Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

অসমাপ্ত | শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়

রাখাল-মাস্টারকে লইয়া গল্প লেখা চলে কি-না কে জানে!

রাখাল-মাস্টার ইস্কুলের মাস্টার নয়—পোস্টমাস্টার৷

আমি গল্প লিখি এবং সেই-সব গল্প কাগজে ছাপা হয় শুনিয়া অবধি রাখাল-মাস্টার আমায় কত দিন কতবার যে তাহাকে লইয়া একটা গল্প লিখিয়া দিতে বলিয়াছে তাহার আর ইয়ত্তা নাই৷

একটি একটি করিয়া সে তাহার জীবনের প্রায় সমস্ত ঘটনাই আমাকে বলিয়াছে কিন্তু সেগুলিকে পরের পর সাজাইয়া কেমন করিয়া যে গল্পের আকারে লিখিয়া ফেলিব তাহা আমি আজও ঠিক করিয়া উঠিতে পারি নাই৷

এই বলিয়া গল্পটি একবার আরম্ভ করিয়াছিলাম!

দেখিতে নাদুশ-নুদুশ, ন্যালা-ক্যাবলা-গোছের চেহারা, চোখে নিকেলের ফ্রেম-দেওয়া চশমা, মাথার চুলগুলি ছোট-ছোট করিয়া কাটা,—রাখালকে দেখিলে ঠিক পাগল বলিয়া মনে হয়৷

এই পর্যন্ত শুনিয়াই ত’ রাখাল-মাস্টার চটিয়া আগুন৷

বলিল, ‘না, তোকে লিখতে হবে না, তুই যা৷ মিছে কথা বানিয়ে বানিয়ে...এমনি করেই লিখিস তোরা তা আমি জানি৷’

বলিয়া খানিকক্ষণ মুখ ভারি করিয়া বসিয়া থাকিয়া চশমার ফাঁকে একবার চোখ দুইটি তুলিয়া বলিল, ‘যা বাপু যা, তুই এখন বিরক্ত করিস নে৷ আমার হিসেব ভুল হয়ে যাবে৷ বেরো তুই এখান থেকে৷’

বলি, ‘চটো কেন মাস্টার, শোনোই না শেষ পর্যন্ত৷’

‘হ্যাঁ, খুব শুনেছি৷’ বলিয়া কলমটা মাস্টার তাহার কানে গুঁজিয়া রাখিয়া সোজাসুজি আমার মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, ‘পাগল কাকে বলে জানিস? না—অমনি লিখে দিলেই হলো৷’

হাসিয়া বলিলাম, ‘পাগল ত লিখিনি৷ লিখেছি—পাগলের মত!’

‘ওই একই কথা৷’ বলিয়া হাত নাড়িয়া আমাকে সে চুপ করাইয়া দিয়া বলিল, ‘পাগল বলে কাকে জানিস? পাগল বলে—তোদের গাঁয়ে ওই নিবারণ মুখুজ্যেকে৷ চব্বিশ ঘণ্টা বৌ আর বৌ৷ সেদিন বললাম, বলি—ওহে নিবারণ, বোসো, তামাক-টামাক খাও৷ ঘাড় নেড়ে বললে, না ভাই, উঠি৷ বেলা হয়ে গেছে,—বৌ বকবে৷ ওই ওদের বলে পাগল৷ বুঝলি?’

বলিয়া কান হইতে কলমটি আবার তাহার হাতে লইয়া নিশ্চিন্ত মনে মাস্টার তাহার কাজ আরম্ভ করিতেছিল, হঠাৎ কি মনে হইল, আবার মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিল, ‘মিছে কথা না লিখলে তোদের গল্প লেখা হয় না৷ তবে কাজ নেই বাপু লিখে, মিছে কথা আমি ভালবাসি না৷’

*   *   *   *

সেই দিন হইতে কিছুই আর লিখি নাই৷

ধানের মাঠের উপর দিয়া প্রায় ক্রোশ-খানেক পথ হাঁটিয়া প্রকাণ্ড একটা বন পার হইয়া গ্রামের শেষে, গুটিকয়েক আমগাছের তলায়, ছোট্ট সেই পোস্টাপিসটিতে প্রায়ই আমাকে যাইতে হয়৷

কোনোদিন হয়ত দেখি,—দরজায় খিল বন্ধ করিয়া পোস্টাপিসের মেঝের উপর তালপাতার একটি চাটাই বিছাইয়া রাখাল মাস্টার তাহার হিসাব লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে৷ চারিদিকে কাগজ ছড়ানো,—উড়িয়া যাইবার ভয়ে কোনোটার উপর প্রকাণ্ড একটা মাটির ঢেলা, কোনোটার উপর আস্ত একখানা ইঁট, কোনোটা বা পায়ের নীচে চাপা দেওয়া, মুখে বিরক্তির ভাব ঝড়-বাতাসের উদ্দেশে যাহা মুখে আসিতেছে তাই বলিয়া অশ্লীল ভাষায় গালাগালি দিতেছে, আর আপন মনেই কাজ করিতেছে৷

হাসি আর কিছুতেই চাপিয়া রাখিতে পারি না৷ অবশেষে অতি কষ্টে হাসি চাপিয়া বলি, ‘ওহে মাস্টার, দরজাটা একবার খুলবে না কি?’

আর যায় কোথা!

