Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

কবি | ম্যাক্সিম গোর্কি | বিমল সেন

গল্পটি শোনার জন্য ইউটিউবের লিঙ্কে ক্লিক করুন।

জিমনাস্টিক ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরে সুরা পোশাক পাল্টে সোজা চলে এলো খাবারঘরে। লক্ষ করলো টেবিলে বসে মা তাকে দেখে মুচকি হাসছে। বিষয়টা একটু অস্বাভাবিক। স্বভাবতই এ পরিস্থিতিতে সুরার কৌতূহল জাগে। কিন্তু সে আর এখন ছোট্ট খুকিটি নয়, ভারিক্কি হতে চলেছে; অহেতুক প্রশ্ন করে কৌতূহল প্রকাশ করা তার সম্ভ্রমে বাঁধে। মায়ের কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে, আয়নায় একঝলক নিজের চেহারাটি দেখে চেয়ারে বসে পড়ল। এখানেও অন্যান্য দিনের তুলনায় কিছু অস্বাভাবিকতা। টেবিলটি সুসজ্জিত এবং পাঁচজনের আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহলে বিষয়টি আর কিছুই নয়, অতিরিক্ত কাউকে হয়তো খাবার টেবিলে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সামান্য হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। মা বাবা এবং কাকিমার সমস্ত বন্ধু-বান্ধব তার পরিচিত। তাদের মধ্যে এমন একজনও নেই যে নাকি সুরার কাছে চমৎকার এবং মজার মানুষ। ভগবান! কিরকম সব একঘেয়ে তারা। কিরকমভাবে পরিস্থিতিটাকে বিরক্তিকর করে তোলে! উদাসীন ভঙ্গিতে মাকে বাড়তি চেয়ারটা দেখিয়ে বললো, ‘কার জন্য?’ কিছু বলার আগে মা কব্জিঘড়ি ও দেয়ালঘড়ির সময় মিলিয়ে, জানলার দিকে তাকিয়ে, কান খাড়া করে কিছু শুনবার চেষ্টা করলো। শেষে সুরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘আন্দাজ করো না!’

‘উঃ, মজা করছ কেন?’—বলেই সুরা বুঝতে পারলো আবার সে দারুণ কৌতূহলী হয়ে উঠছে। তার স্মরণ হলো এবার, বাড়িতে ঢোকবার সময় কি ল্যুবা মাসী দরজা খুলে অস্বাভাবিকভাবেই বলেছিল, ‘এসে পড়েছ? বাঃ খুব খুশি হলাম।’

তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ল্যুবার খুশি হওয়া খুব বিরল ঘটনা, তা আবার এমন জোর গলায় প্রকাশ করা! সুরা খুব ভালোভাবেই জানে একঘেয়ে গৃহজীবনের বাঁধা-বন্ধ রুটিনের মধ্যে সামান্য পরিবর্তনের হাওয়া ঢেউ তুললেই তা অন্তরদৃষ্টিতে ধরা পড়ে যায়, কারণ বৈচিত্র‍্যের জন্য তার চিত্ত সদা-চঞ্চল।

‘হ্যাঁ, হয়তো ঘটনাটা খুব মজাদারই হবে। ভাবতে চেষ্টা করো না!’ মা একইভাবে রহস্য করলো।

ল্যুবা মাসীর কথাবার্তার ধরন থেকেই সে নিশ্চিত ছিল একটা কিছু আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, বেশ আশ্চর্যজনক কিছু। কিন্তু যেচে জিজ্ঞেস করায় সে উৎসাহী ছিল না।

‘আর কি! কোথা থেকে কেউ হয়তো আসবে, এই তো?’—কৌতূহল চেপে রাখলো সে।

‘সে তো ঠিকই’—মা মাথা নাড়লেন, ‘কিন্তু কে?

‘জেনিয়া কাকা’—আন্দাজে ঢিল মেরেই তার গালদুটো লাল হয়ে উঠলো।

‘না, না, কোনো আত্মীয় নয়। এমন একজন যার সম্পর্কে তুমি পাগল।’ সুরার চক্ষু ছানাবড়া। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে মায়ের গলা জড়িয়ে উৎসাহে ফেটে পড়ল, ‘সত্যি? সত্যি বলছো মা?’

