Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

হৈরব ভৈরব | মাহমুদুল হক



মন অন্নময়, কি বুঝছস, অন্ন নাই তো মনই নাই: শ্যাষম্যাষ হ্যা অন্নেই ধরছে তো মন পামু কই-' কিছুক্ষণের জন্যে থামে হৈরব | কথার ফাঁকে ফাঁকে সবসময় এইভাবে জিরিয়ে নেয় । একটা পিনপিনে নীলমাছি তার ফেকো মুখে গোত্তা খায়। হাতের চেটোয় মুখ মুছে সে আবার বলে, 'মন আছিল যেমুন হিজল, নাভিজলে গেন্দুবয়রা হয়া খারায়া রইছে, রাও নাই,মাইনসে খুশিমতো কাটতাছে ডালা, মাছ জিয়ানের লাইগা ভেঁসালে ফালাইতাছে, ফালাইতাছে তো ফালাইতাছেই, তো হইছেডা কি, গজগজ কইরা আবার ডালা গজায়া উঠছে, পাতায় পাতায় যুবতী হয়া উঠছে, ফুল উজায়া উঠছে, ফুলরে ফুল, আরে ফুল, ফুল বলে দেইখা যা! হইবো না ক্যান, প্রাণ হইলো গিয়া তর জলময়, জলের সার হইলো গিয়া প্রাণ। জলের তো আর অভাব নাই, পিরতিপূরুষ আশীব্বাদে হেই প্রাণটুকুই যেমুন রইছে অখন, মন নাই, বুঝছস ভৈরব, হ্যা মন আর নাই-’হৈরবের ছেলে ভৈরব । ভৈরব আড়চোখে বাবাকে দেখে । ঝাঁ ঝাঁ ফাগুনে রোদ তার কপালের ঘামে চিড়িক মারে । টানের সময় দলদলে পচানির ভেতর বুড়ো কাউঠার বুজবুজি তোলা তার ঢের ঢের দেখা আছে, গুচ্ছের কাঠ নিয়ে ফাড়াফাডিতে বাস্ত সে: নৌকোর চিড়খাওয়া গোছার কিছু কিছু না বদলালেই নয়। একটা কাঠের ফালি হাতে নিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, ‘চলবো, দেইখ্যা

দ্যানদি।’

'এই নিকি তর কাঠ, আরে আমার কপাল, হ্যায় কয় নাওয়ের গোছা বানাইব, ব্যাডায় একখান! আকাঠ-কুকাঠ দিয়া ব্যাক কাম চলেনিরে বোদাই ?
 
ভৈরব শুকনো গলায় বললে, ' চলবো না ক্যান, চালাইলেই চলবো! ব্যাক

মাইনসে চালাইতাছে না?’

‘ক্যান, গাদামের খাম আছিল না একখান ?’

'গাদামের খাম আপনে কই দ্যাখলেন ?'

‘তর মায়েরে বুলা, জিগায়া দ্যাখ থুইছে কই!' ডাকতে হয় না, যোগমায়া নিজেই এসে দাঁড়ায়।

যোগমায়ার মুর্তি দেখে হৈরব আন্দাজ করে তার হিসেবের কোথাও জট আছে; আজকাল অনেক কিছুই সে গুলিয়ে ফেলে, মনে রাখতে পারে না ঠিকমতো ।

'অতিসাইরায় কয়কি ' যোগমায়া ফুঁসে উঠে বলে, ‘ক্যান, মুনশির কাছে না বেচলা গেল বছর। পুরা মাস খাতির জমায়া বয়া আছিলা ঘরে, আরাম করছিলা মনে থাকবো ক্যান!'

হৈরব হাসে । যোগমায়ার এক চিলতে ছায়ার ছেঁড়াপাটিতে একটু এগিয়ে ব'সে বলে, 'ফোটের বিষে আমার বলে দিশা আছিলো না, যেমুন চুইয়ায় চুঁইসা থুইছে, অহনে তুই কছকি আরাম, কিনা আরামখান্‌ ! ক্যান, তুই সেবা করছ নাই, পল্লব দিছ নাই ‘ 'দিছিলামনিকি ?' যোগমায়া ভিজে চুলের ডগায় ঝটাৎ ক'রে হাতের একটা কোপ মেরে বললে, ‘তোমার বইনে না দিছিলো ?'

