আজকাল শার্লক হোমসের সঙ্গে আমার দেখাশোনা বড় হয় না। সংসারের নানান ঝামেলা, তার ওপর ডাক্তারি প্র্যাকটিসের চাপ। আমার দম ফেলবার ফুরসত নেই। আর হোমসও খুব ঘরকুনো লোক। বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যাওয়া তার ধাতে নেই। বেকার স্ট্রিটের বাসায় নিজের বইপত্তরের মধ্যে ডুবে থাকতেই সে ভালবাসে। যদিও তার জীবনের লক্ষ্য হল অপরাধের হেস্তনেস্ত করে অপরাধীকে ধরা এই কাজের প্রয়োজন ছাড়া সে ঘর থেকে মোটেই বের হতে চায় না। হোমসের ক্ষুরধার বুদ্ধি, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা আর খুবই তুচ্ছ সূত্র ধরে বেশ জটিল রহস্যের সমাধান করে ফেলবার কায়দা লন্ডনের বিশাল পুলিশবাহিনীকে মাঝে মাঝে রীতিমতো চমকে দেয়। আর পাঁচজনের মতোই আমিও এখন শার্লক হোমসের কীর্তি-কাহিনীর সংবাদ পাই খবরের কাগজের মারফত। একদিন দেখলাম যে, ট্রেপফ খুনের কিনারা করতে হোমস ওডেসায় গেছে। কিছুদিন পরে আবার দেখলাম যে, হোমস ট্রিনকোমালি গেছে অ্যাটকিনসন ভাইদের রহস্য সমাধান করতে। আর এই সেদিন দেখলাম যে, ইংল্যান্ড রাজবংশের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ অথচ একান্ত গোপনীয় একটা ব্যাপারের সুচারু সমাধান করেছে হোমস।
একদিন রাত্তিরে—সঠিক তারিখটা হল ২০ মার্চ ১৮৮৮—আমি রুগি দেখতে গিয়েছিলাম। রুগি দেখে বাড়ি ফেরবার সময় হঠাৎ খেয়াল হল যে আমি বেকার স্ট্রিট ধরে হাঁটছি। পুরনো বাসার দরজার কাছে এসে আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম একবার শার্লক হোমসের খবরাখবর নেওয়া যাক। কেমন আছে? কী করছে? রাস্তা থেকে আমি দেখতে পেলাম তাঁর ঘরে বেশ জোরালো আলো জ্বলছে। নজরে পড়ল তার রোগা লম্বা শরীরের ছায়া বার-দুয়েক জানলার কাচে পড়েই সরে গেল। বুঝলাম হোমস ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। শার্লক হোমসকে আমি যত ভাল ভাবে চিনি তত ভাল ভাবে তাকে আর কেউ চেনে না। তার ওই ভাবে বুকের ওপর আড়াআড়ি দু’হাত রেখে ঘরের ভেতর অস্থির ভাবে পায়চারি করা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম যে, নতুন কোনও তদন্তের ভার হাতে নিয়ে সেই রহস্যের নেশায় সে এমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আমি দরজার বেল টিপলাম আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমার পুরনো ঘরে গিয়ে দাড়ালাম।
যদিও আমাকে দেখে হোমস বিন্দুমাত্র উচ্ছাস দেখাল না তবুও আমি বুঝলাম যে, আমার আসায় সে খুবই খুশি হয়েছে। একটা চেয়ার টেনে বসতেই হোমস আমার দিকে সিগারের বাক্সটা এগিয়ে দিল। আমি একটা সিগার ধরালাম। তারপর সে আমার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ফায়ার প্লেসের আগুনের দিকে একদৃষ্টিতে বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “ওয়াটসন, তুমি এখন দিব্যি আরামে আছ দেখছি। যা ছিলে তাঁর চেয়ে অনেক মোটা হয়েছ। ওজন কত বাড়ল ? সাড়ে সাত পাউন্ড তো হবেই—”
“সাত পাউন্ড”, আমি জবাব দিলাম।
“না; আমার মনে হচ্ছে আর একটু বেশি হবে। দেখছি তুমি পুরোদমে প্র্যাকটিস শুরু করে দিয়েছ। প্র্যাকটিস করবার মতলব কিন্তু তুমি আমার কাছে কখনও বলোনি।”
“তা হলে তুমি জানলে কী করে,” আমি বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।
“আমি দেখতে জানি তাই জানতে পারি। আচ্ছা বলো তো দু’-তিন দিন আগে তুমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলে কিনা? আর তোমার ঘরের কাজ করার লোকটি যেমন অলস তেমনই ফাঁকিবাজ কিনা?”
“হোমস,” আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “এটা তোমার ভয়ানক রকম বাড়াবাড়ি হচ্ছে। তুমি যদি আজ থেকে দু’-তিনশো বছর আগে জন্মাতে লোকে তোমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারত। তুমি ঠিকই বলেছ, গত বৃহস্পতিবার আমাকে একটু পল্লি অঞ্চলে যেতে হয়েছিল আর আমি যাকে বলে কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। কিন্তু আমার আজকের পোশাক দেখে সে কথা তুমি জানলে কী করে? আর ঘরের কাজের মেয়েটির কথা যদি বলো তো তাকে এই মাস গেলেই ছাড়িয়ে দেব ঠিক করেছি। কিন্তু তার কাণ্ডও তো তোমার জানবার কথা নয়।”
হোমস খুশিতে হাত ঘষতে ঘষতে নিজের মনে হাসতে লাগল।
“আরে এ তো জলের মতো সোজা। তোমার বাঁ পায়ের জুতোর যেখানটায় ফায়ারপ্লেসের আগুনের আভা পড়েছে সেখানটায় দেখছি চামড়ার ওপর পর পর ছটা লম্বা আঁচড় টানা। বোঝাই যায় যে, অত্যন্ত যা তা করে দায়সারা ভাবে কেউ শক্ত কোনও কিছু দিয়ে জুতোয় লেগে থাকা শুকনো কাদা তুলতে চেষ্টা করেছে। আর এর থেকে আমি দুটো সিদ্ধান্ত করলাম। এক, তুমি ঝড় জলে ভিজেছিলে। আর তোমার কাজের লোকটি লন্ডন শহরের প্রধান অকর্মাদের একজন। আর তুমি যে ডাক্তারি করছ তার প্রমাণ পেলাম তুমি ঘরে পা দিতেই। যদি কোনও লোক ঘরে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গে আইডোফর্মের গন্ধে ঘর ভরে যায়, যদি তার ডান হাতের তর্জনীতে সিলভার নাইট্রেটের কালো দাগ লেগে থাকে, আর তার মাথার লম্বা টুপির একদিকটা স্টেথিসকোপ গুঁজে রাখার জন্যে ফুলে থাকে, আর এই সব দেখেও আমি যদি বুঝতে না পারি যে, সে একজন রুগিদেখা ডাক্তার তা হলে স্বীকার করতে হবে যে, আমার মতো মাথা-মোটা লোক লন্ডন শহরে আর দুটি নেই।”
হোমসের কথা শুনে আমি না হেসে পারলাম না।
“দেখো হোমস, তুমি যখন সব ব্যাপার বেশ করে বুঝিয়ে বলো তখন মনে হয় এ সব তো জলের মতো সহজ। এটা তো আমারও বলতে পারা উচিত ছিল। কিন্তু প্রত্যেক বারই তোমার কথা শুনে কেমন বোকা বনে যাই। অথচ ভগবান আমাকে তো তোমারই মতন এক জোড়া চোখ দিয়েছেন।”
“ঠিক কথা।” মৌজ করে পাইপ ধরাতে ধরাতে হোমস উত্তর দিল, “আসলে তোমরা সবকিছুই চোখ দিয়ে ওপর ওপর দেখো, মন দিয়ে গভীর ভাবে দেখো না। যেমন ধরো আমাদের একতলা থেকে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে তুমি কত বার ওঠানামা করেছ।”
“অসংখ্য বার।”
“তবু?”
