আমরা ছাব্বিশ জন লোক, ছাব্বিশটা জীবন্ত মেশিন—একটা বিরাট বাড়ির মাটির তলার নোংরা, অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে আবদ্ধ থাকি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়দা ডলা, মচমচে নিমকি-বিস্কুট ও নোনতা বিস্কুট বানানো আমাদের কাজ। নিচের তলার জানলা দিয়ে ইট-গাঁথা নোংরা কুঠুরিটা দেখা যায়—দেয়ালটা চটচটে সবুজ হয়ে গেছে। কুঠুরির জানলাগুলোয় ঘন করে শিক বসানো, আর তার কাচ ভেদে করে সূর্যের আলো কখনই আমাদের এই ঘরে ঢুকতে পারে না—কাচগুলোতে অস্বচ্ছ কিছু একটা মাখানো। মালিক জানলাগুলো এমনভাবে ঘিরে দিয়েছে যাতে ঘর থেকে বিস্কুট কোনো ভিখিরি বা ভবঘুরে, আমাদের বেকার কোনো বন্ধুর হাতে গিয়ে না পৌঁছতে পারে। মালিক আমাদের ডাকে একদল জোচ্চোর বলে, আর রাতের খাবার হিসেবে বরাদ্দ মাংসের নামে নোংরা নাড়িভুড়ি।
কালি-ঝুল ও মাকড়সার জালে ভরা নিচু ছাদের নিচে এই আবদ্ধ কারাকক্ষটির ভেতরে জীবন আমাদের অতিষ্ঠ। নোংরা দাগ ও শ্যাওলা ভরা ঐ পুরু দেয়ালের মধ্যে বেঁচে থাকা বড়ই কষ্টকর, ক্লান্তিময়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। যথেষ্ট ঘুম না হওয়ায় তখনো মাথা ভারী হয়ে থাকে। এবং ছটার সময় নিষ্প্রাণ জড় পদার্থের মতো আমরা টেবিলে বসে মাখা-ময়দা থেকে মচমচে নিমকি-বিস্কুট ও সস্তা বিস্কুট বানাতে শুরু করে দিই। আমরা যখন ঘুমোই আমাদের কিছু সহকর্মী তখন ময়দা মেখে রাখে। ভোর থেকে রাত দশটা, এই সুদীর্ঘ সময় ধরে আমাদের কেউ কেউ টেবিলে বসে শক্ত ময়দার ডেলা থেকে বিস্কুট বানায় আর দুলে দুলে শরীরের জড়তা কাটায়। অন্যেরা ময়দা ও জল মেশায়। নিমকি-বিস্কুটের ময়দা সেদ্ধ-করা-গামছা থেকে সারাদিন ফুটন্ত জলের সোঁ সোঁ শব্দ ওঠে—শব্দটা কেমন অদ্ভুত বিষণ্ন। বিস্কুট যে ভাজে সে বেলচা করে সেদ্ধ পিচ্ছিল ময়দার টুকরোগুলো ক্রুদ্ধ ও দ্রুতবেগে গরম ইটের মধ্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দেয়, ফলে ঠুংঠাং শব্দ ওঠে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চু্ল্লীতে কাঠ জ্বলে। আগুনের লাল আভা যেন নীরব বিদ্রূপ ঘরের দেওয়ালে ঠিকরে পড়ে। বিশাল চুল্লীটাকে মনে হয় কোনো অদ্ভুত দৈত্যের মাথা মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। তার হাঁ-করা মুখের মধ্যে জ্বলছে লকলকে আগুন। আমাদের দিকে তপ্ত নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে তার কপালের উপর দুটো বাতাস নেবার গর্ত থেকে আমাদের এই বিরামহীন পরিশ্রম দেখে। ঐ গর্তদুটোকে দেখে মনে হয়—সেই দৈত্যের নির্দয় নির্বিকার দুটো চোখ। ঐ চোখ দুটো আমাদের মতো গোলামদের অশুভ দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে ক্লান্ত। এই গোলামগুলোর কাছে মানবিক কোনো কিছুই আশা করা যায় না। ঐ চোখ দুটো যেন অধিকতর জ্ঞানের নির্বিকার অবজ্ঞা নিয়ে আমাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে।
এই উত্তপ্ত শ্বাসরোধকারী ঘরে ময়দার গুঁড়ো ও রাস্তা থেকে পায়ে পায়ে বয়ে আনা কালিঝুলির মধ্যে আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়দা ডলি ও নিমকি-বিস্কুট বানাই। নিমকি-বিস্কুটে আমাদের শরীরের ঘাম ঝরে পড়ে। আমরা আমাদের এই কাজকে ভীষণ ঘৃণা করি। নিজ হাতে যা বানাই, তা কখনো খাই না। এর চেয়ে পোড়া ঘাসের রুটিও ভালো লাগে। একটা লম্বা টেবিলের দুপাশে ন’জন করে মুখোমুখি বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে আমরা হাত ও আঙুলের কাজ করে যাই। এত অভ্যাস হয়ে গেছে যে কে কি করছি সেদিকে আর কেউ লক্ষ করি না। আর একে অপরকে এত ভালোভাবে চিনে ফেলেছি যে, প্রত্যেকেই সহকর্মীদের মুখের পতিটি ভাঁজ পর্যন্ত জানি। কথা বলার মতো আমাদের আর কোনো বিষয় নেই, তাই সারাক্ষণ নীরব থাকি। আমরা এতেই অভ্যস্ত। শুধু মাঝে মাঝে অভিশাপ দিই—কারণ সব সময়ই কোনো লোককে, বিশেষ করে নিজের বন্ধুকে অভিশাপ দেবার কিছু না কিছু থাকেই। অবশ্য আমরা একে অপরকে খুব একটা অভিশাপ দিই না। কেউ অর্ধমৃত হয়ে গেলে, পাথরের মূর্তির মতো জড়পদার্থে পরিণত হলে, হাড়ভাঙা খাটুনির চাপে কারো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেলে তাকে কি দোষারোপ করা যায়? যাদের সব কথা শেষ, নীরবতা তাদের কাছে বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর; কিন্তু যাদের কথা এখনো অনুক্ত রয়ে গেছে, তাদের কাছে নীরবতা স্বাভাবিক ও সহজ। মাঝেমধ্যে আমরা গান গাই, কিন্তু সেই গান আসে এইভাবে : কাজ করতে করতে কেউ হয়তো হঠাৎ ক্লান্ত ঘোড়ার মতো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তারপর গুনগুন করে একটা দীর্ঘ টানা সুরে গান গাইতে আরম্ভ করে। সে