Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

ভস্মশেষ | প্রেমেন্দ্র মিত্র

বারান্দার এদিকটা সরু৷ নীচে নামবার সিঁড়িরও খানিকটা ভেঙে পড়েছে৷ তবু সন্ধ্যের আগে এই দিকেই চেয়ারগুলো ও টেবিল পাতা হয়—এদিক থেকে দূরে পাহাড় আর নদীর খানিকটা দেখা যায় বলে৷

কৈফিয়ৎটা নিরর্থক৷ পাহাড় আর নদী কেউ দেখে না আজকাল৷ একদিন হয়ত সত্যিই সেই দেখাটা ছিল বড় কথা, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই৷ যা ছিল আনন্দ তা আজ অর্থহীন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷

বারান্দায় এই চেয়ার পাতাটুকু থেকে এ বাড়ির অনেক কিছুর, আরো গভীর কিছুর পরিচয় হয়ত পাওয়া যেতে পারে৷ এই কাহিনী সেইজন্যেই লেখা৷

সবার আগে জগদীশবাবু এসে বসেন৷ নীচু ইজি-চেয়ারটি তাঁর জন্যেই নির্দিষ্ট৷ চেয়ারের দু’ধারের হাতলে সুপুষ্ট হাতদু’টি ও সামনের টুলে পা দু’টি রেখে নিশ্চিন্তে আরামে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা তাঁর পরম বিলাস৷ স্বেচ্ছায় পারতপক্ষে কথা তিনি বড় বলেন না৷ হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন৷

সুরমা একটু পরে আসেন৷ শাড়িতে প্রসাধনে আলুথালু ভাব৷ আলুথালু ভাব বুঝি প্রকৃতিতেও৷ এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন—‘‘এর মধ্যেই ঘুমোলে নাকি?’’

ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবু একটু নড়ে-চড়ে জানান তিনি ঘুমোন নি৷

সে প্রশ্নের জবাবের জন্যে সুরমার অবশ্য কোনো আগ্রহ নেই৷ অভ্যাস মতই প্রশ্নটা করেন, তারপর বেতের মোড়াটিতে বসতে গিয়ে উঠে প’ড়ে হয়ত বলেন—‘‘ওই যা, দোক্তার কৌটোটা ভুলে এলাম৷’’

জগদীশবাবু চক্ষুমুদ্রিত অবস্থাতেই বলেন—‘‘ডাক না চাকরটাকে৷’’

সুরমা আবার বসে পড়ে বলেন—‘‘তাকে যে আবার বাজারে পাঠালাম৷ যাও না গো তুমি একটু৷’’

ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবুর নড়া-চড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে মনে হয় তিনি বোধ হয় শুনতে পান নি অন্তত ওঠবার আগ্রহ তাঁর নেই৷

কিন্তু সত্যি জগদীশবাবু খানিক বাদে বিশেষ পরিশ্রমে ইজি-চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন দেখা যায়৷ জগদীশবাবুর আরামপ্রিয়তা ও আলস্য যত বেশিই হোক স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্ন ও দৃষ্টি তার চেয়ে প্রখর৷

জগদীশবাবুকে কিন্তু কষ্ট করে আর যেতে হয় না৷ বারান্দার সিঁড়িতে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পাওয়া যায়৷

সুরমা বলেন—‘‘থাক, তোমায় আর যেতে হবে না৷ ডাক্তার, আমার দোক্তার কৌটোটা নিয়ে এসে একেবারে ব’সো৷ বিছানার ওপরই বোধ হয় ফেলে এলাম৷ আর ঘরের আলোটা বোধ হয় নিবিয়ে আসি নি৷ সেটা নিবিয়ে দিয়ে এস৷’’

আদেশ নয়, অনুরোধেরই মিষ্টতা আছে কণ্ঠস্বরে, কিন্তু সে মিষ্টতা খানিকটা যেন যান্ত্রিক৷