“কয়েক শো বার তো হবেই।”
“ভাল কথা। বলো তো সিঁড়িতে কটা ধাপ আছে?”
“কটা ধাপ আছে? মানে…মানে…।”
“দেখলে তো। তাঁর মানে তুমি ভাল করে দেখোনি। আমি দেখেছি। ঠিক সতেরোটা ধাপ আছে। যাক গে। তুমি আমার ছোটখাটো রহস্য সমাধানের উৎসাহী সহকারী আর লেখক বলে তোমার এটা দেখা দরকার,” এই বলে হোমস টেবিল থেকে একটা খোলা চিঠি তুলে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিল। “চিঠিটা আজ বিকেলের ডাকে এসেছে।”
চিঠিটায় না আছে তারিখ না আছে লেখকের নাম বা ঠিকানা।
চিঠিটা এই রকম: “আজ রাত্তিরে পৌনে আটটা নাগাদ এক ভদ্রলোক বিশেষ গুরুতর একটি সমস্যার সমাধানের জন্য আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। কিছুদিন আগে ইউরোপের কোনও রাজবংশের সুনাম বজায় রাখতে আপনি যে কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তার থেকে আমরা বুঝেছি যে, এই ধরনের গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার আপনাকে স্বচ্ছন্দে দেওয়া যায়। আপনার এই দক্ষতার কথা শুনেছি আমরা অনেক জায়গা থেকে। ওই সময়ে অবশ্যই বাড়ি থাকবেন। আর আগন্তুক যদি মুখোশ পরে থাকেন তো কিছু মনে করবেন না।”
চিঠিটা পড়ে আমি বললাম, “এ তো দেখছি রীতিমতো রহস্য। রহস্যটা কী ধরনের কিছু অনুমান করতে পেরেছ নাকি?”
“আমার হাতে কোনও তথ্য নেই। আর তথ্য ছাড়া সিদ্ধান্ত করাটা মস্ত ভুল। তাতে হয় কী, তথ্য অনুযায়ী সিদ্ধান্ত না করে তথ্যগুলোকে আমরা মনগড়া সিদ্ধান্তের মতো করে নিতে চাই। সে কথা থাক। এখন এই চিঠিটা থেকে তুমি কী সিদ্ধান্ত করতে পারো বলো।”
আমি খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠির কাগজ আর হাতের লেখা পরীক্ষা করে হোমসকে নকল করে বললাম, “এই চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি খুব ধনী লোক। এ চিঠির কাগজ যে রকম পুরু আর শক্ত তাতেই বোঝা যায় যে এটা দামি কাগজ।”
“ঠিক বলেছ। কাগজটা খুব পুরু আর শক্ত। আসলে এটা কোনও ব্রিটিশ কোম্পানির তৈরি কাগজই নয়। কাগজটা আলোর সামনে ধরো তো।”
কাগজটা আলোর সামনে ধরতেই নজরে পড়ল কাগজের মধ্যে জলছাপে প্রথমে বড় হাতের E ছোট হাতের g তারপরে বড় হাতের P আর সব শেষে বড় হাতের G আর ছোট হাতের t লেখা।
“এর থেকে কী বুঝলে?” হোমস আমাকে জিজ্ঞেস করল।
“হয় প্রস্তুতকারকের নাম না-হয় তার মনোগ্রাম।”
“না, তা নয়। Gt হচ্ছে জার্মান Geselleschaft-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, মানে ‘কোম্পানি’। ইংরেজিতে যেমন আমরা Co লিখি তেমনি। P হচ্ছে Papier, কাগজ। এখন Egটা কী হতে পারে? দেখি তো কন্টিনেন্টাল গেজেটিয়ারখানা,” বলতে বলতে হোমস বইয়ের শেলফ থেকে একটা মোটা বই নিয়ে এসে তার পাতা ওলটাতে লাগল। “এগলো..এগলোনিৎস…এই যে পেয়েছি এগরিয়া। বোহেমিয়ায় একটা জার্মানভাষী অঞ্চল। কার্লসবাডের খুব কাছে। জায়গাটা ভালেনস্টাইনের হত্যাস্থল বলে পরিচিত। এ ছাড়াও বহু কাচের কারখানা ও কাগজের কল আছে। কী বন্ধু, কেমন হল?” খুশিতে আটখানা হয়ে হোমস একমুখ পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে দিল।
“তা হলে বোঝা গেল কাগজটা বোহেমিয়ায় তৈরি।” আমি বললাম।
“হ্যাঁ। আর এই চিঠি যিনি লিখেছেন তিনি জার্মান। এই যে লিখেছেন ‘আপনার এই দক্ষতার কথা আমরা শুনেছি অনেক জায়গা থেকে’—এই ধরনের বাক্য জার্মান ভাষারই বিশেষত্ব। কোনও ইংরেজ, ফরাসি বা রাশিয়ান এ ধরনের বাক্য লিখবে না। এখন প্রশ্ন হল এই জার্মান ভদ্রলোক যিনি বোহেমিয়ায় তৈরি কাগজে চিঠি লেখেন, মুখোশের আড়ালে মুখ ঢাকতে পছন্দ করেন, তিনি আমাদের কাছে কী চান। আর, আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে তো ওই তিনি আসছেন।”
হোমসের কথা শেষ না হতেই আমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাথ ঘেঁষে খপখপ আওয়াজ করতে করতে একটা ঘোড়ারগাড়ি এসে থামায় হোমস শিস দিয়ে উঠল।
“শব্দ শুনে মনে হল দু’-ঘোড়ায় টানা গাড়ি” বলে হোমস জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল। “ভারী সুন্দর একটা ছোট্ট ব্রুহাম গাড়ি। বুঝলে ওয়াটসন, ঘোড়া দুটোর তুলনা মেলা ভার। এক একটার দাম কম করে দেড়শো গিনি হবে। আর কিছু থাক বা না থাক, এই তদন্তে টাকার কমতি হবে না।”
আমি বললাম, “আমি তা হলে এখন চলি।”
“একদম নয়। যেখানে আছ ঠিক সেইখানেই বসে থাকো। তুমি হচ্ছ আমার বসওয়েল। তোমাকে ছাড়া আমার চলবে কী করে? আর তা ছাড়া মনে হচ্ছে ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হবে। তুমি যদি এখন চলে যাও তো পরে তোমাকে হয়তো পস্তাতে হবে।”
“কিন্তু তোমার মক্কেল—”
“তার কথা বাদ দাও। তোমার সাহায্যের প্রয়োজন আমারও হতে পারে আবার তারও হতে পারে। অতএব ওই চেয়ারটাতেই বসে থাকো আর সব কথা মন দিয়ে শোনো।”
এতক্ষণ সিঁড়িতে যে ধীর অথচ ভারী পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল তা আমাদের দরজার কাছে এসে থেমে গেল। আর তারপর দরজায় বেশ জোর টোকা পড়ল।
হোমস বলল, “ভেতরে আসুন।”
দরজা ঠেলে যিনি ঘরে ঢুকলেন উচ্চতায় তিনি সাড়ে ছ'ফুটের বেশি তবু কম নন। তাঁর হাত-পা বুকের ছাতি হারকিউলিসকে মনে পড়িয়ে দেয়। তাঁর জামাকাপড় খুব দামি। এত দামি যে, ইংল্যান্ডের শিক্ষিত ভদ্রলোক একে বলবে রুচির বিকার। তাঁর ডবল-ব্রেস্টেড কোটের বুকে ও হাতায় আস্ট্রাকানের ভেড়ার লোমের বেড় আর লম্বা পটি দেওয়া। তাঁর ঘন নীল ক্লোকে লাল সিল্কের পটি বসানো। আর ক্লোকের ঘাড়ের কাছে একটা ব্রোচ। আর ব্রোচের ঠিক মধ্যিখানে দামি বেরিল পাথর বসানো। তাঁর বুট জুতোর, যা প্রায় পায়ের ডিম পর্যন্ত উঁচু, সামনে তামাটে রঙের ‘ফার’ দেওয়া। তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদ দেখলেই বোঝা যায় ভদ্রলোক অসম্ভব ধনী। তাঁর হাতে একটা চওড়া আকারের টুপি। কিন্তু তাঁর মুখের ওপরের দিক মুখোশে ঢাকা। আমার মনে হল মুখোশটা তিনি ঘরে ঢোকবার আগেই পরেছেন। কেননা তাঁর একটা হাত তখনও উঠে ছিল। মুখের তলার দিকটা খোলা। তাঁর ঠোঁট আর চিবুকের গড়ন দেখলে বোঝা যায় তিনি যেমন জেদি আর তেমনই দৃঢ়চেতা।
“আপনি আমার চিঠি পেয়েছিলেন?” ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন। গলার স্বর যেমন গম্ভীর তেমনই কঠোর। উচ্চারণ জার্মানদের মতো। “আমি লিখেছিলাম যে আমি আসব।” আগন্তুক আমাদের দু'জনের মুখের দিকে তাকালেন। আমি বুঝলাম তিনি ধরতে পারেননি আমাদের মধ্যে কে শার্লক হোমস।
হোমস বলল, “আপনি অনুগ্রহ করে বসুন। ইনি আমার বন্ধু ও সহকারী ডাঃ ওয়াটসন। আমাকে আমার কাজে প্রয়োজনে সাহায্য করেন। আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?”