‘ছাড়! ছাড়!’—হাসতে হাসতে মা মেয়েকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। ‘একেবারে দুষ্টু মেয়ে! দাঁড়া, সব আমি ওনাকে বলবো।’

‘মা, মা, ক্রিমস্কি? এসেছেন? বাবা আনতে গেছেন? জিনা কাকিমাও? যে কোনো মুহূর্তে তারা হাজির হবেন... মা, মা, আমার ছাই রঙের পোশাকটা পরব! উঃ তাঁরা আসছেন। এখানেই আসছেন। উত্তেজিত ও উদ্ভাসিত হয়ে মায়ের চেয়ারের চারপাশে সে লাফাতে শুরু করলো, ছুটে গেল আয়নার সামনে; মুহূর্তের মধ্যে পোশাক পাল্টাতে হবে ভেবে যখন শুনল সদর দরজা বন্ধ, আবার আয়নার সামনে ফিরে চুলে আলতো আঙুল বুলিয়ে ধীরে চেয়ারে বসে চোখ বুজে হঠাৎ-উত্তেজনা দমন করার চেষ্টা করতে লাগলো। নয়ন-যুগল খুলবে, ক্রিমস্কিকে দেখতে পাবে এই ঘরের মধ্যে, হাতখানেক তফাতে, চেয়ারে উপবিষ্ট! যে কবির কবিতা পড়ে পড়ে সে পাগল, যাকে তার জিমন্যাস্টিক ক্লাবের সবাই মনে করে আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ কবি! কি শান্ত, ধ্বনিব্যঞ্জক, স্নেহস্পর্শ, মধুর কবিতা। ভগবান! এই মুহূর্তে তিনি সশরীরে উপস্থিত হবেন, সুরার ঘনিষ্ঠ হয়ে বসবেন, কথা বলবেন, পাঠ করবেন এমন কবিতার লাইন যা সদ্য তিনি সৃষ্টি করেছেন। জিমনাস্টিক ক্লাবের মেয়েরা কেউ তা শোনার সুযোগ পায়নি। আগামীকাল গর্বে সে তাদের কাছে বলবে, ‘ক্রিমস্কি যা লিখেছেন, তোমাদের পড়া উচিত।’

‘কোন লেখা?’ তারা জিজ্ঞেস করলেই, সুরা আজকের কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনাবে। স্বভাবতই তারা যখন জানতে চাইবে কোথায় সে এগুলো পেল, সুরা বুক ফুলিয়ে—বেশ বুক ফুলিয়ে জবাব দেবে যে কোথাও ছাপা হয়নি এখনো... গতকালই ক্রিমস্কি স্বয়ং সুরাদের বাড়ি খাবার টেবিলে তার সামনে আবৃত্তি করেছিলেন। কি রকম বিস্মিত হবে ওরা! হিংসেয় জ্বলবে! ঐ প্যাঁচালো বুদ্ধির কিকিনা—মুখে ঝামা ঘষে দেয়া যাবে! ওকে শিক্ষা দেয়া যাবে বোনকে-শেখাতে আসা কোন গায়িকার চেয়ে কোন কবির সঙ্গে পরিচয় থাকা কত উঁচুদরের। তারা জিজ্ঞেস করবে, ‘সুরা, আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দে না!’ এবং—আচ্ছা, উনি যদি সহসা ওর প্রেমে পড়ে যায়? এটা অসম্ভব কিছু নয়, কারণ তিনি কবি। সচরাচর কবিরা প্রেমের ব্যাপারে বেশ দুর্বল।

আচ্ছা, কি ধরনের গোঁফ রাখেন তিনি? তাঁর চোখজোড়া? নিশ্চয়ই, আয়ত এবং বিষণ্ন। আঁখিপল্লবে রাত্রি জাগরণের কালচে চাপ। নাকটিও নিশ্চয়ই টিকোলো, ছোট। গোঁফটি নিশ্চয়ই কৃষ্ণবর্ণ হবে। তার সামনে হাত কচলে, হাঁটুগেড়ে বলবে, ‘‘সুরা! সুরা! তোমাকে দেখামাত্রই, ‘জীবনের নতুন ঊষার উদয় হলো, হৃদয়ে কাঁপন তোলে আশার আলা।... এলে শুধু তুমি, তুমিই এলে। শপথ করি, হৃদয় তোমায় চিনতে ঠিকই পেলো’।’’ বাঃ, এ লাইনগুলো তো কবিতায় উনি লিখেই ফেলেছেন। তাহলে...!