মিষ্টতা সুরমার সব কিছুতেই এখনো বুঝি অনেকটা আছে—চেহারায়, কণ্ঠস্বরে, প্রকৃতিতে৷ বয়সের সঙ্গে শরীরের সে তীক্ষ্ণ রেখাগুলি দুর্বল হয়ে এলেও তাদের আভাস আলুথালু বেশ ও প্রসাধনের মধ্য দিয়েও পাওয়া যায়৷ সুরমার সৌন্দর্য এখনো একেবারে ইতিহাস হয়ে ওঠে নি৷ অবশ্য ইতিহাস তার আর একদিক দিয়ে আছে—কিন্তু সে কথা এখন নয়৷

ডাক্তারবাবু ঘরের আলো নিবিয়ে, দোক্তার কৌটো নিয়ে এসে, টেবিলের ওধারে সুরমার সামনা-সামনি বসেন—নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরে৷ নদী ও পাহাড়ের দিকে কোনদিনই তাঁর চাইবার আগ্রহ ছিল না৷ বরাবর তিনি এই আসনটিতে এইভাবেই বসে আসছেন৷

সন্ধ্যার অস্পষ্টতাতেও ডাক্তারবাবুকে কেমন অপরিচ্ছন্ন মনে হয়, শুধু পোশাকে ও চেহারায় নয়, তাঁর মনেও যেন একটা ক্লান্ত ঔদাসীন্য আছে সব ব্যাপারে৷ পোশাকের ত্রুটিটাই অবশ্য সকলের আগে চোখে পড়ে ঢিলে রঙচটা পেন্টুলেনের ওপর গলাবন্ধ একটা কোট পরা৷ গলাটা কিন্তু বন্ধ হয়নি বোতামের অভাবে৷ এই কোট পরেই সম্ভবত তিনি সারাদিন রুগী দেখে ফিরবেন৷ একধারের পকেট স্টেথিস্কোপের ভারেই বোধ হয় একটু ছিঁড়ে গেছে৷ গোটাকতক আলগা কাগজপত্র সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে৷ মাথায় চুলের কিছু পারিপাট্যের চেষ্টা বোধ হয় সম্প্রতি হয়েছিল, কিন্তু সে নেহাৎ অবহেলার৷

ডাক্তারবাবুর মুখের ক্লান্ত ঔদাসীন্যের রেখাগুলি শুধু তাঁর চোখের উজ্জ্বলতার দরুনই বুঝি খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নি৷ সমস্ত ঘুমন্ত নিষ্প্রাণ মানুষটির মধ্যে এই চোখ দু’টিই যেন এখানে জেগে আছে পাহারায়৷ কে জানে কি তাদের আছে পাহারা দেবার৷

অনেকক্ষণ কোনো কথাই শোনা যায় না৷ সুরমার পানের বাটা সঙ্গে আছে এবং থাকে৷ তিনি সযত্নে পান সাজায় ব্যস্ত৷ জগদীশবাবু ইজি-চেয়ারে নিশ্চল ভাবে পড়ে আছেন৷ ডাক্তারবাবু নিজের হাতের নখগুলো বিশেষ মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সুরমার পান-সাজা শেষ হবার জন্যেই বোধ হয় অপেক্ষা করেন৷

সুরমার পান-সাজা শেষ হয়৷ সেটি মুখে দিয়েও তিনি কিন্তু খানিকক্ষণ নীরবে সামনের দিকে চেয়ে বসে থাকেন৷ তারপরে হঠাৎ এক সময়ে জিজ্ঞেস করেন—‘‘তোমার সে ফুলের চারা এল ডাক্তার?’’

জগদীশবাবু চোখ বুজে বলেন—‘‘সে চারা আর এসেছে! তার চেয়ে আকাশ-কুসুম চাইলে সহজে পেতে৷’’

সুরমা হেসে ওঠেন৷ বলেন—‘‘তুমি ডাক্তারকে অমন অকেজো মনে কর কেন বল দিকি! সেবার আমাদের জলের পাম্পটা ডাক্তার না ব্যবস্থা করলে হ’ত?’’