“আমাকে আপনি কাউন্ট ফন ক্রাম বলে ডাকতে পারেন। আমার দেশ বোহেমিয়া। আমি আশা করি আপনার এই বন্ধুটি ভদ্রলোক এবং কোনও গোপন কথা ফাঁস করে দেবেন না জেনে নির্ভাবনায় সব কথা বলা যায়। তা যদি না হয় তো আমার সমস্যাটা আমি কেবলমাত্র আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।”
আমি উঠে যাবার জন্যে দাঁড়াতেই হোমস আমার হাত ধরে টেনে ফের বসিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার ব্যাপারে হয় আমরা দুজনেই থাকব না হয় কেউই থাকব না। আপনার সব গোপন কথা আপনি স্বচ্ছন্দে এঁর সামনে বলতে পারেন।”
ঈষৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাউন্ট বললেন, “বেশ, সব কথাই বলছি। তবে আপনাদের কথা দিতে হবে যে, দু’ বছরের মধ্যে এ সম্পর্কে একটি কথাও প্রকাশ করতে পারবেন না। তার পরে অবশ্য ব্যাপারটা জানাজানি হলেও কোনও ক্ষতি নেই। কিন্তু তার আগে যদি ব্যাপারটা ফাঁস হয় তো সমগ্র ইউরোপে হইচই পড়ে যাবে।”
হোমস বলল, “ঠিক আছে। আমি কথা দিচ্ছি।”
“আমিও।”
“কিন্তু কিছু মনে করবেন না, মুখোশটা আমি খুলতে পারব না। কেননা যিনি আমাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছেন তিনি চান যে, তাঁর দূত হিসেবে আমি যেন আপনাদের অপরিচিতই থেকে যাই। ভাল কথা, আপনাদের কাছে আমার যে পরিচয় দিয়েছি তাও সম্পূর্ণ খাঁটি নয়।”
কিঞ্চিৎ নীরস গলায় হোমস উত্তর দিল, “তা বুঝতে পেরেছি।”
“সমস্ত ব্যাপারটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, যাতে করে কোনও রকম গালগল্প, গুজব বা মিথ্যা রটতে না পারে তার জন্যে আমাদের সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ব্যাপারের সঙ্গে বোহেমিয়ার বংশানুক্রমিক রাজা অরমস্টাইনদের মান-সম্মান জড়িয়ে আছে।”
চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ না খুলেই নিচু গলায় হোমস বলল, “এটাও আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম।”
আমাদের অতিথি কিছুটা বিস্মিত হয়ে চোখ বুজে আলস্যে গা এলিয়ে আরামকেদারায় শুয়ে থাকা হোমসের দিকে তাকিয়ে বোধহয় ভাবছিলেন এই কি সেই ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন দক্ষ রহস্যসন্ধানী যার সম্বন্ধে তিনি এত কথা শুনেছেন?
ধীরে ধীরে চোখ খুলে হোমস কিছুটা অসহিষ্ণু ভাবে বলল, “মহারাজ যদি অনুগ্রহ করে সমস্যাটা আমাকে খুলে বলেন তো আমার পক্ষে আপনাকে পরামর্শ দেওয়া সহজ হয়।”
হোমসের কথায় ভদ্রলোক চেয়ার থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে উত্তেজিত ভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ পরে, বোধহয় হতাশায়, একটানে মুখোশটা ফেলে দিয়ে তিনি বললেন, “আপনার অনুমান ঠিক। আমি বোহেমিয়ার রাজা। সত্য গোপন করে লাভ নেই।”
“ঠিকই বলেছেন। আপনি কোনও কথা বলবার আগেই আমি টের পেয়েছিলাম যে, আমি ভিলহেমল গটসরাইখ সিগিসমন্ড ফন অরমস্টাইন, কাসেল ফেলস্টাইনের গ্র্যান্ড ডিউক, বোহেমিয়ার রাজার সঙ্গে কথা বলছি।”
তখন আমাদের রাজা অতিথি একটা চেয়ারে বসে নিজের কপালে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “বুঝতেই পারছেন যে এই ধরনের কাজে আমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু এটা এমনই একটা ব্যাপার যা কাউকেই বিশ্বাস করে বলতে পারি না। তাতে খবরটার গোপনীয়তা থাকবে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজের পরিচয় সম্পূর্ণ ভাবে গোপন করে প্রাগ থেকে আমি আসছি আপনার সাহায্য ও পরামর্শের জন্যে।”
“তা হলে অনুগ্রহ করে সব কথা আমাকে যথাসম্ভব খুলে বলুন।”
“ব্যাপারটা এই: বছর-পাঁচেক আগে বিশেষ কারণে আমাকে বেশ কিছু দিন ওয়ারশ শহরে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়ে আমার আইরিন অ্যাডলারের সঙ্গে পরিচয় হয়। অ্যাডলারের নাম আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন।”
“ডাক্তার, আমার ইনডেক্স থেকে ওই নামটা বের করো তো।”
বহুকাল ধরে হোমস নানা টুকিটাকি খবর সংগ্রহ করে আসছে। অনেক দিন ধরে সংকলন করার জন্যে এখন এমন হয়েছে যে, এমন কোনও বিখ্যাত বা কুখ্যাত ব্যক্তি নেই বা বিষয় নেই যার সম্বন্ধে কিছু-না-কিছু খবর তার সংগ্রহে নেই। ইনডেক্সের পাতা ওলটাতে ওলটাতে এক ইহুদি ধর্মযাজক আর নৌবিভাগের পদস্থ কর্মচারীর যিনি গভীর সমুদ্রের মাছের ওপর খুব ভাল বই লিখেছেন—নামের মাঝখানে অ্যাডলারের নাম পাওয়া গেল।
“দেখি, দেখি” বলে হোমস বইটা আমার কাছ থেকে নিয়ে নিজেই পড়তে লাগল: “হুঁ, হুঁ, জন্ম নিউ জার্সিতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে।…Contralto তারপর La Scala…বেশ বেশ…ওয়ারশ শহরে ইম্পিরিয়াল অপেরার প্রধান গায়িকা…অপেরা থেকে অবসর গ্রহণ…খুব ভাল…বর্তমানে লন্ডন শহরের বাসিন্দা।” তারপর বইটা বন্ধ করে বোহেমিয়ার রাজার দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু সমস্যাটা কী?”
