তারিণী মাঝি | তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

তারিণী মাঝির অভ্যাস মাথা হেঁট করিয়া চলা৷ অস্বাভাবিক দীর্ঘ তারিণী ঘরের দরজায়, গাছের ডালে, সাধারণ চালাঘরে বহুবার মাথায় বহু ঘা খাইয়া ঠেকিয়া শিখিয়াছে৷ কিন্তু নদীতে যখন সে খেয়া দেয়, তখন সে খাড়া সোজা৷ তালগাছের ডোঙার উপর দাঁড়াইয়া সুদীর্ঘ লগির খোঁচা মারিয়া যাত্রী-বোঝাই ডোঙাকে ওপার হইতে এপারে লইয়া আসিয়া সে থামে৷

আষাঢ় মাস৷ অম্বুবাচী উপলক্ষে ফেরত যাত্রীর ভিড়ে ময়ূরাক্ষীর গনুটিয়ার ঘাটে যেন হাট বসিয়া গিয়াছিল৷ পথশ্রমকাতর যাত্রীদলের সকলেই আগে পার হইয়া যাইতে চায়৷

তারিণী তামাক খাইতে খাইতে হাঁক মারিয়া উঠিল, আর লয় গো ঠাকরুণরা, আর লয়৷ গঙ্গাচান করে পুণ্যির বোঝায় ভারী হয়ে আইছ সব৷

একজন বৃদ্ধা বলিয়া উঠিল, আর একটি নোক বাবা, এই ছেলেটি৷

ওদিক হইতে একজন ডাকিয়া উঠিল, ওলো ও সাবি, উঠে আয় লো, উঠে আয়! দোশমনের হাড়ের দাঁত মেলে আর হাসতে হবে না৷

সাবি ওরফে সাবিত্রী তরুণী, সে তাহাদের পাশের গ্রামের কয়টি তরুণীর সহিত রহস্যালাপের কৌতুকে হাসিয়া যেন ভাঙিয়া পড়িতেছিল৷ সে বলিল, তোরা যা, আসছে খেপে আমরা সব একসঙ্গে যাব৷

তারিণী বলিয়া উঠিল, না বাপু, তুমি এই খেপেই চাপ৷ তোমরা সব একসঙ্গে চাপলে ডোঙা ডুববেই৷

মুখরা সাবি বলিয়া উঠিল, ডোবে তো তোর ওই বুড়িদের খেপেই ডুববে মাঝি৷ কেউ দশ বার, কেউ বিশ বার গঙ্গাচান করেচে ওরা৷ আমাদের সবে এই একবার৷

তারিণী জোড়হাত করিয়া বলিল, আজ্ঞে মা, একবারেই যে আপনারা গাঙের ঢেউ মাথায় করে আইছেন সব৷

যাত্রীর দল কলরব করিয়া হাসিয়া উঠিল৷ মাঝি লগি হাতে ডোঙার মাথায় লাফ দিয়া উঠিয়া পড়িল৷ তাহার সহকারী কালাচাঁদ পারের পয়সা সংগ্রহ করিতেছিল৷ সে হাঁকিয়া বলিল, পারের কড়ি ফাঁকি দাও নাই তো কেউ, দেখ, এখনও দেখ৷—বলিয়া সে ডোঙাখানা ঠেলিয়া দিয়া ডোঙায় উঠিয়া পড়িল৷

লগির খোঁচা মারিয়া তারিণী বলিল, হরি হরি বল সব—হরিবোল৷ যাত্রীসকল সমস্বরে হরিবোল দিয়া উঠিল—হরিবোল৷ দুইতীরের বনভূমিতে সে কলরোল প্রতিধ্বনিত হইয়া ফিরিতেছিল৷ নিচে খরস্রোতা ময়ূরাক্ষী নিম্নস্বরে ক্রূর হাস্য করিয়া বহিয়া চলিয়াছে৷ তারিণী এবার হাসিয়া বলিয়া বসিল, আমার নাম করলেও পার, আমিই তো পার করছি৷

এক বৃদ্ধা বলিল, তা তো বটেই বাবা৷ তারিণী নইলে কে তরাবে বল?

একটা ঝাঁকি দিয়া লগিটা টানিয়া তুলিয়া তারিণী বিরক্তভরে বলিয়া উঠিল, এই শালা কেলে—এঁটে ধর দাঁড়, হ্যাঁ—সেঙাত আমার ভাত খায় না গো৷ টান দেখিস না?

সত্য কথা, ময়ূরাক্ষীর এই খরস্রোতই বিশেষত্ব৷ বারো মাসের মধ্যে সাত আট মাস ময়ূরাক্ষী মরুভূমি, এক মাইল দেড় মাইল প্রশস্ত বালুকারাশি ধু-ধু করে৷ কিন্তু বর্ষার প্রারম্ভে সে রাক্ষসীর মত ভয়ঙ্করী৷ দুই পার্শ্বে চার-পাঁচ মাইল গাঢ় পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতে পরিব্যাপ্ত করিয়া বিপুল স্রোতে তখন সে ছুটিয়া চলে৷ আবার কখনও কখনও আসে ‘হড়পা’ বান, ছয়-সাত হাত উচ্চ জলস্রোত সম্মুখের বাড়ি-ঘর ক্ষেত-খামার গ্রামের পর গ্রাম নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া দিয়া সমস্ত দেশটাকে প্লাবিত করিয়া দিয়া যায়৷ কিন্তু সে সচরাচর হয় না৷ বিশ বৎসর পূর্বে একবার হইয়াছিল৷

মাথার উপর রৌদ্র প্রখর হইয়া উঠিয়াছিল৷ একজন পুরুষ যাত্রী ছাতা খুলিয়া বসিল৷

তারিণী বলিল, পাল খাটিও না ঠাকুর, পাল খাটিও না৷ তুমিই উড়ে যাবা৷

লোকটি ছাতা বন্ধ করিয়া দিল৷ সহসা নদীর উপরের দিকে একটা কলরব ধ্বনিত হইয়া উঠিল—আর্ত কলরব৷

ডোঙার যাত্রী সব সচকিত হইয়া পড়িল৷ তারিণী ধীরভাবে লগি চালাইয়া বলিল, এই, সব হুঁশ করে! তোমাদের কিছু হয় নাই৷ ডোঙা ডুবেছে ওলকুড়োর ঘাটে৷ এই বুড়ি মা, কাঁপছ কেনে, ধর ধর ঠাকুর, বুড়িকে ধর৷ ভয় কি! এই আমরা আর-ঘাটে এসে গেইছি৷ 

নদীও শেষ হইয়া আসিয়াছিল৷

তারিণী বলিল, কেলে!

