এ শহরের বিষয় অস্বাভাবিক ও দুর্বোধ্য। গির্জার আকাশমুখী বিচিত্র গম্বুজ ছাড়িয়ে কল-মিলের প্রাচীর ও চিমনিগুলো মাথা উঁচু করে আছে। মনে হয়, বণিকদের ঘনসন্নিবিষ্ট অট্টালিকার প্রাণহীন ইট-কাঠ-পাথরের গোলকধাঁধায় গির্জাগুলো ঝাপসা ও বিবর্ণ। যেন ধুলা ও ভগ্নস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছে কিছু সুন্দর ফুল। সকাল সন্ধ্যায় প্রার্থনাকারীদের উদ্দেশে গির্জার ঘণ্টার ধাতব আওয়াজ ছাদের লোহালক্কড়ে আছাড় খেয়ে সুউচ্চ প্রাসাদের সঙ্কীর্ণতায় হারিয়ে যায়।
শহরে অট্টালিকার সংখ্যা প্রচুর এবং অধিকাংশই সুন্দর, অভিজাত কিন্তু ভিতরে বাসা বেঁধে আছে এক প্রকার নোংরা ও ঘৃণ্য জীব। উদায়াস্ত ধেড়ে-ইঁদুরের মতো তারা কেবল ইতস্তত অলিগলিতে চলাফেরা করে। কেউবা স্থূল আমোদ, কেউ বা লোলুপ দৃষ্টিতে রুটির সন্ধানে ব্যস্ত। এছাড়াও প্রকাশ্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু মানুষ ভুখা, দুর্বলদের প্রতি এমন তীক্ষ্ন, সদাজাগ্রত দৃষ্টি রাখছে যাতে প্রতিষ্ঠাবানদের প্রতি এইসব দীন-দরিদ্রের বিনম্র আচরণের কোনো অভাব না ঘটে। স্বভাবতই প্রতিষ্ঠাবানরা হলো শহরের ধনী সম্প্রদায়। এখানে অর্থ হলো ক্ষমতা ও স্বাধীনতার সারবস্তু। প্রত্যেকেই ক্ষমতালোভী কারণ তারা গোলাম, তাই ধনীর বিলাস-ব্যসন গরিবের হিংসা ও ঘৃণার বস্তু এবং এ শহরে স্বর্ণালংকারের রিনিঝিনিই হলো মৃদু ও মধুর সঙ্গীত। এখানে মানুষ পরস্পরের শত্রু এবং হিংস্র পথে চালিত।
কখনো-সখনো শহরের আকাশে আলো-ঝলমল সূর্যের সাক্ষাৎ মেলে, কিন্তু জীবন এখানে সর্বক্ষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন; মানুষগুলো যেন ছায়ামূর্তি। রাতে শহরের বুকে অসংখ্য উজ্জ্বল আলো জ্বললেই, ক্ষুধাতুরা কামিনীগণ সামান্য অর্থের আশায় ভালোবাসার ছলাকলা বিক্রির উদ্দেশে পথে নামে। এ সময়ে বিভিন্ন সুস্বাদু খাদ্যের ঘ্রাণে উপবাসীর চোখজোড়া ক্ষুধার আগুনে নীরব ক্রোধে জ্বলতে থাকে—মনে হয় শহরের আকাশে বাতাসে দারিদ্র্যের ক্ষীণ, চাপা, যন্ত্রণাকাতর গোঙানি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। জীবন এখানে বিষণ্ন ও উদ্বেগপূর্ণ। অধিকাংশই বিপথে চালিত, অবশ্য কিছুসংখ্যক মানুষের পৌরুষ আছে, কিন্তু তাদেরও হৃদয় হিংস্রতা ও পশুশক্তিতে আচ্ছন্ন।
এখানে প্রত্যেকেই বেঁচে থাকতে আগ্রহী কিন্তু সঠিক পথ তাদের জানা নেই। কেউই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কাঙ্ক্ষিত জীবনযাত্রায় এগিয়ে যেতে সাহস পায় না। ভবিষ্যৎ স্বপ্নের উদ্দীপনার কয়েকটি পদক্ষেপের পরই ভয়াবহ বর্তমান পিছন হটে আসতে বাধ্য করে। কারণ সে এখন ঘৃণ্য, লোভী এক দৈত্যের নিষ্ঠুর বাহুপেষণে আবদ্ধ। অসহায় এক মূক যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষ তাই জীবনের এই কুৎসিত রূপ দেখে শিউরে ওঠে। সে বীভৎস রূপ তার অন্তরে হাজার হাজার বিষণ্ন ও অসহায় দৃষ্টি মেলে ভাষাহীন এক প্রার্থনা