‘বইনে দিবো ক্যান- ' হৈরব বললে, ‘তুই তো আছিলিই!’

যোগমায়া বললে, 'তোমার বইনমাগীরে ডাইকা না কইরা দেও, হে জানি চাউল না চিবায়, ডাঁসা দিয়া নকশা ছেঁইচা দিমু কয়া রাখলাম, অলক্ষীর ঝাড়, ভাতারখাকি’

হৈরব গলা চড়িয়ে বললে, 'ভালো হইতাছে না দয়া, ভালো হইতাছে না। তর লাইগা আমারে কতোগুলিন কথা শুনাইলো তর বৌঠানে–’'

আড়াল থেকে দয়াও গলা চড়ায়।

'বৌঠাইনের মনে শাস্তি নাই, ঠাইনরে তুমি আবার বিয়া করাও!’

'রয়, তরে পায়া লই, ভাতারখাকি তর লাগল পায়া লই, যেমুন পোয়াতি

হইছে, বাইর করুমনে চাউল চিবানি___'

যোগমায়া স'রে যেতেই ভৈরব বলে, ‘পিসিরে না করেন তো, কিয়ের

এ্যামুন আউখাউ-_’

হৈরব বিম্মিত হয়ে বললে, ‘না করুম, ক্যান ?'

‘আজুইরা বাজাবাজি, হুদাহুদি প্যাচাল-_'

'এগুলিরে বাজাবাজি কয় ?' হৈরব পায়ের আগুলের গেঁজে ওঠা নখুনির চারপাশে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, 'তরা যে কি হইলি, বুঝি না তগো। ঘর হইলো গিয়া তর বাগান, বাগানে পাখিরা তো চিক্কুর পারবই | ভানু হইলে কি হইতো। ভানুর লগে বনাবন্তি আছিলো তগো ? কেউরে থুয়া কতা কইছে হ্যায় । বারিখান মাথায় কইরা রাখছে মাইয়ায় | ঢাকের কাচা লয়া তর মায়ে গেছে পিটাইতে, তো হ্যা-ও কুঁইদা আইছে ছিট লয়া, কইছে খারাইলা ক্যান মনসাকানি, মারবা না ? আমিও ঢাকীর মাইয়া।, মাইরা দ্যাখো ক্যামনে তোমার পিঠের মদ্দে এই ব্যাতের ছিট দিয়া দশখুশি বাজাই! হাঃ ! তো মাইয়ায় দশখুশিরোই বোল তুলছে মুহে, আর তর মায়ে অক্করে মাত্রা ভাগ কইরা কইরা ঝাঁঝিকাঁসির বারি ফালাইছে, শ্যাষম্যাষ পাও বিছায়া কানবার বইছে___’ হৈরব হাহা ক'রে হাসতে থাকে; তার হাসির গায়ে ঝলমল করে পালপার্বণ, ঝাড়লণ্ঠন আর মৃদঙ্গের শব্দ, সন্ধ্যারতি । দলছুট তাতানো হাওয়া হৈরবের চারপাশে ঘুরপাক খায় : কয়েকটা

মডমড়ে বৌনার পাতা খর্খর করে বাজনা তোলে ।

ভৈরবের হাতের শানানো দায়ের চেয়েও ধারালো আর ঝকঝকে রোদ্দুর। কি ঝাঁঝ, কি ধার, একেবারে বালিশান দেওয়া; এক-আধ চিলতে গাছগাছালির যে ছায়া, তা-ও একেবারে খোলায় ভাজা, ফোস্কা পড়া । চোখে ঘোর লাগে হৈরবের।