গানের বিষাদপূর্ণ কোমল সুর গায়কের হৃদয়ের ভারি বোঝা হাল্কা করে দেয়। কোনো একজন গান গায়, আর বাকিরা নীরবে নিঃসঙ্গ গানটি শোনে। এবং শরতের ভেজা রাতে, উন্মুক্ত প্রান্তরে, প্রজ্বলিত আগুনের শিখা যেমন পৃথিবীর উপরে সীসার ছাদের মতো ছেয়ে থাকা ধূসর আকাশের নিচে ধীরে ধীরে নিভে আসে, তেমনি সেই গান এই পীড়াদায়ক অন্ধ প্রকোষ্ঠের ছাদের নিচে ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যায়। তারপর আরেকজন গায়ক প্রথম সুরের সাথে সুর মেলায় এবং দুটো কণ্ঠস্বর এই ঘিঞ্জি ঘরে শ্বাসরোধকারী উত্তাপের মধ্যে মধুর কোমলভাবে ভেসে বেড়ায়। তারপর হঠাৎ বেশ কয়েকটা কণ্ঠস্বর তার সাথে যোগ দেয়—সেই গান যেন তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে এবং বলিষ্ঠ ও তীব্রতর হয়ে মনে হয় আমাদের এই কারাগারের স্যাঁতসেঁতে ভারি দেয়ালগুলো ভেঙে চুরমার করে দেবে।
তারপর ছাব্বিশ জনই গাইতে শুরু করে; বহুদিনের অভ্যাসে গড়ে ওঠা ঐকতানে উচ্চ কণ্ঠস্বরগুলো সমস্ত কারখানাটা ভরে দেয়—এ গান মুক্তির বেদনা প্রকাশ করে; পাথরের দেয়ালে মাথা ঠোকে, গোঙায়, কাঁদে এবং হৃদয়ের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ব্যথার মোচড় আনে, পুরনো ক্ষতগুলোকে প্রকাশ করে এবং বুকের ভেতরে ক্রোধের জন্ম দেয়। গায়কেরা গভীর দীর্ঘশ্বাস নেয়; কোনো একজন হঠাৎ থেমে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বন্ধুদের গান শোনে, তারপর আবার সেই সাধারণ যৌথ সংগীতে গলা মিলিয়ে দেয়। অন্য কোনো একজন চোখ বুজে গান গাইতে গাইতে হতাশার সুরে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আ!’ হয়তোবা, সে শব্দের এই প্রশস্ত তুফানকেই মনে করে দূরগামী কোনো পথ, সূর্যের আলোয় ঝলমল করা কোনো উন্মুক্ত পথ, যে পথ দিয়ে সে হেঁটে চলেছে...।
চু্ল্লীর মুখে আগুনের শিখা তখনো নেচে যায়। যে বিস্কুট ভাজছে, তার বেলচা তখনো ইটের ওপর শব্দ করে, ডেকচিতে জল তখনো টগবগ করে ফুটে চলে, দেয়ালের গায়ে লাল আগুনের আভা তখনো নীরব হাসিতে কাঁপতে থাকে। আর যে গানের বাণী আমাদের সৃষ্টি নয়, সেই গানের কথার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের ভিতরকার ভোঁতা বেদনা, সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত জীবন্ত মানুষের যন্ত্রণাময় বেদনা, গোলামের বেদনাকে প্রকাশ করি। আর এইভাবেই আমরা বেঁচে আছি, আমরা ছাব্বিশ জন লোক একটা বিশাল পাথরের বাড়ির মাটির তলার এক অন্ধকারাচ্ছন্ন বদ্ধঘরে বেঁচে আছি, এবং এখানে জীবনের বোঝা এত ভারি, মনে হয় এই বাড়ির তিনটি তলা যেন আমাদেরই কাঁধের ওপর গড়ে উঠেছে।
গান ছাড়াও একটা জিনিস আছে যাকে আমরা ভালোবাসি ও যাকে নিয়ে আনন্দ করি। এমন একটা কিছু যা সম্ভবত আমাদের না-পাওয়া সূর্যোলোকের স্থান পূরণ করে। আমাদের বাড়িটার দোতলায় একটা জরী-এমব্রয়ডারির কারখানা আছে। অনেক মেয়ে কাজ করে সেখানে, আর তাদের ফাইফরমাশ খাটে ষোলো বছরের একটি মেয়ে তানিয়া। প্রতিদিন সকালে আমাদের কারখানার দরজার ছোট্ট জানালার কাচের উপর একটি খুশি-উজ্জ্বল নীল চোখের গোলাপি মুখ এসে লাগে এবং মিষ্টি রিণরিণে কণ্ঠস্বর আমাদের ডেকে বলে :
‘ওগো জেলঘুঘুরা! কই কিছু নিমকি-বিস্কুট দাও!’
আমরা সকলে সেই উচ্ছল কণ্ঠস্বরে সচকিত হই এবং সেই নিষ্পাপ শিশুসুলভ মুখের দিকে কোমল ও খুশির ভঙ্গিতে তাকাই—আঃ আমাদের দিকে কি মিষ্টি হাসি ছড়ায় ঐ মুখ! আমরা কাচে-চেপ্টে-থাকা নাক এবং হাস্যময় গোলাপি ঠোটের ফাঁক দিয় বেরিয়ে আসা ছোট ছোট চকচকে সাদা দাঁতগুলো দেখতে বড় ভালোবাসি। পরস্পরকে ধাক্কাধাক্কি করে আমরা দরজা খুলতে ছুটে যাই, সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কি প্রাণবন্ত ও স্নিগ্ধ। অ্যাপ্রোনটাকে দুহাতে তুলে ধরে, ঘাড়টাকে সামান্য কাত করে উজ্জ্বল মুখে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার বাদামি চুলের একটা মোটা বেণি কাঁধের উপর দিয়ে বুকের পরে ঝুলছে। মেঝে থেকে চৌকাঠ চার ধাপ উপরে—কালিঝুলি মাখা, শুকনো, কুৎসিত আমরা মাথা উঁচু করে তাকে দেখি ও সুপ্রভাত জানাই। তাকে স্বাগত জানানোর ভাষা একটি বিশেষ ভাষা, কেবল তারই জন্য আমরা এই ভাষা বেছে নিয়েছি। তার সাথে কথা বলার সময় আমাদের সুর কোমল হয়ে যায়, ঠাট্টা হয় হালকা মেজাজের। তার জন্য আমাদের সবকিছুই যেন বিশেষ ধরনের। যে বিস্কুট ভাজে, সে চুল্লী থেকে এক বেলচা মচমচে ভাজা লাল বিস্কুট বার করে খুব দক্ষতার সঙ্গে তানিয়ার অ্যাপ্রোনের ওপর ঢেলে দেয়।
‘দেখো, মালিক যেন দেখতে না পায়!’ আমরা সাবধান করে দিই। সে খিলখিল করে হেসে খুশিতে চিৎকার করে বলে ওঠে :
‘চলি গো জেলঘুঘুরা।’ তারপর খুদে ইঁদুরের মতো চোখের নিমেষে উধাও হয়ে যায়।