ভিতর হইতে মাস্টারের চীৎকার শোনা গেল,—‘তা আবার খুলব না! সময় নেই, অসময় নেই...বেরো বলছি, পালা এখান থেকে, নইলে খুন করে ফেলব৷’

বাস—চুপ৷

কাগজের খুস খুস শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নাই৷

কিয়ৎক্ষণ পরে ভাবিলাম, আর-একবার ডাকি৷ কিন্তু ডাকিতে হইল না৷ জানলার কাছে খুট করিয়া শব্দ হইতেই তাকাইয়া দেখি, রাখাল-মাস্টার কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া আছে৷

চোখোচোখি হইবামাত্র বলিয়া উঠিল, ‘সাড়ে তের আনা পয়সার গোলমাল৷ বুঝলি? আসুক ব্যাটা পিওন, আমি তার চাকরির মাথাটি খেয়ে দিচ্চি—দ্যাখ!’

অত-সব দেখিবার অবসর তখন আমার নাই৷ সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছে, অতখানা পথ আবার আমায় একা ফিরিয়া যাইতে হইবে৷ বলিলাম, ‘দোরটা একবার খোলো মাস্টার, চিঠিপত্রগুলো দেখেই আমি চলে যাব৷’

কেন জানি না, হঠাৎ সে প্রসন্ন হইয়া দরজা খুলিয়া দিল৷ ভিতরে ঢুকিলাম৷ সেদিনের ডাকের চিঠিপত্রগুলো ছিল একটা খাটিয়ার নীচে৷ রাখাল-মাস্টার বাড়াইয়া দেখাইয়া দিয়া বলিল, ‘দেখিস, যেন আর কারও চিঠি নিসনে!’

অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইলাম৷ এমন কথা সে আমাকে কোনো দিন বলে না৷

মাস্টার বলিল, ‘কত সব মজার মজার চিঠি থাকে তা জানিস? তুই ত কোন ছার, খাম-টাম খোলা-টোলা পেলে এক-একদিন আমিই দেখি! দেখে আবার বন্ধ করে দিই!—শুনবি তবে? একদিন একটা মেয়ে লিখেছে—’

বলিয়া সে শতচ্ছিন্ন দড়ির খাটিয়াটির উপর চাপিয়া বসিয়া হয় ত’ কোনও মেয়ের চিঠির গল্প আরম্ভ করিতেছিল৷ আমার মাত্র দু’খানি চিঠি৷ হাতে লইয়া বলিলাম, ‘থাক৷ ও-গল্প তোমার আর-একদিন শুনব, আজ উঠি৷’

‘তা উঠবি বই-কি৷ নিজের কাজ সারা হয়ে গেছে ত’! যা৷’ বলিয়া সে একরকম জোর করিয়াই আমার ঘাড়ে ধরিয়া দরজাটা পার করিয়া দিয়া আবার ভিতর হইতে খিল বন্ধ করিয়া দিল৷

আর-একদিন অমনি চিঠির খোঁজে ডাকঘরে গিয়াছি৷ দেখিলাম, দরজা বন্ধ৷ ভিতরে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া সুরু হইয়াছে৷ তুমুল ঝগড়া!

কি লইয়া ঝগড়ার সূত্রপাত, বাহির হইতে কিছুই বুঝা গেল না৷

রাখাল-মাস্টার ক্রমাগত নিজেকে সাধু প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করিতেছে, আর স্ত্রী বলিতেছে,—‘না তুমি সাধু নও, তুমি ভণ্ড, তুমি বদমাস, তুমি শয়তান৷’

অবশ্য মুখ দিয়া যে ভাষা তাহাদের অনর্গল বাহির হইতেছে তাহা শুনিলে কানে আঙুল দিতে হয়৷ দু’জনেই সমান৷ যেন স্বামী, তেমনি স্ত্রী! কেহই কম যান না৷

নিতান্ত অসময়ে আসিয়া পড়িয়াছি৷ একবার ভাবিলাম, চলিয়া যাই, আবার ভাবিলাম, এতখানা পথ হাঁটিয়া আসিয়া ‘ডাক’ না দেখিয়াই বাড়ী ফিরিয়া গেলে আফসোসের আর বাকি কিছু থাকিবে না৷ ‘যা থাকে কপালে’ বলিয়া কাশিয়া গলাটা একবার পরিষ্কার করিয়া লইয়া ডাকিলাম, ‘মাস্টার!’

উভয়েরই গলার আওয়াজ তৎক্ষণাৎ বন্ধ হইয়া গেল৷ এত সহজে বন্ধ হইবে ভাবি নাই৷ দরজা খুলিয়া রাখাল-মাস্টার মুখ বাড়াইয়া বলিল, ‘ও, তুই! আয়, তোর আজ মেলা চিঠি৷’

মাসের প্রথম৷ কয়েকখানা মাসিকপত্র আসিয়াছিল৷ হাতে লইয়া সেদিন আর দেরি না করিয়াই উঠিতেছিলাম৷ রাখাল-মাস্টার বলিল, ‘বোস, কথা আছে৷’

বাধ্য হইয়া বসিতে হইল৷ জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি কথা?’

মাস্টার বলিল, ‘শুনেছিস? ঝগড়া আমাদের?’

বলিলাম, ‘শুনেছি৷ কিন্তু বুঝতে কিছু পারি নি৷’

মাস্টার তিরস্কার করিতে লাগিলেন—‘বুঝতে পারিস নি কি-রকম? তুই না গল্প লিখিস?—এ ত’ একটা কচি ছেলেতেও বুঝতে পারে৷’

কি জবাব দিব বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিলাম৷

মাস্টার বলিল, ‘শোন তবে৷ ও-হতভাগী যদি অমনি করে ত’ ওর মুখে আমি নুড়ো জ্বেলে দেব না ত’ কী করব?’