“ওয়ারশ শহরে থাকবার সময় আমার লেখা কিছু ব্যক্তিগত কাগজপত্র অ্যাডলারের হাতে…”
তাঁকে শেষ করতে না দিয়ে হোমস বলল, “আছে। এখন আপনি সেগুলো ফেরত পেতে চান অথচ তিনি ফেরত দিচ্ছেন না, তাই তো?”
“ঠিক।”
“সেই কাগজপত্রগুলো কি কোনও কিছুর দলিল ?”
“না”।
“তবে আর ভাবনা কী? অ্যাডলার বা অন্য কেউ যদি কখনও ওই সব কাগজপত্র দেখিয়ে আপনাকে অপদস্থ করতে চায় তো সোজা বলে দেবেন ও সব জাল কাগজ।”
“কিন্তু যে-কাগজে লেখা তা আমার ব্যক্তিগত প্যাডের কাগজ।”
“বলবেন একটা প্যাড চুরি গিয়েছিল।”
“হাতের লেখা যে আমার।”
“বলবেন কেউ আপনার হাতের লেখার নকল করে ওগুলো লিখেছে।”
“কাগজে আমার সিলমোহর করা আছে।”
“ও জাল সিলমোহর।”
“ওই সঙ্গে আমার একটা ছবিও আছে।”
“আপনার ছবি দোকান থেকে সংগ্রহ করা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়।”
“কিন্তু সে ছবিতে আমরা দুজনেই আছি।” বোহেমিয়ার রাজা একটু ইতস্তত করে বললেন।
“তা হলে অবশ্য মুশকিল। আপনি কাঁচা কাজ করে ফেলেছেন।”
“হ্যাঁ। তখন আমার বয়স আর বুদ্ধি দু-ই কম ছিল।”
হোমস একটু চুপ করে থেকে বলল, “তা হলে তো জিনিসপত্রগুলো উদ্ধার করতেই হয়, বিশেষত ওই ছবিটা।”
“আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।”
“তা হলে কিছু খরচ করে ওগুলো কিনে নিতে হবে।”
“ওঁর অভাব নেই। সুতরাং পয়সা দিয়ে কেনবার প্রশ্নই ওঠে না।”
“তা হলে চুরি করতে হয়।”
বোহেমিয়ার রাজা ঘাড় নেড়ে বললেন, “সে চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়। দু’বার পেশাদার চোরকে দিয়ে ওঁর বাড়িতে চুরি করানো হয়েছে। একবার অ্যাডলার যখন বিদেশে বেড়াতে যাচ্ছিলেন ওঁর সমস্ত মালপত্র ইচ্ছে করে ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করা হয়েছে। দু’বার রাস্তায় ওঁকে জোর করে আটকে তল্লাশি করা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার মাল পাওয়া যায়নি।”
“জিনিসগুলো কোথায় থাকতে পারে তার হদিসও পাওয়া যায়নি?”
“না। কোনও হদিসই পাওয়া যায়নি।”
হোমস হেসে বলল, “আপনার সমস্যাটা সামান্য হলেও বেশ চিত্তাকর্ষক।”
মৃদু তিরস্কারের সুরে বোহেমিয়ার রাজা বললেন, “সমস্যাটা কিন্তু আমার পক্ষে খুবই গুরুতর।”
“কী ভাবে,” হোমস প্রশ্ন করল।
“স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজার সঙ্গে কোনও একটা ব্যাপারে আমার যোগাযোগ হতে চলেছে। সে ব্যাপারটা অবশ্য আপনার না জানলেও চলবে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার রাজা অত্যন্ত গোঁড়া। যদি কোনও ভাবে তিনি জানতে পারেন যে, আইরিন অ্যাডলারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে তা হলে ওই যোগাযোগের ব্যাপারে আর এগোবেন না। ফলে সমস্ত ব্যাপারটা কেঁচে যাবে। তাতে আমারই ক্ষতি।”
“কিন্তু আইরিন অ্যাডলার এই ব্যাপারটা কী করে জানতে পারবেন?”
“আগামী সোমবার এই সম্পর্কে খবরের কাগজে একটা সংবাদ থাকবে। তখন অ্যাডলার কেন বিশ্ব-সংসারের সবাই জেনে যাবে। সুতরাং সোমবারের আগেই ওই কাগজপত্রগুলো উদ্ধার করতে হবে।”
“তা হলে তো আমাদের হাতে এখনও দিন তিনেক সময় আছে। ভালই হল,” শার্লক হোমস বলল, “আমার হাতে দু’-একটা জরুরি কাজ আছে। আপনি এখন লন্ডনেই থাকছেন তো?”
“হ্যাঁ। কাউন্ট ফন ক্রাম এই নামে আমি ল্যাংহ্যামে উঠেছি।”
“ঠিক আছে। কাজ কী রকম এগোচ্ছে তা চিঠি দিয়ে আপনাকে জানাব।”
“অবশ্যই। বুঝতেই পারছেন যে এই ব্যাপারে আমি খুবই উদ্বিগ্ন আছি।”
“খরচাপত্রের ব্যাপারটা—”
হোমসকে শেষ করতে না দিয়ে বোহেমিয়ার রাজা বললেন, “যত খরচা হয় হোক। প্রয়োজনে আমি আমার রাজ্যের একটা অংশ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু ওই ছবিটা আমার চাই-ই চাই।”
“তা হলে হাতখরচা বাবদ কিছু দেবেন কি?”
বোহেমিয়ার রাজা তাঁর ক্লোকের ভেতর থেকে শ্যাময় চামড়ার একটা পুরু ব্যাগ বের করে টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “এতে হাজার পাউন্ড আছে।”
হোমস একটা কাগজে টাকার জন্যে রসিদ লিখে দিয়ে বলল, “অ্যাডলারের ঠিকানাটা কি আপনার জানা আছে?”
“ব্রিওনি লজ, সার্পেন্টাইন অ্যাভিনিউ, সেন্ট জনস উড।”
হোমস ঠিকানাটা লিখে নিয়ে বলল, “আর একটা কথা। ছবিটা কি ক্যাবিনেট সাইজের?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে মহারাজ। আশা করি, দু'-একদিনের মধ্যে আপনাকে কিছু সুখবর দিতে পারব। শুভরাত্রি।”
বোহেমিয়ার রাজা চলে যাবার পর হোমস আমাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বলল, “ওয়াটসন, যদি কাল বিকেলে তিনটে নাগাদ আসো তো এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।”
কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় আমি বেকার স্ট্রিটে গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি শার্লক হোমস বাড়ি নেই। ল্যান্ডলেডি আমাকে বললেন যে, হোমস সকালে আটটার কিছু পরেই বেরিয়ে গেছে। হোমস যতক্ষণ না ফেরে ততক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে জেনে চেয়ারটা ফায়ারপ্লেসের কাছে সরিয়ে এনে আমি আরাম করে বসলাম। যদিও আগেকার দু’-একটা রহস্যের তুলনায় বর্তমান তদন্তে রোমহর্ষক ব্যাপার কিছু নেই, তবুও এই সমস্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ব্যক্তিটির সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক খ্যাতির জন্য মনে মনে বিশেষ কৌতূহল অনুভব করছিলাম। তা ছাড়া, হোমসের অনুসন্ধানের পদ্ধতি, যে-কোনও অবস্থার মোকাবিলা করবার ক্ষমতা, এলোমেলো বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে থেকে আসল সত্যটা চট করে বুঝে নেওয়ার শক্তি আমাকে মুগ্ধ করে। অজস্র বার হোমসকে সকল রকম রহস্যের সফল সমাধান করতে দেখে আমি তার সাফল্য সম্বন্ধে এতই নিশ্চিত যে, সে যে কখনও ব্যর্থ হতে পারে, এমন চিন্তা আমার মাথাতেই আসত না।
চারটের একটু আগে একজন সহিস ধরনের লোক ঘরে ঢুকল। যদিও আমি আমার বন্ধুর ছদ্মবেশ ধারণের অসাধারণ ক্ষমতার কথা জানি তবুও এই একমুখ দাড়ি-গোঁফওয়ালা ময়লা জামাকাপড়-পরা অপরিষ্কার লোকটিকে তিন তিনবার দেখবার পরে বুঝলাম যে এ শার্লক হোমসই বটে। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে হোমস নিজের ঘরে ঢুকে গেল। পাঁচ মিনিট পরেই বেশ পরিবর্তন করে সে বেরিয়ে এল। তারপর ফায়ারপ্লেসের সামনে একটা চেয়ারে বসে পা দুটো লম্বা করে ছড়িয়ে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে হাসতে লাগল।
“ওহ্, কী কাণ্ড!” বলেই হোমস ফের এমন হাসতে শুরু করল যে হাসির চোটে তার দম বন্ধ হবার জোগাড়।
“হঠাৎ এত হাসির কী ঘটল?”
“সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কী কী করেছি তা তুমি কোনও মতেই কল্পনা করতে পারবে না।”
“আমার মনে হচ্ছে যে তুমি সারাদিন আইরিন অ্যাডলারের বাড়ির চারপাশে সূত্রের সন্ধানে ঘোরাঘুরি করেছ।”
“ঠিক তাই। কিন্তু শেষকালে যা হল তা ভাবাই যায় না। যাই হোক, বলছি শোনো। আটটার একটু পরেই আমি বেকার সহিসের ছদ্মবেশ নিয়ে তো বেরিয়ে পড়লাম। সহিস, গাড়োয়ান বা ওই ধরনের লোকদের মধ্যে যে কী প্রচণ্ড ভাব-ভালবাসা আছে তা তুমি জানো না। যদি তুমি ওদেরই একজন হয়ে ওদের দলে ভিড়ে যেতে পারো তো যে-কোনও রকম খবর তুমি অনায়াসে পেয়ে যাবে। আমি তো ‘ব্রিওনি লজ’ খুঁজে বের করলাম। সুন্দর ছোট্ট দোতলা বাড়ি। বাড়ির পেছনে বাগান। দরজায় ‘চাবলক’ লাগানো। ঘরগুলো বেশ সাজানো গোছানো। বিরাট বিরাট প্রায় মেঝে পর্যন্ত জানলা। জানলাগুলো ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। তবে ছিটকিনিগুলো এমনই যে, যে-কোনও শিশুই সেগুলো খুলে ফেলতে পারে। বাড়ির পেছনে ‘কোচহাউস’। কোচহাউসের ছাত থেকে বাড়ির ঢাকা বারান্দার জানলাটা ধরা যায়। বাড়িটার চারদিক খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও আর কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি।
“তারপর আমি ওইখানেই ঘুরঘুর করতে লাগলাম। ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম যে, বাগানের একদিকের দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া এক সারি আস্তাবল। আমি সেই আস্তাবলের লোকেদের সঙ্গে জুটে গিয়ে ঘোড়াগুলোকে দলাই মলাই করতে লাগলাম। তার বদলে কী পেলাম জানো? পেলাম দুটো পেন্স, একগ্লাস পানীয়, বেশ খানিকটা তামাক আর অ্যাডলার সম্বন্ধে যাবতীয় খবর। উপরন্তু ওই অঞ্চলের অন্য লোকেদের হাঁড়ির খবর আমাকে শুনতে হল।”
“অ্যাডলার সম্বন্ধে কী জানতে পারলে শুনি?”
“সার্পেন্টাইন মিউজের সবাই একবাক্যে তাঁর প্রশংসা করল। ঠান্ডা প্রকৃতির চমৎকার ভদ্রমহিলা। চুপচাপ থাকেন। মাঝে মাঝে জলসায় গান করেন। রোজ ঘড়ি ধরে বিকেল পাঁচটায় বেড়াতে যান, ফেরেন ঠিক সাতটায় ডিনারের আগে। জলসা না থাকলে অন্য সময় কখনও বাড়ি থেকে বের হন না। গডফ্রে নর্টন নামে ইনার টেম্পলের এক আইনজীবী রোজ অন্তত একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ভদ্রলোক নাকি অত্যন্ত সুপুরুষ। দেখো, এই হচ্ছে কোচোয়ান সহিসদের সঙ্গে ভাব জমাবার ফল। ওরা নর্টনকে বহুবার তাঁর বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। ওদের অজানা খুব কম জিনিসই আছে। ওদের কাছ থেকে যতটা খবর পাওয়া গেল তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি আবার ব্রিওনি লজের দিকে পা বাড়ালাম। কী ভাবে কোন দিক দিয়ে এগোনো যায় তাই ভাবছি।
“এই গডফ্রে নর্টন ব্যক্তিটি হাজির হয়ে পরিস্থিতি ঘোরালো করে তুলল। লোকটা পেশায় আইনজীবী। আমার প্রথম সমস্যা হল অ্যাডলারের সঙ্গে এর কী সূত্রে আলাপ সেটা জানা। নর্টন যদি অ্যাডলারের আত্মীয় বা বন্ধু হয় তো এক কথা; কিন্তু যদি অ্যাডলারের আইন বিষয়ের পরামর্শদাতা হয় তো খুব মুশকিল। নর্টন যদি অ্যাডলারের আত্মীয় বা বন্ধু হয় তো অ্যাডলার তাকে তার বিশেষ মূল্যবান বা গোপন পত্র দেখাবে না বা তার কাছে রাখতে দেবে না। কিন্তু সে যদি নর্টনের মক্কেল হয়? তা হলে তো অ্যাডলার তার গোপন ও মূল্যবান কাগজপত্র তাকে দেখাবে এবং চাই কী তার হেফাজতে রাখতেও দিতে পারে। বিশেষ করে যখন তার বাড়িতে বার-দুয়েক চুরি হয়েছে, তার মালপত্র খোয়া গেছে বা অন্য জায়গায় চলে গেছে এবং তাকে দু’ দু’বার ছিনতাইকারীর হাতে পড়তে হয়েছে। তা যদি হয় তা হলে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রটা অনেক বেড়ে গেল। এখন সমস্যা হল কোথা থেকে শুরু করি। ‘ব্রিওনি লজ’ না ‘ইনার টেম্পল’?
