে চাপা প্রতিযোগিতা চলত। নিশামণি সংকুচিত হতেন। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন গ্রামবাসীদের দিকে। অকেজো শরীরটা থেকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে চাইতেন। এটা নিয়ে গ্রামবাসীরাও উদ্বিগ্ন থাকত। তিনি চলে গেলে গ্রামটায় যে অন্ধকার নেমে আসবে, সেটা ভেবে ওরা শঙ্কিত হত। ওদের ভয় হত নিশামণিকে এক দিন সবাই হয়তো পুরোপুরি ভুলে যাবে। কিন্তু এ নিয়ে ওদের কিছু করারও তো ছিল না।
 
এই উদ্বেগে গ্রামের যে লোকটা প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেই হল গঙ্গেশ। এটা ওর আসল নাম এবং ওর বংশধররা এখনও গ্রামে বাস করে। গঙ্গেশ লেখাপড়া করতে পারত এবং নিশামণির অনেক কথা গোপনে লিখে রাখত। ব্যাপারটা শুধু ওর স্ত্রীই জানত। ওর আকাঙ্ক্ষা ছিল নিশামণির জীবনী লিখবে এবং প্রকাশ করবে তাঁর মৃত্যুর পর। কিন্তু মুশকিল হল, আটান্ন বছর বয়সে এই গ্রামে আসার আগে পর্যন্ত নিশামণির জীবনে কী ঘটেছিল, সেটা কেউ জানে না। নিশামণিও কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু জীবনী লিখতে হলে তো তাঁর জীবনের ওই অংশটাও জানা দরকার, যা হয়তো অন্ধকারে পড়ে থাকা কোনও ধবধবে পাথরের মতো উজ্জ্বল। এ ব্যাপারে ওকে সাহায্য করতে পারেন শুধুমাত্র নিশামণি নিজেই। রাতে নিশামণির ঘরে ভিড় থাকে না। গঙ্গেশ তাই রাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করবে বলে ঠিক করল।
 
এক রাতে সে যখন তাঁর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হল বাইরে তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল। সমস্ত গ্রাম ভেজা গাছপালার মতোই স্তব্ধ। নিজের তক্তপোষে বসে নিশামণি জানলার বাইরে তাকিয়েছিলেন। কোণে জ্বলছিল একটা মৃদু লম্ফ।

গঙ্গেশকে দেখে নিশামণি খুশি হলেন।
 
সে লেখাপড়া করতে পারে বলে তিনি ওকে স্নেহ করেন।

গঙ্গেশ অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। ওর বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল। লম্ফ নিভে যাওয়ার ভয়ে নিশামণি জানলাটা বন্ধ করে দিলেন।

‘আমি যে কাজটা করতে চাই’, শেষ পর্যন্ত দ্বিধাজড়িত গলায় গঙ্গেশ বলল, ‘সেটা করতে শুধু আপনিই সাহায্য করতে পারেন বলে আপনার কাছে এসেছি।’

স্নেহ ও আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে নিশামণি তাকিয়ে থাকলেন গঙ্গেশের দিকে। লম্ফের আলোয় তাঁর মুখটা আশ্চর্য মমতাময় দেখাচ্ছিল।

‘আমি আপনার একটা জীবনী লিখছি। কিন্তু সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি ওটায় আপনার অতীত জীবন সম্পর্কে কিছু না থাকে। আপনার ওই জীবন সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না। আমার খুব ইচ্ছা আপনার মুখ থেকে ওটা সম্পর্কে কিছু শুনি।’
 
একই রকম দৃষ্টিতে গঙ্গেশের দিকে তাকিয়ে নিশামণি চুপ করে বসে থাকলেন। তার পর হঠাৎ উঠে পড়ে ঘরটায় পায়চারি করতে লাগলেন। জানলাটা আবার খুলে দিলেন, বাতাসে লম্ফ নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা সত্ত্বেও।

গঙ্গেশও উঠে দাঁড়িয়েছিল। ওর বুকের ভেতর আরও জোরে জোরে স্পন্দন হচ্ছিল। সে ভাবছিল প্রতিটি মানুষের জীবনেই কিছু গোপন ঘটনা থাকে, যা অন্যেরা কখনওই জানতে পারে না, কারণ অন্যদের সে বলতে চায় না। এই অর্থে কোনও জীবনীই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। নিশামণির জীবনের সেই গোপন অংশ জানতে চেয়ে সে হয়তো অপরাধই করে ফেলেছে।
 
‘আমার জীবনের সমস্ত ঘটনাই আমি তোমাকে বলতে রাজি’, নিশামণি জানলাটা আবার বন্ধ করে তক্তপোষে বসে বললেন। তাঁর বৃদ্ধ, রুগ্ণ মুখটা মৃদু মৃদু কাঁপছিল। ‘কিন্তু সেটা শুনতে শুনতে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়তে পারো, কারণ এমন কিছুই আমার জীবনে ঘটেনি, যা আরও অনেকের জীবনে ঘটে না। তবে কিছু স্বপ্ন হয়তো এমন দেখেছি, যা একটু অন্য রকম। এমন কিছু অনুভূতির স্বাদ একটু পেয়েছি, যা হয়তো একটু অন্য রকম। কিন্তু সেগুলো তোমাকে বোঝাই কী করে বলো তো? ভাবতে গেলে আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। যৌবনে একটা গভীর গিরিখাতের কিনারে এক মধ্যরাতে দাঁড়িয়েছিলাম, যার ভেতরে অগাধ অন্ধকার। কিন্তু ওই অন্ধকারে নেমে আমার সেখানে বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল।
 