কী?

নদীবক্ষের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিয়া তারিণী বলিল, লগি ধর দেখি৷

কালাচাঁদ উঠিয়া পড়িল৷ তাহার হাতে লগি দিতে দিতে তারিণী বলিল, হুই—দেখ—হুই হুই ডুবল৷ বলিতে বলিতে সে খরস্রোতা নদীগর্ভে ঝাঁপ দিয়া পড়িল৷ ডোঙার উপর কয়েকটি বৃদ্ধা কাঁদিয়া উঠিল, ও বাবা তারিণী, আমাদের কি হবে বাবা৷

কালাচাঁদ বলিয়া উঠিল, এই বুড়িরা, পেছু ডাকে দেখ দেখি৷ মরবি মরবি, তোরা মরবি৷ 

পিঙ্গলবর্ণ জলস্রোতের মধ্যে শ্বেতবর্ণের কি একটা মধ্যে মধ্যে ডুবিতেছিল, আবার কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিতেছিল৷ তাহাকে লক্ষ করিয়াই তারিণী ক্ষিপ্ত গতিতে স্রোতের মুখে সাঁতার কাটিয়া চলিয়াছিল৷ সে চলার মধ্যে যেন কত স্বচ্ছন্দ গতি৷ বস্তুটার নিকটেই সে আসিয়া পড়িয়াছিল৷ কিন্তু সেই মুহূর্তেই সেটা ডুবিল৷ সঙ্গে সঙ্গে তারিণী ডুবিল৷ দেখিতে দেখিতে সে কিছুদূরে গিয়া ভাসিয়া উঠিল৷ এক হাতে তাহার ঘন কালো রঙের কি রহিয়াছে৷ তারপর সে ঈষৎ বাঁকিয়া স্রোতের মুখেই সাঁতার কাটিয়া ভাসিয়া চলিল৷

দুই তীরের জনতা আশঙ্কাবিমিশ্র ঔৎসুক্যের সহিত একাগ্রদৃষ্টিতে তারিণীকে লক্ষ্য করিতেছিল৷ এক তীরের জনতা দেখিতে দেখিতে উচ্চরোলে চীৎকার করিয়া উঠিল, হরিবোল৷

অন্য তীরের জনতা চীৎকার করিয়া প্রশ্ন করিতেছিল, উঠেছে? উঠেছে?

কালাচাঁদ তখন ডোঙা লইয়া ছুটিয়াছিল৷

তারিণীর ভাগ্য ভাল৷ জলমগ্ন ব্যক্তিটি স্থানীয় বর্ধিষ্ণু ঘরেরই একটি বধূ৷ ওলকুড়ার ঘাটে ডোঙা ডুবে নাই, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনাবৃতা বধূটি ডোঙার কিনারায় ভর দিয়া সরিয়া বসিতে গিয়া এই বিপদ ঘটাইয়া বসিয়াছিল৷ অবগুণ্ঠনের জন্যই হাতটা লক্ষভ্রষ্ট হইয়া সে টলিয়া জলে পড়িয়া গিয়াছিল৷ মেয়েটি খানিকটা জল খাইয়াছিল, কিন্তু তেমন বেশী কিছু নয়—অল্প শুশ্র+ষাতেই তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল৷

নিতান্ত কচি মেয়ে—তের চৌদ্দ বৎসরের বেশি বয়স নয় দেখিতে বেশ সুশ্রী, দেহে অলঙ্কার কয়খানা রহিয়াছে—কানে মাকড়ি, নাকে টানা-দেওয়া নখ, হাতে রুলি, গলায় হার৷ সে তখনও হাঁপাইতেছিল৷ অল্পক্ষণ পরেই মেয়েটির স্বামী ও শ্বশুর আসিয়া পৌঁছিলেন৷

তারিণী প্রণাম করিয়া বলিল, পেনাম ঘোষমশাই৷

মেয়েটি তাড়াতাড়ি দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টানিয়া দিল৷

তারিণী কহিল, আর সান কেড়ো না মা, দম লাও দম লাও৷ সেই যে বলে—লাজে মা কুঁকড়ি বেপদের ধুকুড়ি৷

ঘোষমহাশয় বলিলেন, কী চাই তোর তারিণী, বল?

তারিণী মাথা চুলকাইয়া সারা হইল, কী তাহার চাই, সে ঠিক করিতে পারিল না৷ অবশেষে বলিল, এক হাঁড়ি মদের দাম—আট আনা৷

জনতার মধ্য হইতে সেই সাবি মেয়েটি বলিয়া উঠিল, আ মরণ আমার! দামী কিছু চেয়ে নে রে বাপু!

তারিণীর যেন এতক্ষণে খেয়াল হইল, সে হেঁটমাথাতেই সলজ্জ হাসি হাসিয়া বলিল, ফাঁদি লত একখানা ঘোষ-মশাই৷

জনতার মধ্য হইতেই সাবিই আবার বলিয়া উঠিল, হ্যাঁ বাবা তারিণী, বউমা বুঝি খুব নাক নেড়ে কথা কয়?

