Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

দুধের দাম | বনফুল

ট্রেন আসিয়াছিল৷ কয়েকটি সুবেশা, সুতন্বী, সুরূপা যুবতী স্টেশনে আসিয়াছিলেন৷ তাঁহাদেরই আশেপাশে জনকয়েক বাঙালী ছোকরাও, কেহ অন্যমনস্কভাবে, কেহ বা জ্ঞাতসারে ঘোরাফেরা করিতেছিল৷ ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধা যে একজনের হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া পড়িয়া গেলেন, তাহা কেহ লক্ষ্য করিল না৷ করিবার কথাও নয়, বিদেশাগত শিভ্যালরি জিনিসটা যুবতীদের কেন্দ্র করিয়াই বিকশিত হয়৷ সকলে অবশ্য যুবতীদিগকে লইয়া প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে ব্যস্ত ছিল না৷ যাঁহার হোলড-অলের স্ট্র্যাপে পা আটকাইয়া বুড়ী পড়িয়া গেলেন, তিনি শিক্ষিত ভদ্রলোক, কাছেই ছিলেন৷ তিনি বুড়ীকে স-ধমক উপদেশ দিলেন একটা৷

‘‘পথ দেখে চলতে পার না? আর-একটু হলে আমার স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে যেত যে!’’

বুড়ীর ডান পা-টা বেশ মচকাইয়া গিয়াছিল৷ তবু তিনি খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া প্লাটফর্মময় ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন৷ তাঁহাকে একটা স্থান সংগ্রহ করিতেই হইবে৷ অসম্ভব৷ ট্রেন বেশীক্ষণ থামিবেও না৷ হুড়মুড় করিয়া শেষে তিনি একটা সেকেলে ইন্টার ক্লাসে উঠিয়া পড়িলেন৷ যথারীতি সকলেই হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিল৷ বর্তমানে অবশ্য ইন্টার ক্লাসের নাম বদলাইয়া সেকেন্ড ক্লাস হইয়াছে৷

একজন বাঙালী ভদ্রলোক ইচ্ছা করিলে একটু সরিয়া বসিয়া জায়গা করিয়া দিতে পারিতেন, তিনি জিনিসপত্র সমেত বেশ একটু ছড়াইয়া বসিয়া ছিলেন৷ কিন্তু তিনি সরিয়া বসিলেন না, উপদেশ দিলেন—

‘‘উঠলে ত, এখন বসবে কোথায় বাছা!’’

‘‘আমি নিচে তোমাদের পায়ের কাছে বসব বাবা৷ দুটো স্টেশন মাত্র, তারপরই নেমে যাব৷ বেশীক্ষণ অসুবিধা করব না তোমাদের৷’’

বুড়ী তাঁহার পায়ের কাছেই তাঁহার জুতাজোড়া সরাইয়া দিয়া বসিয়া পড়িলেন৷ অসুবিধা তেমন কিছু হইল না, কারণ বৃদ্ধা ছোটখাটো আয়তনের মানুষ, গুটিসুটি হইয়া বসিয়া ছিলেন৷ একটু পরেই কিন্তু তিনি অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিলেন৷ যে পায়ে স্ট্র্যাপটা আটকাইয়া গিয়াছিল সেই পা-টা বেশ ব্যথা করিতে লাগিল৷ চাহিয়া দেখিলেন, পা ফুলিয়া উঠিয়াছে৷ তাঁহার ভাবনা হইল নামিবেন কী করিয়া৷ আর দুই স্টেশন পরেই শুধু নামিতে হইবে না, আর-একটা ট্রেনে উঠিতেও হইবে৷ অথচ পা নাড়িতে পারিতেছেন না, দাঁড়ানই যাইবে না যে৷ ট্রেনের কামরায় অনেক বাঙালী রহিয়াছেন, অনেকে তাঁহার পুত্রের বয়সী, অনেকে পৌত্রের৷ কিন্তু ইঁহারা যে তাঁহাকে সাহায্য করিবেন, পূর্ব অভিজ্ঞতা হইতে তাহা তিনি আশা করিতে পারিলেন না৷ তবু হয়তো ইঁহাদেরই সাহায্য ভিক্ষা করিতে হইবে৷ উপায় কি!

বৃদ্ধা যে-স্টেশনে নামিবেন, সে-স্টেশন একটু পরেই আসিয়া পড়িল৷ প্যাসেঞ্জাররা হুড়মুড় করিয়া সবাই নামিতে লাগিলেন, বুড়ীর দিকে কেহ ফিরিয়াও চাহিলেন না৷

‘‘আমাকে একটু নাবিয়ে দাও না বাবা, উঠে দাঁড়াতে পাচ্ছি না আমি৷’’

বুড়ীর এই করুণ অনুরোধ সকলেরই কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল৷ কিন্তু অধিকাংশই ভান করিলেন যেন কিছু শুনিতে পান নাই৷

একজন বলিলেন, ‘‘ভিখারী মাগীর আস্পর্ধা দেখেছেন? যাচ্ছে ত উইদাউট টিকিটে, তার উপর আবার—’’

তিনি বৃদ্ধাকে ভিখারিণীই মনে করিয়াছিলেন৷ বৃদ্ধা কিন্তু ভিখারিণী নন, তাঁহার টিকিটও ছিল৷ সেকেন্ড ক্লাসেরই টিকিট ছিল৷

আর একজন বিজ্ঞ মন্তব্য করিলেন, ‘‘এই সব হেল্পলেস বুড়ীকে রাস্তায় একা ছেড়ে দিয়েছে, এর স্বামী ছেলে নেই না কি, আশ্চর্য কাণ্ড!