‘দমচাপা, ধুলো, তার উপর বীভৎস একটা গন্ধ—সারারাত মশাই ঘুমোতে পারিনি’—কথাবার্তার আওয়াজে সুরা স্বপ্নলোকের বিচরণ ভঙ্গ করে বাস্তবের সম্বিতে ফিরে এলো। কণ্ঠস্বরে যদিও উচ্চব্যক্তির কর্কশ স্বেচ্ছাচারিতার সুর ছিল, সুরার কানে লাগলো কোমল ও আকর্ষণীয়। চোখ খুলে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেল কালো ভেলভেটের জ্যাকেট, ধূসর রঙের প্যান্ট পরিহিত দীর্ঘকায় একজন পুরুষ সুরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। 

‘শুভদিন, ভদ্রমহিলারা! আমাকে ভুলেই গেছেন, তাই না?’

‘আমি!’—সুরা দ্বিধাচিত্তে বলে উঠলো, ‘আপনার কবিতা আমি সর্বদাই পাঠ করি, অবিশ্যি শেষবার যখন এ বাড়ি এসেছিলেন, অনেক ছোট ছিলাম আমি।’ ‘এখন তো বেশ ভারিক্কিই লাগছে’, তির্যক দৃষ্টিতে এক ঝলক দেখেই উনি হাসতে হাসতে বলে উঠলেন। আরও কিছু বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন।

যেমন বয়স্ক ব্যক্তিরা করে থাকেন; চেয়ারে দেহটি এলিয়ে দিতে দিতে সুরার বাবাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বাঃ, তোমার ঘরটি বেশ খোলামেলা, আরামদায়ক, মিখাইল!’

নতমস্তকে নখ খুঁটতে খুঁটতে সুরা চকচকে প্লেটে কবির হাসিহাসি মুখটির প্রতিফলন দেখতে পেল। কবির ধূসর রঙের প্যান্ট, লোম-ছাঁটা মাথা এবং সরু লাল গোঁফটি সুরার ঠিক মনে ধরল না। উঃ, কি নিরস! ছন্দহীন! এমনকি চাঁছা নীল গাল, থুতনি এবং ঠোঁট নাড়াবার ভঙ্গিটি পর্যন্ত। চোখজোড়া অত্যন্ত সাধারণ, যে কেউ বলবে প্রাণহীন; পাতাগুলো যেন খুলে পড়তে চায়। কপালটা বলিরেখায় ঠাসা। বলতে কি, সুরার দেখা বিভিন্ন ডাকঘরের সাধারণ এক কেরানির মতো লাগছে ওনাকে। তাঁর হাব-ভাব-চেহারায় ছিঁটেফোঁটাও কবিত্বভাব নেই। হাতজোড়া? সুরা চোরা চাউনি দেয়। মনে হয় বেতোরুগীর মতো স্থূল, আঙুলগুলিও বেঁটে, মোটা। একটি আঙুলে আবার দামি পাথরের আংটি পরেছেন। বিষাদে সুরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

‘তুমি তাহলে আমার কবিতার পাঠিকা?’

কবি সুরার উদ্দেশে বললেন। সম্মতি জানিয়ে সুরা রক্তিম হয়ে ওঠে।

‘খুব ভালো! কথা হচ্ছে, তোমার কি ভালো লাগে?’

‘বলতে! আপনার লেখা নিয়ে ওরা সব পাগল’—মা জবাব দিলেন।

‘বাঃ, এ আপনি চাটুকারিতা করছেন।’

‘মোটেই না, মিথ্যে কথা!’—মায়ের কথার প্রতিবাদ করলো সুরা, কিন্তু কবির কথার পৃষ্ঠে অর্থটা দাঁড়াল উল্টো।

খুব লজ্জা লাগছে সুরার, এ পরিবেশে নিজেকে বোকা বোকা ঠেকছে। মা, বাবা, কাকা এবং উনি—প্রত্যেকেই হাসছেন। কি একটা কারণে উনি চোখ তুললেন, সমস্ত মুখটায় মনে হলো ভাঁড়ামির ছাপ। উনি অমনভাবে ভুরুযুগল তুললেন কেন? সবার সঙ্গে এত হাসিমশকরারই বা কি দরকার। তিনি তো একজন কবি, অত্যন্ত অনুভূতিশীল এবং বুদ্ধিদীপ্ত হওয়া উচিত ওনার। সুরার এই লজ্জা পাওয়ায় উনি কি মজা পাচ্ছেন? অন্যান্যরা যেমন পায়? উনি দশটা মানুষের মতো অতি সাধারণ? সম্ভবতও প্রথমদিকে উনি সবার সঙ্গে খাপখাওয়াতে চেষ্টা করছেন, পরেই ওনার ব্যবহারে স্বকীয়তা ফুটে উঠবে।

‘কোন ক্লাসে পড়, সুরা?’