জানায়। অন্যদিকে ভবিষ্যতের উদ্দীপনাটুকু হারিয়ে যেতেই প্রতিটি মানুষের অক্ষম আর্তনাদ জীবনবেদীতে বিক্ষত আর দশটা হতভাগ্যের ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। এখানে ছায়ার মতো লেগে আছে বিষাদ ও উদ্বেগ—কখনো বা সন্ত্রাস। গির্জা-আড়াল-করা পাষাণস্তূপকে বুকে নিয়ে, ধূসর অন্ধ শহর অসংখ্য মানুষকে উদরস্থ করে স্থিরনিশ্চল। যেন কারারুদ্ধ সে মানুষগুলো চিরদিন সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত থাকবে। এখানে জীবনের সংগীত হলো যন্ত্রণা ও ক্ষোভের চাপা ক্রন্দন, অবরুদ্ধ ঘৃণার মৃদু, হিসহিসানি, ভয়সঞ্চারী নিষ্ঠুরতার উল্লাস এবং জৈবিক হিংস্রতার উন্মত্ততা।
দুই
তবুও চারদিকের এই দুঃখ, দুর্ভাগ্যের বিষণ্ন আবর্তে, লোভ ও অভাবের পিচ্ছিল কবলের মধ্যে, আত্মম্ভরিতার চোরাবালিতে, সামান্য সংখ্যা স্বপ্নচারী সবার অলক্ষ্যে শহরের নিচুতলায় ঘুরে বেড়ায়। সেখানে বাস করে অগণিত সর্বহারা, যাদের শ্রমে গড়ে উঠেছে শহরের ঐশ্বর্য এবং ইমারত। ঘৃণা ও উপহাসের মধ্যেও মানুষের প্রতি অগাধ বিশ্বাসে স্বপ্নচারীরা বিপ্লবের বাণী প্রচার করে। এক কথায় তারাই হলো খাঁটি সত্যের ভবিষ্যৎ অগ্নিশিখার এক একটি বিপ্লবী স্ফুলিঙ্গ। সেখানে তারা সর্বক্ষণ সরল, মহান শিক্ষার এক ক্ষুদ্র ফলপ্রসূ বীজ বহন করে বেড়ায়; কঠিন প্রত্যয়ে, হৃদয়ের মৃদু উত্তাপ ও ভালোবাসার শীতল সপ্রভ দৃষ্টিতে মানুষগুলোর ভারাক্রান্ত জীবনের পক্ষ উজ্জ্বল, জ্বলন্ত সত্যের বীজ বপন করতে থাকে—দীর্ঘদিন যাবৎ যে মানুষগুলো কেবল লোভী, অত্যাচারীদের হাতে মনুষ্যত্ব হারিয়ে নিছকই ঐশ্বর্য উৎপাদনকারী মূক পশুতে পরিণত হয়েছিল। নিচুতলার সেই সকল মানুষ এক শব্দের ঝঙ্কারে কেমন বিহ্বল হয়ে থাকে, ঠিক বিশ্বাস করতে চায় না। অথচ তাদেরই শ্রান্ত হৃদয়গুলো সেই ঝঙ্কারের জন্য দীর্ঘদিন ব্যাকুল হয়ে ছিল। তাই এ শব্দের মৃদু ব্যঞ্জনায় শক্তিশালী উৎপীড়কের মিথ্যা ছলনার পাশ ছিন্ন করে মানুষগুলো ধীরে ধীরে আপন আপন মাথা তুলতে থাকে।
ক্রোধ-চাপা ধূসর প্রাত্যহিক জীবনে, নানা অন্যায়ের বিষে জর্জরিত হৃদয়ে, বিত্তশালীর মিথ্যা পাণ্ডিত্যের শিকার হয়ে, গ্লানি ও বঞ্চনায় আকণ্ঠ-নিমজ্জিত মানুষগুলোর কাছে যেন এক সুন্দর, উজ্জ্বল বস্তু নিক্ষেপিত হলো : ‘কমরেড!’
শব্দটি এ মানুষগুলোর কাছে অপরিচিত নয়, তারা পূর্বেও শুনেছে, মনে মনে উচ্চারণ করেছে, কিন্তু তখন গতানুগতিক দশটা নীরস বস্তুর মতো মনে হয়েছে ফাঁকা ও বিবর্ণ। কিন্তু আজ সে এক নির্মল, সুস্থ, নতুন বার্তার ইঙ্গিত নিয়ে হাজির হয়েছে, যেন মহামূল্যবান এক হীরকখণ্ড।
আন্তরিকভাবে এই মানুষগুলো কোমল অপত্যস্নেহে মনের মধ্যে শব্দটিকে পোষণ করে, অনেকটা স্নেহময়ী মায়ের সন্তানকে দোলায় দোল দেয়ার মতো। যতই সেই উজ্জ্বল শব্দটির গভীর মর্মস্থলে প্রবেশ করা যায়, ততই মনে হয় সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের ঠোঁট মৃদু নড়ে ওঠে : ‘কমরেড!’
