বাড়ি থেকে বেরুতে প্রায়ই হোঁচট খাই৷ প্রথম পদক্ষেপেই পাথরটা তার অস্তিত্বের কথা প্রবলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়৷ কদিন ধরেই ভাবছি কি করা যায়৷
সেদিন বাড়ি থেকে বেরুবার আমার তেমন কোনো তাড়া ছিল না, অন্তত ঐরূপ তীরবেগে অকস্মাৎ ধাবিত হব এমন অভিপ্রায় ছিল না আদৌ, কিন্তু পাথরটার সংঘর্ষ আমার গতিবেগকে সহসা এত দ্রুত করে দিল যে, অন্যদিক থেকে মোটর আসছে দেখেও আত্মসম্বরণ করতে অক্ষম হলুম কী ভাগ্যি, ড্রাইভারটা ছিলো হুঁশিয়ার—তাই রক্ষে!
সেদিন থেকেই ভাবছি কি করা যায়৷ আমার জীবন-পথের মাঝখানে সামান্য একটুকরো পাথর যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দেখা দেবে কোনোদিন এরূপ কল্পনা করিনি! তাছাড়া, ক্রমশই এটা জীবন-মরণের সমস্যা হয়ে উঠছে, কেননা ধাবমান মোটর চিরদিনই কিছু আমার পদলনকে মার্জনার চোখে দেখবে এমন আশা করতে পারি না৷
তাই ভাবছি একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাক, হয় ও থাকুক নয় আমি৷ ও থাকলে আমি বেশিদিন থাকব কিনা সন্দেহস্থল৷ তাই যখন আমার থাকাটাই, অন্তত আমার দিক থেকে বেশি বাঞ্ছনীয়, তখন একদা প্রাতঃকালে একা কোদাল যোগাড় করে লেগে পড়তে হলো৷
একটা বড় গোছের নুড়ি, ওর সামান্য অংশই রাস্তার ওপর মাথা তুলেছিল৷ বহু পরিশ্রমের পর যখন ওটাকে সমূলে উৎখাত করতে পেরেছি, তখন মাথার ঘাম মুছে দেখি আমার চারিদিকে রীতিমত জনতা৷ বেশ বুঝলাম এতক্ষণ এঁদেরই নীরব ও সরব সহানুভূতি আমার উদ্যমে উৎসাহ সঞ্চার করছিল৷
তাঁদের সকলের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনারা কেউ চান এই পাথরটা?
জনতার মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা গেল, কিন্তু কারু ঔৎসুক্য আছে কি নেই বোঝা গেল না৷ তাই আবার ঘোষণা করতে হলো—যদি দরকার থাকে নিতে পারেন৷ অনায়াসেই নিতে পারেন৷ আমার শ্রম তাহলে সার্থক জ্ঞান করব এবং আমি খুশী হব৷
জনতার এক তরফ থেকে একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে—এটা খুঁড়ছিলেন কেন? কোনো স্বপ্ন টপ্ন পেয়েছেন নাকি?
আমি লোকটার দিকে একটু তাকালাম, তারপর ঘাড় নেড়ে বললাম—না, যা ভাবছেন তা নয়৷
পাথরটাকে রাস্তার এক নিরাপদ কোণে স্থাপিত করা গেল৷ কিন্তু আমার কথায় যেন ওর প্রত্যয় হলো না, কয়েকবার আপনমনে মাথা নেড়ে সে আবার প্রশ্ন করলে—সত্যি বলছেন পাননি, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ?
—কিচ্ছু না৷
লোকটার কৌতূহলকে একেবারে দমিয়ে দিয়ে ওপরে এসে মাকে বললাম, দু’কাপ চা তৈরী করতে৷ আমার জন্যই দু’ কাপ৷ পাথরটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে কাতর হয়ে পড়েছিলাম—প্রায় প্রস্তরীভূত হয়ে গেছলাম, বলতে কি!