সিগারেটে টান দিতে দিতে তিনিও নামিয়া গেলেন৷ গাড়িতে যাঁহারা রহিলেন, তাঁহাদের মধ্যে জন-দুই টিফিন-কেরিয়ার খুলিয়া আহারে মন দিয়াছিলেন, বুড়ীর কথা তাঁহাদেরও কর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল কিন্তু সে-কথায় কর্ণপাত করা তাঁহারা সমীচীন মনে করিলেন না৷

বৃদ্ধা তখন দুই হাতে ভর দিয়া ঘ্যাঁসটাইয়া দ্বারের কাছে আসিয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু নামিতে সাহস পাইতেছিলেন না৷

‘‘এই বুড়ী, হটো দরোয়াজাসে—’’

এক মারোয়াড়ী যাত্রী বৃদ্ধার গায়ে প্রায় পদাঘাত করিয়াই ভিতরে প্রবেশ করিলেন৷ তাঁহার পিছনে এক বলিষ্ঠকায় কুলী৷ তাহার মাথায় স্যুটকেশ হোলড-অল৷ কুলীর পিছনে চপ্পল-পায়ে নীল-চশমা-পরা লক্কা গোছের এক ছোকরা৷ সে ভঙ্গীভরে বলিল, ‘‘দয়াময়ি, পথ ছাড়ুন৷ দরজার কাছে বসে কেন!’’

‘‘পায়ে লেগেছে বড্ড বাবা, নামতে পাচ্ছি না৷’’

‘‘ও, দেখি যদি একটা স্ট্রেচার আনতে পারি!’’

ছোকরা ভিড়ে অন্তর্ধান করিল আর ফিরিল না৷

যে বলিষ্ঠ কুলীটা মাল মাথায় করিয়া ঢুকিয়াছিল সে বাহিরে যাইবার জন্য দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল৷

‘‘মাইজি, কিরপা করকে থোড়া হাটকে বৈঠিয়ে৷ আনে-যানেকা রাস্তা পর কাহ বৈঠ গ্যয়ে?’’

বৃদ্ধা হঠাৎ ফুঁপাইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন৷

‘‘আমি নামতে পাচ্ছি না, বাবা, পায়ে চোট লেগেছে—’’

‘‘আপ কাঁহা জায়েগা—?’’

‘‘গয়া—’’

‘‘চলিয়ে, হাম আপকো লে যাতে হেঁ৷’’

বলিষ্ঠ বয়স্ক ব্যক্তি যেমন করিয়া ছোট শিশুকে দুই হাতে করিয়া বুকের উপর তুলিয়া লয়, কুলীটি সেইভাবে বুকে বৃদ্ধাকে তুলিয়া লইল৷ সোজা লইয়া গেল ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে৷

‘‘আপ হিঁয়া পর বৈঠিয়ে মাইজি, গয়া প্যাসেঞ্জারকা থোড়া দেরি হ্যায়৷ হাম ঠিক টাইম পর আকে আপকো ট্রেনমে চড়া দেঙ্গে৷’’

বৃদ্ধা ওয়েটিং রুমের মেঝেতেই উপবেশন করিলেন৷

যে দুইটি ইজিচেয়ার ছিল, সে-দুইটিতেই সাহেবী পোশাক-পরা দুইজন বঙ্গসন্তান হাতলের উপর পা তুলিয়া দিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া ছিলেন৷ একজন পড়িতেছিলেন খবরের কাগজ, আর একজন একখানি ইংরেজী বই৷ বইটির মলাটের উপর অর্ধনগ্না হাস্যমুখী যে নারীমূর্তিটি ছিল, বৃদ্ধার মনে হইল, সেটি যেন তাঁহার দিকে চাহিয়া ব্যঙ্গের হাসি হাসিতেছে৷

সম্ভবত আলোচনাটা পূর্বেই হইতেছিল৷ পুনরায় আরম্ভ হইল৷

‘‘শিভ্যলরি আমাদের দেশেরও ছিল৷ নার্য্যস্তুযত্র পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা, একথা আমাদের মনুতেই লেখা আছে মশাই৷’’

যিনি নারী-মূর্তি-সম্বলিত ইংরেজী মাসিক পড়িতেছিলেন, তিনি সম্ভবত এ খবর জানিতেন না৷ উঠিয়া বসিলেন৷