প্রফুল্লচিত্ত জনতার হাস্যধ্বনিতে খেয়াঘাট মুখরিত হইয়া উঠিল৷

বধূটি ঘোমটা খুলে নাই, দীর্ঘ অবগুণ্ঠনের মধ্য হইতে তাহার গৌরবর্ণ কচি হাতখানি বাহির হইয়া আসিল—রাঙা করতলের উপর সোনার নথখানি রৌদ্রাভায় ঝকঝক করিতেছে৷

ঘোষমহাশয় বলিলেন, দশহরার সময় পার্বণী রইল তোর কাপড় আর চাদর, বুঝলি তারিণী? আর এই নে পাঁচ টাকা৷

তারিণী কৃতজ্ঞতায় নত হইয়া প্রণাম করিল, আজ্ঞে হুজুর, চাদরের বদলে যদি শাড়ি—

হাসিয়া ঘোষ মহাশয় বলিলেন, তাই হবে রে, তাই হবে৷

সাবি বলিল, তোর বউকে একবার দেখতাম তারিণী৷

তারিণী বলিল, নেহাত কালো কুচ্ছিত মা৷

তারিণী সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরিল আকণ্ঠ মদ গিলিয়া৷ এখানে পা ফেলিতে পা পড়িতেছিল ওখানে৷ সে বিরক্ত হইয়া কালাচাঁদকে বলিল, রাস্তায় এত নেলা কে কাটলে রে কেলে? শুধুই নেলা—শুধুই নেলা—শুধুই নেলা—শুধুই—অ্যা—অ্যাই—একটো—

কালাচাঁদও নেশায় বিভোর, সে শুধু বলিল, হুঁ৷

তারিণী বলিল, জলাম্পয়—সব জলাম্পয় হয়ে যায়, সাঁতরে বাড়ি চলে যাই৷ শালা খাল নাই, নেলা নাই, সমান স—ব সমান৷

টলিতে টলিতেই সে শূন্যের বায়ুমণ্ডলে হাত ছুঁড়িয়া ছুঁড়িয়া সাঁতারের অভিনয় করিয়া চলিয়াছিল৷

গ্রামের প্রান্তেই বাড়ি৷ বাড়ির দরজায় একটা আলো জ্বালিয়া দাঁড়াইয়া ছিল সুখী—তারিণীর স্ত্রী৷ 

তারিণী গান ধরিয়া দিল, লো—তুন হয়েছে দেশে ফাঁদি লতে আমদানি—

সুখী তাহার হাত ধরিয়া বলিল, খুব হয়েছে, এখন এস৷ ভাত কটা জুড়িয়ে কড়কড়ে হিম হয়ে গেল৷

হাতটা ছাড়াইয়া লইয়া কোমরের কাপড় খুঁজিতে খুঁজিতে তারিণী বলিল, আগে তোকে লত পরাতে হবে৷ লত কই—কই কোথা গেল শালার লত?

সুখী বলিল, কোন দিন ওই করতে গিয়ে আমার মাথা খাবে তুমি৷ এবার আমি গলায় দড়ি দেবো কিন্তু৷

তারিণী ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, কেনে, কি করলাম আমি?

সুখী দৃষ্টিতে তাহাকে তিরস্কার করিয়া বলিল, এই পাথার বান, আর তুমি—

তারিণীর অট্টহাসিতে বর্ষার রাত্রির সজল অন্ধকার ত্রস্ত হইয়া উঠিল৷ হাসি থামাইয়া সে সুখীর দিকে চাহিয়া বলিল, মায়ের বুকে ভয় থাকে! বল তু বল, বলে যা বলছি৷ পেটের ভাত ঐ ময়ূরাক্ষীর দৌলতে৷ জবাব দে কথার—আই!

সুখী তাহার সহিত আর বাক্যব্যয় না করিয়া ভাত বাড়িতে চলিয়া গেল৷

তারিণী ডাকিল, সুখী, অ্যাই সুখী, অ্যাই!

সুখী কোনো উত্তর দিল না৷ তারিণী টলিতে টলিতে উঠিয়া ঘরের দিকে চলিল৷ পিছন হইতে ভাত বাড়িতে ব্যস্ত সুখীকে ধরিয়া বলিল, চল এখুনি তোকে যেতে হবে৷ 

সুখী বলিল, ছাড়, কাপড় ছাড়৷

তারিণী বলিল, আলবত যেতে হবে৷ হাজার বার—তিনশো বার৷

সুখী কাপড়টা টানিয়া বলিল, কাপড় ছাড়—যাব, চল৷ তারিণী খুশি হইয়া কাপড় ছাড়িয়া দিল৷ সুখী ভাতের থালাটা লইয়া বাহির হইয়া গেল৷

তারিণী বলিতেছিল, চল, তোকে পিঠে নিয়ে ঝাঁপ দোব গনুটের ঘাটে, উঠব পাঁচথুপীর ঘাটে৷

সুখী বলিল, তাই যাবে, ভাত খেয়ে লাও দিকিনি৷

বাহির হইয়া আসিতে গিয়া দরজায় চৌকাঠে কপালে আঘাত খাইয়া তারিণীর আস্ফালনটা একটু কমিয়া আসিল৷

ভাত খাইতে খাইতে সে আবার আরম্ভ করিল, তুলি নাই সেবার এক জোড়া গোরু? পনের টাকা—পাঁচ টাকা কম এক কুড়ি, শালা মদন গোপ ঠকিয়ে নিলে? তোর হাতের শাঁখা-বাঁধা কী করে হল? বল, কে—তোর কোন নানা দিলে?

সুখী ঘরের মধ্যে আমানি ছাঁকিতেছিল, ঠাণ্ডা জিনিস নেশার পক্ষে ভাল৷ তারিণী বলিল, শালা মদনা—নিলি ঠকিয়ে —লে৷ সুখীর শাঁখাবাঁধা তো হয়েছে, বাস, আমাকে দিস আর না দিস? পড়ে শালা একদিন ময়ূরাক্ষীর বানে—শালাকে গোটা কতক চোবন দিয়ে তবে তুলি৷

সম্মুখে আমানির বাটি ধরিয়া দিয়া সুখী তারিণীর কাপড়ের খুঁট খুলিতে আরম্ভ করিল, বাহির হইল নথখানি আর তিনটি টাকা৷

সুখী প্রশ্ন করিল, আর দু টাকা কই?

