Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

আম্র-তত্ব | প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়

দানাপুর স্টেশনের অনতিদূরে, ইংরাজ টোলায়, লাল টালি আচ্ছাদিত লম্বা ধরনের একখানি একতলা পাকা বাড়ী৷ ইহা রেলওয়ে গার্ডগণের জন্য নির্মিত ‘রেস্ট হাউস’ বা বিশ্রামগৃহ৷ সারি সারি অনেকগুলি প্রকোষ্ঠ—সম্মুখে ও পশ্চাতে লম্বা টানা বারান্দা৷ বাড়ীটির পশ্চাদ্ভাগে, দেশী খোলার ছাপ্পরযুক্ত কয়েকখানি ঘর—তাহার মধ্যে একটি বাবুর্চিখানা, অপর কয়েকখানি ভৃত্যগণের অবস্থানের জন্য৷ সম্মুখভাবে খানিকটা খোলা জমির উপর ফুলের বাগান৷ দুইটি বড় বড় কৃষ্ণচূড়ার গাছ সর্বাঙ্গে ফুল ফুটাইয়া বাতাসে দুলিতেছে বাকিগুলির অধিকাংশই বিলাতী ফুলের ছোট গাছ, দুই একটি দেশী ফুলও আছে৷

আষাঢ় মাস৷ আকাশে মেঘ করিয়া রহিয়াছে৷ সম্মুখের বারান্দায় লোহার খাটে নেটের মশারির মধ্যে গার্ড ডিসুজা সাহেব নিদ্রিত৷ মাঝে মাঝে ফুরফুরে হাওয়ায় সে মশারি কাঁপিয়া উঠিতেছে৷ রাত্রি দুইটার সময় মোগলসরাই হইতে ২৬নং মালগাড়ী লইয়া ডিসুজা সাহেব দানাপুরে আসিয়াছিলেন৷ অদ্য বেলা ১০টায় আবার ১৫ নং লোকাল প্যাসেঞ্জার লইয়া তাঁহাকে মোগলসরাই ফিরিতে হইবে৷

বেলা ৮টা বাজিল৷ রৌদ্র নাই, তাই বেলা বুঝা যাইতেছে না৷ বাঙ্গালার খানসামা নগ্নপদে ধীরে ধীরে আসিয়া সাহেবের শয্যার নিকট দাঁড়াইল৷ লাল ডোরাকাটা কানপুর টুইলের পায়জামা-সুট পরিয়া সাহেব গভীর নিদ্রায় মগ্ন৷ কোটের বুকের অধিকাংশ বোতামই খোলা৷ খানসামা ডাকিল, ‘‘হুজুর৷’’

হুজুরের সাড়া নাই৷

খানসামা আবার ডাকিল, ‘‘আঠ বাজ গিয়া সাহেব—জাগিয়ে৷’’

অবশেষে খানসামা মশারির ভিতর হস্ত প্রবেশ করাইয়া দিয়া, সাহেবের হাঁটু ধরিয়া নাড়া দিয়া বলিল, ‘‘জাগিয়ে হুজুর৷ আঠ বাজ গিয়া৷’’

সাহেব তখন উঃ করিয়া চক্ষু খুলিলেন৷ একটি হাই তুলিয়া, বালিসের নীচে হইতে নিজ বৃহদাকার সরকারী ওয়াচটি বাহির করিয়া দেখিলেন, আটটা বাজিয়া বারো মিনিট৷

সাহেব বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘‘গোসল ঠিক করো৷’’

‘‘ঠিক হায় হুজুর’’—বলিয়া খানসামা চলিয়া গেল৷

সাহেব শয্যা হইতে নামিয়া, কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়া হুক হইতে ঝুলানো নিজ কোটের পকেট হইতে পাইপ, দেশলাই ও তামাকের পাউচ বাহির করিয়া লইলেন৷ ভিতরের বুক পকেটে একখানি চিঠি ছিল, তাহাও বাহির করিলেন৷