“এই রকম সাতপাঁচ ভাবছি এমন সময় একটা গাড়ি এসে থামল ব্রিওনি লজের সামনে। গাড়ি থেকে লাফিয়ে নামলেন এক ভদ্রলোক। তাঁকে এক লহমায় যা দেখলাম তাতে বুঝলাম ভদ্রলোক অসাধারণ সুপুরুষ। কোচোয়ানকে অপেক্ষা করতে বলে ভদ্রলোক দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে যে পরিচারিকাটি দরজা খুলতে এসেছিল তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমি বুঝলাম ইনিই সেই গডফ্রে নর্টন।
“ভদ্রলোক প্রায় আধ ঘণ্টা বাড়ির ভেতরে ছিলেন। আমি রাস্তা থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম যে তিনি ঘরের মধ্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন আর মাঝে মাঝে খুব হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। অ্যাডলারকে অবশ্য আমি দেখতে পাইনি। তারপর ভদ্রলোক ঘর থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে চেপে কোচোয়ানকে বললেন, ‘প্রথমে রিজেন্ট স্ট্রিটে গ্রস অ্যান্ড হ্যাংকি’র ওখানে যাব তারপর যাব এজোয়্যার স্ট্রিটে সেন্ট মনিকার গির্জাতে। কুড়ি মিনিটে নিয়ে যেতে পারলে আধ গিনি পাবে। চালাও জোরে।’
“ভদ্রলোক চলে যাবার পর কী করব ভাবছি এমন সময় একটা ল্যান্ডো এসে হাজির হল ব্রিওনি লজের সামনে। দেখলাম বেচারা কোচোয়ান তখন তাঁর পোশাকের সব বোতামগুলো পর্যন্ত আটকাতে পারেনি। বুঝলাম হঠাৎ গাড়ির মালিকের বের হবার প্রয়োজন হয়েছে তাই তাকে পড়ি-মরি করে গাড়ি এনে হাজির করতে হয়েছে। গাড়িটা এসে থামতেই একরকম প্রায় ছুটে এসে অ্যাডলার গাড়িতে উঠলেন। ‘জন, সেন্ট মনিকার গির্জা চলো। কুড়ি মিনিটে পৌঁছে দিতে পারলে আধ ‘সভরেন’ বকশিশ পাবে।
“বুঝলে ওয়াটসন, এ রকম সুযোগ কখনও ছাড়া উচিত নয়। অথচ কী করে ওদের ধাওয়া করা যায় ? একবার ভাবলাম ব্যান্ডোর পেছনে উঠে পড়ি। এমন সময় দেখি একটা ভাড়াটে গাড়ি আসছে। আমি সেই চলন্ত গাড়িতে লাফ দিয়ে উঠে গাড়োয়ানকে বললাম, শিগগির সেন্ট মনিকার গির্জা চলো। কুড়ি মিনিটে পৌঁছে দিলে আধ ‘সভরেন’ পাবে।
“আমার গাড়োয়ান তো খুব জোরে ঘোড়া ছোটাল। আমি তো মনে করতে পারছি না যে এত স্পিডে এর আগে আমি কখনও গাড়ি চড়েছি কিনা। যাক, আমি যখন গির্জাতে পৌঁছোলাম আগের দুটো গাড়িই তখন সেখানে পৌঁছে গেছে। আমি তো ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গির্জের ভিতরে গেলাম। ঢুকে দেখি যাদের অনুসরণ করে এসেছি তারা আর একজন পাদরি তিনজন দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। বেকার লোক যেমন স্রেফ সময় কাটাবার জন্যে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায় আমিও সেই রকম এদিকে-ওদিকে তাকাতে তাকাতে গির্জের মধ্যে ঘুরতে লাগলাম।
“হঠাৎ নর্টন আমাকে দেখতে পেয়ে আমার দিকে দৌড়ে এসে বলল, ‘ওহ্ ভগবান রক্ষা করেছেন। ঠিক সময়ে এসে পড়েছ। তোমাকে দিয়েই আমাদের কাজ হবে।’ তারপর আমি কিছু বলবার আগেই আমাকে ধরে নিয়ে গেল পাদরির কাছে। তারপর? তারপর আমার উপস্থিতিতে শ্রীযুক্ত গডফ্রে নর্টনের সঙ্গে শ্রীমতী আইরিন অ্যাডলারের শুভ বিবাহ হয়ে গেল।
“নববধু আমাকে নগদ আধ সভরেন পুরস্কার দিল। তারপর তারা দু'জন দু’দিকে চলে গেল। শুধু যাবার আগে আইরিন গডফ্রেকে বলল যে সে বিকেলে পাঁচটার সময়ে পার্কে বেড়াতে যাবে।”
আমি বললাম, “এটা তো আবার নতুন ফ্যাকড়া হল। তার পরে তুমি কী করলে?”
“তারপর আমি একটু নিজের তদারকি করলাম।”
“সেটা আবার কী?”
“সকাল থেকে কিছু খাওয়াদাওয়া হয়নি। পেটে ছুঁচোয় ডন কষছিল তাই যা হোক চারটি মুখে দিলাম আর কি। যাকগে ওয়াটসন, এখন কিন্তু তোমার সাহায্য চাই।”
আমি বললাম, “বলো কী করতে হবে?”
“বেআইনি কাজে আপত্তি নেই তো?”
“মোটেই না।”
“পুলিশে যদি অ্যারেস্ট করে?”
“উদ্দেশ্য যদি সৎ হয় তো তাতেও আপত্তি নেই।”
“উদ্দেশ্য যে সৎ এ ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত হতে পারো।”
“তা হলে আমি তোমার সঙ্গে আছি।”
“তা আমি গোড়া থেকেই জানতাম।”
“তা হলে বলো আমাকে কী করতে হবে?”
আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে মিসেস টার্নার খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিলেন, তাঁর হাত থেকে ট্রে-টা ধরে নিয়ে হোমস বলল, “দাঁড়াও, খেতে খেতে সব কথা তোমাকে বলছি।…এখন প্রায় পাঁচটা বাজে। দু'ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে আমাদের ঘটনাস্থলে হাজির হতে হবে। মিস আইরিন, থুড়ি মাদাম আইরিন ঠিক সাতটার সময় বেরিয়ে বাড়ি ফেরেন।। সেই সময়ে আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করব।”
“তারপর?”
“তার পরের কথা আমার ওপর ছেড়ে দাও। সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। শুধু একটা কথা। যাই ঘটুক না কেন তুমি কোনও ভাবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে না।”
“আমি শুধুই দর্শক?”
হোমস বলল, “গোড়ার দিকে খানিকটা তাই। যা-ই হোক, মন দিয়ে শোনো। ওখানে একটা ছোটখাটো গণ্ডগোল হয়তো হবে, আর আমাকে হয়তো ধরে ব্রিওনি লজের মধ্যে নিয়ে যাবে, তাতেও তুমি বিচলিত হবে না। মিনিট তিন-চার পরে একটা ঘরের জানলা খুলে যাবে আর তুমি চুপি চুপি ওই জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে।”
“বেশ।”
“তারপর আমি এই ভাবে হাত তুললে, যে-জিনিসটা তোমাকে এখন দেব সেটা ঘরের মধ্যে ছুড়ে দিয়ে ‘আগুন, আগুন’ বলে চেঁচাবে। বুঝলে?”
“বুঝেছি।”
“এটা মারাত্মক কোনও কিছু নয়,” বলে হোমস পকেট থেকে লম্বা সিগারের আকারের একটা জিনিস বের করে আমাকে দিলে। “এটা একটা পটকা। সাধারণ পটকা থেকে তফাত এই মাত্র যে এর দু’ দিকেই বারুদ থাকায় আলাদা করে আগুন দিতে হয় না। তোমার কাজ হল ওই পটকা ছুড়ে দেওয়াটুকু। তুমি ‘আগুন’ বললেই চারপাশের আর সকলে চিৎকার শুরু করে দেবে আর সেই সুযোগে তুমি ওখান থেকে চলে এসে বড় রাস্তার মোড়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি মিনিট দশেকের মধ্যে ওখানে পৌঁছে যাব।”
আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম যে তাই হবে। হোমস তখন নিজের ঘরে গেল বাইরে বের হবার জন্যে প্রস্তুত হতে।
হোমসের ঘর থেকে বেরিয়ে এল অত্যন্ত নিরীহ ভালমানুষ এক মাঝবয়সি পাদরি। হোমসের ছদ্মবেশ নেওয়ার সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হল এই যে, সে যখন যে-চরিত্রের ছদ্মবেশ নেয় তখন ঠিক সেই চরিত্র অনুযায়ী কথাবার্তা তো বলেই, চলাফেরাটাও হুবহু তাদের মতো করে। আমার এক এক সময় মনে হয় যে, হোমস যদি অভিনয় করত তা হলে তাঁর সমকক্ষ অভিনেতা পাওয়া শক্ত হত।
সোয়া ছ'টা নাগাদ বেকার স্ট্রিট থেকে বেরিয়ে আমরা যখন সার্পেন্টাইন অ্যাভিনিউয়ে পৌঁছোলাম তখন সাতটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। সন্ধে হয়ে এসেছে। রাস্তার আলো সেই সবে একটা-দুটো করে জ্বলতে শুরু করেছে। হোমসের মুখে ব্রিওনি লজের যে রকম বিবরণ শুনেছিলাম বাড়িটা অবিকল সেই রকম। তবে আমি ভেবেছিলাম এলাকাটা নির্জন হবে। তা কিন্তু মোটেই নয়। রাস্তায় লোকজনের বেশ ভিড় আছে। দেখলাম রাস্তার একদিকে আধময়লা জামাকাপড় পরা কয়েকজন লোক জটলা করছে। তাদের থেকে কিছুটা দুরে একটা ছুরি-কাঁচি-শানওয়ালা আর জনদুয়েক পাহারাদার নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টা করছিল। তা ছাড়া পথচারীও কমতি ছিল না।
আমরা ব্রিওনি লজের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করছিলাম। হোমস বলল, “এখন ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ছবিটা ওঁর কাছেই আছে। এখন প্রশ্ন হল কোথায় আছে ?”