তারিণী বলিল, কেলে, ওই কেলে, দিয়ে দিলাম কেলেকে—যা লিয়ে যা৷

সুখী এ কথায় কোনও বাদ-প্রতিবাদ করিল না, সে তাহার অভ্যাস নয়৷ তারিণী আবার বকিতে শুরু করিল, সেবার সেই তোর যখন অসুখ হল, ডাক পার হয় না, পুলিশ সাহেব ঘাটে বসে ভাপাইছে, হুঁ হুঁ বাপ—সেই বকশিশে তোর কানের ফুল৷ যা, তু যা, এখুনি ডাক লদীর পার থেকে—এই উঠে আয় হারামজাদা লদী৷ উবে আসবে৷ যা যা৷

সুখী বলিল, দাঁড়াও আয়নাটা লিয়ে অসি, লতটা পরি৷

তারিণী খুশী হইয়া নীরব হইল৷ সুখী আনিয়া সম্মুখে রাখিয়া নথ পরিতে বসিল৷ সে হাঁ করিয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল, ভাত খাওয়া তখন বন্ধ হইয়া গিয়াছে৷ নথ পরা শেষ হইতেই সে উচ্ছিষ্ট হাতেই আলোটা তুলিয়া ধরিয়া বলিল, দেখি দেখি৷

সুখীর মুখে পুলকের আবেগ ফুটিয়া উঠিল, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখখানি তাহার রাঙা হইয়া উঠিল৷

তারিণী সাবি-ঠাকরুণকে মিথ্যা কথা বলিয়াছিল৷ সুখী তন্বী, সুখী সুশ্রী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা৷ সুখীর জন্য তারিণীর সুখের সীমা নাই৷

তারিণী মত্ত অবস্থাতে বলিলেও মিথ্যা বলে নাই৷ ওই ময়ূরাক্ষীর প্রসাদেই তারিণীর অন্নবস্ত্রের অভাব হয় না৷ দশহরার দিন ময়ূরাক্ষীর পূজাও সে করিয়া থাকে৷ এবার তেরো শো বিয়াল্লিশ সালে দশহরার দিন তারিণী নিয়মমত পূজা-অর্চনা করিতেছিল৷ তাহার পরনে নূতন কাপড়, সুখীর পরনেও নূতন শাড়ি—ঘোষ মহাশয়ের দেওয়া পার্বণী৷ জলহীন ময়ূরাক্ষীর বালুকাময় গর্ভ গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে ঝিকিমিকি করিতেছিল৷ তখনও পর্যন্ত বৃষ্টি নামে নাই৷ ভোগপুরের কেষ্ট দাস নদীর ঘাটে নামিয়া একবার দাঁড়াইল৷ সমস্ত দেখিয়া একবার আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, ভাল করে পুজো কর তারিণী, জল-টল হোক, বান-টান আসুক, বান না এলে চাষ হবে কি করে?

ময়ূরাক্ষীর পলিতে দেশে সোনা ফলে৷

তারিণী হাসিয়া বলিল, তাই বল বাপু৷ লোকে বলে কি জান দাস, বলে, শালা বানের লেগে পুজো দেয়৷ এই মায়ের কিপাতেই এ মুলুকের লক্ষ্মী৷ ধর ধর কেলে, ওরে, পাঁঠা পালাল, ধর৷

বলির পাঁঠাটা নদীগর্ভে উত্তপ্ত বালুকার উপর আর থাকিতে চাহিতেছিল না৷

পূজা-অর্চনা সুশৃঙ্খলেই হইয়া গেল৷ তারিণী মদ খাইয়া নদীর ঘাটে বসিয়া কালাচাঁদকে বলিতেছিল, হড়হড়—কলকল—বান—লে কেনে তু দশ দিন বাদ৷

কালাচাঁদ বলিল, এবার মাইরি তু কিন্তুক ভাসা জিনিস ধরতে পাবি না৷ এবার কিন্তুক আমি ধরব, হ্যাঁ৷

তারিণী মত্ত হাসি হাসিয়া বলিল, বড় ঘুরণ-চাকে তিনটি বুটবুটি, বুক—বুক—বুক—বুক, বাস—কালাচাঁদ—কালাচাঁদ ফরসা৷

কালাচাঁদ অপমানে আগুন হইয়া উঠিল, কি বললি শালা?

তারিণী খাড়া সোজা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু সুখী মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া সব মিটাইয়া দিল৷ সে বলিল, ছোট বানের সময়—হুই পাকুড়্গাছ পর্যন্ত বানে দেওর ধরবে, আর পাকুড়্গাছ ছাড়ালেই তুমি৷

কালাচাঁদ সুখীর পায়ের ধূলা লইয়া কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়া দিল, বউ লইলে ই বলে কে?

পরদিন হইতে ডোঙা মেরামত আরম্ভ হইল, দুইজনে হাতুড়ি নেয়ান লইয়া সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করিয়া ডোঙাখানাকে প্রায় নূতন করিয়া ফেলিল৷

কিন্তু সে ডোঙায় আবার ফাট ধরিল রৌদ্রের টানে৷ সমস্ত আষাঢ়ের মধ্যে বান হইল না৷ বান দূরের কথা, নদীর বালি ঢাকিয়া জলও হইল না৷ বৃষ্টি অতি সামান্য—দুই চারি পশলা৷ সমস্ত দেশটার মধ্যে একটা মৃদু কাতর ক্রন্দন যেন সাড়া দিয়া উঠিল৷ প্রত্যাসন্ন বিপদের জন্য দেশ যেন মৃদুস্বরে কাঁদিতেছিল৷ কিংবা হয়তো বহুদূরের যে হাহাকার আসিতেছে, বায়ুস্তরবাহিত তাহারই অগ্রধ্বনি এ৷ তারিণীর দিন আর চলে না৷ সরকারী কর্মচারীদের বাইসিকল ঘাড়ে করিয়া নদী পার করিয়া দুই-চারটি পয়সা মেলে, তাহাতেই সে মদ খায়৷ সরকারী কর্মচারীদের এ সময়ে আসা-যাওয়ার হিড়িক পড়িয়া গিয়াছে—তাঁহারা আসেন দেশে সত্যই অভাব আছে কি না তাহারই তদন্তে৷ আরও কিছু মেলে—সে তাহাদের ফেলিয়া দেওয়া সিগারেটের কুটি৷

শ্রাবণের প্রথমেই বন্যা আসিল৷ তারিণী হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল৷ বন্যার প্রথম দিন বিপুল আনন্দে সে তালগাছের মত উঁচু পাড়ের উপর হইতে ঝাঁপ দিয়া নদীর বুকে পড়িয়া বন্যার জল আরও উচ্ছল ও চঞ্চল করিয়া তুলিল৷

কিন্তু তিন দিনের দিন নদীতে আবার হাঁটুজল হইয়া গেল৷ গাছে বাঁধা ডোঙাটা তরঙ্গাঘাতে মৃদু দোল খাইতেছিল৷ তাহারই উপর তারিণী ও কালাচাঁদ বসিয়া ছিল—যদি কেহ ভদ্র যাত্রী আসে তাহারই প্রতীক্ষায়, যে হাঁটিয়া পার হইবে না৷ এ অবস্থায় তাহারা দুইজনে মিলিয়া ডোঙাটা ঠেলিয়া লইয়া যায়৷

সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছিল৷ তারিণী বলিল, ই কি হল বল দেখি কেলে?