মনে হয়েছিল ওখানে যে আশ্রয় পাব, যে নিমগ্নতা পাব, সেটা কোনও আলো দিতে পারে না। অন্ধকারের প্রগাঢ়তা আলোয় নেই। এক স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা অকিঞ্চিৎকর পরমাণুর মধ্যে বসে অবাক দৃষ্টিতে জগতের দিকে তাকিয়ে আছি। মানুষ হতে আমার ইচ্ছেই করছিল না। আমার যখন তেত্রিশ বছর বয়স তখন একটা প্রকাণ্ড মরুভূমির ওপর দিয়ে একটা গোটা দিন ধরে হাঁটতে হয়েছিল। অন্তহীন, নির্জন মরুভূমি। কোথাও কোনও প্রাণ নেই। কখন একটা লোকালয়ে পৌঁছব বুঝতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি হারিয়েই গিয়েছি ওই বালির সমুদ্রে। কখনও কোথাও আর পৌঁছব না। হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল আমি হয়তো আর মারাও যাব না। এই অন্তহীন মরুভূমি নিজে অস্তিত্ববান হয়ে থাকার জন্যই আমার চেতনাকেও টিকিয়ে রাখবে। ওই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি মরুভূমির মধ্যে আছি, না মরুভূমি আমার মধ্যে। আমার জীবনের আরও অনেক ঘটনা আমি তোমাকে বলতে পারি, শুনতে শুনতে তুমি যদি ক্লান্ত না হও। কিন্তু আমার প্রশ্ন, তুমি কেন আমার জীবনী লিখতে চাইছ? আমি তো এটা জানতামই না যে তুমি আমার জীবনী লিখছ!’
 
‘যাতে সারা জগৎ আপনাকে জানতে পারে, আপনার বাণীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতে পারে’, আবেগে ভেজা গলায় গঙ্গেশ বলল।

‘কিন্তু আমি তো এমন কিছুই বলিনি, যা কেউই জানে না। গোটা ব্রহ্মাণ্ডই একটা খোলা আকাশ। যে কেউ এটা দেখতে পারে। আমি কি তোমাদের এ সব কথাই বার বার বলিনি?’
 
‘মানুষের স্মৃতি দুর্বল। মানুষ দ্রুত ভুলে যায়। সেটা যাতে না হয়, তাই আপনার জীবন, আপনার কথা আমি লিখে রাখতে চাইছি।’

‘তুমি যদি সত্যি আমাকে ভালবেসে থাকো, আমার কথা বুঝে থাকো, তবে তোমার প্রতি আমার নির্দেশ আমার জীবনী, আমার কোনও কথাই তুমি লিখে রাখবে না। আজ পর্যন্ত যা লিখেছ আজই সেই কাগজগুলো আমার কাছে নিয়ে এসো!’

‘ওগুলো আমার কাছেই আছে।’

‘তাই? তা হলে বার করো ওগুলো। এবং এই মুহূর্তে আমার সামনেই কাগজগুলোয় আগুন ধরিয়ে দাও, যাতে নিশ্চিন্ত হয়ে মারা যেতে পারি।’

গঙ্গেশ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল নিশামণির দিকে। সে ভাল করে কিছু বুঝতে পারছিল না। ভয়, অপরাধ বোধে জল গড়াচ্ছিল ওর চোখ দিয়ে।
 
‘দুঃখ কোরো না’, নিশামণি বললেন। ‘আমার সম্পর্কে কিছু লিখে রাখলে লোকে এক সময় ও-সব নিয়ে একটা মতবাদ তৈরি করতে পারে। পৃথিবীতে হয়তো আরও একটা ধর্মের জন্ম হতে পারে। তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমার অনুগামীরা অবিরাম রক্তপাত ঘটাতে পারে, যেমন কিনা অতীতে ঘটেছে এবং আমার ভয় হয় ঘটতে পারতে ভবিষ্যতেও। ধর্মের চেয়ে বড় শত্রু ঈশ্বরের আর কিছু নেই।’
 
লম্ফের আগুন ছুঁইয়ে গঙ্গেশ কাগজগুলোয় আগুন ধরিয়ে দিল। ওর হাত কাঁপছিল। তক্তপোষে বসে নিশ্চিন্ত মনে নিশামণি দেখে যাচ্ছিলেন, যেন অনুভব করছেন জীবন্ত অবস্থায় চিতায় পোড়ার অভিজ্ঞতা, দগ্ধ হওয়ার কোনও যন্ত্রণা ছাড়াই।
 
শেষ বারের মতো লোকালয়টি ছেড়ে আমি যখন ফিরছি, ঘটনাচক্রে সে দিনও আকাশে পূর্ণিমা। বর্ষাকাল। চাঁদের গনগনে আলোয় একটা ডোবায় কয়েকটা ব্যাঙ মুখ ওপরে তুলে নিঃশব্দে ভাসছিল। দাঁড়িয়ে পড়ে আমি হেসে ফেললাম। আমার মনে হল দেড়শো বছর আগের সেই ব্যাঙগুলোই যেন আজও চার পাশের রহস্য ও সৌন্দর্যের বিভ্রান্তি উপভোগ করছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