একখানি ঈজি চেয়ারে বসিয়া, পাইপ ধরাইয়া, পত্রখানি খুলিয়া সাহেব পড়িত লাগিলেন৷ পত্রখানি মজঃফরপুর স্টেশন মাস্টারের কন্যা, কুমারী বার্থা ক্যাম্বেল কর্তৃক লিখিত৷ বার্থার সহিত ডিসুজা সাহেব বিগত এপ্রিল মাস হইতে বিবাহপণে আবদ্ধ৷ অক্টোবর মাসে ডিসুজা সাহেবের একমাস ছুটি ‘ডিউ’ হইবে—ছুটি হইলেই বিবাহ, ও সিমলা শৈলে গিয়া মধুচন্দ্র-যাপন স্থির হইয়া আছে৷

পত্রখানি আজ তিনদিন হইতে সাহেবের পকেটে পকেটে ঘুরিতেছে৷ ফেরৎ ডাকে উত্তর দিবার জন্য অনুরোধ ছিল, তাহা হইয়া উঠে নাই—আজ উত্তর দিয়া পত্রখানি ডাকে ফেলিতেই হইবে৷

পাইপ শেষ করিয়া, ক্ষৌরকার্য ও স্নানাদি অন্তে সাহেব যখন বাহির হইলেন তখন ৯টা বাজিয়া গিয়াছে৷ মোকামা-মোগলসরাই লোক্যালখানি ঠিক সাড়ে নয়টার সময় দানাপুরে পৌঁছিবে৷ সেই সময় স্টেশনে উপস্থিত হইয়া, ট্রেনের চার্জ বুঝিয়া লইতে হইবে—সুতরাং পত্র লেখার বাসনা পরিত্যাগ করিয়া সাহেব ‘‘হাজারি’’ আনিবার হুকুম করিলেন৷ পত্রলেখার সময় হইল না বলিয়া সাহেবের মনটা কিছু অপ্রসন্ন, তাঁহার মুখভাব হইতে স্পষ্টই ইহা বুঝা যাইতেছিল৷

খাদ্যদ্রব্যের প্রথম কিস্তি টেবিলে আসিল৷ দুইখানি টোস্ট, মাখন ও চা৷ দুইটি ‘আণ্ডা বইল’ ছিল—সাহেব প্রথম ডিম্বটি ভাঙ্গিয়া দেখিলেন—পচা৷ তাহা সরাইয়া রাখিয়া, দ্বিতীয়টি ভাঙ্গিয়া, মাখন ও টোস্ট সহযোগে ভক্ষণ করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘‘ঔর ক্যা হায়?’’

খানসামা উত্তর করিল, ‘‘মটন চাঁপ হায়, ঠানঢা রোস হায়, কারি-ভাত হায়৷’’—বলিতে বলিতে খানসামার সহকারী একটি ঢাকা পাত্রে মটন চাঁপ আনিয়া টেবিলে রাখিল৷

সাহেব ৩/৪ খানি চপ প্লেটে তুলিয়া লইয়া, ছুরি দিয়া কাটিয়া মুখে তুলিলেন৷ খানিক চর্বণ করিয়া বলিলেন, ‘বহুৎ কড়া হায়, মটন নেহি হায়৷’’

খানসামা বলিল, ‘‘গোট-মটন হায় হুজুর—আসল মটন ত আজ মিলা নেহি৷’’

সাহেব দ্বিতীয় একখানি চপ কাটিয়া, চর্বণ করিবার বৃথা চেষ্টার পর রাগিয়া বলিলেন, ‘‘লে যাও৷ ফেঁক দেও৷ কুত্তাকো মৎ দেও—উস্কা দাঁত টুট যায়েগা৷’’

খানসামা প্লেট উঠাইয়া লইয়া সহকারীকে বলিল, ‘‘রোস লাও—কারি ভাত লাও—জলদি৷’’