‘ক্লাস সিক্সে।’

এ কথা জানতে চাইলেন কেন উনি? সুরা নাম ধরেই বা ডাকলেন কেন? ‘কেন শিক্ষকমশাইকে তুমি বেশি পছন্দ করো? মনে হচ্ছে, আঁকার মাস্টারমশাই?’

‘না, সাহিত্যের।’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সাহিত্যের শিক্ষক,’—চাপা হাসির রোল উঠলো। মনে হলো সুরা টুকরো টুকরো হয়ে বিক্ষত হচ্ছে, কে যেন দেহের মধ্যে ফুটিয়ে দিচ্ছে হাজার হাজার আলপিন। এই মুহূর্তে, টেবিল পরিত্যাগ করে নিষ্কৃতি পেতে চাইল সে। খুব নিরাসক্ত লাগছে, মনে হয় আর সে চোখের জল ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। খুব নিরাসক্ত লাগছে, মনে হয় আর সে চোখের জল ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এভাবে নিজেকে মেলে ধরল কেন সে? আত্মাভিমানে কাঁপতে কাঁপতে সে কবির দিকে তাকালো। চোখজোড়ায় ক্রোধ ও চিত্তচাঞ্চল্যের এক অদ্ভুত মিশ্রণ। ভয় হচ্ছিল, সব কথাগুলো বলার আগেই সাহসের বাঁধটি তার ভেঙে পড়বে; তাই টেবিলটি আঁকড়ে এক নিঃশ্বাসে শুরু করলো, ‘উত্তরটা কি খুবই ছেলেমানুষী মনে হলো আপনার কাছে? কিন্তু কথাটা খুবই সত্যিই। স্কুলের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলে আমরা তাঁকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। তিনি, বলতে পারেন আশ্চর্য সুন্দর করে, পড়িয়ে শোনান সব রকমের বই, সাহিত্যের যে কোনো নতুন দিক তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেন। সবকিছু মিলিয়ে, উনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। আপনি যাকে খুশি জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমাদের ক্লাস কি উর্দু ক্লাস, সবাই এক কথা বলবে। আপনার হাসির কারণটা কি জানতে পারি? অবশ্য, আমি...’ 

‘সুরা? কি হয়েছে তোমার?’ বাবা গম্ভীর আওয়াজ দিলেন।

‘আমরা ছোট্ট মহিলাটিকে আঘাত দিয়েছি’—ধীরকণ্ঠে ক্রিমস্কি বলে উঠলেন, ‘আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।’

তাঁর ক্ষমা চাইবার ধরনটি সুরার কানে কর্কশভাবে বাজল। মনে হলো কথাগুলোর মধ্যে আদৌ আন্তরিকতা নেই এবং সুরার কি মনে হতে পারে সে ব্যাপারে মোটেই চিন্তিত নন। উপরন্তু, এ পরিস্থিতিতে নিজেকে অনাহূত মনে হচ্ছে, কেউ যেন তার উপস্থিতি কাম্য মনে করছে না। আত্মগ্লানিতে, খাওয়ার টেবিলে সে বসে রইল। হৃদয় ভারাক্রান্ত হলো করুণ বেদনায়।

‘এই তাহলে উনি! আবার কবি! আর দশটা মানুষের সঙ্গে কোনো প্রভেদ নেই—খাওয়ার পর নিজের ঘরের জানলায় বসে ভাবতে শুরু করলো সে। জানলার ওপাশেই তার প্রিয় লাইলাকের ঝোপ, বাগান। এমনভাবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, জীবনে এই প্রথম যেন দর্শন-মুগ্ধ হচ্ছে।

‘দশটা সাধারণ মানুষের মতো! কিন্তু কেন, তাহলে বাবাও কবিতা লেখেন না কেন? উনি কি কবির চেয়ে কোনো অংশে নিকৃষ্ট?’—কবির কিছু কবিতার লাইন মনে এলো তার। কি ঐকান্তিক! কি উদ্দীপক! কি বেদনাবিধুর কোমল ছন্দের ছটা! ‘‘খেতে খেতে একবারও তিনি সে ভাষায় কথা বললেন না। তিনি শুধু কলম দিয়ে লিখতেই অভ্যস্ত, যেমন সোনিয়া, সাজাকোভা কাগজ দিয়ে ফুল বানাতে যন্ত্রের মতো অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ তার এ ক্ষমতায় হিংসে করে কিন্তু উনি হেসে বলেন, ‘এ আর এমন কি! খুব সোজা’।’’