ব্যস, ঐ টুকুই...। কিন্তু সে চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ ধরে আমরা তাকে নিয়ে আলোচনা করি—কাল যা বলেছি এবং পরশু যা বলেছিলাম, সেই একই কথা আলোচনা করি, কারণ সে, আমরা এবং আমাদের পারিপার্শ্বিক সবই কাল যেমন ছিল, পরশু যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আছে। চারপাশের কোনো কিছুরই পরিবর্তন না ঘটলে বেঁচে থাকাটা খুবই বেদনাদায়ক ও কঠিন হয়ে পড়ে। যদি এর ফলে তার আত্মার মৃত্যু না ঘটে, তবে যত বেশিদিন সে বেঁচে থাকে, চতুর্পার্শ্বের জিনিসগুলোর পরিবর্তন তত বেশি বেদনায়ক হয়ে ওঠে। আমরা সবসময় মেয়েদের নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করি যে মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের ওপরেই, নিজেদের স্থূল নির্লজ্জ কথাবার্তার ওপরেই বিরক্ত হয়ে উঠি। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই, কারণ যেসব মেয়েদের আমরা চিনি তাদের নিয়ে মার্জিত রুচিতে কথা বলার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু তানিয়াকে নিয়ে কখনো স্থূল আলোচনা করিনি। আমাদের মধ্যে কেউ তাকে স্পর্শ করার কথা ভাবে না এবং সেই কখনো আমাদের কাছ থেকে কোনো স্থূল ইয়ার্কি শোনেনি। সম্ভবত তার কারণ হচ্ছে, সে কখনো বেশি সময়ের জন্য থাকেনি—আকাশ থেকে তারা খসে পড়ার মতো আমাদের দৃষ্টিপটে ধরা পড়েই উধাও হয়ে যায়। অথবা তার কারণ এও হতে পারে যে, সে খুব ছোট ও সুন্দর। এবং যা সুন্দর তা মানুষের, এমনকি লম্পট ও স্থূলরুচির মানুষেরও শ্রদ্ধা জাগ্রত করে। যদিও নিরলস একঘেয়ে খাটুনি আমাদের বোবা ষাঁড়ে পরিণত করেছে, কিন্তু আমরা এখনো মানুষ। আর দশটা মানুষের মতো আমরাও কোনো আরাধ্য বস্তু ছাড়া বাঁচতে পারি না। সেই বাড়িতে এক ডজনের মতো ভাড়াটে থাকা সত্ত্বেও, মাটির তলায় অন্ধকারাচ্ছন্ন এই বদ্ধঘরে অবস্থানকারী মানুষগুলোর চারপাশে তানিয়ার চেয়ে বেশি সুন্দর আর কিছু নেই, আর কেউ আমাদের দিকে তাকায়ও না। সর্বোপরি, সম্ভবত এটাই মূল কারণ যে, আমরা মনে করি সে আমাদেরই। তার অস্তিত্ব বেঁচে আছে আমাদেরই তৈরি বিস্কুটের ওপর। তাকে গরম বিস্কুট দেয়াটা আমরা নিজেদের কর্তব্য করে নিয়েছি। সেই দেবী প্রতিমার কাছে এটা আমাদের দৈনিক অর্ঘ্য, প্রায় একটা পবিত্র ধর্মাচার। ফলে সেও প্রত্যহ বেশি বেশি করে আমাদের আপন হয়ে গেছে। গরম বিস্কুট ছাড়াও আমরা তানিয়াকে অনেক রকম উপদেশ দিই—সে যেন গরম জামা-কাপড় পরে, সিঁড়ি বেয়ে খুব ছুটে না ওঠে, খুব ভারী জ্বালানি কাঠের বোঝা না নেয়। সে হাসতে হাসতে আমাদের উপদেশ শোনে, হাসিমুখেই প্রত্যুত্তর দেয়, আর কখনো সেই উপদেশ মানে না। কিন্তু আমরা সেজন্য রাগ করি না—তার জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছি এতেই আমরা তৃপ্ত।
প্রায়ই সে আমাদের তার কাজ করে দিতে বলে। যেমন, সে যখন একটা অদ্ভুত গর্বভরে আমাদের কোনো গুদামের দরজা খুলে দিতে বা কাঠ কেটে দিতে বলে, আমরা সানন্দে সেই কাজ করে দিই।
কিন্তু আমাদের কেউ যখন তার সবেধন-নীলমণি জামাটির কোনো অংশ সেলাই করে দেবার জন্য অনুরোধ করলো, সে ঘৃণায় নাক সিটকে বলে, ‘আহা কি কথা! ও বাবা আমি পারব না!’
আমরা ঐ বোকা বন্ধুটাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করলাম এবং আর কখনো তাকে কোনো কাজ করার কথা বলি না। আমরা তাকে ভালোবাসি, আর এটাই একমাত্র কথা। মানুষ সব সময়ই তার ভালোবাসার পাত্র খুঁজে বেড়ায়, যদিও তা প্রায়ই অত্যাচারে পরিণত হয়, তার জীবন নোংরা ও বিষাক্ত করে তোলে, কারণ ভালোবাসার সময় মানুষ তার ভালোবাসার পাত্রকে শ্রদ্ধা করে না। তানিয়াকে আমাদের ভালোবাসতেই হবে। ও ছাড়া ভালোবাসার মতো আমাদের আর কেউ নেই।
কখনো-সখনো আমাদের মধ্যে কেউ তর্ক জুড়ে দেয়, ‘এরকম একটা ছোট্ট খুকিকে নিয়ে আদেখলাপনা করার মানে কি? ওর মধ্যে কি এমন আশ্চর্য জিনিস আছে শুনি?’
এরকম কথা যে বলে, তাকে আমরা কঠোর ভাষায় থামিয়ে দিই—আমাদের অবশ্যই ভালোবাসবার মতো কিছু একটা থাকতে হবে; আমরা তা পেয়েছি, তাকে ভালোও বেসেছি, এবং আমরা ছাব্বিশ জন যা ভালোবেসেছি তা আমাদের প্রত্যেকের, সবচেয়ে পবিত্র জিনিস। যে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে, সে আমাদের শত্রু। আমরা যা ভালোবেসেছি হয়তো তা ভালো না হতে পারে; কিন্তু যেহেতু আমরা ছাব্বিশ জনই এর সাথে জড়িত, আমরা চাই অন্যেরাও আমাদের প্রিয় বস্তুটিকে পবিত্র করে রাখবে।
আমাদের ভালোবাসা ঘৃণার চেয়ে কম কষ্টদায়ক নয়... এবং সম্ভবত সেই কারণেই কিছু গোঁয়ার লোক দাবি করে বলে যে ভালোবাসার চেয়ে আমাদের ঘৃণা বেশি চাটুকারিতাপূর্ণ। তা-ই যদি হবে, তবে তারা আমাদের এড়িয়ে চলে না কেন?
