Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

বায়ু বহে পূরবৈয়াঁ | চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মেয়ে-স্কুলের গাড়ির সহিস আসিয়া হাঁকিল—‘‘গাড়ি আয়া বাবা৷’’

অমনি কালো গোরো মেটে শ্যামল কতকগুলি ছোট বড় মাঝারি মেয়ে এক-এক মুখ হাসি আর চোখভরা কৌতুক-চঞ্চলতা লইয়া বই হাতে করিয়া আসিয়া দরজার সম্মুখে উপস্থিত হইল৷ একটি ছোট মেয়ে একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া ঝাঁকড়া চুল ময়ূরের পেখম-শিহরণের মতন কাঁপাইয়া তুলিল৷ হাসিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতে পড়িতে, তাহার পশ্চাতে দণ্ডায়মান একটি কিশোরী সুন্দরীকে বলিল—‘‘দেখ ভাই বিভা-দি, এ আবার কি রকম সহিস!’’

বিভা তাহার সুন্দর চোখ দুটি নূতন সহিসের মুখের উপর একবার বুলাইয়া লইয়া হাসিমুখে বলিল—‘‘কি রকম সহিস আবার? অত হাসছিস কেন মিছি-মিছি?’’

ছোট মেয়েটি তেমনি হাসিতে হাসিতে বলিল—‘‘কত বড় ঘোড়ার কতটুকু সহিস!’’

এতক্ষণে তাহার হাসির কারণ বুঝিতে পারিয়া সব মেয়ে ক’টিই হাসিয়া হাসিয়া বার বার তাহাদের স্কুলগাড়ীর ছোট্ট নূতন সহিসের দিকে চাহিতে লাগিল৷

সহিস বেচারা একেবারে নূতন, তাহাতে বালক এই সব ফুলের মতো মেয়েদের পরীর মতো বেশ দেখিয়াই সে অবাক হইয়া গিয়াছিল৷ এখন তাহাদের হীরক-ঝরা হাসির ধারা দেখিয়া একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িল৷ সঙ্কোচে লজ্জায় থতমত খাইয়া সে একবার ঈষৎ চোখ তুলিয়া অপাঙ্গে মেয়েদের দিকে তাকায়, আবার পরক্ষণেই চক্ষু নত করে৷

বিভার মনে পড়িল রবিবাবুর ইওরোপের ডায়ারির কথা৷ ইটালিতে আঙুরের মতো একটি ছোট্ট মেয়ে প্রকাণ্ড একটা মোষকে দড়ি ধরিয়া চরাইয়া লইয়া বেড়াইতেছে দেখিয়া, চশমাপরা দাড়িওয়ালা গ্রাজুয়েট স্বামীর ছোট্ট নোলক-পরা বৌয়ের উপমা তাঁহার মনে পড়িয়াছিল৷ বিভারও তাই ভারি হাসি পাইল৷ সে হাসিমুখে তাহার সঙ্গিনীদের ধমকাইয়া বলিল—‘‘নে নে থাম, শুধু-শুধু হাসতে হবে না৷ চ৷’’

পশ্চাৎ হইতে পুরাতন সহিস চিৎকার করিয়া উঠিল—‘‘আস না বাবা! বহুত দেরি হচ্ছে যে!’’

মেয়েগুলি কাহারো শাসন না মানিয়া তেমনি হাসিতে হাসিতে লজ্জিত কুণ্ঠিত বালক সহিসের হাতে নিজেদের বই শেলেট খাতা চাপাইয়া দিয়া চলন্ত ফুলগুলির মতো আপনাদের চারিদিকে একটি রূপের মোহের আনন্দের হিল্লোল বহাইয়া একে একে গিয়া গাড়ীতে উঠিল—কোনোটি ফুটন্ত, কোনোটি ফোটো ফোটো, কোনোটি বা মুকুল কলিকা৷ সহিস দুজন গাড়ির পিছনে পা-দানের উপর চড়িয়া দাঁড়াইল৷ গাড়ি দূরের মেঘ-গর্জনের মতো গুরু-গম্ভীর শব্দে পাড়াটিকে উচ্চকিত করিয়া অপর পাড়ায় মেয়ে কুড়াইতে ছুটিয়া চলিতে লাগিল৷

যে মেয়েটি প্রথমেই হাসির ফোয়ারার চাবি খুলিয়া দিয়াছিল, সে লম্বা গাড়ীর অন্ধকার জঠরের ভিতর হইতে গাড়ীর পিছন দিকের চৌকা জানালার ঘুলঘুলির মুখের কাছে সেই নূতন সহিসকে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া আবার হাসিতে হাসিতে কুটিকুটি হইয়া বলিল—‘‘দেখ বিভাদি দেখ, ওর মাথায় কি টোকা-পানা-চুল!’’

বিভা গাড়ীর পিছনের জানলার মুখের কাছেই বসিয়া ছিল৷ সে একবার যেন বাহিরের দিকে চাহিতেছে, এমনি ছলে নূতন সহিসকে দেখিয়া লইল৷ তাহার একমাথা বাবরি চুল রুক্ষ জটায় এলোমেলো হইয়া মুখের চারিদিকে উড়িয়া উড়িয়া আসিয়া পড়িতেছে৷ তাহার মাঝখানে যেন কালো পাথর কাটিয়া কুঁদিয়া-বাহির-করা কিশোর সুকুমার মুখখানি একটি নীল পদ্মের মতো, রমণীয় হাসির সম্মুখে লজ্জিত কুণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছে৷

বিভা সংক্রামক হাসি কষ্টে চাপিয়া চোখ দুটিতে তিরস্কার হানিয়া হাসির রাণী সেই মেয়েটিকে বলিল—‘‘দেখ ভিমরুল, ফের হাসলে মার খাবি৷’’

এ শাসনে কেহই বশ মানিল না৷ এক-এক বাড়ী হইতে এক-একটি নূতন মেয়ে আসিয়া গাড়ীতে চড়ে, আর হাসির ছোঁয়াচ লাগিয়া হাসির প্রবাহ আর থামিতে দেয় না৷ গাড়ীর ভিতরে ভিড়ও যত বাড়ে ঠাসাঠাসির মধ্যে হাসিও তত জমাট হইয়া উঠে৷

কিশোর সহিসটি সেই ঘুলঘুলির মুখের কাছে ঠায় দাঁড়াইয়া নিরাশ্রয় অসহায় ভাবে কিশোরীদের হাসির সূচিতে বিদ্ধ হইতে লাগিল৷ সে আপনাকে লুকাইতে চাহিতেছিল, কিন্তু তাহার লুকাইবার জো ছিল না৷ তখন সে যথাসম্ভব এক পাশে সরিয়া দাঁড়াইয়া বিভার আড়ালে আপনাকে গোপন করিল৷ সে ছাতুখোর মেড়ো এবং একেবারে গাঁওয়ার হইলেও এটুকু সে বুঝিতেছিল যে, যে-মেয়েটি জানলার মুখের কাছে বসিয়া আছে, সে মেয়েটি তাহাকে দেখিয়া না-হাসিতেই চাহিতেছে সে সকলের হাসির হাত হইতে তাহাকে বাঁচাইতে পারিলে বাঁচাইত৷ সে একবার করুণ নেত্রে বিভার দিকে ক্ষণিকের জন্য তাকাইয়া কুণ্ঠিত নতনেত্রে দাঁড়াইয়া রহিল৷

মেয়েস্কুলের বিশ্বম্বহ দীর্ঘ গাড়ী পথ কাঁপাইয়া, পথিকদের ব্যগ্র সচকিত করিয়া, হাজার দৃষ্টির উপর অতৃপ্তির ঝিলিক হানিয়া, বিরাট অবহেলার মতন, একবুক আনন্দ-প্রতিমা বহিয়া স্কুলে গিয়া পৌঁছিল৷ কিশোর সহিস অব্যাহতি পাইয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল৷