ভৈরব মুখ শক্ত ক'রে আছে; বড় বিশ্রী লাগে । চোয়ালের হাড় ঠেলে বেরিয়েছে, এখন তার মুখ চারকোনা; বেড়া দেওয়া জমি, দখল নিয়েছে এইমাত্র। বেড়া তুলে দিয়েছে, তুমি একটু ঘুরে যাও, পা রাখতে পারবে না, হওনা নবাব, লাট-বেলাটের নাতি, তফাৎ যাও -'বাজো মুদঙ্গ, বাজো-’ হৈরবের মনে একটা ভ্রাম্যমাণলহরী পালকের মতো ভেসে বেড়ায়, ‘মৃদঙ্গ তৃমি মৃদঙ্গ তুমি মুদঙ্গ তুমি বাজো, তুমি বাজো,

তুমি বাজো তুমি মুদঙ্গ তুমি বাজো, আরো বাজো-’

'ইশ্‌, ব্যাক জুলতাছে, ধূপখান কি _’

নিজের সঙ্গে কথা বলে হৈরব, ইশ! দিকদারি করো, হালার পো হালা

দিকদারি করো!

'তা তা থৈ, তা তা থৈ, বহুৎ দেখছি তোমারে, তোমারে বাজামু!

'তা তা ধিন্‌, তা তা ধিন্‌, কি বুঝলা ?

'তা, কি বুঝলা ?

‘তা, ত্রেকেটে-ধা?

'ত্রেকেটে-ধা ত্রেকেটে-ধা ত্রেকেটে-ধা, হাঃ!

‘হাঃ!’

একফাঁকে দয়া এসে দাঁড়ায় । কোঁচড়ভরা শিমুল ফুল হৈরবের গায়ে ঢেলে দিয়ে বলে, 'লও, তোমার সোহাগের মণিমালায় পাঠায়া দিছে__’

‘মণিমালা ?' 'হ হ মণিমালা, ঐতো সাইজা-গুইজা খারায়া খারায়া ক্যামনে তোমারে দেখতাছে-’'

দয়া পশ্চিমের শিমুলগাছের দিকে আঙুল তুলে দেখায় । হৈরবের মণিমালা। 'কি কইলো ?'

কইলো তোর দাদারে গিয়া ক, কি করছি আমি হের, চক্ষু তুইলা তাকায় না, রাও কাড়ে না, মুখ ফিরায়া লয় । কথা না দিছিলা, হ্যারে বিয়া করবা ?'

'দিছিলাম ?'

‘দাও নাই ? চক্ষে ধরছে, তো ভান কইরা কথা দিয়া ফালাইছ, কইছো রানী কইরা আনমু তোমারে । কামিনীসুন্দরীরে তো কইছিলা কত কথা, চুমা খায়া আইতা আন্ধার রাইতে, ডালা ধইরা কতো কথা কইতা, মনে নাই ?'

'ঠিকোই, ঠিকোই, সাধ হইতো সবতেরে রানী কইরা রাখি, তর বউঠাইনে চাইলে তবে না স্যান, হ্যা যদি জাগা না দ্যায়! জাগা দিব হ্যা ?'

ভৈরব অস্বস্তিতে আরো রুক্ষ হয়ে ওঠে । শরীরে ক্ষতচিহ্ন থাকলে তার জন্যে তার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই, এতোসব ঘোরপ্যাঁচ সে বোঝে না, খোলা চোখে দেখেই সে রুষ্ট হয়, তৃপ্ত হয়; বাবা ও পিসির ঠাট্টাবটকেরা তার কাছে অর্থহীন কলরব মনে হয়।