এরপর প্রায়ই বাড়ি থেকে বেরুতে এবং বেড়িয়ে ফিরতে নুড়িটার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় অনেক সময় হয় না, যখন অন্যমনস্ক থাকি৷ এখন ওকে আমি সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করতে পেরেছি, কেননা আমাকে অপদস্থ করার ক্ষমতা ওর আর নেই৷ সে-দৈবশক্তি ওর লোপ পেয়েছে৷
আমাদের মধ্যে একরকম হৃদ্যতা জন্মেছে এখন বলা যেতে পারে৷ এমন সময়ে অকস্মাৎ একদিন দেখলাম নুড়িটার কান্তি ফিরেছে, ধুলোবালি মুছে গিয়ে দিব্য চাকচিক্য দেখা দিয়েছে৷ যারা সকালে বিকালে হোস পাইপে রাস্তায় জল ছিটোয়, বোঝা গেল, তাদেরই কারুর স্নেহদৃষ্টি এর ওপর পড়েছিল৷ ওর চেহারার শ্রীবৃদ্ধি দেখে সুখী হলাম৷
—ব্যাপার কিরকম বুঝচেন?
হঠাৎ পেছন থেকে প্রশ্নাহত হয়ে ফিরে তাকালাম৷ সেদিনের সেই অনুসন্ধিৎসু ভদ্রলোক৷
জিজ্ঞাসা করলাম—আপনি কি সেই থেকে এখানে পাহারা দিচ্ছেন নাকি? না, কোনো প্রত্যাদেশ-টত্যাদেশ পেলেন?
—না না, তা কেন? এই পথেই আমার যাতায়াত কিনা৷
ভদ্রলোক কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হন, কিন্তু অল্পক্ষণেই নিজেকে সামলে নিতে পারেন৷
—নুড়িটা দেখছি আছে ঠিক৷ কেউ নেবে না—কি বলেন?
প্রশ্নটা এইভাবে করলো যেন যে-রকম দামী জিনিসটা পথে পড়ে আছে অমন আর ভূভারতে কোথাও মেলে না এবং ওর গুপ্তশত্রুর দল ওটাকে আত্মসাৎ করবার মতলবে ঘোরতর চক্রান্তে লিপ্ত ছোঁ মেরে লুফে নেবার তালে হাত বাড়িয়ে সবাই যেন লোলুপ৷ আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানালাম—না, না, আপনার যারা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারত, সরকার বাহাদুর তাদের নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে রাঁচির অতিথিশালায় সযত্নে রেখে দিয়েছেন, তাছাড়া, আপনি নিজেই যখন এদিকে কড়া নজর রেখেছেন তখন তো চিন্তা করার কিছু দেখিনে৷
সে একটু হেসে বলল—আপনার যেমন কথা! দেখেছেন এদিকে কারা ওর পূজার্চনা করে গেছে?
ভালো করে নিরীক্ষণ করি—সত্যিই, দেখিনি তো, এক বেলার মধ্যেই কারা এসে পাথরটার সর্বাঙ্গে বেশ করে তেলসিঁদুর লেপে দিয়ে গেছে৷
আমি আনন্দ প্রকাশ করলাম—ভালোই হয়েছে৷ এতদিনে তবু ওর কান্তি ফিরলো এবং আরেকটি সমঝদার জুটলো!
পাথরটার সমাদরে পুলকিত হবার কথা, কিন্তু লোকটিকে বেশ ঈর্ষান্বিত দেখলাম৷ কপাল কুঁচকে সে বললে—সেই তো ভয়! সেই সমঝদার না ইতিমধ্যে ওটিকে সরিয়ে ফ্যালে!