বিস্কুট ছাড়াও মালিকের একটা বানরুটির কারখানা আছে। সেটা এই বাড়িতেই এবং একটিমাত্র দেয়াল সেটাকে আমাদের এই ঘিঞ্জিঘর থেকে পৃথক করে রেখেছে। অবশ্য বানরুটির কারিগরেরা সংখ্যায় মাত্র চারজন হলেও, নিজেদের আমাদের থেকে পৃথক করে রাখে। মনে করে তারা আমাদের চেয়ে পরিষ্কার কাজ করে এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত জীব; তারা কখনো আমাদের কারখানায় আসে না এবং যদি উঠোনে তাদের কারো সঙ্গে আমাদের হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, তারা বিদ্রূপসূচক ঘৃণা প্রকাশ করে। আমরাও তাদের কারখানায় যাই না—মালিক এই ভয়ে আমাদের ওখানে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়েছে পাছে আমরা বানরুটি চুরি করি। বানরুটির কারিগরদের আমরাও ঘৃণা করি, কারণ আমরা ওদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। আমাদের চেয়ে ওদের কাজ হালকা, ওরা বেশি মাইনা পায়, ভালো খাবার পায়, ওদের কারখানা বেশ খোলামেলা হাওয়া খেলে, এবং ওরা সকলেই বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যবান। সেই কারণেই তারা এত বেশি ঘৃণ্য। অপরদিকে আমরা সকলেই পাণ্ডুর প্যাঁচামুখো, আমাদের মধ্যে তিনজনের সিফিলিস রোগ আছে, কারো কারো চুলকানি, একজন তো বাতে বিকলাঙ্গ। ছুটির দিন বা রবিবারে তারা স্যুট ও মচমচে উঁচু বুট জুতো পরে, তাদের দুজনের এ্যাকরডিয়ান আছে, এবং তারা সকলে মিলে পার্কে বেড়াতে যায়। আর আমরা নোংরা ছেঁড়া জামাকাপড় পরি, পায়ে থাকে ছেঁড়া কেম্ব্রিজের জুতো, আর পুলিশও আমাদের পার্কে ঢুকতে দেয় না—সুতরাং আমরা কি ঐসব বানরুটির কারিগরদের পছন্দ করতে পারি?
একদিন শুনলাম যে ওদের প্রধান কারিগর মদ খেয়ে মাতলামি করেছে এবং মালিক তাকে খুব গালাগাল করে বদলে অন্য একজন লোক নিয়োগ করেছে। সেই নতুন কারিগরটা আগে সৈনিক ছিল। সে স্যাটিনের ওয়েস্টকোট পরে এবং তার সোনার চেনের একটা ঘড়ি আছে। সেই ফুলবাবুটিকে দেখবার জন্য আমরা খুব উৎসুক হয়ে গেলাম। তাকে দেখবার আশায় একের পর এক ঘন ঘন উঠানে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।
কিন্তু সে নিজেই আমাদের কারখানায় চলে এলো। লাথি দিয়ে দরজা খুলে দরজার গোড়ায় দাঁড়াল, হেসে সম্ভাষণ করলো : ‘কি খবর! খোকনরা সব কেমন চলছে?’
ধূমায়িত মেঘের মতো মিহি তুষার-বাতাস দরজা দিয়ে ঢুকে তার পায়ের কাছে কুণ্ডলি পাকাতে লাগলো, আর সে নিচে আমাদের দিকে তাকিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। গর্বোদ্ধত গোঁফের তলা থেকে তার বড় বড় হলুদ দাঁত চকচক করতে লাগলো। তার ওয়েস্টকোটটা সত্যিই চমৎকার—নীল, তার ওপর এমব্রয়ডারি করা ফুলগুলো চকচক করছে এবং বোতামগুলো এক ধরনের লাল পাথরের তৈরি। চেনটাও আছে।
সৈনিকটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে—লম্বা, গাট্টাগোট্টা চেহারা, গালটা লাল টকটকে এবং বেশ বড় হালকা রঙের চোখজোড়ার দৃষ্টিও খুব সুন্দর—বেশ স্নেহভরা, স্বচ্ছ দৃষ্টি। মাথায় আছে কড়া-মাড়-দেওয়া সাদা টুপি এবং টানটান অ্যাপ্রোনের তলা থেকে অত্যন্ত চকচকে কেতাদুরস্ত জুতোর ছুঁচালো মাথা উঁকি মারছে।
আমাদের প্রধান কারিগর তাকে মোলায়েম ভদ্রতায় দরজাটা বন্ধ করতে বললো। অত্যন্ত ধীরে দরজাটা বন্ধ করে সে মালিক সম্পর্কে আমাদের প্রশ্ন করতে লাগলো। আমরা একজনের কথার ওপর আরেকজন বলতে লাগলাম যে, মালিকটি হচ্ছে একটা হাড়-কিপটে, খচ্চর, বদমাশ এবং অত্যাচারী—মালিক সম্পর্কে আমরা যা যা বললাম তা সব সম্ভবত এখানে লেখা যায় না। গোঁফে তা দিয়ে পরিষ্কার মার্জিত দৃষ্টি দিয়ে আমাদের সম্মান দেখিয়ে সৈনিকটা সব শুনতে লাগলো।
‘তোমাদের এখানে অনেক মেয়ে আছে দেখছি’, হঠাৎ সে বলে উঠলো।
আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ভদ্রভাবে হেসে উঠলো, অন্যরা প্রসন্ন মুখ করে চেয়ে রইল এবং কোনো একজন তাকে জানিয়ে দিল যে এখানে অনেক ডপ্কা তুলতুলে সুন্দরী আছে।
‘ভোগ-টোগ চলে?’ সৈন্যটা চোখ মেরে স্পষ্ট ইঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করে।
আবার আমরা হেসে উঠলাম, এবার একটু নরম করে, বিব্রত ভঙ্গিতে, আমাদের মধ্যে অনেকেরই সৈনিকটির মনে এই বিশ্বাস অর্জন করানোর ইচ্ছে হলো যে, তার মতো আমরাও খোস মেজাজী, কিন্তু তারা তা করতে পারলো না। আমাদের মধ্যে কেউ তা করলো না। কেউ একজন ধীরে এইটুকু শুধু বললো,
‘ওরা আমাদের জন্য নয়...।’