ইজি-চেয়ারের ভেতর থেকে ঘুমন্ত স্বরে শোনা যায়—‘‘তা হত না বটে৷ অন্য কেউ ব্যবস্থা করলে হয়ত পাম্পে সত্যিই জল উঠত৷’’

তিনজনেই এ রসিকতায় হাসেন৷ এ বাড়ির এটি একটি পুরাতন পরিহাস৷

সুরমা বলেন—‘‘সত্যি, তুমি কি করে ডাক্তারি কর তাই ভাবি! লোকে বিশ্বাস করে তোমার ওষুধ খায়?’’

‘‘খাবে না কেন, একবার খেলে আর অবিশ্বাসের সময় পায় না ত৷’’

সুরমা হাসতে হাসতে পানের বাটা খুলে জিভে একটু চুন লাগিয়ে বলেন—‘‘তোমার বাপু ডাক্তারের ওপর একটু গায়ের জ্বালা আছে৷ তুমি ওর কিচ্ছু ভালো দেখতে পাও না৷’’

‘‘সেটা ওঁর চোখের দোষ, অনেক ভালো জিনিসই উনি দেখতে পান না৷’’—ডাক্তারের মুখে এতক্ষণে কথা শোনা যায়৷

সুরমা হেসে বলেন—‘‘তা সত্যি৷ চোখ বুজে থাকলে আর দেখবে কি করে৷’’

‘‘চোখ বুজে থাকি কি সাধে! চোখ খুলে থাকলে কবে একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যেত!’’

সুরমা ও জগদীশবাবুর উচ্চ হাসির মাঝে ডাক্তারবাবুর নিস্তব্ধতাটা যেন একটু বিসদৃশ ঠেকে৷ সুরমার মুখের দিকে চেয়ে ডাক্তারের চোখে একটু বেদনার ছায়া এখনো দেখা যায় কি?

সুরমা হাসি থামিয়ে বলেন—‘‘ওই যা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, তোমায় এখন কিন্তু একবার উঠতে হবে ডাক্তার৷’’

‘‘এখনি? কেন?’’

‘‘এখনি না উঠলে হবে না৷ দাদা কি-সব পার্সেল করেছেন৷ স্টেশনে কাল থেকে পড়ে আছে,—উনি একবার তবু সারাদিনে সময় করে যেতে পারলেন না৷ তোমায় এখন গিয়ে ছাড়িয়ে আনতেই হয়!’’

ডাক্তারবাবু একটু ইতস্তত করে বলেন—‘‘কাল সকালে গেলে হয় না?’’

‘‘হয় না আবার! একমাস পরে গেলেও হয়! জিনিসগুলো খোয়া যাবার পর গেলে আরো ভালো হয়৷’’—সুরমার কণ্ঠে মিষ্টতার চেয়ে এবার ঝাঁঝটাই বেশ স্পষ্ট৷

‘‘এক রাত্তিরেই খোয়া যাবে কেন?’’—ডাক্তারবাবু একটু সঙ্কুচিতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন৷

সুরমা বেশ একটু উচ্চস্বরেই বলেন—‘‘তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারি না বাপু! সোজাসুজি বলই না তার চেয়ে যে, পারবে না! তোমায় বলা-ই ঝকমারি হয়েছে আমার৷’’

ডাক্তারবাবু এবার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উঠে পড়েন,—‘‘আমি কি যাব না বলেছি? ভাবছিলুম একটা রাত্তির বই ত না৷’’

‘‘রাতটা কাটিয়ে গেলেই বা তোমার কি এমন সুবিধে! এমন কিছু কাজ ত আর হাতে নেই, চুপ করে বসেই ত থাকতে৷’’

সে কথা মিথ্যে নয়৷ ডাক্তার শুধু চুপ করে বসে থাকতেই এখানে আসেন৷ চুপ করে বসে আছেন আজ বহু বৎসর ধরে৷

ডাক্তার টুপিটা তুলে নিয়ে একবার তবু বলেন,—‘‘আসুন না জগদীশবাবু আপনিও! গাড়িটা ত রয়েছে, একটু ঘুরে আসা হবে৷’’

জগদীশবাবুর আগে সুরমাই আপত্তি করেন—‘‘বেশ কথা! আমি একলা বসে থাকি এখানে তাহলে!’’