পরদিন সকালে উঠে দেখি কোথাও পাথরটার চিহ্নমাত্র নেই৷ ওর এই আকস্মিক অন্তর্ধানে আশ্চর্য হলাম খুব৷ কে ওটাকে নিয়ে গেল, কোথায় নিয়ে গেল, ইত্যাকার নানাবিধ প্রশ্নের অযাচিত উদয় হলো মনে কিন্তু সঠিক সদুত্তর পাওয়া গেল না৷ পাথরটার এরূপ অনুপস্থিতিতে এই পথে হরদম যাতায়াতকারী সেই লোকটি যে প্রাণে বেজায় ব্যথা পাবে অনুমান করা কঠিন নয়৷ একথা ভেবে লোকটার জন্য একটু দুঃখই জাগলো—কিম্বা, এ সেই তত্বজিজ্ঞাসুরই কর্মযোগ?
অনেকদিন পরে গলির মোড়ের অশথতলা দিয়ে আসছি—ও হরি! এখানে নুড়িটাকে নিয়ে এসেছে যে! নুড়ির স্থূল অঙ্গটা গাছের গোড়ায় এমন ভাবে পুঁতেছে যে, উপরের উদ্ধৃত গোলাকার নিটোল মসৃণ অংশ দেখে শিবলিঙ্গ বলে ওকে সন্দেহ হতে পারে৷ এই প্রয়োগনৈপুণ্য যার, তাকে বাহাদুরি দিতে হয়৷ নুড়িটার চারিদিকে ফুল বেলপাতা আতপচালের ছড়াছড়ি৷ সকালের দিকে এই পথে যে সব পুণ্যলোভী গঙ্গাস্নানে যায়, তারাই ফেরার পথে সস্তায় পারলৌকিক পাথেয় সঞ্চয়ের সুবর্ণসুযোগরূপে একে গ্রহণ করেছে সহজেই বোঝা গেল৷ যাই হোক, মহাসমারোহেই ইনি এখানে বিরাজ করছেন—অতঃপর এঁর সমুজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কারু দুশ্চিন্তার আর কোনো কারণ নেই৷
নুড়িটার এই পদোন্নতিতে আন্তরিক খুশি হলাম৷ আমি একদিন ওকে মুক্তি দিয়েছি, এখন সবাইকে ও মুক্তি বিতরণ করতে থাক—ওর গৌরব, সে তো আমারই গর্ব৷ পৃথিবীর বুকে ওর জন্মদাতা আমি, এইজন্য মনে মনে পিতৃত্বের একটা পুলক অনুভব না করে পারলাম না! এবং কায়মনোবাক্যে ওকে আশীর্বাদ করলাম৷
সেই লোকটাকে তার দেবতার সন্ধান দেব কিনা মাঝে মাঝে ভেবেছি৷ পথে ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু পাথরটার কথা ও আর পাড়ে না৷ পাথরটার পলায়নে ভেবেছিলাম ও মুহ্যমান হয়ে পড়বে, কিন্তু উলটে ওকে প্রফুল্লই দেখা গেল৷ এত বড় একটা বিচ্ছেদ-বেদনা যখন ও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তখন আর ওকে উতলা করে তোলায় কি লাভ৷
মাঝে মাঝে অশথতলার পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরি, লক্ষ্য করি, দিনকের দিন নুড়িটার মর্যাদা বাড়ছে৷ একদিন দেখলাম, গোটাকতক সন্ন্যাসী এসে আস্তানা গেড়েছে, গাঁজার গন্ধ এবং ববমবম শব্দের ঠেলায় ওখান দিয়ে নাক কান বাঁচিয়ে যাওয়া দুষ্কর৷ ঘ্রাণ এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের ওপরে দস্তুরমতই অত্যাচার৷
যখন সন্ন্যাসী জুটেছে তখন ভক্ত জুটতে দেরি হবে না এবং ভক্তির আতিশয্য অনতিবিলম্বেই ইট-কাঠের মূর্তি ধরে মন্দিররূপে অভ্রভেদী হয়ে দেখা দেবে৷ দেবতা তখন বিশেষভাবে বনেদী হবেন এবং সর্বসাধারণের কাছ থেকে তাঁর তরফে খাজনা আদায় করবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েমী হয়ে দাঁড়াবে৷