অন্তরাল হইতে মাস্টার-গিন্নির কণ্ঠস্বর শোনা গেল ‘হ্যাঁ, তা আবার দেবে না! আ মরি মরি, কি গুণের সোয়ামী গো!’

‘ওই শোন!’ বলিয়া আঙুল বাড়াইয়া মাস্টার বলিল, ‘গলার আওয়াজ শুনেছিস? কাঠে যেন চোট মারচে৷’

এবারেও গৃহিণী কি যেন বলিলেন, কিন্তু কথাটা ভাল বুঝা গেল না৷

মাস্টার তখন বলিতে লাগিলেন, ‘শোন তবে আসল কথাটাই বলি৷ একদিন একটা খামের চিঠি—দেখলাম, মুখটা ভাল করে আঁটা হয়নি৷ সরিয়ে রাখলাম৷ এই গাঁয়েরই চিঠি৷ নিতাই গাঙ্গুলী কয়লা-খাদে চাকরি করে৷ লিখেছে তার বৌ-এর কাছে৷ নিতাই-এর বয়েস...এই তোদেরই বয়েসী হবে, ছোকরা বয়েস—বৌটিও তেমনি৷ ভাবলাম, পড়েই দেখি না কি লিখেছে৷—আঃ! সে কি লেখা রে! হ্যাঁ, বিয়ে করা সাত্থক! বৌকে যদি অমনি চিঠিই না লিখতে পারলাম....আর ওই দ্যাখ আমার বাড়ীতে—’ বলিয়া মাস্টার আর-একবার তাহার গৃহিণীর উদ্দেশ্যে আঙুল বাড়াইয়া বলিল, ‘ওকে চিঠি লিখব কি,—বিয়ে করা ইস্তক আজ পর্যন্ত মুখে আমার লাথি-ঝাঁটাই মারছে৷ যেমন প্যাঁচার মতন চেহারা, তেমনি গুণ! বলে কি না, ‘‘হতভাগা, তোর সঙ্গে আমার বিয়ে না হ’লে আমি সুখী হতাম৷’’ বলি তাই—‘‘যা না বাপু, যেখানে খুশী তোর চলে যা, যাকে খুশী বিয়ে করগে যা, আমার হাড়টা জুড়োক৷’’ কিন্তু ক্ষেমতা নাই৷ হেঁ হেঁ! তখন বলে কি না—? হ্যাঁ যাব! মেয়েমানুষের যাবার পথ যে নেই রে পোড়ারমুখো! আমি মরব৷ মরে ভূত হয়ে এসে তোর ঘাড় মটকাব দেখে নিস!’’ এই ত’ বাক্যি৷ —যাক, ‘শোন তবে আসল কথাটাই শোন!’...

বলিয়া মাস্টার একটা ঢোক গিলিয়া একবার এদিক-ওদিক তাকাইয়া বলিল, ‘নিতাই-এর যেমন বুদ্ধি! দেখি না, চিঠির ভেতর একখানা দশ টাকার নোট৷ বৌকে পাঠিয়েছে৷ ভাবলাম, নোটখানা দিই মেরে! ধরবার ছোঁবার ত’ কিছু নেই৷ তখন আমার সংসারে যা কষ্ট রে, সে আর কি বলব! পঁচিশটি টাকা মাইনে৷ তাই থেকে বোনের তত্ব পাঠালাম দশ টাকার—বাকি পনেরটি টাকায় আর ক’দিন চলে! বাস, নোটখানা সরিয়ে রেখে খেতে গেলাম৷ খেতে বসে ভাত আর রোচে না, হাত যেন মুখে আর উঠতেই চায় না৷ খালি খালি ওই নোটটার কথাই মনে হয়৷ বলি,—না বাবা, এ অস্বস্তিতে কাজ নাই৷ আধ-খাওয়া করে উঠে পড়লাম৷ বৌ বললে, ‘ও কি গো! এ আবার কি ঢং!’ বললাম, ‘থামো৷’ বাস! তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে নোটখানা আবার তেমনি খামের ভেতর পুরে আঠা দিয়ে এঁটে নিজেই হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ নিতাই গাঙ্গুলীর দরজায় গিয়ে ডাকলাম—নিতাই-এর-বৌকে৷ বৌ ছেলেমানুষ কিছুতেই আসতে চায় না৷ বললাম, ‘এসে ওই দরজার পাশে দাঁড়াও মা, তাহ’লেই হবে৷ আমি পোস্ট-মাস্টার৷’ নিতাই-এর বৌ ঘোমটা টেনে এসে দাঁড়ালো! বললাম, ‘এই নাও মা, তোমার চিঠি নাও৷ চিঠির ভেতর দশ-টাকার একটি নোট আছে৷’—চিঠিখানি বৌ হাতে করে’ নিলে৷ বললাম, ‘নিতাইকে বারণ করে দিও, বৌমা, এমন করে টাকা পাঠালে টাকা মারা যায়৷’ ঘাড় নেড়ে বৌ বললে, ‘বেশ৷’

বাবা! বাঁচলাম! এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হয়ে বাসায় ফিরে এসে বললাম, ‘দাও, এবার ভাত দাও, খাব৷’ বৌ জিজ্ঞেস করলে, ‘কি হয়েছে বল দেখি!’ আগাগোড়া সব কথা বললাম বৌকে৷—‘বৌ বলে কি জানিস?’