'বুঝছস দয়া__' ভৈরবের দিকে আঙুল তুলে হৈরব বলে, ‘হ্যার যে হইবো না স্যা আমি আগেই বুঝছিলাম। হ্যার বাপে আছিলো বারোআনির বাজনদার, হ্যা চারআনিরও হইবার পারে নাই । পারবো ক্যামনে, যেমুন-তেমুন কইরানি সব কাম চলে ? কি দিয়া নাও-এর গোছা বানাইতাছে দ্যাখ। অহনে কই, কামিনী গাছটারে কিয়ের লাইগা রাইখা দিছস, কাইটা ফালাইলেই পারস। একবার ধরছ গয়া, একবার একবার ধরছ জাম্বুরা, হ্যা দিয়ানি চোক হয়রে বোদাই ? কামিনী ডালার চোক না হইলে তর বাপেনি ঢোলে বারি দিছে? জিগায়া দেহিছ মাইনসেরে, দেহিছ কি কয়! জিগায়া দেহিছ দত্তগো, ক্যামনে কাছা খুইলা লইছিলাম বরইশালে নট্টগো, থম ধইরা দেখছিলো আমাগো কয়কীর্তনের বাহাদুর ঋষিদাসেরা । কয় বলে ঢাক লয়া ব্যহাদুরি কইরো। ঢোলকের তোমরা কি বুঝো! কি বুঝি ? বুঝায়া দিছিলাম হ্যাগো, শ্যাষম্যাষ লুটায়া কুল পায় না, পায়ের ধুলা দাও, ওস্তাদ মানি, ‌ওস্তাদ অনুমতি করে তো আমু, নৈলে এই দ্যাশে আর না । ঢাক! ঢাক বইলা কথা, ঢাকী বইলা কথা: যে নিকি নিজেরে বাজাইয়া থুইছে হ্যার কাছে যা দিবা হ্যা তা বাজায়া দ্যাখাইবো । দ্যাখ্যাইতারব না ? জিগায়া দেহিছ নাগারচিগো, হ্যারা কি কয়! কয় হৈরব, তুমি কারে পাইছিলা, কে তোমারে দিছে, যা ধরো তাই বাজাও এ্যামুন, হাতের মদে কি আছে তোমার! আরে পাগল, তরা বুঝছ না, হাত কি বাজাইব, বাজায় গিয়া মন: পেরথম নিজেরে বাজান শিখ, শ্যাষম্যাষ যা ধরছ হেই বাইজা উঠব, জয়গুরু!'

দয়া হাসে । হৈরবের অনর্গল কথার ভেতরে যেখানে ছিটেফোঁটা মাত্র শৃঙ্খলা, ঠিক সেখানেই চিমটি কেটে মজা পায় সে। বলে, ‘তা, আর কারে কারে তুমি বাজায়া দেখছিলা, কওনা দাদা ।'

'এ-রে , কিনা বাজান! চ্যাঁট বাজাইছি! হৈরব হইলো ইয়া, লোম! যহন মনিষ্যি আছিলো না, তহন বাজনা আছিল; পর্বত বাইজা উঠছে, জল বাইজা উঠছে, মাটি বাইজা উঠছে, ধরিত্রী বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে আকাশ। হারপর স্যান বাইজা উঠলো মনুষ্যজন্, বাইজা উঠলো মনুষ্যধর্ম, তর গিয়া মানবজীবন, জয়-গুরু!'
 
'হরি-বোল!' হৈরবের গলা জড়িয়ে হেসে কুটপাট হয় দয়া, 'হারিবোল, হরিব্বোল!'

ভৈরব ধমক মেরে বলে, ‘পিসি, পাইলেন কি আপনেরা, খামোক্য মায়েরে চেতাইতাছেন ক্যান! হ্যার গাওন শুরু হইলে থামাতেই পারবেন নি ?’ 'ই-রে, কিনা একখান গাইলাইন্যা! যেমুন তর মায়ের রইছে মুখ, আমাগোর নাই’, দয়া রুখে উঠে বলে, ‘হ্যার ডরেনি তর পিসির চক্ষে ঘুম নাই, হ্যা ক্যাঠায় ? হ্যারে দয়া কইরা আমরা আনছিলাম, বাপমায়ে দাসী কইরা আনছিলো: হ্যা যহন আছিলো না এ বাইতে, আমরা আছিলাম-’