এর কিছুদিন পরে একটা চিনির কলের ব্যাপারে কয়েক মাসের জন্য আমাকে চম্পারণ যেতে হলো৷ অশথতলার পাশ দিয়ে গেলেও চলে, ভাবলাম, যাবার আগে দেবতার অবস্থাটা দেখে যাই৷ যা অনুমান করেছিলাম তাই, সন্ন্যাসীর সমাগমে ভক্তের সমারোহ হয়েছে৷ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের আলাপ আলোচনা অনুসরণে যা বুঝলাম তার মর্ম এই যে, ইনি হচ্ছেন ত্রিলোকেশ্বর শিব, সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু, একেবারে পাতাল ফুঁড়ে ফেঁপে উঠেচেন—এঁর তল নেই৷ অতএব এঁর উপযুক্ত সম্বর্ধনা করতে হলে এখানে একটা মন্দির খাড়া না করলে চলে না৷
একবার বাসনা হলো, ত্রিলোকেশ্বর শিবের নিস্তলতার ইতিহাস সবাইকে ডেকে বলে দিই, কিন্তু জীবন-বীমা করা ছিল না এবং ভক্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে জানতাম, আর তা ছাড়া ট্রেনের বিলম্বও বেশি নেই—ইত্যাদি বিবেচনা করে নিরস্ত হলাম৷ সেই লোকটাকে খবর না দিয়ে দেখলাম ভালোই করেছি, কেননা যতদূর ধারণা হয়, নুড়িটাকে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করাই তার অভিরুচি ছিল কিন্তু ইনি যে ভক্তের তোয়াক্কা না রেখেই স্বকীয় প্রতিভাবলে এবং স্বচেষ্টায় ইতিমধ্যেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ হয়েছেন, এই সংবাদে সে পুলকিত কিম্বা মর্মাহত হতো বলা কঠিন৷
কয়েক মাস বাদে যখন ফিরলাম তখন অশথতলার মোড়কে আর চেনাই যায় না৷ ছোটখাট একটা মন্দির উঠেছে, শঙ্খঘণ্টার আর্তনাদে কান পাতা দায় এবং ভক্তের ভিড় ঠেলে চলা দুরূহ৷ কিন্তু সে কথা বলছি না, সবচেয়ে বিস্মিত হলাম সেই সঙ্গে আরেক জনের আবির্ভাবে, কেবলমাত্র আবির্ভাব নয় কলেবর পরিবর্তন পর্যন্ত দেখে৷ মন্দিরের চত্বরে সেই লোকটা—প্রথমতম, সেই আদি ও অকৃত্রিম উপাসক—গেরুয়া, তিলক এবং রুদ্রাক্ষের চাপে তাকে আর চেনাই যায় না এখন!
—এ কি ব্যাপার?
আমিই গায়ে পড়ে প্রশ্ন করলাম একদিন৷
—আজ্ঞে, এই দীনই শিবের সেবায়েত৷
লোকটি বিনীত ভাবে জবাব দেয়৷
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি৷ দিব্যি বিনিপুঁজির ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে৷ এই জন্যেই বুঝি পাথরটার ওপর অত করে নজর রাখা হয়েছিল?
শিলাখণ্ডের প্রতি ওর প্রীতিশীলতা যে অহেতুক এবং একেবারেই নিঃস্বার্থ ছিল না, এইটা জেনেই বোধ করি অকস্মাৎ ওর ওপর দারুণ রাগ হয়ে যায়, ভারি রূঢ় হয়ে পড়ি৷
কানে আঙুল দিয়ে সে বলল—অমন বলবেন না৷ পাথর কি মশাই? শ্রীবিষ্ণু! সাক্ষাৎ দেবতা যে৷ ত্রিলোকেশ্বর শিব!