সৈন্যটি আমাদের দিকে চোখ কুঁচকে বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সাথে বললো, ‘নাঃ। তোমরা দেখছি অনেক পেছনে পড়ে আছ। কোনো কাজের লোক নও...। খাঁটি চরিত্র বলতে কিছু নেই।... আসল জিনিসটা কি জানো? আসল জিনিস হচ্ছে চোখের চাউনি। মেয়েছেলেরা পুরুষের চোখের চাউনিকে সচচেয়ে বেশি পছন্দ করে। মোটামুটি শরীর দেখাও... দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, অবশ্য সে কিছুটা ছ্যাঁচা শরীর পছন্দ করে। আর পছন্দ করে ডানার মতো ডানা—একরম।’
সৈন্যটা পকেটে গোঁজা ডান হাতটা বার করে কনুই অবধি হাতাটা গুটিয়ে নেয়, এবং আমাদের দেখাবার জন্য পেশী তুলে ধরে। হাতটা শক্ত ও সাদা, চকচকে সোনালি চুলে ভরা।
‘পা, বুক, সমস্ত কিছুই শক্ত থাকতে হবে। বুঝলে হে, তারপর তোমার পোশাক, সেটাও ঠিক ঠিক থাকা চাই—একেবারে ফিট্ফাট্। এই ধর আমারই কথা—মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে আমার ওপর এসে পড়ে। তা বলে ভেবো না, আমি তাদের পেছনে ছুটি বা তাদের উসকানি দিই—তারা এখনই এসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে—এক একবারে পাঁচজন করে।’
একটা ময়দার বস্তার ওপর বসে সবিস্তারে বলে, মেয়েরা তাকে কেমন করে ভালোবাসে, তাদের নিয়ে সে কি তৎরতার সাথে চলে। তারপর তার প্রস্থান ঘটে। সশব্দে দরজা বন্ধ হয়ে গেলে আমরা দীর্ঘ সময় ধরে নীরবে বসে থাকি। তার কথা ও কাহিনীর কথা ভাবি। তারপর হঠাৎই সবাই একসাথে কথা বলতে শুরু করে দিই। আলোচনায় প্রকাশ পায় যে আমাদের সকলেরই তাকে খুব ভালো লেগে গেছে। কি সুন্দর সরল একটা লোক, সে কিভাবে ভেতরে এলো, বসল এবং গল্প করলো, এইসব নিয়ে আমরা আলোচনা করি। এর আগে কখনো কেউ আমাদের সাথে দেখা করতে আসেনি, কেউ আমাদের সাথে এরকম বন্ধুর মতো কথা বলেনি। আমরা নতুন কারিগরটিকে জড়িয়ে সেই দরজি মেয়েগুলো সম্পর্কে আলোচনা শুরু করে দিলাম, যারা উঠোনে হয় মুখ ভেঙেচুরে চলে যায়, না হয় আমাদের উপস্থিতিকেই উপেক্ষা করে সোজা হাঁটা লাগায়। আমাদের বিশ্বাস, ভবিষ্যতে এ লোকটা ওসব দজ্জালদের জয় করবে। যখন সেইসব মেয়ে শীতকালে পশমের কোট ও সুন্দর ছোট্ট টুপি পরে, এবং গরমকালে ফুলতোলা টুপি ও উজ্জ্বল রঙের ছাতা মাথায় দিয়ে উঠোনে, আমাদের জানলার পাশ দিয়ে যেত আমরা তাদের কেবল প্রশংসাই করতাম। অবশ্য তাদের নিয়ে আমাদের মধ্যে এমনসব আলোচনা করতাম, কানে গেলে ওরা লজ্জা ও ঘৃণায় পাগল হয়ে যেত।
‘আশা করি সে কখনো আমাদের তানিয়ার দিকে যাবে না।’ আমাদের প্রধান কারিগর হঠাৎ উদ্বেগের সুরে কথাটা বলে ফেললো।
এই কথায় আমরা সবাই হতবাক হয়ে গেলাম। তানিয়ার কথা ভুলেই গেছিলাম—সৈনিকটা যেন তার বিশাল সুন্দর চেহারা নিয়ে আমাদের মন থেকে তানিয়ার কথাটা মুছে ফেলেছিল। আমাদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। কেউ কেউ বললো যে তানিয়াকে সে কিছুতেই টলাতে পারবে না, কেউ কেউ বললো তানিয়া সৈনিকটার আকর্ষণ ঠেকাতে পারবে না, এবং অন্যরা প্রস্তাব করলো ব্যাটা যদি তানিয়ার দিকে এগোতে চায়, মেরে ওর হাড় গুঁড়ো করে দেওয়া হবে। অবশেষে সকলে ঠিক করলো যে সৈন্যটা ও তানিয়ার ওপর নজর রাখা হবে, এবং মেয়েটিকে ওর সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হবে। ওখানেই তর্কাতর্কির অবসান হলো।
প্রায় এক মাস কেটে গেল। সৈনিকটা রুটি সেঁকে, দরজি মেয়েদের সাথে বাইরে যায়, প্রায়ই আমাদের সাথে দেখা করতে ঘরে আসে, কিন্তু কখনই তার অধিকার সম্পর্কে কোনো কথা বলে না—কেবল গোঁফ পাকায় ও ঠোঁট চাটে।
তানিয়া প্রতি সকালে বিস্কুট নিতে আসে এবং আগের মতোই সে আনন্দোচ্ছল, মিষ্টি ও ভদ্র। আমরা তার সাথে সৈন্যটার ব্যাপারে কথা বলতে চেষ্টা করি—সে লোকটাকে ‘ড্যাবা চোখের পুতুল’ এবং অন্যরা অদ্ভুত বিশেষণ দেয়, এবং আমরা খুশিই হই। দরজি মেয়েগুলো সৈন্যটার সাথে আঠার মতো লেগে থাকায় আমরা আমাদের ছোট্ট মেয়েটির জন্য গর্ববোধ করি। লোকটার প্রতি তানিয়ার বিরূপ মনোভাব আমাদের খুব উৎফুল্ল করে তোলে, তারই প্রভাবে আমরা সৈন্যটাকে ঘৃণার চোখে দেখতে শুরু করি। আমরা তানিয়াকে আগের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে শুরু করি এবং প্রতি সকালে তাকে বেশি বেশি আনন্দোচ্ছ্বাস ও দরদ দিয়ে সংবর্ধনা জানাই।
যা হোক, একদিন সৈন্যটা মাতাল হয়ে টলতে টলতে আমাদের সাথে দেখা করতে এলো। বসে পড়ে হাসতে শুরু করলো। যখন জিজ্ঞেস করলাম হাসছো কেন? সে বলতে আরম্ভ করলো :
‘লিডা ও গ্রুশা আমাকে নিয়ে মারামারি করেছে। নিজেরাই নিজেদের সাথে ঢলাঢলি করেছে। ওঃ সে কি হিসহিসানি! হাঃ হাঃ, একজন আরেকজনের চুলের মুঠি ধরে মাটিতে টানতে টানতে ঐ গলিটার ভেতর নিয়ে গিয়ে বুকে চেপে বসেছে। হাঃ—হাঃ—হাঃ! একজন আরেকজনের মুখ আঁচড়ে জামা ছিঁড়ে ফেলেছে। আমি কি হাসলাম। এইসব ঢলানি মাগীগুলো সরাসরি লড়াই করতে পারে না কেন? ওরা আঁচড়ায় কেন, এ্যা?’