ডাক্তার একটু হেসে বলেন—‘‘আরে! তুমিও এস না!’’

‘‘তার চেয়ে বাড়ি-সুদ্ধ পাড়া-সুদ্ধ সবাই একটা পার্সেল আনতে গেলেই হয়! সত্যি তুমি দিন দিন যেন কি হচ্ছ!’’

ডাক্তার আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান৷

‘‘দিন দিন কি যেন হয়ে যাচ্ছ!’’ মোটরে চড়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ডাক্তার সে কথা ভাবেন কি? না বোধ হয়৷ ভাবনা ও আবেগের উদ্বেল সাগর বহুদিন শান্ত নিথর হয়ে গেছে৷ সে সব দিন এখন আর বোধহয় মনেও পড়ে না৷ স্মৃতির সে সমস্ত পাতাও বুঝি অনেক তলায় চাপা পড়ে আছে৷ জীবনের একটি বাঁধা ছকে তিনি খাপ খেয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে৷ আগুন কবে ভস্মশেষ রেখে একেবারে নিবে গেছে তা তিনি জানতেই পারেন নি৷

আগুন একদিন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল বইকি! কিন্তু সে যেন আর এক জনের কাহিনী, সে অমরেশকে তিনি শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে এখন চিনতে পারেন৷ তার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ তাঁর নেই৷

একদিন একটি ছেলে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে পরম দুঃসাহসভরে দাঁড়াতে দ্বিধা করে নি৷

মেয়েটি ভীতস্বরে বুঝি একবার বলেছিল, সুযোগ পেয়ে—‘‘তুমি এখানে চলে এলে!’’

‘‘আরে অনেক দূরে যেতে পারতাম!’’

‘‘কিন্তু—?’’

‘‘কিন্তু এঁরা কি ভাববেন মনে করছ? তার চেয়ে তুমি কি ভাবছ সেইটেই আমার কাছে বড় কথা৷’’

‘‘আমি ত...’’, মেয়েটি নীরবে মাথা নীচু করেছিল৷

অমরেশ তার মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলেছিল—‘‘তোমার ভাববার সাহস পর্যন্ত নেই সুরমা!’’

সুরমা মুখ তুলে মৃদুস্বরে বলেছিল—‘‘না৷’’

‘‘সেই সাহস সৃষ্টি করতেই আমি এসেছি সুরমা৷ সেই সাহসের জন্যে আমি অপেক্ষা করব৷’’

সুরমা চুপ করে ছিল৷ অমরেশ আবার বলেছিল—‘‘ভাবছ, কতদিন—এমন কতদিন অপেক্ষা করতে পারব? দরকার হলে চিরকাল৷ কিন্তু তা বোধ হয় হবে না৷’’

জগদীশবাবু বুঝি সেই সময়ে ঘরে ঢুকেছিলেন৷ তাঁর চেহারায় এখনকার সঙ্গে তখনো বুঝি বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না৷ বেঁটে গোলগাল মানুষটি৷ শান্ত নিরীহ চেহারা৷ একেবারে নীচের ধাপ থেকে সংগ্রাম করে তিনি যে সাংসারিক সিদ্ধি বলতে লোকে যা বোঝে তাই লাভ করেছেন, তাঁর চেহারায় তার কোনো আভাস নেই৷ দেখলে মনে হয় ভাগ্য তাঁকে চিরদিন বুঝি অযাচিত অনুগ্রহ করেই এসেছে৷ সুরমা-সম্পর্কে সে কথা হয়ত মিথ্যাও নয়৷

তিনি ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—‘‘এখনও ট্রেনের জামা-কাপড় ছাড়েন নি? না না, এখন ছেড়ে দাও সুরমা৷ সারারাত ট্রেনের ধকল গেছে৷ স্নান করে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আগে৷’’