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হৈরব বলে, উঠানে গান্দাফুল আছিলো, দোপাটি আছিলো, রক্তজবা আছিলো, কৃষ্ণকলি আছিলো, স্থলপদ্ম আছিলো, গন্ধরাজ আছিলো, কিনা আছিলো, বাবুরা আছিলো, পালপার্বণ আছিলো, ঢাকীগ ভাত আছিলো, গায়ে শাল আছিলো : অহনে পিন্দনের তেনাও নাই__' ঘরের ভেতর থেকে এক ঝটকায় বেরিয়ে আসে যোগমায়া, তার চোখে ধকধক ক'রে আগুন জ্বলে। চিৎকার করে যোগমায়া বলে, ‘অই বাঞ্জামাগী, অই ভাতারখাকি, ভায়েরে লয়া থাকবার পারছ নাই, ভায়ের লগে বিয়ায় বইতে পারছ নাই, সাইধ্যানি আইছিলাম তগো ফুডা কপালে, না তর যক্ষারুগী বাপে আনছিলো, পচতাছে অহনে নরকে-_’

'পচতাছে না__' উঠে দাঁড়িয়ে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে মুখ ঝামটা দিয়ে দয়া বলে, ‘হ্যা তোমারে আনছিলো বইলাই স্বর্গবাসী হইছে। দেইখা শুইন্যা কানীবৌ আনছিলো, মনে থাকবো ক্যান! কিনা আছিলো ছিরিখান___'

হাতের কাজ ফেলে উঠে যায় ভৈরব ; কোথায় একটু বাধে, তা না হলে একটা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড বাধিয়ে দিতে পারতো সে।

যোগমায়া পা লম্বা ক'রে কাঁদতে বসে, মাঝে মাঝে মাটিতে মাথা খোঁড়ে। মাঠ ঘাটে রোদ খাঁ খাঁ করে, রোদময় চিলের চিত্কার। এক একবার বিস্তীর্ণ দুপুর ঝনঝন ক'রে বেজে ওঠে । ঝলসানো গাছপালা মুখ নিচু ক'রে আচ্ছনপ্রায় দাড়িয়ে থাকে । এরই মাঝে এক একটি গন্ধ নেশার মতো জড়িয়ে ধরে হৈরবকে, সে বুঝতে পারে বৌনার ডালে ডালে এখন মঞ্জরি, কি আনন্দ, কী আনন্দ, ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি নামে । এক একটা গন্ধ এমন এক একটা স্মৃতি, যাতে নখের কোনো আঁচড় নেই, দাঁতের কোনো দাগ নেই, ছিমছাম, নির্ভার, অবিরল । কাঁঠালের মুচির গন্ধে হৈরবের বুক গুমরে ওঠে । টুনটুনি পাখি চিরকালই তার চোখে একটা আশ্চর্য প্রাণী, যেমন কাচকি মাছ ; এইতো একফোঁটা অথচ এরাও কি স্বচ্ছন্দে বেঁচে থাকে, তাল মিলিয়ে বংশ বৃদ্ধি ক'রে চলে । একটা টুনটুনি, যার ঠোঁটে তুলো, চোখে রাজ্যের বিস্ময়, আকন্দগাছের

শাখায় দোল খেয়ে ফরফর ক'রে একদিকে উড়ে যায় ; হৈরবের মনে শিশিরের ছোঁয়ায় পদ্মকোরক শিরশির ক'রে ওঠে, এ যে তিনি, তিনি নিরভিমান, তিনি নম্র, তিনি ব্যাকুল, তিনি বলেন আমি একফোঁটা, আমি তুচ্ছ, অতিতুচ্ছ।

ভিটির খুব কাছে টেকের কোল ঘেঁষে একফালি জমি। গম বুনেছিল ভৈরব, ফলন ভালো নয়; আপন মনে সে এখন সেই ছন্নছাড়া চেহারার রুখু রুখু গোছাগুলো ঘরে তোলায় ব্যস্ত। ডাঁটাশাকও বুনেছিলো একপাশে, তার চেহারাও পোকায় খাওয়া, নির্বোধ অনিচ্ছায় কেমন যেন লাবণ্যহীন দেখায় পাতাগুলো, সবকিছু অচেনা মনে হয় হৈরবের, এখন আর কোনো কিছুতেই সে ছিরিছাঁদ দেখে না।