সে বেঞ্চের ওপর বসে—তাকে কি পরিষ্কার, স্বাস্থ্যবান ও হাসিখুশি দেখাচ্ছে—কি বিরামহীন হাসছে। আমরা কিচ্ছু বললাম না। যে কারণেই হোক, এখন তাকে দেখে আমাদের ঘৃণা হচ্ছে।
‘মেয়েছেলের বিষয়ে আমার ভাগ্য এত ভালো কেন বলতো? সত্যিকারের হিসহিসানি! কেন। আমি একবার শুধু চোখ মারব আর কেল্লা ফতে!’
চকচকে লোমশ সাদা হাতটা সে উপরে তুলল এবং নামিয়ে হাঁটুর ওপরে চাপড় মারলো। সে আমাদের দিকে একটা খুশিভরা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাল, যেন মহিলাদের ব্যাপারে নিজের সৌভাগ্যে সত্যিকারের বিস্ময় বোধ করছে। একটা নির্মল আনন্দে তার গোলগাল লাল মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, আর ঠোঁটের ওপর জিভ বুলাতে লাগলো।
আমাদের প্রধান কারিগর ক্রুদ্ধভাবে বেলচাটা চুল্লির ভেতর ঢুকিয়ে, হঠাৎ ব্যাঙের সুরে বলে উঠলো :
‘নিছক ফার গাছ ফেলায় কোনো মজা নেই—পাইন গাছ নিয়ে কি কর দেখতে ইচ্ছে করে!’
‘কি, কি বললে? আমায় কিছু বলছ?’ সৈন্যটা প্রশ্ন করলো।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে।’
‘তুমি কি বলছ কি?’
‘কিছু মনে করো না...। যা বলেছি থাক।’
‘এই দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি কি নিয়ে বলছ বলতো? পাইন গাছ বলতে কি বোঝায়?’
আমাদের কারিগর উত্তর দিল না। তার বেলচা সেদ্ধ করা বিস্কুটগুলো কড়াইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল এবং ভাজা বিস্কুটগুলো মেজেয় ফেলে দিল। সেখানে ছেলেরা সুতোয় গাঁথছে। সে যেন সৈন্যটার কথা ভুলে গেছে। কিন্তু সৈন্যটা হঠাৎ ক্ষেপে উঠলো। দাঁড়িয়ে কড়াইয়ের কাছে গেল, বেলচার হাতলটা উঁচুতে লাফিয়ে উঠে একটু হলেই তার বুকে আঘাত করত।
‘শোন,—কি বলতে চাও? এটা রীতিমত অপমান। কেননা, এখানে এমন কোনো মেয়ে নেই যে আমার হাত ফসকাতে পারে। না, দাদা এমন কেউ নেই! আর তুমি কিনা আমার সাথে মশকরা করছ?’
মনে হলো সে সত্যিই আহত হয়েছে। এ কথা ঠিক, তার আত্মসম্মানের মূল উৎসই হচ্ছে মেয়ে শিকারের ক্ষমতা; সম্ভবত এই একটিমাত্র মানবিক গুণ নিয়েই সে অহংকার করতে পারে এবং এই একটিমাত্র জিনিসের জন্যই সে মনে করে সে একজন পুরুষ।
এমন লোক আছে যাদের কাছে জীবনের আসল বিষয়ই হচ্ছে দেহ বা মনের বিকৃতি। এ সবই তাদের জীবনকে ঘিরে রাখে, এর জন্যই তারা বেঁচে থাকে। এই বিকৃতির জন্য কষ্ট ভোগ করলেও এর দ্বারাই তারা নিজেদের তৃপ্তি সাধন করে। লোককে তারা এ বিষয়ে নালিশ জানায়, এভাবেই তাদের সহগামীদের চিত্তাকর্ষণ করে, লোকের কাছ থেকে সহানুভূতির মাশুল আদায় করে, আর জীবনে তাদের এই একটিমাত্র জিনিসই আছে। সেই বিকৃতি থেকে বঞ্চিত করলে, সুস্থ করে তুললে তাদের জীবন হয়ে উঠবে একান্তই দুর্বিষহ, কারণ জীবনের মূল উদ্দেশ্যটাই হারিয়ে তারা শূন্য খোলসে পরিণত হবে। কখনো-সখনো মানুষের জীবন এতই হতভাগ্য হয়ে পড়ে যে, পাপকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়, তাকে আঁকড়েই পড়ে থাকে। কেউ হয় বলবেন, মানুষ প্রচণ্ড এক-ঘেয়েমির মধ্যে থেকেই পাপকর্মে আসক্ত হয়ে পড়ে।
সৈন্যটির যেন মর্মে হুল বিঁধেছে। সে আমাদের কারিগরের সামনে গিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করে বলতে লাগলো :
‘না, তুমি বল—কে সে?’
‘বলব, বলছ?’ কারিগর হঠাৎ তার দিকে ঘুরে বললো।
‘হ্যাঁ!’
‘তুমি তানিয়াকে চেন?’
‘আচ্ছা?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার কথাই বলছি! ওকে কি করতে পার দেখব।’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি।’
‘ওকে? অতি সহজে, তুড়ি মেরে!’
‘আমরা দেখতে চাই।’
‘দেখতে চাও! হাঃ হাঃ!’
‘কেন, সে তো—’
‘এক মাসও সময় লাগবে না!’
‘তোমার খুব দম্ভ, তাই না সৈনিক?’
‘ঠিক আছে, তবে পনেরো দিন! আমি তোমাদের দেখাব! কার কথা বললে? তানিয়া? ফুঃ!’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও। লেগে পড়!’
‘মাত্র পনেরো দিন, তারপরই দেখবে কাজ ফতে! বুঝলে হে!’
‘বেরিয়ে যাও!’
কারিগর হঠাৎ রেগে উঠে তার বেলচাটা উঁচিয়ে ধরলো। সৈন্যটা বিস্ময়ে পিছিয়ে এলো, তারপর নীরবে কিছুক্ষণ আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁত কড়মড়িয়ে বলে উঠলো, ‘ঠিক আছে!’ তারপর বেরিয়ে গেল।
গভীর আগ্রহে, নীরবে এই লড়াইটা শুনছিলাম। কিন্তু সৈনিকটি চলে যেতেই আমরা সবাই চিৎকার করে উত্তেজিত বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়লাম।
কে যেন একজন কারিগরকে চিৎকার করে বলে উঠলো :
‘পেভেল, তুমি একটা বাজে জিনিসের সূত্রপাত ঘটালে!’