সে মুচির ছেলে৷ তাহার নাম কাল্লু৷

ছেলে হাকিমের দপ্তরে নোকরি পাইবে, এই আশায় তাহার বাপ তাহাকে ইংরেজি স্কুলে পড়িতে দিয়াছিল৷ প্রথমে যে-স্কুলে সে ভর্তি হইতে গেল, সেখানে সে মুচির ছেলে বলিয়া স্কুলের কর্তারা হইতে ছাত্রেরা পর্যন্ত আপত্তি তুলিয়াছিল৷ শেষে আরা শহরে এক সাহেব মিশনারির স্কুলে স্থান পাইয়া সে বছর ছয়েক ইংরেজি ও নাগরী শিক্ষা করিয়াছিল৷ তারপর তাহার পিতার মৃত্যু হইলে গ্রামের মাতব্বরেরা বলিল, কাল্লুর লিখা-পড়ি শিখিয়া কোনো ফায়দা নাই তাহার বাপদাদার পেশা অবলম্বন করাই উচিত৷ তখন বেচারা বইয়ের দপ্তর ফেলিয়া জুতাসেলাইয়ের থলি ঘাড়ে করিল৷ তাহার হাকিমের দপ্তরে নোকরি করিয়া মাতব্বর হওয়ার কল্পনা বাপের মৃত্যুর সঙ্গেই মিলাইয়া গেল৷ তবু তাহার জাতভাই-বিরাদরীর মধ্যে কাল্লুর খাতির হইল যথেষ্ট—সে তুলসীকৃত রামায়ণ পড়িতে পারে সে বিরাদরীর পঞ্চায়েৎ মজলিশে তোতাকাহিনী, বেতাল-পঁচিশী, চাহার দরবেশ পড়িয়া শুনাইতে পারে খত চিঠঠি বাচাইতে পারে এবং সাড়ে সাত রূপেয়া তনখা হইলে এক রোজের মজদুরী কত, বা শতকরা দশ রূপেয়া সুদ হইলে, এক রূপেয়ার সুদ কত মুখে মুখে কষিয়া দিতে পারে৷

এইরূপে লেখাপড়া শিখিয়া ও প্রণয়রসমধুর বিচিত্র ঘটনাপূর্ণ কেতাব পড়িয়া কাল্লুর কিশোর চিত্ত পৃথিবীর সহিত পরিচিত হইবার জন্য উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছিল৷ সে আর তাহার গাঁয়ে গাঁওয়ার লোকদের মধ্যে থাকিয়া তৃপ্তি পাইতেছিল না৷ সে স্থির করিল একবার কলকাত্তা যাইতে হইবে সেখানে তাহার চাচেরা ভাই বহুত টাকা কামাই করে৷

কাল্লুকে বাধা দিবার কেহ ছিল না সে জগৎসংসারে একা৷ আপনার বাপের হাতিয়ারগুলি থলিতে ভরিয়া সে কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইল৷

তাহার ভাই বলিল যে, রাস্তায় রাস্তায় রোদে বৃষ্টিতে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জুতা সেলাই করিয়া বেড়াইতে তাহার বড় তকলিফ হইবে তাহার চেয়ে কাল্লু স্কুলে নোকরি করুক৷ স্কুলে একটি নোকরি খালি আছে৷

স্কুলে নোকরি! শুনিয়া কাল্লু উৎফুল্ল হইয়া উঠিল৷ চাই কি সে সেখানে নিজের বিদ্যাচর্চারও সুবিধা করিয়া লইতে পারে৷ তাহার পর যখন শুনিল যে, সেটা জানানা স্কুল, তখন তাহার কল্পনাপ্রবণ মন সেখানকার পদমাবতী শাহারজাদী ও পরীবানুদের স্বপ্নে ভরপুর হইয়া উঠিল৷

কিন্তু পরীবানুদের সহিত প্রথম দিনের পরিচয়ের সূত্রপাত তাহার তেমন উৎসাহজনক মনে হইল না৷ পরীর মতো বেশভূষায় মণ্ডিত ফুলের মতো মেয়েগুলি যেন হাসির দেশের লোক!

কাল্লু ঘোড়ার সাজ খুলিয়া দানা দিয়া উদাস মনে আসিয়া আস্তাবলের সামনে একটা শিশুগাছের ছায়ায় গামছা পাতিয়া পা ছড়াইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল৷ মেয়েগুলো তাহাকে দেখিয়া অমন করিয়া মিছামিছি হাসিয়া খুন হইল কেন? তাহার চেহারার মধ্যে হাসি পাইবার মতো এমন কি আছে? তাহার গাঁয়ের বাচ্চী আকালী পবনী তো তাহাকে দেখিয়া কৈ এমন করিয়া হাসে না! কিসমতিয়া ইঁদারা হইতে জল ভরিয়া হাত দুলাইতে দুলাইতে বাড়ী ফিরিবার সময় তাহার গায়ে জল ছিটাইয়া দিয়া হাসিত বটে, কিন্তু তাহার হাসি তো এমন খারাপ লাগিত না—তাহার সেই দিললগীতে তো দিল প্রসন্নই হইয়া উঠিত! যত নষ্টের গোড়া ঐ কোঁকড়া-চুলওয়ালী ছোঁড়ী৷ ভিমরুলের উপর তাহার ভারি রাগ হইতে লাগিল—সেইই তো প্রথমে হাসি আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল৷ সব মেয়েগুলোই খারাপ—কেবল—কেবল—ঐ গোরীবাবা ভারি ভালো! সে তাহাকে দেখিয়া হাসে নাই, সকলকে হাসিতে মানা করিয়াছে, ভিমরুলকে মারিতে পর্যন্ত চাহিয়াছিল! ঐ বাবা বহুত নিক৷ বহুৎ খুবসুরৎ৷

কাল্লু বসিয়া বসিয়া যত ভাবে ততই তাহার বিভাকে বড়ই ভালো লাগে৷ সে তাহার দৃষ্টিতে কেমন করুণা ভরিয়া একবার উহার দিকে তাকাইয়াছিল! সে কেমন করিয়া উহাকে সকলের হাসির আঘাত হইতে আড়াল করিয়া রাখিতেছিল! বহুত নিক! বহুত খুবসুরৎ! সেই গোরীবাবা!