দূরে ইছামতি, রুপোর সুতোয় বোনা দুপুর রোদের পাড়, পাড়ের গায়ে নৌকোর ফোঁটা ফোঁটা নকশা ; মন হু হু করে, কত মানুষের কথা মনে পড়ে, কি সুন্দর সুন্দর সব মানুষ, বড় বড় বাবুরা, গমগমে মণ্ডপ, হ্যাজাকের আলো,

রঙিন চাঁদোয়া, আহারে, এতো তাড়াতাড়ি সব কী করে যে গল্প হয়ে যায়! মনে পড়ে ভরতের কথা, ভানুর কথা । চোখ করকর করে হৈরবের ; ভানু তো গেল, কিন্তু সেই থেকে সবকিছু আঁধার । কেউ হাসে না, কেউ মন খুলে কথা

বলে না, সকলের অমতে মুসলমানের ঘরে গিয়ে উঠলো ভানু, জাতের মুখ কালি। তার মা বলে ছিঃ, তার ভাই বলে ছিঃ, তার পিসি বলে ছিঃ বলো ছিঃ করো, আর হৈরব নিজে অনেক হিসেব কষে, অনেক যোগবিয়োগ ক'রে ভেবে

দ্যাখে মেয়েটা নেই, তাই এতো আঁধার, আর কেউ তো বলে না ‘বাবা তুমি যেমুন কি, পঞ্চম সোয়ারী ধইরাও কানদো-’

চোখে ধরে গেল রমজানকে; ভুল হলো, ভানু ওর বাবার চোখ পেয়েছিলো, হৈরব নিজেকে শুধরে নেয়, রমজানকে ওর মনে ধ'রে গেল, মন্দ কি, নাগারচিদের ঘরে রমজানের মতো অমন হাত পেয়েছে ক'জন, সোনার টুকরো, হ্যাঁ বাজনদার একখান! পালটিঘরের সম্বন্ধ এসেছিল একটাই, সেই ভরাকর থেকে; হৈরবের মেয়ে ভানু, হৈরব বাজনদার, ভানু যাবে ভরাকরের চোরচোট্টা পরিবারে ঘর করতে, আবদারখানা কি-সেই ভানুকে এরা ফেলে দিল। ভৈরব বলে, ‘নাম নিবার পারবা না, খুনখারাবি হয়া যাইবো, হ্যারে আমরা চিতায় থুয়া আইছি, ব্যাস্‌__'

ভরতও যেন কেমন হয়ে গেছে, বদল ব'লে বদল, হৈরব বোঝে না মানুষ আগাগোড়া সবটা কিভাবে বদলে যায় । নিজের ছেলে, বাবাকে দেখে সেও বিব্রত হয়। পূজার সময় গলাধাক্কা পাসপোর্টে বর্ডার পার হয়ে সে অন্যান্যবারের মতো কলিকাতা গিয়েছিল, গিয়ে শুনে ভরত কাজ নিয়েছে প্লাস্টিকের ফুলের কারখানায়, থাকে বাঁশদ্রোণী । খুঁজে খুঁজে অস্থির । শেষে দেখা যখন মিললো তখন ভরতের বিপদের আর শেষ নেই, বলে, 'আইচ্ছ৷ কন, আক্কলখান কি আপনের, ঢাকসুদ্ধ আয়া পরছেন, আপনের বৌমায় গাইলাইয়া আস্তা থুইবো আমারে, মাইনসের কাছেনি মুখ দেহান্‌ যাইবো! ঢাক আপনে অন্যখানে থুয়া লন, সমাজ নিয়া কথা__’