‘কি বলে?’ বলিয়া মাস্টারের মুখের পানে তাকাইয়া রহিলাম৷

মাস্টার হাসিল৷ বলিল, ‘তবে আর তুই লেখক কিসের রে?’

বলিয়াই মাস্টার আবার আরম্ভ করিল, ‘পোড়ারমুখী বলে কি না,—ওরে আমার কে রে! সাধু শ্যাওড়াগাছ! টাকা তুমি নিলে না কেন?’

‘বাস! এই নিয়ে হ’লো ঝগড়া! বুঝলি এবার?’

ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ৷’

মাস্টার রাগিয়া উঠিল৷ বলিল, ‘ছাই বুঝলি৷ কিছুই বুঝিসনি৷—বুঝেও কি তুই ওকে নিয়ে আমাকে ঘর করতে বলিস?’

হাসিয়া বলিলাম, ‘কি বলব তা হ’লে?’

‘কি বলবি?’ বলিয়া মাস্টার আমার মুখের পানে তাকাইয়া দাঁত কিসমিস করিয়া বলিল, ‘বলবি—খ্যাঁংরা মেরে বাড়ী থেকে দূর করে দিতে৷’

পোস্টাপিস ও মাস্টারের ‘ফেমিলি কোয়ার্টারে’ মাত্র একটি দেওয়ালের ব্যবধান৷ দেওয়ালের ও-পার হইতে শোনা গেল, ‘হে ভগবান! হে ভগবান! এমন সোয়ামীর হাত থেকে আমায় নিষ্কৃতি দাও ভগবান! চিরজন্মের মত নিষ্কৃতি দাও—হে হরি, হে মধুসূদন!’—বলিয়া মট মট করিয়া আঙুল মটকানোর শব্দ আর কান্না৷

রাখাল-মাস্টার উঠিয়া দাঁড়াইল৷ বলিল, ‘চল! এ আর চব্বিশঘণ্টা আমি কত শুনব? চল—তোকে খানিকটা এগিয়েই দিয়ে আসি৷ চল৷’

তখন সূর্যাস্ত হইতেছে৷ বাড়ী ফিরিতে হয় ত’ রাত্রি হইবে৷

বাহিরে আসিয়া দেখি, অস্ত-সূর্যের স্তিমিত রশ্মি মেঘে-মেঘে প্রতিফলিত হইয়া সারা আকাশটাকে বিচিত্র বর্ণে রঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছে৷ সম্মুখে হরীতকী, শাল ও মহুয়ার বন৷ তখন ফাল্গুন মাস৷ সুচিক্কণ মসৃণ পত্রভারাবনত বৃক্ষশ্রেণী৷ শাল ও মহুয়া ফুলের গন্ধেভরা বাতাস৷ ঢেউ খেলানো অসমতল ভূমিখণ্ডের উপর সুমুখে কয়েক-ঘর সাঁওতালের বস্তি৷ তাহারই পাশ দিয়া সঙ্কীর্ণ একটি পথ-রেখা আঁকিয়া-বাঁকিয়া বনে গিয়া প্রবেশ করিয়াছে৷

সেই পথ ধরিয়াই নীরবে চলিতেছিলাম৷ রাখাল-মাস্টার হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিয়া বসিল, ‘হাঁ রে, লিখেছিস কিছু?’

‘কি?’

‘বা-রে! ভুলে গেলি এরই মধ্যে? সেই যে বলেছিলাম৷’

হাসিয়া বলিলাম, ‘তোমার গল্প?’

মাস্টার শুধু ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল৷

বলিলাম, ‘না, তোমার গল্প আমি আর লিখব না৷’

মাস্টার সে কথায় কান দিল না৷ বলিল, ‘কেন লিখবি না? লিখবি লিখবি৷ তবে সত্যি কথা লিখিস বাপু৷ এই ধর—আমার বৌটার কথা লিখবি আগে৷ লিখবি যে, ওর মত খারাপ মেয়ে আর দুনিয়ায় নেই৷ মাগীটার কাছ থেকে পালাতে পারলে আমি বাঁচি৷ নিজের চোখেই ত সব দেখে এলি,—তোকে আর বেশি কি বলব!’

বলিলাম, ‘আচ্ছা৷ তুমি এবার যাও, নইলে ফিরতে তোমার রাত হবে৷’

‘হোক না৷’ বলিয়া রাখাল-মাস্টার আমার কাঁধে হাত দিয়া ঈষৎ হাসিল৷ বলিল, ‘অন্ধকারে সাপে কামড়াবে? কামড়াক না৷ বাঁচতে আর ইচ্ছে নেই, মাইরি বলছি, বৌটার জ্বালায় এক একদিন মনে হয় আমি মরি৷’

বলিয়াই সে ফিরিয়া যাইবার জন্য পিছন ফিরিল৷ বলিল, ‘আসি তবে৷ লিখিস কিন্তু৷’

*   *   *   *

সম্মতি দিয়া ত বাড়ী ফিরিলাম৷

লিখিবার চেষ্টাও যে করি নাই তাহা নয়৷

লিখিয়াছিলাম 

‘‘পঁচিশটি টাকা মাত্র বেতন৷ রাখাল-মাস্টারের পোস্ট-মাস্টারী করিবার কথা নয়! অদৃষ্টের বিড়ম্বনা!