বাগান থেকে কিছু কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে এলো। বাবা এবং ক্রিমস্কি আছেন ওখানে। লাইলাক ঝোপটার ঠিক পেছনের বেঞ্চটায় যদি ওনারা বসেন, সুরা সব কথাই শুনতে পাবে। ঘাড়টা বাঁকিয়ে সে দেখতে থাকে কোথায় বসেন ওনারা।

‘নতুন বইটা কেমন বিক্রি হচ্ছে তোমার?’—বাবা জিজ্ঞেস করলেন।

‘খারাপ না। দ্বিতীয় মুদ্রণের কথা ভাবছি আমি। কিন্তু লোকগুলো কৌতূহলে যত কিনছে, ততটা কবিতাকে ভালোবেসে নয়। বইটা বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে হতভাগা সমালোচকগুলো অপসংস্কৃতি, অপসংস্কৃতি বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। আর লোকগুলোরও সুড়সুড়ি লাগছে দেখি অপসংস্কৃতিটা কি বস্তু! এ শব্দটা নিয়ে অনেক চেঁচামেচি হয়েছে যার কোনো মানেই হয় না। যাক, আখেরে লাভ হলো আমারই। হুড়হুড় করে বইটা কেটে গেল।’

ক্রিমস্কির কণ্ঠে দুশ্চিন্তার চাপ, তবুও প্রতিটি কথায় ফুটে উঠছিল ক্রোধ। জানলায় বসা সুরার অন্তরে কথাগুলো প্রতিধ্বনি তুলছিল।

‘হ্যাঁ’—বাবা বললেন, ‘সমালোচকরা তো লেখকদের ওপর খড়গহস্ত।’

‘ওদের কথা হচ্ছে কবিরা সাধারণ মানুষের ক্রোধ ও আর্তনাদের কাব্যিক রূপ দেবে। নিজস্ব জগতে বসে তারা ভাবে মানুষের শুধু ক্রোধ আর আর্তনাদই আছে। জঘন্য! ওরকম মানুষ আমরা তো জীবনে দেখি না। সাধারণ মানুষ বলতে তো কিছু মূর্খ আর কিছু আত্মসুখী, এর বাইরে কি আছে? আমাদের সমালোচক মশাইদের এ বিষয়টি মগজে ঢোকে না। তাঁরা শুধু বইয়ের ধুলোই ঘাঁটে, জীবনের সঙ্গে যোগ নেই। নেই কোনো ঐতিহ্য বা নতুন চিন্তার সঙ্গে পরিচয়। তরুণেরা? ‘তরুণেরা আজকাল অকালবৃদ্ধ হয়েই জন্মায়, বন্ধু’—কে যেন বলেছিল কথাটা। খুবই সত্য কথা। কাব্যটাব্য ওদের বোঝার বিষয় নয় এমনকি আত্মার শুদ্ধির ব্যাপারেও ওগুলো নিরেট। যাক, এ প্রসঙ্গ থাক্‌... তোমার মেয়েটি কিন্তু ভারী সুন্দর!’

‘ও তো জন্ম থেকেই কবি! বোধহয় লক্ষ্য করেছ ব্যাপারটা?’

‘ওনাকে ধন্যবাদ!’—আপন মনে ফিসফিস করে সুরা আনন্দে পুলকিত হয়ে উঠলো। ওনার কথাবার্তা থেকে সিদ্ধান্ত করলো অহেতুক সে ওনার বিরুদ্ধে মনে মনে অভিযোগ করেছিল, ঠিক বুঝতে পারেনি ওনাকে। পুনরায় সুরার কল্পনার উনি একজন যথার্থ কবি হয়ে উঠলেন। তখনই বাগান থেকে ভেসে এলো প্রশংসার বাক্য।

‘হ্যাঁ, ভালো কথা, অশোভন হলে ক্ষমা করো, তোমার সেই...’