গত রাত্রে রোস্ট করা লেগ-অব-মটনের কিয়দংশ ছিল, তাহা হইতে টুকরা দুই কাটিয়া সাহেব ভক্ষণ করিলেন—ভাল লাগিল না৷

সাহেব তখন কারি-ভাত-চাহিলেন৷ মুর্গীর কারি—পাত্র হইতে হু-হু করিয়া ধোঁয়া উঠিতেছে৷ প্লেটে লইয়া মুখে দিয়া দেখিলেন, চর্বণ করা তাঁহার কর্ম নয়৷

সাহেব গর্জন করিয়া উঠিলেন, ‘‘ক্যা হুয়া?—ইয়ে ক্যা হায়? ইউ ড্যাম উল্লুকা বাচ্চা, হাম তুমারা উপর রিপোট কর দেঙ্গে—সী ইফ আই ডোন্ট’’—বলিয়া কাঁটা চামচ ফেলিয়া সাহেব উঠিয়া পড়িলেন৷ ঘড়ি দেখিলেন—নয়টা বাজিয়া সাতাশ মিনিট৷ হ্যাট লইয়া বাহির হইয়া দ্রুতপদে স্টেশন অভিমুখে অগ্রসর হইলেন৷

যথাসময়ে ট্রেন দানাপুর ছাড়িল৷ খান পাঁচ ছয় আরোহীগাড়ী, বাকি সমস্তই মাল বোঝাই ওয়াগন৷ প্রত্যেক স্টেশনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া, সন্ধ্যা নাগাদ গাড়ী মোগলসরাই পৌঁছিবে৷

গোটা দুইতিন স্টেশন পার হইলে, ডিসুজা ক্ষুধার তাড়নায় ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল৷ ট্রেনের চার্জ লইবার সময় সে দেখিয়াছিল, ব্রেকভ্যানে মেঝে হইতে গাড়ীর ছাদ পর্যন্ত আমের ঝুড়ি বোঝাই করা আছে৷ এ সময় দ্বারভাঙ্গা অঞ্চল হইতে বিস্তর আম চারিদিকে চালান যাইয়া থাকে৷ সাহেব ভাবিল, গোটাকতক আম বাহির করিয়া ততক্ষণ খাওয়া যাউক৷

এই ভাবিয়া সাহেব ব্রেকভ্যানের দ্বার খুলিল৷ পক্ব ফলের লোভনীয় সুমিষ্ট গন্ধ ক্ষুধার্তের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিল৷

সামনেই একটা বৃহৎ ঝুড়ি—মুখটার উপর আচ্ছাদনখণ্ড দড়ি দিয়া সেলাই করা, সেলাইয়ের ফাঁক দিয়া কালো কালো আমপাতা উঁকি দিতেছে৷ ডিসুজা পকেট হইতে ছুরি বাহির করিয়া, সেলাই কাটিয়া, ভিতরে হাত ভরিয়া দিল৷ প্রথমটা কেবল পাতা, আরও নিম্নে হাত ঢুকাইয়া ডিসুজা একটি আম বাহির করিল৷ দেখিল, বৃহদাকার উৎকৃষ্ট ল্যাংড়া৷ আরও একটা আম বাহির করিয়া, ব্রেকভ্যানের দ্বার বন্ধ করিয়া স্বস্থানে আসিয়া বাক্স হইতে একখানি প্লেট বাহির করিল৷ সাহেব আম দুইটিকে সোরাইয়ের জলে উত্তমরূপে ধৌত করিল৷ তাহার পর সে দুইটি কাটিয়া, পরম পরিতৃপ্তির সহিত ভোজন আরম্ভ করিল৷

ভোজন অর্ধ শেষ হইতেই, গাড়ী আসিয়া কৈলোয়ার স্টেশনে দাঁড়াইল৷ স্টেশন মাস্টার রামতারণ মিত্র ধুতির উপর ছেঁড়া চাপকান পরিয়া ‘গাড়ী পাস’ করিতে আসিয়াছেন৷ ব্রেকভ্যানে আসিয়া বলিলেন, ‘‘গুড মর্নিং মিস্টার ডিসুজা—কিছু পার্শেল-টার্শেল নামবে নাকি?’’