‘বড়লোকের ছেলে নয়৷ ছেলে নিতান্ত গরীবের৷ তাও যদি বাবা বাঁচিয়া থাকিতেন!

‘শৈশবে পিতৃহীন বালক—মামার বাড়ীতেই মানুষ৷ মামা মস্ত বড়লোক৷ প্রকাণ্ড অট্টালিকা, দাসদাসী, লোকজন—তিন তিনটি মোটরকার৷ তাহারই একটিতে চড়িয়া প্রত্যহ বৈকালে রাখাল বেড়াইতে যায়৷ যেন পোশাক, তার তেমনি চেহারা৷ লোকে দেখে আর বলে, ব্যাটার কপাল ভাল৷

‘মামা বিবাহ দিলেন৷ গরীবের ঘরের অনাথা একটি মেয়ে৷

‘মেয়ের অভিভাবিকা ছিলেন এক পিসি৷ মামা নিজে মেয়ে দেখিতে গিয়েছিলেন৷’ মেয়ের পিসি বলিলেন, ‘তাই ত’ বাছা, ছেলেটির মা নেই বাপ নেই, তার ওপর মামার কাছে মানুষ...’

মামা বলিয়াছিলেন, ‘সেজন্য আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বেয়ান, মামা আর অর্ধেক সম্পত্তি ভাগনেকে দিয়ে যাবে৷’

‘হয় ত’ দিতেন৷ কিন্তু এমনি রাখালের অদৃষ্ট যে, তিনি কিছু না দিয়াই মরিলেন৷’

রাখাল—বোনের ছেলে, সুতরাং বলিবার কিছুই নাই৷

কিছুদিন পরেই দেখা গেল সে তাহার স্ত্রীকে লইয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে৷—নিরবলম্ব, নিঃসহায়, নিঃসম্বল রাখাল৷

তাহার পর সে-সব অনেক কথা৷ বলিতে গেলে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ হয়৷

‘পথে পথে ঘুরিয়া ঘুরিয়া অনেক দুঃখ কষ্ট পাইয়া শেষে বহুদিন পরে রাখাল একটি চাকরি পায়—পোস্টাপিসের পিওন৷ তাহার পর পিওন হইতে হয় পোস্ট-মাস্টার৷

‘কিন্তু এই যে দুঃখ-দুর্ভোগ, ইহাও হয় ত’ সে নীরবে সহ্য করিতে পারিত—যদি সঙ্গিনীটি হইত তাহার মনের মতন৷

‘রাখাল বলে, সে দুঃখের কথা আর বোলো না ভাই, মেয়েটা আমাকে ভালবাসে না৷ ভালবাসলে এত ঝগড়াঝাঁটি, এত কথা-কাটাকাটি হয় না কখনও৷’

এই পর্যন্ত লিখিয়া রাখিয়াছিলাম৷

লেখা কাগজগুলা প্রায় প্রত্যহই সঙ্গে লইয়া যাইতাম৷ ভাবিতাম মেজাজ ভাল থাকিলে মাস্টারকে একদিন পড়িয়া শোনাইব৷ কিন্তু পড়া আমার আর কোনদিনই হইয়া উঠিল না৷

ভাল মেজাজে রাখাল-মাস্টারকে পাওয়া বড় কঠিন৷

যে-দিন যাইতাম, শুনিতাম, কেহ-না-কেহ তাহাকে বড় বিরক্ত করিয়া গেছে৷

বিরক্ত করিবার লোকের অভাব নাই৷ কেহ একখানা পোস্টকার্ড কিনিতে আসিলেও মাস্টার তাহাকে দাঁত খিঁচাইয়া তাড়িয়া মারিতে ওঠে৷ অথচ পোস্টাপিসে নানা প্রয়োজনে লোকজন আসিবেই৷

গ্রামে তাহার দুর্নামের একশেষ৷ সবাই বলে, ‘এমন বদ-মেজাজী লোক বাবা আমরা জীবনে কখনও দেখি নি৷ ওর নামে সবাই মিলে একটা দরখাস্ত না করলে আর উপায় নেই!’

কথাটা শুনিয়া বড় দুঃখ হইয়াছিল৷ মাস্টারকে একদিন বলিয়াছিলাম,—‘দ্যাখো মাস্টার, পোস্টাপিসের কাজে যে-সব লোকজন আসবে, তাদের সঙ্গে তুমি ওরকম-ধারা ব্যবহার কোরো না৷ এতে তোমার ক্ষতি হবে৷’

‘ক্ষতি? কি বললি,—ক্ষেতি?’ বলিয়া সে আমার মুখের পানে তাকাইয়া জবাব দিয়াছিল, ‘না৷ ক্ষেতি আমার কেউ করতে পারবে না তা তুই দেখে নিস৷ অনেকে অনেক চেষ্টাই করেছিল কিন্তু পারে নি৷ উল্টে পিওন থেকে পোস্টমাস্টার! ভগবান আমার সহায় আছেন৷’

এই বলিয়া মাস্টার চোখ বুজিল৷ বলিল, ‘ভগবান সহায় না থাকলে...দ্যাখ, আমি যে কারও ক্ষেতি কোন দিন করিনি রে, আমার ক্ষেতি কেউ করবে না দেখিস৷ ক্ষেতি যা কিছু আমার করবার, তা ওই উনি করেছেন৷’ বলিয়া সে তাহার অন্তঃপুরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘চুপ! শুনতে পেলে কিছু বাকি রাখবে না৷’