‘‘বলেন কি! এ-কথা জানলে ব্যাটাকে ছাড়তুম নাকি! মনুর যুগেও যে আমাদের দেশে শিভ্যলরি ছিল, আমরা যে বর্বর ছিলুম না, এ-কথা ভাল করেই বুঝিয়ে দিতুম বাছাধনকে—’’

বৃদ্ধা অনুভব করিলেন ইতিপূর্বে কোন সাহেবের সঙ্গে বোধহয় লোকটির তর্ক হইয়াছিল৷ শ্বেতবর্ণ সাহেব সম্ভবত এই সাহেবী পোশাক-পরা কৃষ্ণচর্ম বঙ্গ-সুন্দরকে বর্বর বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়াছিলেন৷

বৃদ্ধা মনে মনে বলিলেন, ‘‘তোমরা বর্বরই বাছা৷ তোমাদের শিভ্যালরি অবশ্য আছে, কিন্তু তার প্রকাশ কেবল যুবতী মেয়েদের বেলা৷’’

বৃদ্ধার বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজীতে কিঞ্চিৎ দখল ছিল৷ সেকালের বেথুন স্কুলে পড়িয়াছিলেন৷

হঠাৎ দ্বিতীয় ভদ্রলোকটি বৃদ্ধাকে দেখিতে পাইলেন৷

‘‘আরে, এ আবার কোত্থেকে জুটল এসে এখানে?’’

‘‘কোনো ভিখিরী-টিকিরী বোধ হয়৷’’

প্রথম ভদ্রলোক আন্দাজ করিলেন৷

‘‘সত্যি, ভিখিরীতে ভরে গেল দেশটা৷ স্বাধীনতার পর ভিখিরীর সংখ্যা আরও বেড়েছে৷ সবাই আবার মুখ ফুটে চাইতেও পারে না৷’’

দেখা গেল ভদ্রলোকটি একটি পয়সা বাহির করিয়া বুড়ীর দিকে ছুঁড়িয়া দিলেন৷

নির্বাক হইয়া বসিয়া রইলেন বৃদ্ধা৷

‘‘পয়সাটা তুলে নাও, পয়সাটা তোমাকেই দিলাম৷’’

বৃদ্ধা তবু কোনো কথা বলিলেন না৷

দাতা ভদ্রলোকের সন্দেহ হইল বোধহয় বুড়ী বাঙালী নয়৷ তখন রাষ্ট্রভাষা ব্যবহার করিলেন৷ চাকুরির অনুরোধে কিছুদিন পূর্বেই রাষ্ট্রভাষায় পরীক্ষা পাস করিয়াছেন৷

‘‘পয়সা উঠা লেও৷ তুহমী কো দিয়া৷’’

তখন বৃদ্ধা পরিষ্কার বাংলায় বলিলেন, ‘‘আমি ভিখিরী নই বাবা, আমি আপনাদের মত একজন প্যাসেঞ্জার৷’’

‘‘এখানে কেন? এটা যে আপার ক্লাস ওয়েটিং রুম৷’’

‘‘আমার সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট আছে৷’’

পরমুহূর্তে সেই বলিষ্ঠ কুলীটি দ্বারপ্রান্তে দেখা দিল৷

‘‘চলিয়ে মাইজি, গয়া প্যাসেঞ্জার আ গিয়া৷’’

তাহার বলিষ্ঠ বাহুর দ্বারা পুনরায় বৃদ্ধাকে শিশুর মতো বুকে তুলিয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল৷

গয়া প্যাসেঞ্জারে একটু ভিড় ছিল৷ কিন্তু কুলীটি বলিষ্ঠ৷ শক্তির জয় সর্বত্র৷ সে ধমক-ধামক দিয়া বুড়ীকে একটা বেঞ্চের কোণে স্থান করিয়া দিতে সমর্থ হইল৷

বৃদ্ধা তাহাকে দুইটি টাকা বাহির করিয়া দিলেন৷

এই প্রসঙ্গে কুলীর সহিত হিন্দীতে যে কথাবার্তা হইল তাহার সারমর্ম এই 

‘‘আমার মজুরি আট আনা৷ দু টাকা দিচ্ছেন কেন?’’

‘‘তুমি আমার জন্যে এত করলে বাবা, তাই বেশী দিলুম৷’’

‘‘না মাইজি, আমাকে মাপ করবেন৷ আমি ধর্ম বিক্রি করি না৷’’

‘‘তুমি আমার ছেলে বাবা, ছেলের কাজই করেছ৷ আমি তো তোমাকে দুধ খাওয়াইনি, সামান্য যা দিচ্ছি তা দুধের দাম মনে করেই নাও বাবা৷ দীর্ঘজীবী হও, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন৷’’

বৃদ্ধার গলার স্বর কাঁপিয়া গেল৷ চোখের কোণে জল টলমল করিতে লাগিল৷

কুলী ক্ষণকাল হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর প্রণাম করিয়া নামিয়া গেল৷


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