চিন্তাকুলভাবে কালাচাঁদ বলিল, তাই তো!

তারিণী আবার বলিল, এমন তো কখনও দেখি নাই!

সেই পূর্বের মতই কালাচাঁদ উত্তর দিল, তাই তো!

আকাশের দিকে চাহিয়া তারিণী বলিল, আকাশে দেখ কেনে—ফরসা লী-ল৷ পচিদিকেও তো ডাকে না!

কালাচাঁদ এবার উত্তর দিল, তাই তো!

ঠাস করিয়া তাহার গালে একটা চড় কসাইয়া দিয়া তারিণী বলিল, তাই তো! তাই তো—বলতেই যেন আমি ওকে বলছি৷ তাই তো! তাই তো!

কালাচাঁদ একান্ত অপ্রতিভের মত তারিণীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল৷ কালাচাঁদের সে দৃষ্টি তারিণী সহ্য করিতে পারিল না, সে অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া বসিল৷ কিছুক্ষণ পর অকস্মাৎ যেন সচেতনের মত নড়িয়া-চড়িয়া বসিয়া সে বলিয়া উঠিল, বাতাস ঘুরেছে লয় কেলে, পচি বইছে না? বলিতে বলিতে সে লাফ দিয়া ডাঙ্গায় উঠিয়া শুষ্ক বালি একমুঠা ঝুরঝুর করিয়া মাটিতে ফেলিতে আরম্ভ করিল৷ কিন্তু বায়ুপ্রবাহ অতি ক্ষীণ, পশ্চিমের কি না ঠিক বুঝা গেল না৷ তবুও সে বলিল, হুঁ, পচি থেকে ঠেল হইছে—একটুকুন৷ আয় কেলে, মদ খাব, আয়৷ দু আনা পয়সা আছে আজ৷ বার করে নিয়েছি আজ সুখীর খুঁট খুলে৷

সস্নেহ নিমন্ত্রণে কালাচাঁদ খুশি হইয়া উঠিয়াছিল৷ সে তারিণীর সঙ্গ ধরিয়া বলিল, তোমার বউয়ের হাতে টাকা আছে দাদা৷ বাড়ি গেলে তোমার ভাত ঠিক পাবেই৷ মলাম আমরাই৷ 

তারিণী বলিল, সুখী বড় ভাল রে কেলে, বড় ভাল৷ উ না থাকলে আমার হাড়ির ললাট ডোমের দুগগতি হয় ভাই৷ সেবার সেই ভাইয়ের বিয়েতে—

বাধা দিয়া কালাচাঁদ বলিল, দাঁড়াও দাদা, একটা তাল পড়ে রইছে, কুড়িয়ে লি৷

সে ছুটিয়া পাশের মাঠে নামিয়া পড়িল৷

একদল লোক গ্রামের ধারে গাছতলায় বসিয়াছিল, তারিণী প্রশ্ন করিল, কোথা যাবা হে তোমরা, বাড়ি কোথা?

একজন উত্তর দিল, বীরচন্দ্রপুর বাড়ি ভাই আমাদের, খাটতে যাব আমরা বদ্ধমান৷

কালাচাঁদ প্রশ্ন করিল, বদ্ধমানে কি জল হইছে নাকি?

জল হয় নাই, ক্যানেলে আছে কিনা৷

দেখিতে দেখিতে দেশে হাহাকার পড়িয়া গেল৷ দুর্ভিক্ষ যেন দেশের মাটির তলেই আত্মগোপন করিয়া ছিল, মাটির ফাটলের মধ্য দিয়া পথ পাইয়া সে ভয়াল মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করিয়া বসিল৷ গৃহস্থ আপনার ভাণ্ডার বন্ধ করিল৷ জনমজুরের মধ্যে উপবাস শুরু হইল৷ দলে দলে লোক দেশ ছাড়িতে আরম্ভ করিল৷

সেদিন সকালে উঠিয়া তারিণী ঘাটে আসিয়া দেখিল কালাচাঁদ আসে নাই৷ প্রহর গড়াইয়া গেল, কালাচাঁদ তবুও আসিল না৷ তারিণী উঠিয়া কালাচাঁদের বাড়ি গিয়া ডাকিল, কেলে!

কেহ উত্তর দিল না৷ বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিল, ঘরদ্বার শূন্য খাঁ খাঁ করিতেছে, কেহ কোথাও নাই৷ পাশের বাড়িতে গিয়া দেখিল, সে বাড়িও শূন্য৷ শুধু সে বাড়িই নয়, কালাচাঁদের পাড়াটাই জনশূন্য৷ পাশের চাষাপাড়ায় গিয়া শুনিল, কালাচাঁদের পাড়ার সকলেই কাল রাত্রে গ্রাম ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে৷

হারু মোড়ল বলিল, বললাম আমি তারিণী, যাস না সব, যাস না৷ তা শুনলে না, বলে, বড়নোখের গাঁয়ে ভিখ করব৷

তারিণীর বুকের ভিতরটা কেমন করিতেছিল সে ওই জনশূন্য পল্লীটার দিকে চাহিয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল৷