প্লাসটিকের ফুলের মালী ভরত, হ্যাঁ তার একটা সমাজ আছে বৈকি; সমাজ আছে, সম্মান আছে, 'বৌমারে আমি আশীর্বাদ দিয়া গেলাম, বুঝ কইরা চলবিরে, একবার গিয়া মায়েরে দেইখা আইছ, তগো প্যাটে ধরছে, কষ্ট পায়-' এই ব'লে হৈরব চ'লে এসেছিল । আর কবে? আর কখন ? না, আর কখনো নয়; এমনভাবে অভিমান আর কখনো বুকে বাজেনি। তার কোনো ধারণাই ছিল না ভরত এভাবে ঢাকের অমর্যাদা করবে।

কি দিনকাল! কোথায় গেল সব বাবুরা, বাবুরা তোমরা স্বর্গে থাকো, ঈশ্বর বাবুদের তুমি ভালো রেখো, বাবুদের কোনো কষ্ট না হয়, হৈরব মনে মনে কাঁদে। চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মাজাকোমর ধ'রে যায়, পাল কি পাল ঢাকী, ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুলী, বুড়োমানুষ, তার দিকে কে ফিরে তাকায়। কারো একটু মর্জি হলো তো দাঁড়িয়ে গিয়ে বললে, ‘ও বুড়ো, এ চ্যাটাং চ্যাটাং করো দিকিনি, শুনি, ঝামাহাড়ে কি কুলুতে পারবে ?'

সমজদার হলে বলে, 'খাঁটিমাল, তবে শ্মশানঘাটের মড়া, হাঁপিয়ে যায়___' হাঁপানোর তো কথাই, দেখছো তো বুড়ো, বয়স জানো কতো ? হৈরব মনে আনার চেষ্টা করে, পারে না, এ হিসেবও রাখতে হবে!

সবেমাত্র বায়নার টাকা পেয়েছে অমনি ভোজবাজির মতো গনিমিয়া এসে হাজির, 'ট্যাকা পাইছ?'

'পাইছি, বহুৎ কম-__’ 'তালিবালি কইরো না, ট্যাকা না পাইলে অক্করে মাঠে মারা যামু, খালি

হাতে আয়া পড়ছি, ট্যাকা ছারো, ট্যাকা ছারো-__’

টানাটানির সময় হাতেপায়ে ধ'রে কেঁদে পড়লে গনিমিয়া তাকে টাকা-পয়সা ধার দেয় । তবে তা একটা শর্তে, শতকরা সত্তর টাকা হারে তাকে ইন্ডিয়ায় গিয়ে টাকা দিতে হবে । গনিমিয়া পুজোর মৌসুমে কলকাতায় বাজারঘাট করতে আসে, তার কিছু সুবিধে হয় । গনিমিয়া চলতি রেটের চেয়ে পাঁচদশ টাকা বেশি পেলেই খুশি মনে তাকে অব্যাহতি দিতো, হৈরবও হালকা হয়ে যেত। পরপর দু'বছর পাওনার টাকা পুরো না মেটাতে পারায় ঠেলতে ঠেলতে সে এখন সত্তরে উঠিয়ে ছেড়েছে!

গনিমিয়া বলে, ‘আগের সনের হিসাবের ল্যানজা ঝুলাইয়া রাখছো দুইশো ট্যাকা, এই সনের তোমার গিয়া তিন আর দুয়ে পাঁচশ, সাতশ দিবা, বহুত কেনাকাটি রইছে-’

কেনাকাটি-ফেনাকাটি ওসব কিছু না, সব বাজে কথা, হৈরব জানে বছরে একবার গনিমিয়ার কলকাতায় দৌড়ানোর একমাত্র কারণ সিনেমা দেখা আর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে গড়িয়াহাটায় ঘুরে বেড়ানো । তবু সে জোড়হাতে বলে, ‘বাবু, আপনেরা দয়া না করলে বাঁচুম ক্যামনে, পুরা সিজিন বাজায়াও হ্যার আটআনিও উঠবো না!'