উদ্দেশে সে নমস্কার জানায়৷
আমি হেসে ফেললাম—ওর তল নেই, না?
এবার সে একটু কুণ্ঠিত হয়—ওরাই তো বলে৷
—তুমি নিজে কী বলো? ওরা তো বলে নিচে যতই কেন খুঁড়ে যাও না, টিউব-কলের মত ওই শিবলিঙ্গ বরাবর নেমে গেছে৷ কিন্তু তোমার কী মনে হয়?
—কী জানি! তাই হয়তো হবে৷
—কতদূর শেকড় নেবেছে খুঁড়ে দেখই না কেন একদিন?
জিভ কেটে লোকটা বলল—ওসব কথা কেন, ওতে অপরাধ হয়৷ বাবা রাগ করবেন—উনি আমাদের জাগ্রত৷
—বটে? কিরকম জাগ্রত শুনি?
—এই ধরুন না কেন! এবার তো কলকাতায় দারুণ বসন্ত, টিকে নিয়ে কিছু করেই কিছু হচ্ছে না—
—য়্যাঁ, বলো কি, মহামারী নাকি, জানতাম না তো!
—খবরের কাগজেই দেখবেন কিরকম লোক মরছে৷ কর্পোরেশন থেকে টিকে দেবার ত্রুটি নেই অথচ প্রত্যেক পাড়াতেই—৷ কিন্তু আমাদের পাড়ায় এ-পর্যন্ত কারু হয়নি দেবতার কৃপায়৷ আমরা কেউ টিকেও নিইনি, কেবল বাবার চন্নামেত্ত খেয়েছি৷ এ যদি জাগ্রত না হয় তবে জাগ্রত আপনি কাকে বলেন?
এবার কি জবাব দেব তা চিন্তা করবার সময় ছিল না৷ আগে একবার এই রোগে যা কষ্ট পেয়েছিলাম এবং যা করে বেঁচেছিলাম তাতে বাবা ত্রিলোকনাথের মহিমা তখন আমার মাথায় উঠেছে৷ ‘‘—আমি এখন চললুম৷ আমাকে এক্ষুনি টিকে নিতে হবে৷ আরেকদিন এসে গল্প করব৷’’ বলে আর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করে মেডিকেল কলেজের উদ্দেশে ধাবিত হলাম৷
পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা৷ দাঁড় করিয়ে সে বললে—আরে, কোথায় চলেছো এমন হন্যে হয়ে?
—টিকে নিতে৷
—টিকে নিয়ে তো ছাই হচ্ছে৷ টিকেয় কিসসু হয় না৷ তুমি বরং দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম এক ডোজ খাও গে, কিং কম্পানির থেকে—যদি টিঁকে থাকতে চাও! পরের হপ্তায় ঐ আরেক ডোজ, তারপরে আরেক—ব্যাস, নিশ্চিন্দি৷ টিকে ফেল করেছে আকচার দেখা যায়, কিন্তু ভেরিওলিনাম—নেভার!
—বলো কি? জানতাম না তো!