হারু আবার বলিল, দেশে বড়নোক কি আছে? সব তলা-ফাঁক৷ তাদের আবার বড় বেপদ৷ পেটে না খেলেও মুখে কবুল দিতে পারে না৷ এই তো কি বলে—গাঁয়ের নাম, ওই যে পলাশডাঙ্গা, পলাশডাঙ্গার ভদ্দরনোক একজন গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে৷ শুধু অভাবে মরেছে৷

তারিণী শিহরিয়া উঠিল৷

পরদিন ঘাটে এক বীভৎস কাণ্ড৷ মাঠের পাশেই এক বৃদ্ধার মৃতদেহ পড়িয়া ছিল৷ কতকটা তার শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়িয়া খাইয়াছে৷ তারিণী চিনিল, একটি মুচি পরিবারের বৃদ্ধ মাতা এ হতভাগিনী৷ গত অপরাহ্ণে চলচ্ছক্তিহীনা বৃদ্ধার মৃত্যু-কামনা বার বার তাহারা করিতেছিল৷ বৃদ্ধার জন্যই ঘাটের পাশে গত রাত্রে তাহার আশ্রয় লইয়াছিল৷ রাত্রে ঘুমন্ত বৃদ্ধাকে ফেলিয়া তাহারা পালাইয়াছে৷

সে আর সেখানে দাঁড়াইল না৷ বরাবর বাড়ি আসিয়া সুখীকে বলিল, লে সুখী, খানচারেক কাপড় আর গয়না কটা পেট-আঁচলে বেঁধে লে৷ আর ই গাঁয়ে থাকব না, শহর দিকে যাব৷ দিন-খাটুনি তো মিলবে৷

জিনিসপত্র বাঁধিবার সময় তারিণী দেখিল, হাতের শাঁখা ছাড়া কোন গহনাই সুখীর নাই৷ তারিণী চমকিয়া উঠিয়া প্রশ্ন করিল, আর?

সুখী ম্লান হাসিয়া বলিল, এতদিন চলল কিসে বল?

তারিণী গ্রাম ছাড়িল৷

দিন তিনেক পথ চলিবার পর সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের প্রান্তে তাহারা রাত্রির জন্য বিশ্রাম লইয়াছিল৷ গোটা দুই পাকা তাল লইয়া দুইজনে রাত্রির আহার সারিয়া লইতেছিল৷ তারিণী চট করিয়া উঠিয়া খোলা জায়গায় গিয়া দাঁড়াইল৷ থাকিতে থাকিতে বলিল, দেখি সুখী গামছাখানা৷ গামছাখানা লইয়া হাতে ঝুলাইয়া সেটাকে সে লক্ষ্য করিতে আরম্ভ করিল৷ ভোরবেলায় সুখীর ঘুম ভাঙিয়া গেল, দেখিল, তারিণী ঠায় জাগিয়া বসিয়া আছে৷ সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, ঘুমোও নাই তুমি?

হাসিয়া তারিণী বলিল, না, ঘুম এল না৷

সুখী তাহাকে তিরস্কার আরম্ভ করিল, ব্যামো-স্যামো হলে কী করব বল দেখি আমি? ই মানুষের বাইরে বেরুনো কেনে বাপু, ছি—ছি—ছি!

তারিণী পুলকিত কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, দেখেছিস, সুখী, দেখেছিস?

সুখী বলিল, আমার মাথামুণ্ডু কি দেখব, বল?

তারিণী বলিল, পিঁপড়েতে ডিম মুখে নিয়ে ওপরের পানে চলল, জল এইবার হবে৷ 

সুখী দেখিল, সত্যই লক্ষ লক্ষ পিপীলিকা শ্রেণীবদ্ধ ভাবে প’ড়ো ঘরখানার দেওয়ালের উপর উঠিয়া চলিয়াছে৷ মুখে তাহাদের সাদা সাদা ডিম৷

সুখী বলিল, তোমার যেমন—৷

তারিণী বলিল, ওরা ঠিক জানতে পারে, নিচে থাকলে যে জলে বাসা ভেসে যাবে৷ ইদিকে বাতাস কেমন বইছে, দেখেছিস? ঝাড়া পচি থেকে৷

আকাশের দিকে চাহিয়া সুখী বলিল, আকাশ তো ফটফটে—চকচক করছে৷

তারিণী চাহিয়া ছিল অন্যদিকে, সে বলিল, মেঘ আসতে কতক্ষণ? ওই দেখ, কাকে কুটো তুলছে—বাসার ভাঙা-ফুটো সারবে৷ আজ এইখানেই থাক সুখী, আর যাব না দেখি মেঘের গতিক৷

খেয়া মাঝির পর্যবেক্ষণ ভুল হয় নাই অপরাহ্নের দিকে আকাশ মেঘে ছাইয়া গেল, পশ্চিমের বাতাস ক্রমশ প্রবল হইয়া উঠিল৷

তারিণী বলিল, ওঠ সুখী, ফিরব৷

সুখী বলিল, এই অবেলায়?

তারিণী বলিল, ভয় কি তোর, আমি সঙ্গে রইছি৷ লে, মাথালি তু মাথায় দে৷ টিপিটিপি জল ভারি খারাপ৷

সুখী বলিল, আর তুমি, তোমার শরীল বুঝি পাথরের?

তারিণী হাসিয়া বলিল, ওরে, ই আমার জলের শরীল, রোদে টান ধরে জল পেলেই ফোলে৷ চল, দে পুঁটলি আমাকে দে৷

ধীরে ধীরে বাদল বাড়িতেছিল৷ উতলা বাতাসের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ রিমিঝিমি বৃষ্টি হইয়া যায়৷ তারপর থামে৷ কিছুক্ষণ পর আবার বাতাস প্রবল হয়, সঙ্গে সঙ্গে নামে বৃষ্টি৷

যে পথ গিয়াছিল তাহারা তিন দিনে, ফিরিবার সময় সেই পথ অতিক্রম করিল দুই দিনে৷ সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরিয়াই তারিণী বলিল, দাঁড়া, লদীর ঘাট দেখে আসি৷ ফিরিয়া আসিয়া পুলকিত চিত্তে তারিণী বলিল, লদী কানায় কানায়, সুখী৷

প্রভাতে উঠিয়াই তারিণী ঘাটে যাইবার জন্য সাজিল৷ আকাশ তখন দুরন্ত দুর্যোগে আচ্ছন্ন, ঝড়ের মত বাতাস, সঙ্গে সঙ্গে ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি৷