চুপ করিয়াই ছিলাম৷

মাস্টার কিন্তু চুপ করে নাই৷ বলিতে লাগিল, ‘গাঁয়ের লোক আমার বদনাম করে, না? তা ত’ করবেই, বেটারা নিমকহারাম! আমি সাচ্চা মানুষ কি-না! ওই দ্যাখ—ওই রেজেস্টারী চিঠিখানা ফেলে রেখেছি৷ কেন রেখেছি জানিস? ওই অবিনাশ-বেটার কাছে সেদিন আমি চাল কিনতে গেলাম, শুনলাম নাকি ব্যাটা টাকায় দশ সের করে চাল বেচছে৷ আমায় দেখে বলে কি না, ‘না ঠাকুর, চাল আমি আর বিক্রি করব না৷ টাকায় দশ সের করে ত’ নয়—টাকায় আট সের৷’ অনেকক্ষণ চেঁচামেচির পর বললাম, ‘তাই আট সেরই দে না রে বাপু, ঘরে যে গিন্নি আমার জল চড়িয়ে বসে আছে৷’ অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বললে, ‘না ঠাকুর, মিছে বকাবকি—আমি দেবো না৷’ আচ্ছা দাঁড়া রে ব্যাটা অবিনাশ, তোকে কি আমি একদিনও পাব না! বাস, পেয়েছি৷ রেজেস্ট্রী চিঠি একখানা এসেছে ব্যাটার নামে৷ আজ দু’দিন হলো—ওইখানেই পড়ে আছে৷ থাক ব্যাটা ওইখানে পড়ে!’

বলিলাম, ‘কিন্তু এ তোমার অন্যায়, মাস্টার৷’

‘অন্যায়?’ বলিয়া মাস্টার আমার মুখের পানে কটমট করিয়া তাকাইয়া বলিল, ‘তবে আর তুই লেখক কিসের রে?’

কি আর বলিব! চুপ করিলাম৷

কিন্তু রেজেস্ট্রী চিঠি ফেলিয়া রাখা যে অন্যায়, সে কথা বোধ করি রাখালমাস্টার ভুলিতে পারিল না তাই সে আবার আমাকে প্রশ্ন করিয়া বসিল, ‘অন্যায় কিসের শুনি? সে-যে অন্যায় করলে সেটা বুঝি অন্যায় হলো না? আমার অন্যায়টাই অন্যায়?’

কি যে বলিব ঠিক বুঝিতে পারিলাম না৷ আমার চিঠি কয়খানি লইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছি, মাস্টার ধরিয়া বসিল, ‘ওসব চলবে না৷ তুই বলে যা৷’

বলিলাম, ‘চাল সে না দেওয়ায় তোমার ক্ষতি কিছু হয় নি কিন্তু এতে যদি তার ক্ষতি হয়?’

মাস্টার অন্যমনস্ক হইয়া কি যেন ভাবিতেছিল, জিজ্ঞাসা করিল, ‘কিসে ক্ষতি হয়?’

‘চিঠিখানা ফেলে রাখায়!’

‘তাও ত বটে৷’ বলিয়া মাস্টার নীরবে বারকয়েক মাথা নাড়িয়া চুপ করিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, ‘ঠিক বলেছিস৷ লেখক-মানুষ কি-না, বুদ্ধি-সুদ্ধি একটু আছে৷’

উভয়েই চুপ৷

মাস্টার সহসা উঠিয়া দাঁড়াইল৷—‘হয়েছে তোর চিঠি নেওয়া?’

ঘাড় নাড়িয়া আমিও উঠিয়া দাঁড়াইলাম৷—

অবিনাশের চিঠিখানা হাতে লইয়া মাস্টার বলিল, ‘চল, তবে নিজেই দিয়ে আসি৷ কাজ কি বাপু, রেজেস্ট্রী চিঠি, দরকারিও ত’ হ’তে পারে! চল৷’

দু’জনে একসঙ্গে বাহির হইতেছিলাম, বাহিরে দরজার কাছে একজন হৃষ্টপুষ্ট লম্বা-চওড়া সাঁওতাল ছোকরা দাঁড়াইয়া আছে, মাথায় বাবরি চুল, গলায় লাল কাঁটির মালা, হাতে একটা বিড়ালের বাচ্চার মত মেটে-রঙের মরা খরগোস৷ সাঁওতাল ছোকরাটিকে দেখিবামাত্র রাখাল-মাস্টারের মুখখানি শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল৷ চৌকাঠের কাছে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িয়া বলিল, ‘কে...মুংরা...তুই আজও এসেছিস...?’

বলিয়া দাঁত দিয়া ঠোঁট কামড়াইতে কামড়াইতে মাস্টার কি যেন বলিতে লাগিল৷

মুংরা বলিল, ‘ধেৎ তেরি! রোজ রোজ পুইসা নাই, পুইসা নাই, আনতে তবে তুঁই বলিস কেনে?’

অনুমানে ব্যাপারটা কতকটা বুঝিলাম৷ মুংরাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কত দাম?’