—জানবে কোত্থেকে? কেবল ফোঁড়াফুঁড়ি এই তো জেনেছো! অন্য কিছুতে কি আর তোমাদের বিশ্বেস আছে? আমি হোমিওপ্যাথি প্রাকটিস ধরেছি, আমি জানি৷
—বেশ, তাই খাচ্ছি না হয়৷
কিং কম্পানিতে গিয়ে এক ডোজ দু’শ শক্তির ভেরিওলিনাম গলাধঃকরণ করলাম৷ যাক, এতক্ষণে অনেকটা স্বচ্ছন্দ হওয়া গেল৷ হালকা হতে পারলাম৷
এর পরেই পথ দিয়ে উপরি-উপরি কয়েকটা শবযাত্রা গেল—নিশ্চয়ই এরা বসন্ত রোগেই মরেছে? কী সর্বনাশ, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে, ওদের থেকে এইভাবে কত লক্ষ লক্ষই না বীজাণু আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে৷ ভেরিওলিনাম রক্তে পৌঁছতে না পৌঁছতেই এতক্ষণে এই সব মারাত্মক রোগাণুর কাজ শুরু হয়ে গেছে নিশ্চয়! হাত পা সিঁটিয়ে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসে—এই বিপদসংকুল বাতাসের নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়৷
অতি সংক্ষিপ্ত এক টুকরো প্রাচীরপত্রে বিখ্যাত বসন্ত চিকিৎসক কোন এক কবিরাজের নাম দেখলাম৷ হোমিওপ্যাথি করা গেছে, কবিরাজিই বা বাকি থাকে কেন—যে উপায়েই হোক সবার আগে আত্মরক্ষা৷ বিজ্ঞাপিত ঠিকানায় পৌঁছতেই দেখলাম কয়েকজন মিলে খুব ধুমধাম করে প্রকাণ্ড একটা শিলে কী যেন বাঁটছেন৷ কবিরাজকে আমার অবস্থা বলতেই তিনি আঙুল দেখিয়ে বললেন—ওই যে বাঁটা হচ্ছে৷ কণ্টিকারির শেকড়—বেঁটে খেতে হয়৷ ওর মত বসন্তের অব্যর্থ প্রতিষেধক আর কিছু নেই মশাই!
ব্যবস্থামত তাই এক তাল খেয়ে রিক্সা ডেকে উঠে বসা গেল৷ গায়ে যেন জোর পাচ্ছিলাম না, মাথাটা ঝিমঝিম করছিল, জ্বর-জ্বর ভাব—বসন্ত হবার আগে এই রকমই নাকি হয়ে থাকে৷ বাড়ি ফিরে মাকে বললাম—আজ আর কিছু খাব না, মা৷ দেহটা ভালো নয়৷
উদ্বিগ্ন মুখে মা বললেন—কী হয়েছে তোর?
—হয়নি কিছু৷ বোধহয় হবে!...বসন্ত৷
—বালাই ষাট৷ বলতে নেই৷ তা কেন হতে যাবে? এই হর্তুকির টুকরোটা হাতে বাঁধ দিকি৷ আমি তিরিশ বছর বাঁধছি, এই হাতে বসন্ত রোগীই তো ঘাঁটলাম, সেবা করলাম, কিন্তু বলতে নেই, এরই জোরে কোনোদিন হাম পর্যন্ত হয়নি—৷ নে ধর এটা তুই৷
মা তাঁর হাতের তাগাটা খুলে দিলেন৷
—তিরিশ বছরে একবারো হয়নি তোমার? বলো কি? দাও, দাও তবে৷ এতক্ষণ বলোনি কেন? কিন্তু এই একটুকরোয় কি হবে? রোগ যে অনেকটা এগিয়ে গেছে৷ আমাকে আস্ত একটা হর্তুকি দাও যদি তাতে আটকায়৷
হর্তুকি তো বাঁধলুম, কিন্তু বিকালের দিকে শরীরটা বেশ ম্যাজম্যাজ করতে লাগলো৷ নিজেকে রীতিমত জ্বরজড়িত মনে হলো৷ আয়না নিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম, মুখেও যেন দু’একটা ফুসকুড়ির মতো দেখা দিয়েছে৷ নিশ্চয়ই বসন্ত, তবে আর বাঁচন নেই, মাকে ডেকে দেখালাম৷
মা বললেন—মার অনুগ্রহ নয়—ব্রণ৷
আমি বললাম—উঁহু৷ ব্রণ নয়, নিতান্তই মার অনুগ্রহ!