সাহেব আম খাইতে খাইতে বলিল, ‘‘কুছু না৷’’

‘‘বাঃ—বেশ আম ত! খাসা গন্ধ বেরিয়েছে—পার্শেলের আম বুঝি?’’

সাহেব শিরশ্চালনা করিয়া বলিল, ‘‘খাইবে?’’

‘‘দাও না সাহেব৷’’—বলিতে বলিতে রামতারণ বাবু ব্রেকভ্যানে উঠিলেন৷

সাহেব বলিল, ‘‘দরজা খোল৷ ঐ—ঐ সামনের বাস্কেট হইতে দুইটা লও৷’’

রামতারণ বাবু ঝুড়ির আবরণ চাড়া দিয়া তুলিয়া ধরিয়া, এ-পকেটে দুইটা ও-পকেটে দুইটা এবং হাতে দুইটা আম লইয়া বাহির হইলেন৷

সাহেব বলিল, ‘‘পান আছে?’’

‘‘আছে বৈ কি’’—বলিয়া বাবু পকেট হইতে ডিবা বাহির করিয়া, দুইটি পান সাহেবের ‘‘ভ্যানবুক’’ নামক বহিখানির উপর রাখিয়া দিলেন৷ নামিয়া, ঘণ্টা দিতে বলিলেন—গাড়ী ছাড়িল৷

সাহেব হাত ধুইয়া, ড্রাইভারকে সবুজ ঝাণ্ডী দেখাইয়া পান দুটি খাইতে যাইতেছিল, এমন সময় তাহার মনে হইল, ক্ষুধা এখনও ভাঙ্গে নাই, আর গোটা দুই আম খাইলে মন্দ হইত না৷ যেমন ভাবনা—কার্যও সেইরূপ৷ আহারান্তে মুখ হাত ধুইয়া পান খাইতে খাইতে, গাড়ী আরা স্টেশনে আসিয়া দাঁড়াইল৷

আরা অপেক্ষাকৃত বড় স্টেশন—স্টেশন মাস্টার গাড়ী পাস করিতে আসেন নাই—আসিয়াছেন জেনারেল এসিস্ট্যান্ট৷ বাবুটির বয়স হইয়াছে, চোখে রূপার ফ্রেমযুক্ত চশমা৷ ব্রেকভ্যানে উঠিয়া বলিলেন, ‘‘হ্যালো মিস্টার ডিসুজা—ম্যাঙ্গো স্মেলিং—বিউটিফুল৷’’

সাহেব হাসিয়া বলিল, ‘‘ফাইন ল্যাংড়াজ৷ খাইবে?’’

‘‘দাও না সাহেব গোটা কতক৷’’

ডিসুজা সেই ঝুড়ি হইতে গোটা চারি আম বাহির করিয়া বাবুটিকে দিল৷ ব্রেকভ্যান বন্ধ করিয়া স্টেশনের আপিসে গেল—এখানে কয়েকখানা মালগাড়ী কাটিতেছে—দেরি হইবে৷ স্টেশন মাস্টার তখন বাড়ীতে, আহারান্তে নিদ্রাগত৷ তাঁহার পুত্র চারু ও কন্যা কমলা সেখানে খেলা করিতেছিল৷ জেনারেল বাবুর হাতে আম দেখিয়া এবং তাহা ডিসুজা সাহেব দিয়াছে শুনিয়া, চারু ও কমলা বাহানা ধরিয়া বসিল, ‘‘সাহেব, আমরাও আম খাব৷’’—বলিয়া তাহারা সাহেবের হাঁটু ধরিয়া লাফাইতে লাগিল৷