‘নিজের কাজ কর!’ কারিগর ধমক দিয়ে উঠলো।
আমরা বুঝতে পারলাম যে সৈন্যটির অহংকারে ঘা লেগেছে এবং তানিয়া বিপদে পড়বে। এবং এটা জানা থাকা সত্ত্বেও আমরা সকলেই কি হয় জানবার একটা তীব্র আনন্দদায়ক কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে পড়লাম। তানিয়া কি সৈন্যটির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে? আমরা প্রায় বিনা প্রতিবাদে এই প্রত্যয় উচ্চারণ করলাম :
‘তানিয়া? অবশ্যই জিতবে! সে অত সস্তা নয়, তাকে নিয়ে খেলা অত সোজা নয়।’
আমাদের আরাধ্য দেবীকে এই পরীক্ষায় নামাবার জন্য ভয়ঙ্কর উৎকীর্ণ হয়ে উঠলাম। পরস্পরকে আপ্রাণ বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে আমাদের দেবীমূর্তি অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং সে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেই। উল্টো, আমরা এও আলোচনা করতে লাগলাম যে আমরা সৈন্যটিকে যথেষ্ট তাতাতে পেরেছি কি না—কারণ আমার ভয় হলো যে, সে হয়তো এই বাজির কথা ভুলে যাবে, তাই তার আত্ম-অহংকারে আরও কিছু খোঁচা লাগাতে হবে। এখন থেকে একটা নতুন উত্তেজক উৎসাহ আমাদের জীবনে যুক্ত হলো, এ এমন একটা জিনিস যার স্বাদ আমরা আগে কখনোই পাইনি। বেশ কয়েকদিন ধরে আমরা নিজেদের মধ্যে তর্কাতর্কি করলাম; আমরা সবাই কিভাবে যেন বেশ চালাক হয়ে উঠেছি, ভালো ভালো কথা বেশি বেশি করে বলতে লাগলাম। আমরা যেন শয়তানের সাথে একটা খেলায় মেতেছি, আমাদের লড়াইয়ের সম্বল হচ্ছে তানিয়া। যখন বানরুটির কারিগরের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে তাদের সৈনিকটি ‘তানিয়ার জন্য মরণযাত্রা শুরু করেছে’, আমাদের উত্তেজনা চরম সীমায় উঠে গেল। উত্তেজনাময় অভিজ্ঞতায় জীবন এমন ভরপুর হয়ে উঠলো যে, লক্ষ্যই করলাম না কোন ফাঁকে মালিক এই সুযোগে আমাদের দিয়ে প্রতিদিন অতিরিক্ত চোদ্দ দলা ময়দার কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আমাদের কাজে আর ক্লান্তিও আসছে না। সারাদিনই মুখে তানিয়ার নাম ঘুরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো একদিন আমাদের কাছে এলে দেখব যে এক অন্য তানিয়া এসেছে, এ যেন সেই তানিয়া নয় যাকে আমরা সব সময় জানতাম।
অবশ্য, আমরা ঐ বাজি সম্পর্কে তাকে কিছু বলিনি।
তাকে কখনো কোনো প্রশ্ন করিনি বরং একই স্নেহভরা ভালো ব্যবহার করেছি। কিন্তু আমাদের মনোভাবের মধ্যে যেন নতুন কিছু একটা প্রবেশ করেছে, যা তানিয়া সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক—আর নতুন উপাদানটি হচ্ছে অদম্য কৌতূহল, এমন কৌতূহল যা ইস্পাতের ফলার মতো তীক্ষ্ন ও শীতল।
‘খোকারা! আজ শেষ দিন!’ কোনো এক সকালে কারিগর কাজ শুরু করে বললো।
মনে না করিয়ে দিলেও আমরা খুব ভালোভাবেই তা জানতাম। তবুও সবাই চমকে উঠলাম।
‘তোমরা তানিয়াকে লক্ষ্য রেখো। ও এখুনি ভেতরে আসবে,’ কারিগর পরামর্শ দিল। কে যেন অনুতাপের সাথে বলে উঠলো :
‘এ জিনিস চোখে দেখে বোঝা যায় না।’
এবং আবার একটা হৈচৈ তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেল। আজকে, অবশেষে আমরা জানতে পারব যে পাত্রে আমরা আমাদের অন্তরের সর্বোৎকৃষ্ট বস্তুটি বিশ্বাস করে রেখেছি সেটা কতখানি পবিত্র, নিষ্কলুষ। এই প্রথম একটি সকাল আমাদের সামনে আসছে যখন আমরা সর্বোচ্চ পণ দিয়ে জুয়ো খেলছি, যখন আরাধ্য দেবীমূর্তির পরীক্ষা আমাদের ভরাডুবি ঘটাতে পারে। এতদিন শুনে আসছি যে সৈনিকটি তানিয়াকে কাছে টানবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক আমরা কেউ তানিয়াকে তার সম্বন্ধে প্রশ্ন করিনি। সে বরাবরের মতোই প্রতি সকালে আমাদের কাছে বিস্কুট নিতে এসেছে এবং সব সময়েই নিজের মতোই ছিল।
সেদিনও আমরা তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম :
‘কি গো, জেলঘুঘুরা। আমি এসেছি...।’
তাড়াতাড়ি তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলাম এবং যখন সে ভেতরে এলো, বিপরীত পদ্ধতিতে তাকে স্বাগত জানালাম—সেটা হলো নীরবতা। আমরা তার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালাম এবং বুঝতে পারলাম না কি বলবো, কি জিজ্ঞেস করবো। তার সামনে দাঁড়িয়ে একজন নির্বাক, গোমরামুখো লোক। এই অস্বাভাবিক সম্বর্ধনা পেয়ে সে অবশ্যই অবাক হয়ে গেল, এবং হঠাৎ দেখলাম সে ফ্যাকাশে হয়ে গ্যাছে, তাকে অস্থির দেখাচ্ছে। ধরা গলায় সে প্রশ্ন করলো :
‘তোমরা সবাই আজ এতো অদ্ভুত কেন?’
‘তোমার খবর কি?’ কারিগর তার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলো।
‘আমার আবার কি খবর?’
‘না কিছু না।’
‘ঠিক আছে, বিস্কুট দাও, জলদি।’
আগে কখনো সে তাড়া দেখায়নি!