এইরূপে সে দিনের পর দিন ধরিয়া কত মেয়েকে দেখিতে পায়, কত মেয়ের হাত হইতে সে বই গ্রহণ করে৷ কিন্তু কোনো মেয়েই তাহার প্রাণের উপর তেমন আনন্দের ছটা বিস্তার করে না, যেমন হয় তাহার বিভাকে দেখিলে৷ আর সকলের কাছে সে ভৃত্য, গাড়ীর সহিস, সে অস্পৃশ্য মুচির ছেলে—কুণ্ঠিত সঙ্কুচিত অপরাধীর মতন কিন্তু বিভাকে দেখিলেই তাহার অন্তরের পুরুষটি তারুণ্যের পুলকে জাগিয়া উঠে, মনের মধ্যে আনন্দের রসের শিহরণ হানে, তাহার দৃষ্টিতে কৃতার্থতা ঝরিয়া ঝরিয়া বিভার চরণকমলের জুতার ধূলায় লুণ্ঠিত হইতে থাকে৷ বসন্তের অলক্ষিত আগমনে তরুশরীরে যেমন করিয়া শিহরণ জাগে, যেমন করিয়া নব-কিশলয়দলে শুষ্ক তরুর অন্তরের তরুণতা বিকশিত হইয়া পড়ে, যেমন করিয়া ফুলে ফুলে তাহার প্রাণের উল্লাস উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, মধুতে গন্ধে যেমন করিয়া ফুলের প্রাণে রসসঞ্চার হয়, বিভাকে দেখিয়া কিশোর কাল্লুর অন্তরের মধ্যেও তেমনি একটি অবুঝ যৌবনের বিপুল সাড়া পড়িয়া গেল, তাহার অন্তরের পুরুষটি প্রকাশ পাইবার জন্য মনের মধ্যে আকুলি-ব্যাকুলি করিতে লাগিল৷ তাহার শিক্ষা ও অশিক্ষার মধ্যবর্তী অপটু অক্ষম মন চাহিতেছিল, সেও তেমনি করিয়া আপনার অন্তরবেদনা তাহার আরাধিতার চরণে নিবেদন করে, যেমন করিয়া বজ্রমুকুট পদমাবতীকে তাহার হৃদয়বেদনা নিবেদন করিয়াছিল যেমন করিয়া শাহজাদা পরীজাদীকে তাহার মর্ত্যমানবের মনের ব্যথা বুঝাইতে পারিয়াছিল৷ তাহার মনের কোণের গূঢ় গোপন প্রণয়বেদনা সে কেমন করিয়া এই অনুপমা মহীয়সী রমণীর চরণে নিবেদন করিবে! সে যদি তাহাদের গ্রামের কিসমতিয়া হইত, তাহা হইলে কোনো কথা ছিল না কিন্তু ইহার তো কিসমতিয়ার সহিত কোনোই মিল নাই! এ না পরে ঢিলি চুনুরি, লাহেঙ্গা, না পরে আঁটি আঙিয়া না যায় ইঁদারায় জল আনিতে, না সে কাজরী গীত গাহিয়া তাহাকে সাহসী করিয়া তোলে! এ যে এ জগতের জীব নয়! এর পরণের শাড়ীখানি বিচিত্র মনোরম ভঙ্গিতে তাহার কিশোর সুকুমার তনু দেহখানির উপর সৌন্দর্যের স্বপ্নের মতন অনুলিপ্ত হইয়া আছে ইহার গায়ের ঝালর-দেওয়া ফুলের জালি-বসানো জামাগুলির ভঙ্গি যেন কোন স্বর্গলোকের আভাস দেয়৷ ইহার পায়ে জুতা, চোখে সুনেহরী চশমা৷ ইহার কাছে সে কত হীন, কত অপদার্থ, কি সামান্য! সে আপনার মনের ভাবলীলার বিচিত্র মাধুর্যের কাছে নিজের ক্ষুদ্রতায় নিজেই কুণ্ঠিত লজ্জিত সঙ্কুচিত হইয়া পড়িতেছিল, সে পরের কাছে তাহার মনের কথা প্রকাশ করিবার কল্পনাও করিতে পারে না৷

এমন কি বিভার সামনে দাঁড়াইতেও তাহার লজ্জা বোধ হইতে লাগিল৷ সে যেন অপবিত্র অশুচি, দেবতার মন্দিরে প্রবেশ করিতে ভয়ে সঙ্কোচে কুণ্ঠিত হইয়া উঠে৷ আপনার দেহ মন শিক্ষা সহবৎ জন্ম কর্ম কিছুই তাহার বিভার উপযুক্ত তো নহে৷

তবুও সে অন্তরের যৌবন-পুরুষের তাড়নায় আপনাকে যথাসাধ্য সংস্কৃত সুদর্শন করিতে চাহিল৷ সে রাস্তার ধারে একখানি ইঁট পাতিয়া বসিয়া দেশওয়ালী হাজামের কাছে হাজামত করাইল কপালের উপরকার চুল খাটো করিয়া ছাঁটিয়া মধ্যে অর্ধচন্দ্রাকার ও দুই পাশে দুই কোণ করিয়া থর কাটিল৷ তারপর বাজার হইতে একখানি টিন-বাঁধানো আয়না ও একখানি কাঠের কাঁকই কিনিয়া দীর্ঘ বাবরি চুলগুলিকে প্রচুর কড়ুয়া তেলে অভিষিক্ত করিয়া শিশু-গাছের তলায় পা ছড়াইয়া বসিয়া ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় কাঁধের উপর কুঞ্চিত সুবিন্যস্ত ফণাকৃতি করিয়া তুলিল৷ সেদিন সে নাহিয়া-ধুইয়া মাজিয়া-ঘষিয়া আপনাকে চকচকে সাফ করিয়া যথাসাধ্য নিজের মনের মতন করিয়া তুলিল৷ কিন্তু তাহার সহিসের পোশাকটা তাহার মোটেই রুচি-রোচন হইতেছিল না৷ নীল রং করা মোটা ধুতির উপর হলদে-পটি লাগানো নীল রঙের খাটো কুর্তা ও নীল পাগড়ী তাহাকে যে নিতান্ত কুৎসিত করিয়া তুলিবে, ইহাতে সে অত্যন্ত অস্বস্তি ও লজ্জা অনুভব করিতে লাগিল৷ কিন্তু উপায় নাই, সেই কুৎসিত উর্দি পরিয়াই তাহাকে বিভার সম্মুখে বাহির হইতে হইবে৷ তখন সেই পোশাকই অগত্যা যথাসম্ভব শোভন-সুন্দর করিয়া পরিয়া সেদিন সে গাড়ীর পিছনে চড়িয়া বিভাকে বাড়ী হইতে স্কুলে আনিতে গেল৷

কিন্তু তাহাতেও তাহার অব্যাহতি নাই৷ তাহার চক্ষুশূল সেই ভিমরুল ছুঁড়ি তাহাকে দেখিয়াই আবার হাসিয়া গড়াইয়া বলিয়া উঠিল—‘‘বা রে! আবার ফ্যাশন করে চুল কাটা হয়েছে!’’

তাহার সেই বিশৃঙ্খল রুক্ষ চুলই মেয়ের চোখে ক্রমশ অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল আজ তাহাকে নব বেশে দেখিয়া তাহাদের আবার ভারি হাসি আসিল৷ বিভা ঈষৎ হাসিমুখে তাহার দিকে চাহিয়া যখন চক্ষু ফিরাইয়া ভিমরুলকে বলিল—‘‘কি হাসিস!’’ তখন কাল্লুর চোখ দুটি আগুনের ফুলকির মতন ভিমরুলের দিকে চাহিয়া জ্বলিতেছিল৷ ভিমরুল হাততালি দিয়া হাসিয়া বলিয়া উঠিল—‘‘দেখ দেখ বিভা-দি, ও কেমন করে তাকাচ্ছে!’’ বিভা যেই তাহার দিকে স্মিত মুখে তাকাইল, অমনি তাহার দৃষ্টি কোমল প্রসন্ন হইয়া যেন বিভার চরণে আপনার জীবনের কৃতার্থতা নিবেদন করিয়া দিল৷ বিভা ভিমরুলকে ধমক দিয়া বলিল—‘‘কৈ কি করে তাকাচ্ছে আবার!’’ ভিমরুল বলিয়া উঠিল—‘‘না বিভা-দি, ও এমনি করে কটমট করে তাকাচ্ছিল, তুমি ফিরে চাইতেই অমনি ভালো-মানুষটি হয়ে দাঁড়াল!’’