মুংরা দাম বলিবার আগেই মাস্টার বলিয়া উঠিল, ‘নিবি তুই? আহা খরগোসের মাংস—বুঝলি কি না—ভারি সুন্দর! আমার বৌ খুব ভালবাসে! দু’তিন মাস ধরে আমাকে বলছে, কিন্তু ছাই এমন দিনে মুংরা আসে যে আমার হাতে পয়সাই থাকে না৷ আরও দু’বার দুটো এনেছিল, তা ওই যে বললাম, এমন দিনে আসে হতভাগা...! দাম? দাম আর বেশি কোথায়? দাম দু আনা৷’

পকেট হইতে একটি দু’আনি বাহির করিয়া মুংরার হাতে দিয়া বলিলাম, ‘দে, ওটা আমাকে দিয়ে যা৷’

মুংরা অত্যন্ত খুশী হইয়া হাসিতে হাসিতে দু’ আনিটি হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল৷

‘দাঁড়া তবে, দাঁড়া৷’ বলিয়া মাস্টার তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া লোহার একটি লম্বা ছুরি আনিয়া বলিল, ‘বেশ করে কেটে কুটে ওকে দিয়ে যা মুংরা, বাবু ছেলেমানুষ, কুটতে পারবে না—বুঝলি? সেই তোরা যেমন করে কুটিস—যা—আগে ওই ছোট তালগাছটা থেকে একটা ‘বাগড়ো’ কেটে আন, তারপর তালের এই পাতা দিয়ে বাবুকে জিনিসটা বেশ ভাল করে বেঁধে দিবি, বুঝলি? বাবু হাতে করে ঝুলিয়ে বাড়ী নিয়ে যাবে৷’

সুমুখের ছোট তালের গাছ হইতে একটা ‘বাগড়ো’ কাটিয়া আনিয়া মুংরা খরগোস কাটিতে বসিল৷

মাস্টারের রেজেস্ট্রী চিঠি দিতে যাওয়া আর হইল না৷ বলিল, ‘থাক, পিওনের হাতে পাঠালেই চলবে৷’ বলিয়া চৌকাঠের উপর চাপিয়া বসিয়া বলিতে লাগিল, ‘মামার বাড়ী যখন ছিলাম, বন্দুক নিয়ে প্রায়ই শিকার করতে যেতাম৷ যেতাম বটে, কিন্তু একটা পাখীও কোন দিন মারতে পারি নি৷ গুলি ছুঁড়তাম৷ ছোঁড়বার সময় মনে হতো—আহা, কেন মারব? বাস, হাত যেতো কেঁপে, আর শিকার যেতো ফসকে৷ একদিন একটা কুকুর মেরেছিলাম৷ মামার ছিল পায়রার সখ৷ বুঝলি?’

বলিয়া মাস্টার চোখ বুজিয়া চুপ করিল৷ বিগত দিনের সুখৈশ্বর্যের স্মৃতি বোধ করি তাহার মনে পড়িল৷

কিয়ৎক্ষণ পরে চোখ চাহিয়া বলিল, ‘বাড়ীতে অনেকগুলো পায়রা ছিল৷ নানান রকমের পায়রা৷ একদিন একটা পায়রাকে বুঝি বেড়ালে ধরেছিল৷ পায়রাটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতো, ভাল করে উড়তে পারত না৷ পাশের বাড়ীর সুরেশের পোষা কুকুরটা একদিন ঝপ করে এসে তার ঘাড়ে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে—দিলে পায়রাটাকে মেরে৷ আমার রাগ হয়ে গেল৷ জানিস ত আমার রাগ! বাস, তৎক্ষণাৎ বন্দুক বের করে চালালাম গুলি৷ দড়াম করে লাগলো গিয়ে কুকুরটার পেটে৷ কাঁই কাঁই করে সে কি তার কান্না! ছুটে পালাবার চেষ্টা করছিল৷ আবার গুলি! বাস! খতম! কুকুরটা ছটফট করতে করতে গোঁ গোঁ করে আমার চোখের সুমুখে মারা গেল৷ উঃ! সে কি দৃশ্য!’

বলিয়া মাস্টার একবার শিহরিয়া উঠিয়া দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বলিল, ‘সেই যে বন্দুক ছেড়েছি, জীবনে আর কোনো দিন...’

এই বলিয়া সেই যে সে মুখ ঢাকা দিয়া চুপ করিয়া রহিল, অনেকক্ষণ অবধি সে আর কথা কহিল না৷

তাহার গল্পটা আমার পকেটে-পকেটেই ফিরিত৷ ভাবিলাম ইহাই উপযুক্ত সময়৷ বাহির করিয়া বলিলাম, ‘গল্প তোমার খানিকটা আমি লিখেছি৷ শোনো৷’

মুখের ঢাকা খুলিয়া মাস্টার বলিল, ‘পড়৷’

পড়িলাম৷

খানিকটা শুনিয়াই ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘নাঃ, গল্প লিখতে তোরা জানিস না৷’

জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কেন?’

মাস্টার খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘না, দুঃখ তুই নিজে পাস নি কোনো দিন, দুঃখুর কথা তুই লিখবি কেমন করে? আমি যদি লিখতে জানতাম ত’ দেখিয়ে দিতাম কেমন করে লিখতে হয়৷—আচ্ছা পড়৷ শুনি শেষ পর্যন্ত৷’

শেষ পর্যন্ত শুনিয়া কি একটা কথা যেন সে বলিতে যাইতেছিল, হঠাৎ তাহার নজর পড়িল—মুংরার দিকে৷ মাংস কুটিয়া সে তখন দু’জায়গায় ভাগ করিতেছে৷ মাস্টার জিজ্ঞাসা করিল, ‘ও কি রে? দু’জায়গায় কেন?’