অমরেশ হেসে বলেছিল,—‘‘ছেড়ে না দেওয়ার অপরাধটা আমার—ওঁর নয়৷’’

জগদীশবাবু উচ্চস্বরে হেসেছিলেন৷ হাসলে তাঁকে এত কুৎসিত দেখায় অমরেশও ভাবতে পারে নি৷ সুরমার পেছনে তাঁর এই হাস্য-বিকৃত মুখটা সে উপভোগ করেছিল বেদনাময় আনন্দে—

তারপরে উঠে পড়ে বলেছিল—‘‘আচ্ছা এখন ওঠাই যাক৷’’

জগদীশবাবু সঙ্গে যেতে যেতে বলেছিলেন—‘‘বড় অসময়ে এলেন অমরেশবাবু৷ এই দারুণ গ্রীষ্মে এখানে কিছু দেখতে পাবেন না৷ বাইরে বেরুনই দায়৷’’

‘‘সেটা দুর্ভাগ্য নাও হতে পারে!’’ জগদীশবাবুর বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে আবার বলেছিল—‘‘তা ছাড়া গ্রীষ্ম ত একদিন শেষ হবে৷’’

‘‘তখন আপনাকে পাচ্ছি কোথায়!’’ জগদীশবাবুর স্বরে বুঝি একটু সন্দেহের রেশ ছিল৷

‘‘পাবেন বই কি৷ হয়ত বড় বেশি পাবেন৷’’

অমরেশ ডাক্তার মিথ্যে বলেনি৷ সত্যই একদিন এই ধূলিমলিন দরিদ্র শহরের একটি রাস্তার ধারে অমরেশ ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল৷

জগদীশবাবু বলেছিলেন—‘‘বিলিতি ডিগ্রির খরচ উঠবে না যে ডাক্তার! এ জঙ্গলের দেশে আমাদের মত কাঠুরের পোষায় বলে কি তোমার পোষাবে?’’

অমরেশ ডাক্তার হেসে বলেছিল—‘‘কাঠের কারবার আর ডাক্তারি ছাড়া আর কি পোষাবার কিছুই নেই?’’

অমরেশ ডাক্তারকে রোগীর ঘরে দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, জগদীশবাবুর বাড়ির সরু বারান্দাটিতে প্রতিদিন তারপর দেখা গেছে৷

‘‘চেয়ারটা ঘুরিয়ে বোস ডাক্তার৷’’—জগদীশবাবু বলেছেন৷

‘‘কেন? আপনার ওই নদী আর পাহাড় দেখবার জন্যে? আপনার ট্রেডমার্ক পড়ে ওর সব দাম নষ্ট হয়ে গেছে৷’’

‘‘মড়া কেটে কেটে মনটাও তোমার মরে গেছে ডাক্তার!’’

জগদীশবাবু তারপরেই আবার জিজ্ঞেস করেছেন অবাক হয়ে—‘‘উঠলে কেন সুরমা?’’

‘‘আসছি৷’’—বলে সুরমা মুখ নীচু করে ভেতরে চলে গেছে৷

অমরেশ ডাক্তার অদ্ভুতভাবে হেসে বলেছে—‘‘মেয়েরা কাটা-কাটির কথা সইতে পারে না, না জগদীশবাবু?’’

জগদীশবাবু কোনো উত্তর দেন নি৷ গম্ভীর মুখে কি যেন তিনি ভাবছেন মনে হয়েছে৷

অমরেশ ডাক্তার আবার বলেছে—‘‘ওইটুকু ওদের করুণা!’’