ক্রমে তাহার নূতন বেশও মেয়েদের চোখে সহিয়া গেল৷ একজন তরুণ পুরুষ যে নিত্য তাহাদের সেবা করিতেছে, এ বোধ তাহাদের মনে জাগ্রত রহিল না৷ কিন্তু সেই তরুণ সহিসের মনে তরুণী একটি নারীর ছাপ দিনের পর দিন গভীর ভাবে মুদ্রিত হইয়া উঠিতেছিল৷

তাহার মনে হইত, সে একদিন বিভার চরণতলের ধূলায় পড়িয়া যদি বলিতে পারে যে, সে একেবারে সাধারণ নয়, নিতান্ত অপদার্থ নয়, সেও তাহাদেরই মতো স্কুলে ইংরেজি পড়িয়াছে, এখনো দুচারটা ইংরেজি বাত সে পড়িতে পারে, সে রামায়ণ পড়িতে পারে, কাহানিয়া পড়িতে পারে!—তবে তাহার জীবন সার্থক হইয়া যায়৷ কিন্তু পারিত না—সে কোনো দিন বিভাকে একলা পাইত না বলিয়া পারিত না, সে ভিমরুলের হাসির হুলের ভয়ে! তখন সে ভাবিত, মুখের কথা যাহাকে খুশি শুনানো যায়, আর মনের কথা মনের মানুষটিকেও শুনানো যায় না কেন? মনের মন্দিরে সে যে-সব পবিত্র অর্ঘ্য সাজাইয়া সাজাইয়া তাহার আরাধ্য দেবতার আরতির আয়োজন করিতেছিল, তাহা যদি তাহার দেবতা অন্তর্যামী হইয়া অনুভব করিতে পারিত! দেবতা যদি অন্তরের মুখের ভাষা না বুঝে, তবে মূক মুখের ভাষায় সে তো কিছুই বুঝিতে পারিবে না!

তবু একদিন সাহসে বুক বাঁধিয়া সে বিভার হাত হইতে বই লইতে লইতে উপরকার বইখানির নাম যেন নিজের মনেই পড়িল—লিগেন্ডস অফ গ্রীস অ্যান্ড রোম!

ভিমরুল অমনি হাততালি দিয়া হাসিয়া বলিল—‘‘বিভাদি তোমার সহিস আবার ইংরিজি পড়তে পারে! এইবার থেকে তুমি ওর কাছে পড়া বলে নিয়ো!’’ ভিমরুলের চেয়ে বড় একটি মেয়ে সরযূ হাসির বিদ্রুপের স্বরে বলিল—‘‘লিগেন্ডস! লিগেন্ডস অফ গ্রীস অ্যান্ড রোম! লেজেন্ডসকে লিগেন্ডস বলছে!’’ বিভা হাসি-মুখে কাল্লুর দিকে চাহিয়া বলিল—‘‘তুই ইংরিজি পড়তে পারিস?’’ কাল্লুর মনের সমস্ত বিদ্রুপ-গ্লানি লজ্জা-সঙ্কোচ বিভার হাসিমুখের একটি কথায় কাটিয়া গেল৷ সে উৎফুল্ল হইয়া বলিল—‘‘হাঁ বাবা, হাম তো কয়ইক বরষ ইংলিশ পঢ়া থা৷’’ বিভা তাহার কথা শুনিয়া হাসিল৷ কাল্লু সাহস পাইয়া বলিল যে, সে গোরী-বাবার পড়িয়া-চুকা পুরাণা ধুরাণা একখানা কেতাব পাইলে এখনো পড়ে৷ বিভা হাসিয়া বই দিতে স্বীকার করিল৷ গর্বের আনন্দে কাল্লুর মন ফুলিয়া উঠিল৷ আজ সে বিভার কাছে আপনার অসাধারণত্ব প্রমাণ করিয়া দিয়াছে! বিভা আজ তাহার সহিত কথা বলিয়াছে! বিভার প্রথম দান আজ সে পাইবে! ভিমরুল যে তাহাকে ‘পণ্ডিত সহিস’ বলিয়া ঠাট্টা করিয়া কত হাসিল, আজ আর সেদিকে সে কানই দিল না৷

সেই দিন হইতে সে আবার পাঠে মন দিল৷ বিভা তাহাকে একখানা ইংরেজি বই দিয়াছে সেইখানি পাইয়া সে ভরা মনে শিশু-গাছের তলায় গামছা পাতিয়া পা ছড়াইয়া পড়িতে বসিল৷ প্রথমে বই খুলিয়াই সে খুঁজিতে লাগিল বইয়ের কোথাও গোরী-বাবার কোনো নাম লেখা আছে কি না! কোথাও কোনো নাম খুঁজিয়া সে পাইল না৷ সে শুনিয়াছে, ভিমরুল তাহাকে বিভাদি বলিয়া ডাকে৷ বিভাদি আবার কি রকম নাম? তাহাদের গাঁয়ে একটি মেয়ের আবাদীয়া নাম আছে, একটি ছেলের নাম আছে বিদেশীয়া পার্বতীয়া, পরভাতীয়া নামও হইতে পারে৷ কিন্তু বিভাদি, সে কি রকম নাম? সে মনে মনে ভাবিয়া ঠিক করিল, উহার নাম দুলারী কি পিয়ারী হইলে বেশ মানায়! সে স্থির করিল, গোরী-বাবাকে সে পিয়ারী নামেই নিজের মনে চিহ্নিত করিয়া রাখিবে৷ সে বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল, এই বইখানি পিয়ারী পড়িয়াছে বইয়ের স্থানে স্থানে পেন্সিলের দাগ ও দুই-একটা কথার মানে লেখা আছে—সেগুলি পিয়ারীই লিখিয়াছে, তাহার সোনার মতো আঙুলগুলি এই বইয়ের বুকের উপর বুলাইয়া গিয়াছে! বইখানি তাহার কাছে পরম অমূল্য নিধি হইয়া উঠিল৷ সে সমস্ত দিনের অবসরের সময় সেখানিকে খুলিয়া কোলে করিয়া লইয়া বসিয়া থাকে কদাচিৎ এক-আধ লাইন পড়ে, শুধু বইখানিকে কোলে করিয়াই তাহার আনন্দ৷ রাত্রে সে বইখানিকে বুকের কাছে লইয়া শোয়৷ যখন বইখানি আস্তাবলে তাহার কাপড়ের বোঁচকার মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়া বইখানিকে ছাড়িয়া দুবেলা মেয়েদের আনিতে ও রাখিতে যাইতে হয়, তখন তাহার মন সেই বইখানির কাছেই পড়িয়া থাকে৷ তখন সে অবাক হইয়া বিভার মুখের দিকে চাহিয়া আকাশপাতাল ভাবে!

একদিন তাহাকে ঐরূপ চাহিয়া থাকিতে দেখিয়া ভিমরুল বলিয়া উঠিল—‘‘বিভাদি, বিভাদি, দেখ, সহিসটা তোমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখ!’’ বিভা একবার চকিতে কাল্লুর দিকে চাহিয়া লজ্জিত হইয়া হাসিমুখে বলিল—‘‘তুই ভারি দুষ্টু হচ্ছিস ভিমরুল!’’ কাল্লু বিভাকে লজ্জিত হইতে দেখিয়া ব্যথিত অনুতপ্ত হইয়া নিজের অসাবধান দৃষ্টি নত করিল৷ সেইদিন হইতে সে এক মুহূর্তের বেশি বিভার দিকে আর চাহিতে পারিত না৷ সে যে হীন, সে যে মুচি, সে যে ঘোড়ার সহিস—সে যে বিভার দিকে তাকাইতে সাহসী—এমন ধৃষ্টতা প্রকাশ করিবারও যোগ্যতা তাহার যে নাই!