দ্বিপ্রহরে তারিণী ফিরিয়া আসিয়া বলিল, কামার বাড়ি চললাম আমি৷

সুখী ব্যস্তভাবে বলিল, খেয়ে যাও কিছু৷

চিন্তিত মুখে ব্যস্ত তারিণী বলিল, না, ডোঙার একটা বড় গজাল খুলে গেইচে৷ সে না হলে—উহুঁ, অল্প বান হলে না হয় হত, লদী একেবারে পাথার হয়ে উঠেছে দেখসে আয়৷

সুখীকে না দেখাইয়া ছাড়িল না৷ পালদের পুকুরের উঁচু পাড়ের উপর দাঁড়াইয়া সুখী দেখিল, ময়ূরাক্ষীর পরিপূর্ণ রূপ৷ বিস্তৃত যেন পারাপারহীন৷ রাঙা জলের মাথায় রাশি রাশি পুঞ্জিত ফেনা ভাসা-ফুলের মত দ্রুতবেগে ছুটিয়া চলিয়াছে৷ তারিণী বলিল, ডাক শুনছিস—সোঁ-সোঁ? বান আরও বাড়বে, তু বাড়ি যা, আমি চললাম৷ লইলে কাল আর ডাক পার করতে পারব না৷

সুখী অসন্তুষ্ট চিত্তে বলিল, এই জল ঝড়—

তারিণী সে কথা কানেই তুলিল না৷ দুরন্ত দুর্যোগের মধ্যেই সে বাহির হইয়া গেল৷

যখন সে ফিরিল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে৷ দ্রুতপদে সে আসিতেছিল৷ কি একটা ‘ডুগডুগ’ শব্দ শোনা যায় না? হাঁ, ডুগডুগিই বটে৷ এ শব্দের অর্থ তো সে জানে, আসন্ন বিপদ৷ নদীর ধারে গ্রামে গ্রামে এই ডুগডুগি যখন বাজে, তখন বন্যার ভয় আসন্ন বুঝিতে হয়৷

তারিণীর গ্রামের ও-পাশে ময়ূরাক্ষী, এ-পাশে ছোট একটা কাঁতার অর্থাৎ ছোট্ট শাখা নদী৷ একটা বাঁশের পুল দিয়া গ্রামে প্রবেশের পথ৷ তারিণী সড়ক পথ ধরিয়া আসিয়াও বাঁশের পুল খুঁজিয়া পাইল না৷ তবে পথ ভুল হইল নাকি? অন্ধকারের মধ্যে অনেকক্ষণ ঠাহর করিল, সে পুলের মুখ এখনও অন্তত এক শত বিঘা জমির পরে৷ ঠিক বন্যার জলের ধারেই সে দাঁড়াইয়া ছিল, আঙুলের ডগায় ছিল জলের সীমা৷ দেখিতে দেখিতে গোড়ালি পর্যন্ত জলে ডুবিয়া গেল৷ সে কান পাতিয়া রহিল, কিন্তু বাতাস ও জলের শব্দ ছাড়া কিছু শোনা যায় না, আর একটা গর্জনের মত গোঁ-গোঁ শব্দ৷ দেখিতে দেখিতে সর্বাঙ্গ তাহার পোকায় ছাইয়া গেল৷ লাফ দিয়া মাটির পোকা পালাইয়া যাইতে চাহিতেছে৷

তারিণী জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িল৷

ক্ষিপ্রগতিতে মাঠের জল অতিক্রম করিয়া গ্রামে প্রবেশ করিয়া সে চমকিয়া উঠিল৷ গ্রামের মধ্যেও বন্যা প্রবেশ করিয়াছে৷ এক কোমর জলে পথঘাট ঘরদ্বার সব ভরিয়া গিয়াছে৷ পথের উপর দাঁড়াইয়া গ্রামের নরনারী আর্ত চীৎকার করিয়া এ উহাকে ডাকিতেছে৷ গরু ছাগল ভেড়া কুকুরের সে কি ভয়ার্ত চিৎকার! কিন্তু সে সমস্ত শব্দ আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল ময়ূরাক্ষীর গর্জন, বাতাসের অট্টহাস্য আর বর্ষণের শব্দ লুণ্ঠনকারী ডাকাতের দল অট্টহাস্য ও চিৎকারে যেমন করিয়া ভয়ার্ত গৃহস্থের ক্রন্দন ঢাকিয়া দেয়, ঠিক তেমনই ভাবে৷

গভীর অন্ধকারে পথও বেশ চেনা যায় না৷

জলের মধ্যে কি একটা বস্তুর উপর তারিণীর পা পড়িল, জীব বলিয়াই বোধ হয়৷ হেঁট হইয়া তারিণী সেটাকে তুলিয়া দেখিল, ছাগলের ছানা একটা, শেষ হইয়া গিয়াছে৷ সেটাকে ফেলিয়া দিয়া কোনরূপে সে বাড়ির দরজায় আসিয়া ডাকিল, সুখী—সুখী!

ঘরের মধ্য হইতে সাড়া আসিল—অপরিমেয় আশ্বস্ত কণ্ঠস্বরে সুখী সাড়া দিল, এই যে, ঘরে আমি৷

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তারিণী দেখিল, ঘরের উঠানে এক কোমর জল৷ দাওয়ার উপর এক-হাঁটু জলে চালের বাঁশ ধরিয়া সুখী দাঁড়াইয়া আছে৷

তারিণী তাহার হাত টানিয়া ধরিয়া বলিল, বেরিয়ে আয়, এখন কি ঘরে থাকে, ঘর চাপা পড়ে মরবি যে!

সুখী বলিল, তোমার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি৷ কোথা খুঁজে বেড়াতে বল দেখি?

পথে নামিয়া তারিণী দাঁড়াইল, বলিল, কি করি বল দেখি সুখী?

সুখী বলিল, এইখানেই দাঁড়াও৷ সবার যা দশা হবে, আমাদেরও তাই হবে৷

তারিণী বলিল, বান যদি আরও বাড়ে, সুখী? গোঁ-গোঁ ডাক শুনছিস না?