‘অনেক সময় আছে’, কারিগর স্থির দৃষ্টিতে উত্তর দিল।
হঠাৎই সে ঘুরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল।
কারিগর তার বেলচা তুলে নিয়ে চুল্লীর দিকে ঘুরে শান্তভাবে বললো :
‘হ্যাঁ, সে ধরা দিয়েছে! সৈন্যটা, শয়তানটা জয় করেছে।’
আমরা ভেড়ার পালের মতো পরস্পরকে গুঁতো মারতে মারতে টলতে টলতে টেবিলে ফিরে গিয়ে বসে পড়লাম এবং নীরবে উদাসভাবে কাজ শুরু করে দিলাম। কোনো একজন তখন বলে উঠলো :
‘সে ধরা নাও দিতে...।’
‘চুপ কর অনেক হয়েছে!’ কারিগর চিৎকার করে উঠলো।
সবাই জানি সে বুদ্ধিমান, আমাদের সকলের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান। তার চিৎকারই আমাদের বলে দিল যে সৈনিকের বিজয় সম্পর্কে সে নিশ্চিত। আমরা বিষণ্ন ও হতবিহ্বল বোধ করতে লাগলাম।
বারোটার সময়—মধ্যাহ্নভোজের সময়—সৈনিকটি ভেতরে এলো। সে বরাবরের মতোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ফিটফাট, এবং আগের মতোই সোজাসুজি আমাদের মুখের দিকে তাকালো। তার দিকে তাকাতে আমরা খুবই অস্বস্তি বোধ করছি।
‘কি গো, মহাশয়েরা, দেখতে চাও একজন সৈনিক কি করতে পারে? সবাই ঐ সরু পথটায় গিয়ে দাঁড়াও, দেয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারো। বুঝলে আমার কথা?’ সে গর্বভরে কথা কটা বললো।
আমরা দল বেঁধে সরু পথটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। একে অপরের উপরে ঠাসাঠাসি কাঠের দেয়ালের একটা ফাঁকের মধ্যে আমাদের মুখগুলো চেপে ধরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দেখলাম তানিয়া দ্রুত পায়ে, উদ্বিগ্ন দৃষ্টি নিয়ে গলা বরফ ও কাদা-ভরা গর্তের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠোনটা পার হয়ে গুদাম ঘরের দরজার ভেতরে ঢুকে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সৈনিকটিও শিস দিয়ে অলসভাবে ঘোরাঘুরি করতে করতে সেখানে ঢুকে গেল। হাত দুটো তার পকেটে ঢোকানো আর গোঁফজোড়া নাচছে।
বৃষ্টি পড়ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি গর্তটায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে বুদবুদ উঠছে। দিনটা ভেজা ধূসর, অত্যন্ত বিষণ্ন। ছাদে এখনো তুষার পড়ে আছে, মাটিটা থকথকে কাদায় ভরা। ছাদের ওপরের বরফও খয়েরি রঙের ধুলোয় ধূসরিত। এই পথটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা খুব অস্বস্তিকর এবং ঠাণ্ডাও খুব বেশি।
ঐ গুদাম ঘর থেকে প্রথমে বেরিয়ে এলো সৈনিকটি। পকেটে দুটো হাত চুকিয়ে, গোঁফ নাচাতে নাচাতে, সে তার অভ্যেস মতোই অলসভাবে উঠোনটা পার হয়ে গেল।
তারপর বেরিয়ে এলো তানিয়া। তার চোখজোড়া... তার চোখজোড়া আনন্দ ও খুশিতে উজ্জ্বল, আর ঠোঁটে রয়েছে হাসি। আর সে যেন স্বপ্নের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছে, অসংলগ্ন পা ফেলে, দুলে দুলে...।
আমাদের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। হঠাৎ সবাই ধাক্কাধাক্কি করে দরজা দিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এলাম এবং ভয়ংকর, সুউচ্চ, আদিম গর্জনের মতো আমরা তার দিকে চিৎকার করে উঠলাম, শিস দিতে শুরু করলাম।
আমাদের দেখেই সে চমকে উঠলো এবং স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একটা নোংরা গর্তে তার পা পড়েছে। তাকে ঘিরে ধরে নোংরা ও অশ্লীল বিদ্রূপ বর্ষণ করে আমরা এক ধরনের বীভৎস উল্লাসে তাকে অভিশাপ দিতে লাগলাম।
যখন দেখলাম ব্যূহ করে তার পক্ষে বেরিয়ে যাওয়া অসম্ভব, তার মনের ইচ্ছেয় বিদ্রূপ করা যাবে, তখন কোনো তাড়াহুড়ো না করে, নিচু গলায় আমরা এসব করতে লাগলাম। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, আমরা ওকে আঘাত করলাম না। সে আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে সমস্ত অপমান শুনছে, এবং আমরা আরো বেশি জোরে ও ক্রুদ্ধভাবে আমাদের ক্রোধের বিষ ও বিষ্ঠা তার দিকে ছুড়ে দিতে লাগলাম।
তাঁর মুখ প্রাণহীন, ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সেই নীল চোখজোড়া, একটু আগেও যা খুশিতে ভরপুর ছিল, ঘোলাটে হয়ে গেল। সে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগলো, তার ঠোঁট কাঁপতে শুরু করলো।
এবং আমরা তাকে চারদিক থেকে বেষ্টন করে তার প্রতি আমাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে লাগলাম—কারণ, সে কি আমাদের নিঃস্ব করে দেয়নি? সে ছিল আমাদের। তার জন্যই হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ অনুভূতিগুলো হারিয়েছি, এবং যদিও সেইসব শ্রেষ্ঠ অনুভূতি নিতান্তই একটি ভিক্ষুকের সম্পদ, কিন্তু আমরা ছাব্বিশ জন আর সে একা এবং তার অপরাধের সমতুল্য কোনো বেদনাই আমরা প্রকাশ করতে পারলাম না। আমরা কি ভাবেই না তাকে অপমান করলাম! সে একটি কথাও বললো না, কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে তার সারা শরীর কাঁপতে লাগলো এবং সে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমরা হো হো করে হাসলাম, হুংকার দিলাম, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলাম। অন্যান্য লোকেরাও এসে পড়লো। আমাদের একজন তানিয়ার ব্লাউজের হাতা ধরে টানল।
হঠাৎ তার চোখ জ্বলে উঠলো। সে ধীরে হাত তুলে চুল ঠিক করলো এবং স্থির উচ্চস্বরে আমাদের মুখের ওপর বলে উঠলো :
‘ওঃ, যত সব জঘন্য জেলঘুঘু!’
যেন আমরা সেখানে নেই, তার পথে দাঁড়িয়ে নেই, ঠিক এইভাবে সে সোজা আমাদের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গেল। বস্তুত মনে হলো, ঠিকই যেন আমাদের কেউই তার পথে দাঁড়িয়ে নেই। বেষ্টনী থেকে যখন সে পুরোপুরি বেরিয়ে গেছে, আমাদের দিকে না তাকিয়ে ঘৃণা ও গর্ব মিশ্রিত স্বরে একই রকম চিৎকার করে সে বলে উঠলো :
‘যত সব নোংলা, শুয়োরের দল। জন্তুর দল।’ এবং সে চলে গেল—সোজা, সুন্দর ও গর্বিত।
উঠোনে কাদার মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, মাথার উপর বৃষ্টি পড়ছে এবং ধূসর আকাশে সূর্যের দেখা নেই।
তারপর আমরাও আবার আমাদের স্যাঁতসেঁতে কুঠুরির কারাগারে ফিরে গেলাম। আগের মতোই, সূর্য কখনো আমাদের জানলা দিয়ে উঁকি মারে না। এবং তানিয়াও আর কখনো এখানে আসে না।
0 মন্তব্যসমূহ