এই ক্ষণিকের চকিত দর্শনই তাহার জীবনের আনন্দপ্রদীপ৷ যেদিন ছুটি থাকে, সেদিন তাহার সহকর্মীরা হুড়ুক খঞ্জনী ও করতাল খচমচ করিয়া কর্কশ কণ্ঠে চেঁচাইয়া গোলমাল করিয়া ছুটি উপভোগ করে, আর কাল্লু গাছতলায় বইখানি কোলে করিয়া উদাস মনে আকাশের দিকে চাহিয়া একাকী বসিয়া থাকে! কেহ তাহাকে গানের মজলিশে যোগ দিতে ডাকিলে, সে ওজর করিয়া বলে—‘‘জী বহুৎ সুস্ত হ্যায়, আচ্ছী নেহী লাগতা!’’ প্রাণ আজ তাহার বড় অসুস্থ, তাহার কিছুই ভালো লাগিতেছে না৷ যেদিন বিভাদের বাড়ী হইতে স্কুলে অপর সকল মেয়ে আসে, কেবল বিভা আসে না, সেদিন সকলের বইয়ের বোঝা হাতে করিয়া কাল্লু বিভার আগমনের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করে—‘‘উয় বাবা জায়েগী নেহী?’’ যখন শুনে আজ সে যাইবে না, তখন সে একবার বাড়ীর দিকে একটি চকিত দৃষ্টি হানিয়া গাড়ীর পিছনে গিয়া উঠে এবং চলন্ত গাড়ী হইতে যতক্ষণ সেই বাড়ী দেখা যায়, ততক্ষণ বারবার ফিরিয়া ফিরিয়া দেখিয়া যায় যদি কোনো জানালার ফাঁকে একবার পিয়ারীর খুবসুরৎ মুখখানি তাহার নজরে পড়ে! দীর্ঘ অবকাশের সময় তাহার দেশওয়ালী বন্ধুরা সকলেই বাড়ী চলিয়া যায়, ঘোড়া তখন কুকের বাড়ীতে পোষানী থাকে, সহিসদের ছুটির দরমাহা মিলে না! কিন্তু কাল্লু নিজের সঞ্চিত অর্থে একবেলা দুটি চানা ও একবেলা একটু ছাতু খাইয়া দীর্ঘ অবকাশ কলিকাতাতে পড়িয়াই কাটায়৷ পিয়ারী যে-শহরে আছে, সে-শহর ছাড়িয়া সে দূরে যাইতেও পারে না৷ দিনের মধ্যে একবারও অন্তত বিভাদের গলি দিয়া সে বেড়াইয়া আসে, সেই গলিটাতে গিয়াও তাহার আনন্দ, যে বাড়ীর মধ্যে পিয়ারী আছে তাহার দর্শনেও তাহার পরম সুখ৷ ছুটির সময়কার উদাস দীর্ঘ কর্মহীন দিনগুলি কোনো রকমে কাটাইয়া রাত্রে কেরোসিনের ডিবিয়ার প্রচুর ধুমোদগম দেখিতে দেখিতে কাল্লু ভাবিতে থাকে সেই বিভারই কথা৷ কবে সে তাহাকে দেখিয়া একটু হাসিয়াছিল, কবে সে তাহার সহিত দয়া করিয়া কি কথা বলিয়াছিল, কবে তাহার হাত হইতে বই লইতে গিয়া আঙুলে একটু আঙুল ঠেকিয়াছিল৷ তাহার নিকষের মতো কালো দেহে সোনার মতো আঙুলের ঈষৎ স্পর্শ লাগিয়া তাহার বুকের মধ্যে যে সোনার রেখা আঁকিয়া দাগিয়া দিয়া গিয়াছে, তাহাই সে বিভার প্রভাতারুণরশ্মির ন্যায় সমুজ্জ্বল হাসির আলোকে এক মনে মুগ্ধ নয়নে বসিয়া বসিয়া দেখিত৷ দেখিতে দেখিতে তাহার সমস্ত অন্তর প্রভাতের পূর্বাকাশের মতো একেবারে সোনায় সোনায় মণ্ডিত হইয়া সোনা হইয়া উঠিত! পূজা ও হোলিতে সহিসেরা সকল মেয়ের নিকট হইতেই কিছু কিছু বখশিশ পায় কাল্লু বিভার কাছ হইতে যে সিকি-দুয়ানিগুলি পাইয়াছিল, সেগুলিকে একটি গেঁজেয় ভরিয়া কোমরে লইয়া ফিরিত, বিরহের দিনে গেঁজে হইতে সেগুলিকে বাহির করিয়া হাতের উপর মেলিয়া ধরিয়া সে দেখিত, যেন রজতখণ্ডগুলি বিভারই শুভ্র সুন্দর দন্তপংক্তির মতন তাহাকে দেখিয়া হাসির বিভায় বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে৷

এমনি করিয়া দিনের পর দিন গাঁথিয়া বছরের পর কত বছর চলিয়া গেল৷ কত মেয়ে স্কুলে নূতন আসিল, কত মেয়ে স্কুল হইতে চলিয়া গেল৷ কাল্লুর চোখের সামনে তিল তিল করিয়া কিশোরী বিভা যৌবনের পরিপূর্ণতায় অপরূপ সুন্দরী হইয়া উঠিল৷ কেবল কোনো পরিবর্তন হইল না কাল্লুর মনের এবং অদৃষ্টের৷ কিন্তু তাহার কর্মের পরিবর্তন হইয়াছে৷ বিভা এম. এ. পাশ করিয়া স্কুলে পড়াইতেছে কাল্লু লেখাপড়া জানে বলিয়া বিভা তাহাকে দুপ্রহরের জন্য বেহারা করিয়া লইয়াছে৷ সকাল-বিকাল সে সহিসের কাজ করিয়া দুপ্রহরে গোরী-বাবার বেহারার কামও করে৷ ইহাতে তাহার পাওনা বেশী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাহার বেশেরও পরিবর্তন ও পরিপাট্য হইয়াছে৷ এখন সে অন্তত দুপুরবেলাটা চুড়িদার পায়জামার উপর ধোয়া চাপকান পরিতে পায় মাথার চুলগুলিকে সেই কাঠের কাঁকইখানি দিয়া আঁচড়াইয়া তাহার উপর শাদা কাপড়ের পাগড়ী বাঁধে৷ আর গোরী-বাবার আপিসঘরের দরজায় সে পাষাণমূর্তির মতো নিশ্চল হইয়া হুকুমের প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া থাকে৷ এখন সে অনেকক্ষণ ধরিয়া পিয়ারীকে দেখিতে পায়৷ তাহার দিল এখন পুরা ভরপুর আছে!

এই সময় একজন বাবু বড় ঘনঘন কাল্লুর গোরী-বাবার কামরায় আনাগোনা করিতে আরম্ভ করিল৷ তাহার সহিত বিভার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছিল৷ তাহার গায়ের রং এমন সুন্দর যে সোনার চশমা যে তাহার নাকে আছে, তাহা বুঝিতে পারা যায় না সুন্দর সুগঠিত শরীর, দেখিবার মতো তাহার মুখখানি৷ কিন্তু ইহাকে কাল্লু মোটেই দেখিতে পারিত না৷ ইহাকে দেখিলেই কাল্লুর মাথায় খুন চড়িত, তাহার চোখ দুটা কয়লার মালসায় দুখানা জ্বলন্ত আঙারের মতন জ্বলিয়া উঠিত৷