“সেই তো, কোথায় আছে সেটাই প্রশ্ন।”
“আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছবিটা উনি সঙ্গে নিয়ে বেড়ান না। প্রথমত ক্যাবিনেট সাইজের ছবি নিয়ে ঘোরাঘুরি করা অসুবিধেজনক আর দ্বিতীয়ত, উনি জানেন যে বোহেমিয়ার রাজা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে যে-কোনও সময়ে ওঁকে রাস্তায় আটকাতে পারেন।”
“তা হলে ছবিটা আছে কোথায়?”
“অনেক জায়গাতেই থাকতে পারে! ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোজিট ভল্টে থাকতে পারে। তাঁর উকিলের কাছেও থাকতে পারে। তবে আমার ধারণা ছবিটা ওঁর কাছেই এবং ওই বাড়িতেই আছে। কেননা সাধারণত মেয়েরা নিজেদের জিনিস নিজেদের কাছেই রাখতে চায়।”
“কিন্তু ওঁর বাড়িতে তো দু’বার চুরি করানো হয়েছে,” আমি বললাম।
“আরে দূর, ওরা জানেই না জিনিসটা কোথায় আছে।”
“তুমিই কি জানো যে খুঁজে পাবে?”
“আমি তো খুঁজব না। উনিই আমায় দেখিয়ে দেবেন।”
“কেন উনি তা করতে যাবেন শুনি?”
“না করে ওঁর উপায় থাকবে না।…ওই বোধহয় ওঁর গাড়ি এসে পড়ল। যেমন যেমন বলে দিয়েছি সেইমতো করো।” হোমস চট করে কোথায় মিলিয়ে গেল।
একটা চমৎকার ল্যান্ডো ব্রিওনি লজের দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। গাড়িটা থামতে না থামতেই একটা লোক দৌড়ে গেল গাড়ির দরজা খুলে দু’-চার পয়সা পাবার জন্যে। একই উদ্দেশ্যে আর-একজন লোকও ছুটে গেল। আর কে দরজা খুলবে এই নিয়ে দু'জনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল। আর অমনি ওই সময়ে ওখানে যত লোক ছিল সবাই ছুটে গিয়ে এক একজনের পক্ষ নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে লাগল।
এরই মধ্যে ভদ্রমহিলা গাড়ি থেকে নেমে খুব মুশকিলে পড়ে গেলেন। তাঁকে ঘিরে দু’পক্ষের বচসা তখন পুরোদমে জমে উঠেছে। এর মধ্যে কে আবার কাকে যেন দু’-এক ঘা দিয়ে দিয়েছে। হোমস ভদ্রমহিলাকে ওদের মধ্যে থেকে বের করে আনবার জন্যে ছুটে গিয়েই আর্তনাদ করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল; তার মুখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মজাটা হল তারপর। হোমসকে ওই ভাবে পড়ে যেতে দেখে বেশির ভাগ লোকই সেখান থেকে সরে পড়ল। আইরিন এই গোলমালের মধ্যে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাড়ির দরজা থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “উনি কি খুব বেশি চোট পেয়েছেন?”
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, “লোকটা মরে গেছে।”
“না, না, এখনও বেঁচে আছে। তবে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই শেষ হয়ে যাবে।”
একজন ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, “ফাদারের খুব সাহস। উনি ছুটে না গেলে ওই গুন্ডা-বদমায়েসগুলো মাদামের ঘড়ি আর ব্যাগ ছিনতাই করে পালাত।”
“এঁকে তো এই ভাবে রাস্তায় ফেলে রাখা যায় না। যতক্ষণ না চিকিৎসার ব্যবস্থা হয় এঁকে আপনার বাড়িতে শুইয়ে রাখা যাবে কি?”
“নিশ্চয়ই। ওঁকে ভেতরে নিয়ে এসে আরাম করে শুইয়ে দাও”, আইরিন জবাব দিলেন।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম কী রকম ধরাধরি করে হোমসকে আইরিনের বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন ভদ্রমহিলার সঙ্গে এই রকম কপটতা করতে আমার খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমি নিরুপায়। হোমসের সঙ্গে কথার খেলাপ করাটা চরম বিশ্বাসঘাতকতা হবে ভেবে মনকে শক্ত করে পটকা হাতে করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
খানিকক্ষণ পরে দেখলাম হোমস ধীরে ধীরে উঠে বসে এমন ভাব করছে যেন তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। কে একজন তাড়াতাড়ি রাস্তার দিকের একটা জানলা খুলে দিল। আমি জানলাটার দিকে এগিয়ে যেতে না যেতেই হোমস তার একটা হাত তুলল। আর তৎক্ষণাৎ পটকা ছুড়ে দিয়েই আমি ‘আগুন’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। আমার মুখের কথা খসতে না খসতেই সেখানে যত লোক ছিল সবাই ‘আগুন, আগুন’ বলে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল। আমি দেখলাম সেই ঘরটা থেকে হু-হু করে চাপ চাপ কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। দু’-চার মিনিট পরে হোমস বেরিয়ে এসে সকলকে আশ্বাস দিয়ে জানাল যে আগুনটাগুন কিছু লাগেনি। আমি তখন বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ালাম।
“ডাক্তার, তোমার অপারেশন সাকসেসফুল, খুব ভাল হয়েছে,” হোমস আমার পিঠ চাপড়ে দিল।
“ছবিটা উদ্ধার করতে পেরেছ?”
“আমি জানতে পেরেছি সেটা কোথায় আছে।”
“কী ভাবে?”
“তোমাকে যা বলেছিলাম। উনিই আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন।”
“বুঝতে পারলাম না।”
“তবে শোনো ডাক্তার। এটা নিশ্চয়ই বুঝেছ যে, আজকের সবটাই সাজানো ঘটনা। এরা সকলেই আমার ভাড়া-করা লোক।”
“সেটা বুঝেছি।”
“এখন বাকিটা শোনো। যখন গোলমাল আরম্ভ হল তখন আমি তো ছুটে গেলাম। গোড়া থেকেই আমার হাতের চেটোয় লাল রং লাগানো ছিল। আমি দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে পড়ে যাবার সময় সব রং সারা মুখে ভাল করে লাগিয়ে নিলাম। এটা অবশ্য খুবই পুরনো কৌশল। তারপর আমাকে তো ধরাধরি করে আইরিনের খাসকামরায় নিয়ে গিয়ে একটা বড় সোফায় শুইয়ে দিল। এই ঘরটার ওপর আমার গোড়া থেকেই নজর ছিল। এটা বাইরের বসবার ঘর আর আইরিনের শোবার ঘরের মাঝখানে। তারপর আমি এমন ভাব করলাম যেন বন্ধ ঘরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। তখন রাস্তার দিকের জানলা খুলে দেওয়া হল। আর তুমিও ঠিক তালমাফিক পটকাটা ছুড়লে।”
“তাতে তোমার কী সুবিধে হল ?”