সাহেব বলিল, ‘‘আচ্ছা, তুমিরা হামার জন্যে পান লইয়া আসে৷ হামি আম দিবে৷’’

চারু ও কমলা ডিসুজা সাহেবের জন্য পান আনিতে ছুটিল৷ তাহারা ইহাকে ‘‘পানখেকো সাহেব’’ বলিত৷ পূর্বেও কতবার সাহেবের পান আনিয়া দিয়াছে৷

পান লইয়া, সাহেব ইহাদিগকে ব্রেকভ্যানে লইয়া গিয়া, স্বহস্তে ঝুড়ি হইতে বাহির করিয়া আম দিল৷ ইহারাও ‘‘আরও দাও—আরও দাও’’ করিয়া, কোঁচড় ও অঞ্চল ভরিয়া আম লইয়া, আনন্দে নৃত্য করিতে করিতে গৃহে ফিরিয়া গেল৷

এইরূপে প্রতি স্টেশনে ‘‘দাতব্য’’ করিতে করিতে এবং মাঝে মাঝে খাইতে খাইতে, বেলা ৫টা নাগাইদ ঝুড়িটি প্রায় খালি হইয়া গেল৷ সকলডিহার স্টেশন মাস্টারকে ঝুড়ির ইতিহাস বলিতে বলিতে দুইটি আম দিবার সময় ডিসুজা দেখিল, বড় জোর আর গুটি ১৫/১৬ আম নিম্নে পড়িয়া আছে৷ স্টেশন মাস্টার বাবু বলিলেন, ‘‘তা সাহেব, দিলে দিলে, একটা ঝুড়ি থেকেই সব দিলে কেন? এত ঝুড়ি ত রয়েছে! ভাগাভাগি করে নিলেই ত হ’ত!’’

সাহেব বলিল, ‘‘এ আমগুলি খুব চমৎকার যে! অন্য ঝুড়ির আম কেমন হইত তাহার ঠিক কি?’’

বাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘‘তা বটে৷—আর, পাঁচজনের অভিশাপ কুড়ানোর চেয়ে, একজনের অভিশাপই ভাল৷’’

সাহেব বলিল, ‘‘ঝুড়িটি একেবারেই খালি হইয়া গেল৷ এই খালাসী—লাইন সে থোড়া পাত্থল উঠাও ত৷’’

খালাসী পাথর উঠাইয়া ব্রেকভ্যানের উপর রাখিতে লাগিল৷ অনেকগুলা জমিলে, সাহেবের আদেশ অনুসারে খালাসী উঠিয়া, আমের ঝুড়ি হইতে আমগুলা বাহির করিয়া, পাথর ভরিয়া, তাহার উপর আম, তাহার উপর আমপাতা চাপাইয়া দিল৷ গাড়ী ছাড়িলে সাহেব স্বহস্তে ঝুড়ির মুখ আবার সেলাই করিয়া দিল৷ গুনছুঁচ, দড়ি প্রভৃতি এইরূপ কুকার্যের জন্য গার্ডসাহেবদের বক্সেই মজুত থাকে৷

সন্ধ্যার পূর্বেই ট্রেন মোগলসরাই পৌঁছিল৷

কাজকর্ম সারিয়া, বাড়ী যাইবার পূর্বে ডিসুজা কেলনারের হোটেলে গিয়া এক পেয়ালা চা হুকুম করিয়া, রুটিতে মাখন মাখাইয়া খাইতে আরম্ভ করিয়া দিল৷

চা পানান্তে বাহির হইয়া বাড়ী যাইতেছিল, পথে রেলওয়ে ইনস্টিট্যুটের কাছে দুইজন বন্ধু তাহাকে গ্রেপ্তার করিল৷ বলিল, ‘‘চল, এক হাত পোকরা খেলা যাউক৷’’