প্রথম যেদিন এই সুন্দর যুবকটি আসিয়া হাসিহাসি মুখে পরদা-টানা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া নিশ্চল নিস্পন্দ কাল্লুর হাতে একখানা কার্ড দিয়া বলিল—‘‘মেম-সাহেবকো-সেলাম দেও’’, তখনই তাহার হাসিবার ভঙ্গিটা কাল্লুর চোখে কেমন কেমন ঠেকিল৷ সে কার্ড লইয়া সন্তর্পণে পর্দা সরাইয়া বিভার হাতে গিয়া কার্ডখানি দিল৷ কার্ড পাইয়া বিভা যেমনতর হাসিমুখেই উৎফুল্ল হইয়া চেয়ার হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—‘‘বাবুকো সেলাম দেও৷’’—বিভার তেমনতর উৎফুল্ল আনন্দমূর্তি কখনো কাল্লুর দেখিবার সৌভাগ্য হয় নাই৷ তাই গোরী-বাবার এইরূপ আনন্দের আতিশয্য কাল্লুর মনে কেমন একটা অশুভ-আশঙ্কা জাগাইয়া তুলিল৷ তারপর যখন সে পর্দাটা একপাশে সরাইয়া ধরিয়া যুবকটিকে বলিল—‘‘যাইয়ে৷’’ এবং পরদার ঈষৎ ফাঁক দিয়া কাল্লু দেখিতে পাইল, যুবকটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিতেই বিভা হনহন করিয়া আগাইয়া আসিল, ও যুবকটি দুইহাতে বিভার দুইহাত চাপিয়া ধরিয়া মুগ্ধ নয়নে বিভার দিকে চাহিয়া রহিল, এবং বিভারও চোখ দুটি আবেশময় বিহ্বলতায় ও সুখের লজ্জায় ধীরে ধীরে নত হইয়া পড়িল, তখন কাল্লুর অন্তরাত্মা অনুভব করিল সেই আগন্তুক যুবক—ডাকু হ্যায়!—সে কাল্লুর সর্বস্ব অপহরণ করিয়া লইতে আসিয়াছে৷ সেইদিন হইতে তাহার মন যুবকটির প্রতি হিংসায় ও ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল, এবং দিনের পর দিন যত সে বিভার কাছে আনাগোনা করিতে লাগিল, ততই কাল্লুর নিষ্ফল ক্রোধ তাহার অন্তরে আগুন লাগাইয়া তাহার চোখদুটাকে জ্বলন্ত করিয়া তুলিতে লাগিল৷ যুবকটিকে দেখিলেই তাহার বুকের মধ্যে যখন ধকধক করিয়া উঠিত, তখন মনে হইত সে তাহার ঘাড়ের উপর লাফাইয়া পড়িয়া হাতের দশ আঙুলের নখে করিয়া তাহার বুকটাকে ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া রক্ত খাইতে পারিলে তবে শান্ত হয়৷ সে শক্ত আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আপনাকে সম্বরণ করিয়া রাখিত, কিন্তু সে এমন করিয়া চাহিত যে, তাহার অন্তরের সকল জ্বালা যেন দৃষ্টির মধ্য দিয়া ছুটিয়া গিয়া সেই ডাকুটাকে দগ্ধ ভস্ম করিয়া ফেলিতে পারে৷ আজ সে কত বৎসর ধরিয়া কৃপণের ধনের মতন যে বিভাকে হৃদয়ের সমস্ত আগ্রহ দিয়া ঘিরিয়া আগলাইয়া রাখিয়াছে, সেই তাহার পলে পলে সঞ্চিত সর্বসুখ এই কোথাকার কে একজন হঠাৎ আসিয়া লুণ্ঠন করিয়া লইয়া যাইবে, শুধু একখানা গোরা চেহারা ও এক জোড়া সুনেহরী চশমার জোরে! কাল্লু কালো কুৎসিত মুচি, কিন্তু তাহার অন্তরে পিয়ারীর প্রতি যে একটি ভক্তি পুঞ্জিত পুষ্পিত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার কিছু কি ঐ বাবুটার অন্তরে আছে? যদি থাকিত, তবে কি সে বিভার সম্মুখে অমন করিয়া বকবক করিয়া বকিতে পারিত, অমন হো-হো করিয়া হাসিতে পারিত, অমন করিয়া পা ছড়াইয়া চেয়ারে হেলিয়া পড়িতে পারিত! লোকটার মনে এতটুকু সম্ভ্রম নাই, এতটুকু দ্বিধা ভয় আশঙ্কা নাই! সে যেন ডাকাত, জোর করিয়া লুটপাট করিয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে৷

কাল্লু শুনিয়াছিল যে, কয়লার মধ্যে হীরা হয়৷ সে যদি কয়লার মতো কালো, তাহার বুকের মধ্যে হীরার মতো উজ্জ্বল বিভাকে লুকাইয়া রাখিতে পারিত! যদি সে কালো মেঘ হইয়া বিদ্যুতের মতো এই তরুণীটিকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া এই ডাকাত লোকটার মাথায় বজ্রের মতো গর্জন করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়া এক নিমেষে তাহাকে জ্বালাইয়া, পুড়াইয়া খাক করিয়া ফেলিতে পারিত! কিন্তু যতই সে কোন উপায় খুঁজিয়া পাইতেছিল না, যতই সে নিজের যে কি দাবী তাহা নিজের কাছেই সাব্যস্ত করিতে পারিতেছিল না, যতই সে নিজেকে অসহায় মনে করিতেছিল, ততই তাহার অন্তর জ্বলিয়া চোখ দুটাতেও আগুন ধরাইয়া তুলিতেছিল৷ যুবকটিকে দেখিলেই তাহার চোখ দুটা বুনো মহিষের চোখের মতো যেন আগুন হানিতে থাকে কিন্তু তখনই যদি বিভা তাহার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়ায়, তাহা হইলে তাহার সেই অগ্নিদৃষ্টি অমৃতে অভিষিক্ত দুটি ফুলের অঞ্জলির মতো তাহার চরণতলে লুটাইয়া পড়ে!

একদিন কাল্লু পর্দার ফাঁক দিয়া দেখিল, সেই শয়তানটা বিভার হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে তুলিয়া ধরিয়া, নিজের হাত হইতে একটা আংটি খুলিয়া বিভার আঙুলে পরাইয়া দিল! তারপর সেই হাতখানিকে ধরিয়া চুম্বন করিল—তাহারই চোখের উপরে!

আজ কাল্লুর সর্বাঙ্গে একেবারে আগুন ধরিয়া উঠিল৷ তাহার অন্তরের পুরুষত্ব উন্মত্ত হইয়া তাহাকে লাঞ্ছিত পীড়িত বিদলিত করিতে লাগিল৷ তাহার পায়ের তলা দিয়া মাটি সরিয়া চলিতে লাগিল, তাহার চোখের সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পাগলের মতো টলিয়া টলিয়া বোঁ বোঁ করিয়া ঘুরিতে লাগিল! কোথায় তাহার আশ্রয়? কোথায় তাহার অবলম্বন?

কতক্ষণ সে এমন ছিল, সে জানে না৷ অকস্মাৎ দেখিল, তাহার সম্মুখে সেই যুবকটি দাঁড়াইয়া হাসি মুখে দুটি টাকা ধরিয়া বলিতেছে—‘‘বেয়ারা, এই লেও বকশিশ!’’ কাল্লু দেখিল, সেই যুবকের ঠোঁটের উপর ও ত’ হাসি নয়, ও যেন আগুনের রেখা! তাহার হাতে ও ত’ টাকা নয়, ও যেন দুখণ্ড উল্কা! আর সেই লোকটা ত’ মানুষ নয়, সে সাক্ষাৎ শয়তান!—ইহারই কথা সে মিশনারী সাহেবদের কাছে পড়িয়াছিল, আজ একেবারে তাহার সহিত চাক্ষুষ সাক্ষাৎ! তাই উহার বর্ণ অমন আগুনের মতন! তাই উহাকে দেখিলে কাল্লুর অন্তরে অমনতর অগ্নিজ্বালা জ্বলিয়া উঠে! কাল্লুর মাথায় খুন চাপিয়া গেল, তাহার চোখ দিয়া আগুন ঠিকরাইতে লাগিল, তাহার দশাঙ্গুলের নখের মধ্যে রক্ত-পিপাসা ঝঞ্ঝনা হানিয়া গেল! এমন সময় তাহার কানে গেল কোন স্বর্গের পরম দেবতার অমোঘ আদেশ ‘‘কাল্লু, বাবু বকশিশ দিচ্ছেন, নে৷’’ কাল্লু মন্ত্রবশ সর্পের মতো মাথা নত করিয়া তাহার কম্পিত হস্ত প্রসারিত করিয়া ধরিল, যুবকটি তাহার হাতের উপর টাকা দুটি রাখিয়া দিল৷