“ওইটেই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তুমি লক্ষ করেছ কি না তা জানি না, বাড়িতে আগুন লাগলে বাড়ির মেয়েরা আগে বাঁচাতে যায় সে জিনিসটা যেটা তার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। ডার্লিংটন তদন্তের সময় দেখেছিলাম বাড়িতে আগুন লাগতেই ভদ্রমহিলা ছুটলেন তাঁর বাচ্চা ছেলে যেখানে ছিল সেইখানে। আর আর্নসওয়ার্থ ক্যাসল তদন্তের সময় দেখেছিলাম আগুন লেগেছে শুনেই ভদ্রমহিলা দৌড়েছিলেন নিজের গয়নার বাক্স সামলাতে। আজও একই ব্যাপার হল। ওই চাপ চাপ কালো ধোঁয়া আর হই-হট্টগোলে যে-কোনও লোকই ঘাবড়ে যেত। ছবিটা আছে ঘরের দেওয়াল বরাবর যে কাঠের প্যানেল আছে তার ডান দিকের ঘণ্টাটানা দড়ির পেছনের একটা খোপে। আমি আড়চোখে দেখলাম আগুন লেগেছে শুনেই ভদ্রমহিলা ওইখানকার প্যানেলটা ঠেলে সরিয়েছেন। আমি যখন বললাম যে আগুন লাগেনি, তখন তিনি চট করে সেখান থেকে সরে এসে পটকাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমিও সেই সুযোগে পালিয়ে এলাম। একবার ভেবেছিলাম ছবিটা নিয়েই আসি। কিন্তু দেখলাম কোচোয়ান সেখানে হাজির রয়েছে।
“আমাদের কাজ মোটামুটি শেষ। কাল সকালে বোহেমিয়ার রাজাকে সঙ্গে নিয়ে আইরিনের সঙ্গে দেখা করতে আসব। তিনি যখন সাজগোজ সেরে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন ততক্ষণে আমরা ছবিটা বগলদাবা করে ওখান থেকে লম্বা দেব।”
“কাল কখন আসবে?”
“এই ধরো আটটা নাগাদ।”
এই সব আলোচনা করতে করতে আমরা বেকার স্ট্রিটে পৌঁছে গেছি। হোমস পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলছিল এমন সময় একজন পথচারী বললেন, “শুভরাত্রি মিস্টার শার্লক হোমস।” রাস্তায় তখন অনেক লোক ছিল তাই কে যে বলল ঠিক বোঝা গেল না। মনে হল একটি যুবকই বোধহয় সম্ভাষণ করল।
হোমস বলল, “গলাটা চেনা চেনা ঠেকল। ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
সেই রাত্রিটা আমি বেকার স্ট্রিটে কাটালাম। পরদিন সকালে আমরা কফি টোস্ট দিয়ে সবেমাত্র ব্রেকফাস্ট সাঙ্গ করেছি, আর তখনই বোহেমিয়ার রাজা এলেন।
“আপনি ছবিটা পেয়েছেন?” তিনি অধীর ভাবে প্রশ্ন করলেন।
“পাইনি তবে পাবার আশা রাখি।”
“তা হলে চলুন ছবিটা উদ্ধারের জন্যে যাওয়া যাক।”
“হ্যাঁ। দাড়ান, আগে একটা গাড়ি ডাকাই।”
“কেন আমারই তো গাড়ি রয়েছে।”
“চলুন।”
ব্রিওনি লজে পৌঁছে দরজার বেল টিপতেই একজন বয়স্কা পরিচারিকা এসে দরজা খুলে বলল, “আপনাদের মধ্যে কেউ কি মিস্টার শার্লক হোমস ?”
“আমিই শার্লক হোমস”, বিস্মিত হয়ে আমার বন্ধু উত্তর দিল।
“আমাদের গিন্নিমা বলছিলেন যে, আপনি হয়তো আসতে পারেন। তিনি আপনাকে বলতে বলেছেন যে আজ ভোরে ৫-১৫ মিনিটের ট্রেনে তিনি চেয়ারিং ক্রশ থেকে ইউরোপের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন।”
“সে কী। তিনি ইংল্যান্ড ছেড়ে চলে গেছেন?”
“হ্যাঁ। আর তিনি কখনও ইংল্যান্ডে ফিরবেন না।”
হতাশায় ভেঙে পড়ে বোহেমিয়ার রাজা বললেন, “তা হলে ছবি আর কাগজপত্রগুলোও ফেরত পাওয়া যাবে না।”
“চলুন দেখি,” বলে একরকম জোর করে সেই পরিচারিকাকে সরিয়ে দিয়ে হোমস ঘরে ঢুকে গেল। তারপর সেই খাসকামরার ঘণ্টা-টানা দড়ির কাছে কাঠের প্যানেল সরিয়ে একটা খোপের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে সেখান থেকে একটা ছবি আর খাম বের করল। ছবিটা সান্ধ্য পোশাক-পরা আইরিন অ্যাডলারের। আর খামটার ওপরে লেখা শার্লক হোমস এস্কোয়ার।
খাম ছিঁড়ে হোমস চিঠিটা পড়তে শুরু করল।
প্রিয় মিস্টার শার্লক হোমস,
সত্যই আপনার ক্ষমতা অসাধারণ। আপনি আমাকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করেছেন। কিন্তু আগুনের মিথ্যে হল্লার আগে পর্যন্ত আমি কোনও রকম সন্দেহই করতে পারিনি। কিন্তু যখন ব্যাপারটা বুঝলাম তখন আমি ধরা পড়ে গেছি। অনেকদিন আগে আমাকে বহু লোক আপনার সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল যে, বোহেমিয়ার রাজা যদি নিজের কাজ হাসিল করবার জন্যে কোনও লোককে নিযুক্ত করেন তো সে লোক হলেন আপনি। তারা আপনার ঠিকানাও আমাকে দিয়েছিল। এ সমস্ত জানা সত্ত্বেও আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন।
মনে মনে সন্দেহ হলেও একজন নিরীহ পাদরিকে এর সঙ্গে জড়াতে মন চাইছিল না। যাই হোক, আপনি হয়তো জানেন যে, একসময়ে আমিও অভিনয় করতাম। তাই পুরুষের ছদ্মবেশ ধরা আমার পক্ষে মোটেই শক্ত নয়। তাই আমার কোচোয়ান জনকে আপনার ওপর নজর রাখতে বলে আমি মেকআপ নিতে যাই। আমার অনুপস্থিতির সুযোগে আপনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গে আমি আপনাকে অনুসরণ করি।
আপনার বাড়ির দরজার কাছে এসে নিশ্চিত হলাম যে বিখ্যাত শার্লক হোমস আমার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন। অহমিকার বশে আমি আপনাকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে আসি।
তারপর ভেবে ভেবে ঠিক করি যে আপনার হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে এখান থেকে পালানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কাল সকালে আপনি এসে দেখবেন পাখি উড়ে গেছে। ভাল কথা, আপনার মক্কেলকে বলবেন ছবির জন্যে তিনি যেন বিন্দুমাত্র উদ্বেগ না করেন।…
ইতি
আপনার একান্ত বিশ্বস্ত
আইরিন নর্টন (অ্যাডলার)
এইভাবে এই কাহিনীর ওপর যবনিকা পড়ল। বোহেমিয়ার রাজা কেলেঙ্কারির ভয় থেকে মুক্তি পেলেন ঠিকই কিন্তু শার্লক হোমসের সমস্ত প্ল্যানকে উলটে দিলেন অসামান্য বুদ্ধিমতী এক মহিলা।
0 মন্তব্যসমূহ