‘আমার সেই স্ত্রীর খবর? জানি না কোথায় আছে এখন। বছর দুয়েক আগে শুনেছিলাম ককেশাস অঞ্চলের কোনো এক স্থলে মাস্টারি করে। উঃ, ওর কথা জানলেই গায়ে কাঁপুনি দেয়। জগতে কিছু কিছু মেয়েছেলে আছে যাদের গুণ বা মূর্খামিতে উদ্দীপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, শিউরে উঠতে হয়। ওর সান্নিধ্যে মনে হতো যথার্থই আমি একজন ভীরু হয়ে উঠছি, যেন আমি একজন পাপী। ওর আসল স্বরূপ আবিষ্কারের পর, আমার জন্য আমি জীবনে এমন অনুকম্পা বোধ করিনি। মনে হতো অহেতুক কোনো খ্রিস্টানের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে। বিরক্তিকর একঘেয়ে! বলছিলাম, আমাদের জন্য চা আসবে কখন?’

‘এই এলো বলে! কিন্তু যেটা আমি জানতে চাচ্ছি তা হলো—তুমি কি ফের বিয়ে করেছ, না অবিবাহিত?’

‘অবিবাহিত, সেই মে মাস থেকেই। সারা শীতকালটা আমি এক রূপসীর সঙ্গে কাটালাম। বুঝলে বন্ধু, সে এক দারুণ ব্যাপার! মেয়েটি আমার গুণমুগ্ধা; দেখতে ঠিক এক টুকরো আগুন, শিক্ষা-দীক্ষাও আছে; তাহলেও মেয়েটি ছিল জড়বুদ্ধিসম্পন্না। আমাদের পরস্পরের পরিচয় নিছকই দুর্ঘটনা—অন্তত আমার তরফে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ঘটনাটা ঘটেছিল একটা পিকনিকে; বেশ খানিকটা টেনে মৌজে ছিলাম আমি। শয়তানই জানে কি করে সে আমার ফ্ল্যাটে চলে এলো। সক্কালে ঘুম থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে ভাবছি, সেকি! আমি বিবাহিত। নিজেকে ধন্যবাদ জানিয়ে, পোশাক পরে পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।’

বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন। সুরার মনে হলো হাসিটা অন্তর বিদীর্ণ করে দিয়ে গেল। ভয়ানক আঘাত পেল সে।

‘বলতে চাচ্ছ সাক্ষাৎ বিষধর? তারপর?’

‘হ্যাঁ, মেয়েটি ঘুম থেকে উঠলো। দেখলাম তার চোখে জল; তারপর যা হয়, চুম্বনের বন্যা বইয়ে অনেক কিছু শপথ করলাম তার কাছে। সপ্তাহখানেক ধরে পরিপূর্ণ ডুবে থাকার পর, আমার ক্লান্তি এসে গেল।’

‘মেয়েটার বাবা-মা ছিলো না?’

‘তাদের কথা সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিল। তারপর, ধীরে ধীরে, স্বাভাবিক জীবন শুরু হতেই, ঝামেলার আরম্ভ। শয়তানই জানে কেন। প্রথমেই মেয়েটা বলতে চাইল আমার সুন্দর কোমল ছন্দ-লালিত কবিতার সঙ্গে আমার রেসিংগাউনটির কোনো মিল নেই। বলব কি তোমায়, ষাট রুবল দিয়ে কিনেছিলাম ওটি! প্রতিবাদ করতেই, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করলো। সে এক দৃশ্য বটে! দ্বিতীয়ত, তার ধ্যান-ধারণায় কবি হলো এমন এক স্বর্গীয় সৃষ্টি যার বাড়িতে কোনো আড্ডার জায়গা থাকা উচিত নয়। অন্যের কথা বাদ দিলাম, মনের দিক দিয়ে বিচার করলে কবির কাছে অন্য কবিরাও তো আড্ডা দিতে আসবে। উঃ, কোন শয়তান যে আমাদের মেয়েদের এসব উদ্ভট চিন্তা ঠেসে দিয়েছে! এর পরই বিবাদ, কান্নাকাটি, সন্তান চেয়ে গিন্নি-বান্নি হওয়ার জন্য ঘ্যানঘ্যানানি—সবকিছু চেয়ে দাবি আর দাবি। শেষকালে, পালিয়ে এসে চিঠিতে কয়েকটা লাইন লিখলাম, ‘এসব কিছুর উপর কোনো কবির আগে দরকার স্বাধীনতা।’

‘বেশ, তার পরের ঘটনা?’—বাবা মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন।

‘মাসে মাসে ছাব্বিশ রুবল পাঠিয়ে দিই।’

‘সুরার সমস্ত অনুভূতি শীতল, স্নায়ুগুলো কাঁপছে; উদাসদৃষ্টিতে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল সে।

‘তাই তোমার ইদানীংকালের লেখাগুলো নৈরাশ্যে ভরা!’