ইনস্টিট্যুটে ‘‘পানীয়’’ মিলে, তাহার নগদ দামও দিতে হয় না৷ ডিসুজা সহজেই সম্মত হইল৷

দুই বাজি পোকর খেলিতে ও কয়েক পাত্র হুইস্কি পান করিতে রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল৷ ডিসুজা তখন বলিল, ‘‘বাড়ী যাই—আমার ক্ষুধা পাইয়াছে৷’’—বাড়ীতে কেবল ডিসুজার বৃদ্ধ মাতা আছেন৷

বাঙ্গালায় পৌঁছিয়া ডিসুজা দেখিল, তাহার মাতা রাগিয়া আগুন হইয়া বসিয়া আছেন৷ মেঝের উপর আমের একটি ঝুড়ি, আশে পাশে আম পাতা ছড়ান, একস্থানে গুটি ১৫/১৬ আম, এবং এক বোঝা পাথরের টুকরা৷

মত্ততার অবস্থায় ডিসুজা ব্যাপারটা ঠিক বুঝিতে পারিল না৷

মিসেস ডিসুজা বলিলেন, ‘‘এই যে জন—কোন ট্রেনে ফিরলে?’’

ডিসুজা সে কথার উত্তর না দিয়া বলিল, ‘‘এ—বাস্কেট—কোথা হইতে আসিল?’’

‘‘মজঃফরপুর হইতে৷ আজ দ্বিপ্রহরে তোমার হবুশ্বশুরের পত্র পাইলাম, ১৫০টা ভাল ল্যাংড়া আম পাঠাইতেছেন, খুব সম্ভব ১৫ নম্বরে তাহা এখানে আসিয়া পৌঁছিবে৷ লিখিয়াছিলেন, রসিদ ডাকে আসিতে বিলম্ব হইতে পারে, ১৫ নম্বর আসিলে স্টেশনে লোক পাঠাইয়া যেন ঝুড়িটা আনাইয়া লই৷ ট্রেন পৌঁছিবার আধ ঘণ্টা পরেই আমি স্টেশনে গিয়া বাস্কেট আনিলাম৷ আনিয়া খুলিয়া দেখি—আম সব চুরি গিয়াছে, আমের স্থানে পাথর বোঝাই করিয়া দিয়াছে৷ দেখ দেখি কাণ্ড! কি ভয়ানক কথা! ফিফটিন আপ-এ গার্ড কে ছিল খবর নাও ত!’’

ডিসুজা বলিল, ‘‘ফিফটিন আপ—আমিই ত—লইয়া আসিয়াছি৷’’

‘‘তুমি?—তুমি তবে এতক্ষণ ছিলে কোথা?—তুমি?—তবে আম কে লইল? বোধ হয় দীঘায়—অথবা বাঁকীপুরে—’’

ডিসুজা বলিল—‘‘না—না— ও—ও—আম— আ—আ—আমিই খাইয়াছি৷’’

বৃদ্ধা ইতিপূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন, পুত্র প্রকৃতিস্থ নাই৷ বলিলেন, ‘‘তুমি খাইয়াছ—এই এক ঝুড়ি আম? অসম্ভব!’’

ডিসুজা নিকটস্থ চেয়ারে বসিয়া বলিল, ‘‘বড়ই ক্ষুধা পাইয়াছিল—তাই খা—খা—খাইয়া ফেলিয়াছি৷’’

মাতা বলিলেন, ‘‘ননসেন্স৷ একথা এখন তোমাকে বলিয়া কোনও ফল নাই৷ কল্য প্রাতে এসম্বন্ধে রীতিমত তদন্ত করিয়া, ব্যাপারটা উপরিওয়ালাদের জানাইতে হইবে৷ সহজে আমি ছাড়িতেছি না৷ এতগুলা আম!—রেলের কর্মচারীরা কি চোর! কি পাষণ্ড! ছি ছি ছি!’’


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