জগদীশবাবু গম্ভীরভাবে বলেছেন—‘‘সেটুকু পাবারও সবাই যোগ্য নয়৷’’

ডাক্তারের আসা-যাওয়া গোড়ায় হয়ত এ বাড়ির উৎসাহ পায় নি৷ কিন্তু ক্রমে তা সয়ে গিয়েছে—সহজ হয়ে এসেছে জগদীশবাবুর কাছেও বুঝি৷

‘‘কদিন আমায় জঙ্গলেই থাকতে হবে ডাক্তার৷ গুনতির সময়ে না থাকলে চলে না৷ দেখাশুনো কোরো৷ তোমায় অবশ্য বলতে হবে না৷’’

ডাক্তার হেসে বলেছে—‘‘না, তা হবে না৷ আসতে বারণ করেও দেখতে পারেন!’’

জগদীশবাবু হেসেছেন৷ সুরমাও হেসেছে, হাসলেই হয়ত তার মুখ লাল হয়ে ওঠে৷ লাল হবার আর কোনো কারণ নেই বোধ হয়৷

কিন্তু সুরমাই একদিন তীব্র স্বরে বলেছে—‘‘আমি কিন্তু আর সইতে পারছি না!’’

‘‘পারবে না-ই ত আশা করি৷’’

‘‘না না, তুমি এখান থেকে যাও৷ এমন করে নিজেকে ও আমাকে মেরে কি লাভ?’’

‘‘বাঁচবার পথ ত খোলা আছে এখনো!’’

‘‘সে পথ যখন আগে নেওয়া হয় নি...’’

‘‘সে অপরাধ ত আমার নয় সুরমা৷ তুমি তোমার নিজের মন জানতে না, আমি জানতাম না সুযোগের মূল্য৷ ভাগ্যের নিষ্ঠুর রসিকতাকে তাই বলে মেনে নিতে হবে কেন!’’

‘‘তুমি কি বলছ জান না! তা হয় না! তা হয় না!’’ সুরমার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আবেগে৷ 

‘‘অপরাধের কথা ভাবছ? অপরাধ করার চরম দামও যার জন্যে দেওয়া যায় এমন বড় জিনিস কি নেই?’’

‘‘আমি বুঝতে পারি না৷ আমার ভয় হয়!’’

‘‘বুঝতে পারবে, সেই প্রতীক্ষাতেই ত আছি৷’’

প্রতীক্ষা একদিন বুঝি সার্থক হল বলে মনে হয়েছে৷ জগদীশবাবুর কাঠের কারবারের জন্যে জমা নেওয়া বিস্তীর্ণ জঙ্গল সেদিন তারা দেখতে গেছল৷ অরণ্যের রহস্যঘন আবেষ্টনে সারাদিন রাজসূয় ‘চড়িভাতি’র উত্তেজনাতেই কেটেছে৷ বিকেলের দিকে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল৷

অমরেশ ও সুরমা পথহীন অরণ্যে সকলের থেকে কেমন করে আলাদা হয়ে গেছে৷ আলাদা হওয়াটা হয়ত সম্পূর্ণ দৈবাৎ নয়, অমরেশেরও তাতে হয়ত হাত ছিল৷

সুরমা খানিকক্ষণ বাদে বলেছে—‘‘এ জঙ্গলে কিন্তু পথ হারাতে পারে!’’

‘‘পথ জঙ্গলে ছাড়াও হারানো যায়!’’

সুরমা একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলেছে—‘‘সব সময়ে তোমার এ ধরনের কথা ভালো লাগে না৷’’

‘‘কোথাও তোমার ব্যথা আছে বলেই ভালো লাগে না৷ নিজের কাছে তুমি ধরা দিতে চাও না বলেই এসব কথা তোমার অসহ্য৷’’

সুরমা নীরবে খানিক দূর এগিয়ে গেছে৷ অরণ্যের পশ্চাৎ-পটে তার দীর্ঘ সুঠাম দেহের গতিভঙ্গিতে বুঝি বনদেবীরই মহিমা ও মাধুর্য৷ সেটুকু উপভোগ করবার জন্যেই বুঝি খানিকক্ষণ নিঃশব্দে অমরেশ দাঁড়িয়ে থেকেছে৷ তারপর কাছে গিয়ে বলেছে—‘‘এ জঙ্গলে হারাবার বদলে পথ আমরা পেতেও পারি৷’’