‘‘তুমি কি আমার এ বইটা পড়েছ, ‘বহুবর্ণ স্মৃতির পোশাক রাত্রির অন্ধকারে বিদীর্ণ হয়ে যায়’?’’

‘বাঃ!’

‘ও বইটাতে আমি এই বিশ্রী কাহিনীটার স্মৃতি বর্ণনা করেছি।’

‘সুন্দর বর্ণনা হয়েছে’—বাবার দীর্ঘশ্বাস উঠলো, ‘‘তুমি তো, সর্বদাই বর্ণনার রাজা। সেই যে লাইনটা, ‘আবেগের অস্পষ্ট নকশার মালা’।’’

‘দেখছি, খুব খুঁটিয়েই আমার বই পড় তুমি!’

‘তা ঠিকই। সামনে বলে চাটুকারি করছি না, সত্যিই তোমার কবিতা আনন্দ দেয়।’

‘ধন্যবদ। এ প্রশংসা তো বেশি শুনতে পাই না, যদিও সত্যি বলতে কি, জানি আমি এ প্রশংসার যোগ্য।’

‘নিঃসন্দেহে, বন্ধু! চলো চা পান করা যাক।’

‘একটু লক্ষ্য করো আধুনিক কবি এবং কবিতার ওপর; মানুষগুলো তো কবি নয়, এক একটি শকুন। ভাষাকে ওরা ধর্ষণ করছে, গলিয়ে-পচিয়ে দিচ্ছে। বরঞ্চ আমি যত্ন নিয়ে চেষ্টা করছি...’

সুরা লক্ষ্য করলো, বাবা এবং কবি পরস্পর কোমর জড়িয়ে পাশাপাশি বাগানটা পেরিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে তাদের কথাবার্তাগুলো অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল।

‘সুরা সোজা উঠে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে ভারী কিছু বস্তু তাকে চেপে রাখতে চাচ্ছে, নড়তে দিচ্ছে না।

‘সুরা, এসো চা তৈরি’—মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। আয়নায় চোখ পড়তেই দেখল, তার মুখটা ফ্যাকাশে, লম্বা এবং ভীত। অশ্রুবাষ্পে চোখদুটো ঝাপসা। খাওয়ার ঘরে ঢুকতেই মনে হলো পরিচিত মুখগুলো অবয়বহীন, অস্পষ্ট সাদা সাদা কিছু বিন্দু।

‘আশা করি তরুণীটি আর আমাদের ওপর রাগ পোষণ করছে না’—কবির কণ্ঠ শোনা গেল।

সুরা জবাব দিল না। তাঁর লোম-ছাঁটা মাথাটার দিকে তাকিয়ে স্মরণ করতে চেষ্টা করলো, যখন প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না নিছক কবিতা পড়ে মানুষটার সম্পর্কে কি কল্পনার স্বর্গ তৈরি করেছিল।

‘সুরা, কথার জবাব দিচ্ছ না যে? এ কি অভদ্রতা হচ্ছে!’ বাবা, চেঁচিয়ে উঠলেন। সুরার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ল। চিৎকার করে বললো, ‘কি চাও, কি চাও তোমরা আমার কাছে? একা থাকতে দাও আমায়। যতসব ভণ্ড। ফোঁপাতে ফোঁপাতে রান্নাঘর থেকে সে ছুটে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে আবার সে প্রলাপের মতো বকে উঠলো, ‘ভণ্ড!’ ভণ্ড!’

বেশ কিছু সময়, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে টেবিলের চার ব্যক্তি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। আস্তে মা এবং কাকীমা উঠে গেলে, বাবা কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাগানের কথাবার্তা ও কি কিছু শুনে ফেলেছে?’

‘বাদ দাও তো!’ দ্বিতীয়জন অস্থিরভাবে চেয়ার নাড়িয়ে, বিরক্তিতে ছুড়ে মারলো কথাগুলো।

মা ফিরে এলো।

দুজনার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে কাঁধটা সামান্য ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, ‘ও কাঁদছে!’


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