সুখী বলিল, আর কি বান বাড়ে গো? আর বান বাড়লে দেশের কি থাকবে? ছিষ্টি কি আর লষ্ট করবে ভগবান?

তারিণী এ আশ্বাস গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পারিল না৷

একটা হুড়মুড় শব্দের সঙ্গে বন্যার জল ছটকাইয়া দুলিয়া উঠিল৷ তারিণী বলিল, আমাদেরই ঘর পড়ল সুখী৷ চল, আর লয়, জল কোমরের ওপর উঠল, তোর তো এক ছাতি হয়েছে তা হলে৷

অন্ধকারে কোথায় বা কাহার কণ্ঠস্বর বোঝা গেল না৷ কিন্তু নারীকণ্ঠের কাতর ক্রন্দন ধ্বনিয়া উঠিল, ওগো, খোকা পড়ে গেইছে বুক থেকে৷ খোকা রে!

তারিণী বলিল, এইখানেই থাকবি সুখী, ডাকলে সাড়া দিস৷

সে অন্ধকারে মিলাইয়া গেল৷ শুধু তাহার কণ্ঠস্বর শোনা যাইতেছিল, কে? কোথা? কার ছেলে পড়ে গেল, সাড়া দাও, ওই!

ওদিক হইতে সাড়া আসিল, এই যে৷

তারিণী আবার হাঁকিল, ওই!

কিছুক্ষণ ধরিয়া কণ্ঠস্বরের সঙ্কেতের আদান-প্রদান চলিয়া সে শব্দ বন্ধ হইয়া গেল৷ তাহার পরই তারিণী ডাকিল, সুখী!

সুখী সাড়া দিল, অ্যাঁ?

শব্দ লক্ষ্য করিয়া তারিণী ডাকিল, আমার কোমর ধর সুখী, গতিক ভাল নয়৷

সুখী আর প্রতিবাদ করিল না৷ তারিণীর কোমরের কাপড় ধরিয়া চলিল, কার ছেলে বটে? পেলে?

তারিণী বলিল, পেয়েছি, ভূপতে ভল্লার ছেলে৷

সন্তর্পণে জল ভাঙিয়া তাহারা চলিয়াছিল৷ জল ক্রমশ যেন বাড়িয়া চলিয়াছে৷ তারিণী বলিল, আমার পিঠে চাপ সুখী৷ কিন্তু এ কোন দিকে এলাম সুখী, ই—ই—

কথা শেষ হইবার পূর্বেই অথই জলে দুইজনে ডুবিয়া গেল৷ পরক্ষণেই কিন্তু ভাসিয়া উঠিয়া বলিল, লদীতেই যে পড়লাম সুখী৷ পিঠ ছেড়ে আমার কোমরের কাপড় ধরে ভেসে থাক৷

স্রোতের টানে তখন তাহারা ভাসিয়া চলিয়াছে৷ গাঢ় গভীর অন্ধকার, কানের পাশ দিয়া বাতাস চলিয়াছে—হু-হু শব্দে, তাহারই সঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে ময়ূরাক্ষীর বানের হুড়মুড় শব্দ৷ চোখে মুখে বৃষ্টির ছাঁট আসিয়া বিঁধিতেছিল তীরের মত৷ কুটার মত তাহারা চলিয়াছে—কতক্ষণ, তাহার অনুমান হয় না, মনে হয় কত দিন কত মাস তাহার হিসাব নাই—নিকাশ নাই৷ শরীরও ক্রমশ যেন আড়ষ্ট হইয়া আসিতেছিল৷ মাঝে মাঝে ময়ূরাক্ষীর তরঙ্গ শ্বাসরোধ করিয়া দেয়৷ কিন্তু সুখীর হাতের মুঠি কেমন হইয়া আসে যে! সে যে ক্রমশ ভারী হইয়া উঠিতেছে৷ তারিণী ডাকিল, সুখী—সুখী?

উন্মত্ততার মত সুখী উত্তর দিল, হ্যাঁ?

ভয় কি তোর, আমি—

পরমূহূর্তে তারিণী অনুভব করিল, অতল জলের তলে ঘুরিতে ঘুরিতে তাহারা ডুবিয়া চলিয়াছে৷ ঘূর্ণিতে পড়িয়াছে তাহারা৷ সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত করিয়া সে জল ঠেলিবার চেষ্টা করিল৷ কিছুক্ষণেই মনে হইল, তাহারা জলের উপরে উঠিয়াছে৷ কিন্তু সম্মুখের বিপদ তারিণী জানে, এইখানে আবার ডুবিতে হইবে৷ সে পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিল৷ কিন্তু এ কি, সুখী যে নাগপাশের মত জড়াইয়া ধরিতেছে! সে ডাকিল, সুখী—সুখী!

ঘুরিতে ঘুরিতে আবার জলতলে চলিয়াছে৷ সুখীর কঠিন বন্ধনে তারিণীর দেহও যেন অসাড় হইয়া আসিতেছে৷ বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড যেন ফাটিয়া গেল৷ তারিণী সুখীর দৃঢ় বন্ধন শিথিল করিবার চেষ্টা করিল৷ কিন্তু সে আরও জোরে জড়াইয়া ধরিল৷ বাতাস—বাতাস! যন্ত্রণায় তারিণী জল খামচাইয়া ধরিতে লাগিল৷ পরমুহূর্তে হাত পড়িল সুখীর গলায়৷ দুই হাতে প্রবল আক্রোশে সে সুখীর গলা পেষণ করিয়া ধরিল৷ সে কি তাহার উন্মত্ত ভীষণ আক্রোশ! হাতের মুঠিতেই তাহার সমস্ত শক্তি পুঞ্জিত হইয়া উঠিয়াছে৷ যে বিপুল বিরাট পাথরের মত টানে তাহাকে অতলে টানিয়া লইয়াছিল, সেটা খসিয়া গেল৷ সঙ্গে সঙ্গে জলের উপরে ভাসিয়া উঠিল৷ আঃ, আঃ—বুক ভরিয়া বাতাস টানিয়া লইয়া আকুলভাবে সে কামনা করিল, আলো ও মাটি৷