মা বললেন—অলক্ষুণে কথা মুখে আনিস নে৷ ও কিছু না, সমস্ত দিন ঘরে বসে আছিস, একটু বাইরে থেকে বেড়িয়ে আয় গে৷
এরকম দারুণ ভাবনা মাথায় নিয়ে কি বেড়াতে ভালো লাগে? লোকটা বলছিল, ওরা সবাই চরণামৃত খেয়ে নিরাপদ রয়েছে৷ আমিও তাই খাবো নাকি? হয়তো বা চরণামৃতের বীজাণুধ্বংসী কোনো ক্ষমতা আছে, নেই যে, তা কে বলতে পারে?...হ্যাঁঃ ওর যেমন কথা! ওটা স্রেফ অ্যাকসিডেন্ট—কলকাতার সব বাড়িতেই কিছু আর অসুখ হচ্ছে না৷ তাছাড়া মনের জোরে রোগ-প্রতিরোধের শক্তি জন্মায়—মারীরও যেখানে মার—সেই মনের জোরই ওদের পক্ষে একটা মস্ত সহায়—কিন্তু ওই যৎসামান্য পাথরটাকে দেবতাজ্ঞান করার মতো বিশ্বাসের জোর আমি পাবো কোথায়?
এ সব যা-তা না করে সকালে টিকে নেওয়াই উচিত ছিল, হয়তো তাতে আটকাতো৷ এখুনি গিয়ে টিকেটা নিয়ে ফেলব নাকি? টিকে নিলে শুনেছি বসন্ত মারাত্মক হয় না, বড় জোর হাম হয়ে দাঁড়ায়৷ আর হামে তেমন ভয়ের কিছু নেই—ও তো শিশুদের হামেশাই হচ্ছে৷ নাঃ, যাই মেডিকেল কলেজের দিকেই বেরিয়ে পড়ি৷
টিকে নিয়ে অশথতলার পাশ দিয়ে ফিরতে লোকটার সকালের কথাগুলো মনে পড়ল৷ হয়তো ঠিকই বলেছে সে৷ সত্যিই এক জায়গায় গিয়ে আর কোনো জবাব নেই, সেখানে রহস্যের কাছে মাথা নোয়াতেই হয়৷ এই তো আজ বেঁচে আছি, কাল যদি বসন্তে মারা যাই তখন কোথায় যাবো? শেকসপীয়ারের সেই কথাটা—সেই স্বর্গমর্ত্য-হোরাশিও-একাকার-করা বাণী—না, একেবারে ফেলনা নয়৷ এই পৃথিবীর, এই জীবনের, সুদূর নক্ষত্রলোক এবং তার বাইরেও বহুধা বিস্তৃত অনন্ত জগতের কতটুকুই আমরা জানি? কটা ব্যাপারেই বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে পারি? যতই বিজ্ঞানের দোহাই পাড়ি না কেন, শেষে সেই অজ্ঞেয়ের সীমান্তে এসে সব ব্যাপারীকেই নতমুখে চুপ করে দাঁড়াতে হয়৷
মন্দিরের সম্মুখ দিয়ে আসতে ত্রিলোকনাথের উদ্দেশে মনে মনে দণ্ডবৎ জানালাম৷ প্রার্থনা করলাম, বাবা, আমার মূঢ়তা মার্জনা করো, মহামারীর কবল থেকে বাঁচাও আমাকে এযাত্রা৷
খানিক দূর এগিয়ে এসে ফিরলাম আবার৷ নাঃ, দেবতাকে ফাঁকি দেওয়া কিছু নয়৷ মুখের ফুসকুড়িগুলো হাত দিয়ে আঁচ করা গেল—এগুলো ব্রণ, না বসন্ত?
এবার মাটিতে মাথা লুটিয়ে প্রণাম করলাম৷ বললাম—জয় বাবা ত্রিলোকনাথ! রক্ষা করো বাবা! বম বম!
উঠে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখলাম৷ কেউ দেখে ফ্যালেনি তো?
0 মন্তব্যসমূহ