বলিলাম, ‘আমি বলেছি৷ একটা তোমার, একটা আমার৷’

‘আমার?’ বলিয়া সে আমার মুখের পানে তাকাইয়া বলিল, ‘বললাম আমার কাছে পয়সা নেই...তুই আচ্ছা বোকা ত’! চারটে পয়সাই বা এখন আমি পাই কোথায়?’

বলিলাম, ‘পয়সা তোমাকে দিতে হবে না৷’

মাস্টার সকরুণ দৃষ্টিতে একবার তাকাইল, তাহার পর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘চারটে পয়সা খরচ করবার ক্ষমতাও আজ আমার নাই৷’ বলিতে বলিতে চোখ দুইটা তাহার জলে ভরিয়া আসিল৷

বলিল, ‘দাঁড়া, গিন্নিকে দেখিয়ে আনি৷’

বলিয়া একটা ভাগ সে দু হাত দিয়া তুলিয়া লইয়া ভিতরে গিয়া হাঁকিতে লাগিল, ‘গিন্নি! ও গিন্নি!’

সেই অবসরে আমার ভাগটা লইয়া আমি পলায়ন করিলাম৷

যথাসম্ভব দ্রুতপদে অনেকখানি পথ চলিয়া আসিয়াছি, এমন সময় পশ্চাতে ডাক শুনিয়া তাকাইয়া দেখি, রাখাল-মাস্টার ছুটিতে ছুটিতে আমার পিছু ধরিয়াছে৷

সারাপথ ছুটিয়া আসিয়া সে হাঁপাইতে লাগিল৷ বলিল, ‘পালিয়ে এলি যে? তোকে একবার আসতে হবে৷’ বলিয়া সে আমার হাতখানি চাপিয়া ধরিল৷

বলিলাম, ‘না, রাত হয়ে যাবে, আমি আর যাব না৷’

মাস্টার কিছুতেই ছাড়িবে না, বলিল, ‘উঁহু, যেতেই হবে তোকে৷’

ব্যাপার কিছু বুঝিলাম না৷ বাধ্য হইয়া ফিরিতে হইল৷

হাতে ধরিয়া আমাকে পোস্টাপিসের ভিতর লইয়া গিয়া মাস্টার হাঁকিল ‘ধরে এনেছি গিন্নি, ওগো ও শ্রীমতী, কোথায় গেলে?’

মাথায় একটুখানি ঘোমটা টানিয়া শ্রীমতী আসিয়া দাঁড়াইল৷—এক হাতে এক গ্লাস জল, আর এক হাতে ছোট একটি পাথরের বাটিতে খানচারেক বাতাসা৷

মাস্টার বলিল, ‘একটু জল৷’

পাছে দুঃখ পায় বলিয়া বাতাসা-কয়টি চিবাইয়া জল খাইলাম৷

মাস্টার হাঁকিল, ‘পান? পান কোথা?’ বলিয়াই সে নিজের ভুল শুধরাইয়া লইল৷ বলিল, ‘ও, পান ত’ নেই বাড়ীতে৷ পান আমরা দু’জনেই খাই না৷ আচ্ছা দাঁড়া, দেখি৷’

বলিয়া কি যেন আনিবার জন্য মাস্টার ভিতরে যাইতেছিল, কিন্তু তাহাকে যাইতে হইল না, পিতলের একটি রেকাবির উপর চারটি কাটা সুপারি ও কতকগুলি মৌরি লইয়া হাসিতে হাসিতে তাহার স্ত্রী ঘরে ঢুকিল৷ রেকাবি হইতে সুপারি লইতে গিয়া একবার চাহিয়া দেখিলাম৷ দেখিলাম—আয়ত দুইটি চক্ষু, ম্লান একটুখানি হাসি! গৌরবর্ণ কৃশাঙ্গী যুবতী,—দেখিলে সুন্দরী বলিয়া ভ্রম হয়৷ তবে সৌন্দর্য যে তাহার একদিন ছিল তাহাতে আর কোনও সন্দেহ রহিল না৷ দুঃখে দারিদ্র্যে সে সৌন্দর্য আজ তাহার ম্লান হইয়া গিয়াছে৷

ভাবিলাম, গল্পে যে জায়গায় তাহাকে কুৎসিত লিখিয়াছি সে জায়গাটা কাটিয়া দিব৷ বলিলাম, ‘নমস্কার! আজ আসি৷’

মাস্টার-গৃহিণী হাসিয়া প্রতি-নমস্কার করিল না, কোনও কথা বলিল না, ম্লান একটু হাসিয়া মাত্র তাহার জবাব দিল৷

এ মেয়ে যে কেমন করিয়া মাস্টারের জীবন দুর্বহ করিয়া তুলিতে পারে, তাহাই ভাবিতে ভাবিতে বাহির হইয়া আসিলাম৷ মাস্টারও আমার সঙ্গে সঙ্গে চলিতে লাগিল৷

কিয়দ্দূর আসিয়া মাস্টার হাসিয়া আমার কাঁধে হাত দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘দেখলি?’

কি দেখিলাম সে প্রশ্ন করিবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না৷ ঘাড় নাড়িয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ৷’

মাস্টার বলিল, ‘দ্যাখ, আমার গল্পের ভেতর সেই যে এক জায়গায় লিখেছিস—ও আমাকে ভালবাসে না, ওটা কেটে দিস৷’

বলিলাম, ‘নিশ্চয়ই৷’

ভাবিলাম, গল্পটা আগাগোড়া ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আবার নূতন করিয়া লিখিব৷


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