কাল্লুর মনে হইতে লাগিল, টাকা দুটা তাহার হাতের তেলো পুড়াইয়া ফুটো করিয়া অপর দিক দিয়া মাটিতে ঝনঝন করিয়া পড়িয়া যাইবে৷ সে-ঝনৎকার তাহার কাছে বজ্র-বিদারণশব্দের ন্যায় মনে হইল৷ সে প্রাণপণে টাকা দুটাকে চাপিয়া মুঠি করিয়া ধরিল,—হাত পুড়িয়া যায় যাক, কিন্তু টাকা দুটা মাটিতে পড়িয়া অট্টহাস্য না করিয়া উঠে!

যখন তাহার চৈতন্য ফিরিয়া আসিল তখন তাহার মনে হইল, এই অগ্নিখণ্ড দুটা সেই শয়তানটার মুখের উপর ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতে পারিলে বেশ হইত৷ তাড়াতাড়ি ভালো করিয়া চোখ মেলিয়া চাহিয়া সে ছুঁড়িতে গিয়া দেখিল সেখানে কেহ নাই, সে একা দরজার একপাশে আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া আছে৷

কাল্লু মুশকিলে পড়িয়া গেল, এই টাকা দুটা লইয়া সে কি করিবে! এ সে লইল কেন, এ ত’ সে লইতে পারে না! কি করিবে, কি করিবে সে এই টাকা দুটা লইয়া! তাহাকে ঘিরিয়া চারিদিকে যেন টাকার মতো চাকা চাকা আগুনের চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতে লাগিল—যেন সেই লোকটার চশমাপরা চোখ দুটার হাসিভরা ক্রূর দৃষ্টি!

কাল্লু টাকা দুটাকে মুঠায় চাপিয়া ধরিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল! সে কোথায় ফেলিবে এই বিষের চাকতি দুটা৷ যেখানে পড়িবে সেখানকার সকল সুখ সকল আনন্দ সকল শুভ সকল হাসি জ্বলিয়া পুড়িয়া খাক হইয়া যাইবে৷

তাহাকে টাকা হাতে করিয়া ভাবিতে দেখিয়া একজন ভিখারী তাহাকে বলিল—‘‘এক পয়সা ভিখ মিলে বাবা৷’’ কাল্লু হঠাৎ যেন অব্যাহতি পাইয়া বাঁচিয়া গেল সে তাড়াতাড়ি দুটা টাকাই সেই পঙ্গুর হাতে দিয়া ফেলিল৷ অনন্ত উড়ে তাহা দেখিয়া হাসিয়া বলিল—‘‘কি রে কাল্লু, তু কল্পতরু হউচি পরা!’’ স্কুলময় রটিয়া গেল কাল্লুর মনিবের বিবাহ হইবে বলিয়া কাল্লু মনের আনন্দে একটা ভিখারীকে দু-দুটা টাকা দান করিয়া বসিয়াছে!

আজ বিভার বিবাহ৷ সেখানে কত লোকের নিমন্ত্রণ হইয়াছে, কাল্লুর হয় নাই৷ তবু তাহাকে সেখানে যাইতে হইবে৷ স্কুলের বোর্ডিঙের মেয়েদের নিমন্ত্রণ হইয়াছে তাহাদের গাড়ীর সঙ্গে তাহাকে বিনা নিমন্ত্রণেও যাইতে হইবে৷ আজ তাহার সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিন৷ সেখানে আজ আলোক-সমারোহের মধ্যে সুসজ্জিত হইয়া হাসিমুখে সেই শয়তান ডাকাতটা চিরজন্মের মতো তাহার পিয়ারী গোরী-বাবাকে আত্মসাৎ করিত আসিবে, সেখানে আজ তাহাকে সহিসের নীল রঙের কুৎসিত উর্দি পরিয়া ম্লান মুখে বিনা আহ্বানে যাইতে হইবে, কিন্তু তাহার ভিতরে প্রবেশের অধিকার থাকিবে না, তাহাকে দ্বারের বাহিরেই দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে৷

তাহাকে যাইতেই হইল৷ তাহার চোখের সামনে সেই শয়তানটা নিজের হাতে বিভার হাত ধরিয়া ফুলের মালায় বাঁধিয়া তাহাকে চিরদিনের জন্য দখল করিয়া লইল৷ তখন কাল্লু পুষ্পবিভূষণা আলোকসমুজ্জ্বলা সভা হইতে পলায়ন করিয়া আপনার অন্ধকার দুর্গন্ধ আস্তাবলে আসিয়া বিচালির বিছানায় শুইয়া বিভার-দেওয়া বইখানি বুকে চাপিয়া পড়িয়া রহিল৷

সেই দিন হইতে স্কুল তাহার কাছে শূন্যাকার অন্ধকার৷ শতেক বালিকা যুবতীর হাসি সৌন্দর্য আনন্দলীলা সত্বেও একজনের অভাবে সেস্থান নিরানন্দ অসুন্দর! সে গাড়ীর পিছনে চড়িয়া বিভাদের বাড়ীতে যায়, কিন্তু সেখান হইতে বিভা আর স্মিতমুখে বাহির হইয়া আসিয়া তাহার হাতে বই দেয় না গাড়ীর জানলাটির কাছে বিভার সোনার কমলের মতন অপরূপ সুন্দর মুখখানি আর হাসিতে ঝলমল করে না৷ সে বাড়ী হইতে বাহির হয় কাল্লুর চক্ষুশূল সেই ভিমরুলটা, আর সে-ই গাড়ীর মুখের কাছে বসিয়া বসিয়া তাহাকে দেখিয়া দেখিয়া হাসে!

এ রকম জীবন কাল্লুর অসহ্য হইয়া উঠিল৷ সে একদিন ছুটির দিনে বিভার নূতন বাড়ীতে গিয়া গোরী-বাবার সহিত দেখা করিয়া বলিল যে, গোরী-বাবা যদি তাহাকে কোনো নকরি দেয় ত’ তাহার পরবস্তী হয়৷ বিভা জিজ্ঞাসা করিল, ‘‘কেন কাল্লু, স্কুলের চাকরী ছাড়বি কেন? ওখানেই ত’ বেশ আছিস৷’’

কাল্লুর বুক এই প্রশ্নে যেন ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল, তাহার অশ্রুসাগর যেন উথলিয়া পড়িতে চাহিল৷ পিয়ারী, তুই, এমন পুছলি! এতটুকু দয়া তোর হইল না! এতটুকু বুদ্ধি তোর ঘটে নাই! সে কি বলিবে, কেমন করিয়া বলিবে যে, স্কুলের নোকরি আর তাহার ভালো লাগিতেছে না কেন! কাল্লু মাথা হেঁট করিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল৷

বিভা আবার জিজ্ঞাসা করিল—‘‘কেন, স্কুলের চাকরী ছাড়বি কেন?’’

কাল্লু ধীর স্বরে বলিল—‘‘জী নেহি লাগতা!’’ এর বেশী সে কি বলিবে৷ প্রাণ তাহার সেখানে থাকিতে চাহিতেছে না, সেখানে তাহার প্রাণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে!