এ ধ্বনির মধ্যে তারা উপলব্ধি করে বিশ্বভ্রাতৃত্বের বাণী, স্বাধীনতার উচ্চশিখরে মাথা তুলবার আহ্বান এবং সমস্ত মানুষকে এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ করার স্পৃহা, যে বন্ধন হলো মনুষ্যত্বের শ্রদ্ধা ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মান। এই গভীর অর্থবহ ধ্বনি যখন শহরের নিষ্পেষিত গোলামদের অন্তরে শিকড় বিস্তার করে, মনের দৈন্য ছিন্ন হয়ে যায়। একদিন তারাই এই শহরের সম্ভ্রান্তদের উদ্দেশে বলে : ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।’
তখনই জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যায় কারণ এরাই হলো সচল জীবনযাত্রার মূল চালিকাশক্তি। শহরের জলপ্রবাহ বন্ধ, চুল্লির অগ্নি নির্বাপিত, ঘন অন্ধকারে সুউচ্চ প্রাসাদগুলি নিমজ্জিত। মহাশক্তিধর ধনীদের মনে হয় অসহায়, অনাথ। ভয় তাদের গ্রাস করে। আপন জঞ্জালের পূতিগন্ধময় প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে, নিচুতলার বিদ্রোহীদের প্রতি চিরদিনের ঘৃণাকে আপাত-দমন করে রাখে কারণ শহরের নিচুতলার মানুষদের বিপুল শক্তিতে এই সকল বিত্তশালীরা এখন বিস্ময়াভূত। ক্ষুধার বিভীষিকা তাড়া করে বেড়ায় এবং অন্ধকারে শোনা যায় শিশুদের করুণ আর্তনাদ। প্রাণহীণ লোহা-পাথরে ঠাসা প্রাসাদ ও গির্জায় বিষাদের ছায়া, পথে-ঘাটে শীতল মৃত্যুর মতো অশুভ নীরবতা। এতদিন যারা শুধু রথের চাকাই টেনে গেছে, তারা সচেতন হয়ে ওঠায় জনজীবন স্তব্ধ। শহরের এই সকল গোলামরা এক জাদুবলে যে অজেয় আত্মশক্তির সন্ধান পেয়েছে তা হলো সৃষ্টিশক্তি।
বিত্তশালীদের পক্ষে এ দিনগুলো বড় দুঃসহ। এতদিন যারা নিজেদের শুধু প্রভু বলে মনে করত, তাদের কাছে অন্ধকার রাত অনন্তপ্রসার এবং বিষাদপূর্ণ। প্রাসাদের ক্ষীণ আলো এতই নিষ্প্রভ ও করুণ—মনে হয় শত বৎসরের প্রাচীন শহরটার মৃতদেহের ওপর রক্তলোভী এক দৈত্য ইট-কাঠ-পাথরের জঘন্য কুৎসিত চেহারা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। অন্ধ জানলাগুলো বিষণ্ন ক্ষুধিত দৃষ্টিতে রাজপথের দিকে তাকানো, যেখানে চলছে জনজীবনের সত্যিকারের প্রভুদের আজ নতুন উদ্যমে পদচারণা। তারাও ক্ষুধা-তৃষ্ণায় ক্লান্ত, এমনকি গৃহে-আবদ্ধ মানুষগুলোর চাইতে একটু বেশিই, কিন্তু এ ক্লান্তি ধনীদের মতো তাদের অসহায় করে তোলেনি কিংবা হৃদয়ের উজ্জ্বল দীপশিখাকে এতটুকু নিষ্প্রভ হতে দেয়নি। বরং আত্মশক্তিতে উদ্দীপিত হয়ে তাদের চোখে-মুখে জয়ের প্রত্যাশা। যে শহর এতদিন তাদের কাছে ছিল গুমোট, রুদ্ধকণ্ঠ এক কারাগার, যেখানে তাদের ভাগ্যে শুধু জুটত নিদারুণ অবজ্ঞা ও উপহাস এবং ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে জমে উঠত পাহাড় প্রমাণ অভিযোগের স্তূপ, সেই শহরের রাস্তায় আজ মানুষগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথা তুলে। এতদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় তারা বুঝেছে শ্রমের তাৎপর্য, আজ সে আলোতেই জীবনের প্রভু হওয়ার পবিত্র অধিকার সম্বন্ধে তারা সচেতন। তারা শহরের নতুন সৃষ্টি ও বিধানকর্তা। তাই এক নতুন শক্তি, নবজীবনের বার্তাবহ অতি উজ্জ্বল শব্দটি বেজে উঠলো : ‘কমরেড!’
এ যেন বর্তমানের প্রবঞ্চনাময় হাজার শব্দের মধ্যে ভবিষ্যতের এক অমূল্য বাণীমন্ত্র। নতুন যে জীবনের জন্য এতদিন মানুষগুলো উন্মুখ হয়ে ছিল, আজ কি তার লগ্ন আগতপ্রায়, না এখনো তা মরীচিকা? ব্যাপারটা তাদেরই স্থির করার কথা। যে-মুক্তির দিকে আজ তারা ধাবমান, এতদিন নিজেরাই তার আগমনকে বিলম্বিত করে তুলেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