সুরমা তবু নীরব৷

হঠাৎ তার একটা হাত ধরে ফেলে অমরেশ বলেছে—‘‘চুপ করে থেকো না সুরমা৷ বলো, আজ তোমার অটলতার গৌরব আর নেই—আছে শুধু দুর্বলতার লজ্জা৷ এ সম্বল নিয়ে চিরদিন বাঁচা যায় না, বাঁচা উচিত নয় সুরমা৷’’

সুরমা প্রায়-অস্পষ্ট স্বরে বলেছে,—‘‘আমি কি করতে পারি বলো!’’

একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর পা দিয়ে অমরেশ বলেছে—‘‘এই কাটা গাছটা দেখছ সুরমা! কাঠের কারবারে এর একটা দাম মিলেছে কিন্তু তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে আসল দাম এর ছিল! তুমিও কারবারের কাঠ নও সুরমা, তুমি অরণ্যের৷’’

সুরমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমরেশ আবার বলেছে,—‘‘সহজ করে কথা আজ বলতে পারছি না বলে ক্ষমা কোরো সুরমা৷ মনের ভেতরেই আজ আমার সব জড়িয়ে গেছে৷’’

সুরমা অমরেশের আরো কাছে সরে এসেছে, বুকের ওপর মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ধরা গলায় বলেছে—‘‘তুমি আমায় সাহস দাও৷’’

কিন্তু চলে যাওয়া তাদের তখন হয়ে ওঠেনি৷ বাধা এসেছে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে৷ জগদীশবাবু হঠাৎ অসুখে পড়েছেন—গুরুতর অসুখ৷ সুরমা ও অমরেশ দিনরাত্রি বিনিদ্র হয়ে রোগ-শয্যার পাশে জেগেছে আর শান্তভাবে প্রতীক্ষা করেছে মুক্তিক্ষণের৷ আর বেশিদিন নয়৷ এই তাদের শেষ পরীক্ষা, নূতন জীবনের এই প্রথম মূল্যদান৷

জগদীশবাবু ভালো হয়ে উঠেছেন, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর কিছুদিন, আর কয়েকটা দিন! ছোটখাট বাধা, ঘাটের নোঙর একেবারে তুলে ফেলতে সুরমার সামান্য একটু বিহ্বলতা৷ এটুকু সময় তাকে দেওয়া যেতে পারে,—নিজের ভেতর থেকে বল পাওয়ার সময়৷ অমরেশ কোথাও এতটুকু জোর খাটাতে চায় না, সব শিকড় আপনা থেকে আলগা হয়ে আসুক, সব বন্ধন খুলে যাক৷ অসীম তার ধৈর্য৷

অমরেশ ডাক্তার অপেক্ষা করেছে—কিছু দিন—অনেক দিন অপেক্ষা করেছে৷

বড় বেশি দিন অপেক্ষা করেছে৷

ধীরে ধীরে কখন আগুন গিয়েছে নিবে৷ কখন আর-বছরের পাপড়ির মত সে ম্লান শুকনো বিবর্ণ হয়ে গেছে,—তারা সবাই বিবর্ণ হয়ে গেছে৷ বিবর্ণ আর সুলভ আর সাধারণ৷ অভ্যাসের ছাঁচে তারা বদ্ধ হয়ে গেছে, জীর্ণ মলিন হয়ে গেছে সংসারের ধূলায়৷

সবচেয়ে মলিন বুঝি ডাক্তার, সবচেয়ে মলিন আর ক্লান্ত৷ আগুন তার মধ্যে অমন লেলিহান হয়ে জ্বলেছিল বলেই সবার আগে তার সব পুড়ে ছাই হয়েছে৷ ডাক্তার তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে এখানে রোজ বসে, নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরে৷ কিন্তু সে শুধু অভ্যাস৷ ডাক্তার স্টেশনে পার্সেল খালাস করতে ছোটে, সে শুধু দুর্বল আজ্ঞাবাহিতা৷


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