বিভা বলিল—‘‘আচ্ছা, তুই দাঁড়া, আমি একবার বাবুকে বলে দেখি৷’’

বাবুর নামে কাল্লুর রক্ত গরম হইয়া উঠিল৷ যে শয়তান তাহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়াছে, ভিক্ষার জন্য হাত পাতিতে হইবে তাহার কাছে! কাল্লু বলিয়া উঠিল—‘‘গোরী-বাবা, হাম নোকর নেহি...’’ কাল্লু চাহিয়া দেখিল বিভা তখন চলিয়া গিয়াছে৷

বিভা গিয়া স্বামীকে বলিল—‘‘ওগো শুনছ, দেখ, আমাদের স্কুলের সেই যে সহিসটা আমার বেয়ারার কাজ করত, সে আমার এখানে কাজ করতে চায়৷ তাকে রাখব? তাকে এতটুকু বেলা থেকে দেখছি, বড় ভালো লোক সে৷’’

বিভার স্বামী সচকিত হইয়া বলিয়া উঠিল—‘‘কে, সেই কালো কুচকুচে শয়তানটা? সে ভালো লোক! তুমি দেখনি তার চোখের চাউনি—যেন কালো বাঘের চোখ! তাকে রেখো না, সে কোন দিন ঘাড় ভেঙে রক্ত খাবে, আমায় খুন করবে!’’

বিভা হাসিয়া বলিল—‘‘অনাছিষ্টি ভয় তোমার! সবাই ত’ তোমার মতো সুন্দর হতে পারে না৷ ভগবান ওকে কালো করেছে তা এখন কি হবে৷’’

বিভার স্বামী ভয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল—‘‘শুধু কালো রং নয়, তার ঐ ছুরির নখের মতো জ্বলজ্বলে চোখ দুটো যেন একেবারে মর্মে গিয়ে বেঁধে৷ ওকে বাড়ীতে ঠাঁই দেওয়া সে কিছুতেই হবে না৷’’

বিভা স্বামীর স্বরের দৃঢ়তা দেখিয়া আর কিছু বলিল না৷ আস্তে আস্তে বাহির হইয়া গিয়া ডাকিল—‘‘কাল্লু!’’

কাল্লু আর সেখানে নাই, কাল্লু চলিয়া গিয়াছে৷

বিভা মনে করিল, তাহার স্বামীর কথা শুনিতে পাইয়াই কাল্লু বোধ হয় ব্যথিত আহত হইয়া চলিয়া গিয়াছে৷ বিভাও ইহাতে একটু বেদনা অনুভব করিয়া ক্ষুণ্ণ হইল৷ আহা, গরীব বেচারা!

কাল্লু স্কুলে গিয়া কর্মে ইস্তফা দিল৷ তাহার আলাপীরা বলিল, তুই কাজ ছাড়িয়া করিবি কি? কাল্লু বলিল, সে জুতো সেলাই করিবে৷ ইহা শুনিয়া তাহার সঙ্গীরা স্থির করিল, কাল্লু নিশ্চয় বাউরা হইয়া গিয়াছে, নতুবা কাহারো কি কখনো এমন নোকরী ছাড়িয়া জুতা সেলাই করিবার শখ হয়? তাহারা কত বুঝাইল, কাল্লু কোনো উপদেশই কানে তুলিল না৷ 

কাল্লু বিভার নিকট হইতে যে সিকি-দুয়ানি বখশিশ পাইয়াছিল, তাহাতে কোঁড়া ঝালাইয়া পাটোয়ারকে দিয়া রেশম ও জরি জড়াইয়া গাঁথাইয়া লইয়াছিল৷ সেই মালাটিকে সে আজ গলায় পরিল৷ তারপর সেলাই বুরুশের সরঞ্জামের সঙ্গে বিভার-দেওয়া বইখানি থলিতে পুরিয়া থলি কাঁধে উঠাইয়া স্কুল হইতে সে বাহির হইয়া চলিল৷ পথে তাহার দেখা হইল ভিমরুলের সঙ্গে৷ একটি ছোট মেয়ে হাসিয়া বলিয়া উঠিল—‘‘বা রে, সহিস আবার সেলাই ব্রুশ সেজেছে৷ লাব্রুশ৷’’ কাল্লু একবার তাহাদের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানিয়া গেট পার হইয়া পথের জনস্রোতে ভাসিয়া পড়িল৷

বিভা হঠাৎ জানালার কাছে গিয়া দেখিল, তাহাদের বাড়ির অপর দিকের ফুটপাতের উপর কাল্লু তাহার জুতা-সেলাইয়ের তোড়-জোড় লইয়া বসিয়া আছে৷ বিভাকে দেখিয়াই তাহার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল৷ সে হাসিয়া বুঝাইয়া দিল—সে স্কুলের চাকরী ছাড়িয়া দিয়া এই বৃত্তি অবলম্বন করিয়াছে এবং সে বেশ সুখেই আছে৷ কিন্তু বিভা কেন যেন অকারণে বিষণ্ণ হইয়া উঠিল, সে আর জানালায় দাঁড়াইতে পারিল না৷

তারপর হইতে রোজই বিভা দেখে, সকাল-বিকাল দু’বেলাই কাল্লু সেই ঠিক এক জায়গাতেই বসিয়া থাকে—রৌদ্র নাই—বৃষ্টি নাই সে বসিয়াই থাকে, কোনো দিন তার কামাই হয় না৷ অতিবৃষ্টির সময়ও সে নড়ে না, জুতার তলায় হাফসোল দিবার চামড়াখানি মাথার উপর তুলিয়া ধরিয়া সে ঠায় বসিয়া বসিয়া ভিজে দারুণ রৌদ্রের সময়ও সে নড়ে না, গামছাখানি মাথার পাগড়ির উপর ঘোমটার মতন করিয়া ঝুলাইয়া দিয়া সে বসিয়া বসিয়া দরদর করিয়া ঘামে৷ বর্ষা ঘনাইয়া আসিলে, সে আনন্দে কাজরীর গান গাহে—

পিয়া গিয়া পরদেশ, লিখত নাহি পাঁতি রে

রোয় রোয় আঁখিয়া ফাটত মেরি ছাতি রে!

উৎসবের দিন সুসজ্জিতা বিভাকে গাড়ী চড়িয়া কোথাও যাইতে দেখিলেও তাহার গান পায়, সে গাহে—

করি উজর শিঙার তু চললু বাজার,

তেরি কাজর নয়না ছাতি তোড়ত হাজার!

তাহার গানে শুধু ছাতি টুটিবারই সংবাদ সে ছুতায়নাতায় প্রকাশ করিত৷ পথের লোকে এই রসপাগল মুচির কাছে জুতা সেলাই করাইতে করাইতে এমনি সব গান শুনিত—

নৈয়া ঝাঁঝরি, অন পরি মউজ ধারা

বায়ু বহি পূরবৈয়াঁ,

অব কস মিলন ভঁয়ে হু হামারা৷

রহি গো পংথ, পাগর পবনা,

সুনহর ঘুংঘট কাজর-নয়না৷

পার করো গোঁসাইয়া৷

তাহার টুটা নৌকা, তাহার উপর অবিরল বর্ষণ এবং প্রবল পবন পাগল হইয়া উঠিয়াছে! কাজল-নয়না মেঘ সোনালি বিদ্যুতের ঘোমটা টানিয়া রহিয়াছে৷ পথ এখনো অনেক বাকি৷ মিলনের আশা তাহার আর নাই৷ তাই তাহার ব্যথিত অন্তর হায় হায় করিয়া দেবতার শরণ মাগিতেছিল—ওগো স্বামী, ওগো প্রভু, তুমিই আমার এই ভগ্ন জীবনতরণীকে পাড়ে ভিড়াইয়া দাও, ওগো পাড়ি জমাইয়া দাও৷


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