'তোমাগোর খাইসলৎ যাইবো না, অহনে মাল ছাইরা কথা কও, আহনের আগে না কইলা কালীপূজাতক থাকলে ট্যাকা উইঠা আইবো-_’'নমুনা তো দেহি না__’ ঝেড়েঝুড়ে সব দিয়েও গনিমিয়ার দেনা শোধ হয় না। তারপরও শতেক ঝামেলা । নবমীর রাতে পূজা কমিটির ছেলেছোকরারা বলে, ‘খানকী নাচাতে

পারবে ?'

হৈরব বলে, ‘কি কন!

'কি কই বোঝো না? ঝন্টে বুঝিয়ে দেতো বানচোৎকে !' ঝন্টে এক ঝটকায় তাকে উলঙ্গ ক'রে বুঝিয়ে দেয়। এই হচ্ছে দিনকাল, এই হচ্ছে কর্তাবাবুরা ; সবকিছু দেখেশুনে ঘেন্না ধ'রে গেছে তার। হঠাৎ কি মনে ক'রে হৈরব চঞ্চল হয়ে ওঠে । ডাকে, 'ভৈরবরে__’ ‘কি কও?’ গমের শুকনো গোছা মাথা থেকে নামিয়ে ভৈরব কাছে দাঁড়ায়। 'ধর যেমুন আতকা মইরা গ্যালাম, গনিডাকতোরের ট্যাকাটা যেমনেই হউক মিটায়া দিছ, বহুত পাইবো হ্যায়, তরগিয়া চাইরশোর কিছু কম...'

ওষুধের দোকান থাকায় গনিমিয়াকে গ্রামাঞ্চলের সবাই ঐ নামেই ডাকে, চারহাতপায়ে তাকে ডাক্তারিও করতে হয়। 'কাউলকা ট্যাকার কথা তুলছিলো, বাজারের মদে খারায়া অক্করে ধুইছে

আমারে, ভৈরব বিরস মুখে বলে, ' কইলো, তর বাবারে গিয়া কবি, হ্যা যান টালটিবালটি ছারান দিয়া ট্যাকা শোধ দেয়-_’

‘কি কইছোস?’

'কইলাম বাবার হাতে ট্যাকা নাই, শুইন্যা কুঁইদা আইতে চায়। কয় আছিলো কবে, যা রইছে হেই বেইচা খাইতারছ না। সুজানগরের দত্তবাড়ি থিকা ট্যাকা হাওলাত নিছে কয়া আমারে বুজ দিয়া গেছে। কইছে না দত্তরা, কিয়ের হাওলাত, নামকীর্তনের বায়নার ট্যাকা আগাম লইছে হ্যায়__'

'ঠিকোই-_’

‘আইজ আইতারে তাগাদায়, কি করবেন কি ?'

হৈরব ক্ষেপে ওঠে একথায়, 'হাড়-হাবাইতা আমারে জিগাছ, দত্তরা কি দিছে না দিছে জানছ না ‘

মন খাঁখাঁ করে হৈরবের, দশগাঁয়ের ভেতর ঐ একটা বাড়ি ছিলো, যেখানে বছরে একবার জৌলুস ক'রে নামকীর্তন হয়, নানা জেলার আটদশটা দল এসে জমে, সেরা দলের কপালে সোনার মেডেল জোটে; তা তারও পাট চুকতে বসেছে। প্রবীণ কেশব দত্ত পষ্ট বলেই দিয়েছে তাকে, 'এই এই হইলো শেষবার, নামকীর্তনের পালা আমরা তুইলা দিতাছি। অহনে সব ভাগ হয়া গেছে, খরচপাতি চালায় কেঠায়-__'

‘আরে খরচ, ট্যাকায় সব খাইলো' ভৈরবের পায়ের পচা নখ টসটস করে টাটায়। কয়কীর্তনের ঢাকীদের কি দাপটটাই না ছিল একসময়, পালপার্বণের আগে সারাদেশ থেকে বায়না করতে আসতো মানুষজন । বনেদি বাবুদের বাড়ি না হলে তারা বায়না ফিরিয়ে দিয়েছে কতোবার, সেই তারাই এখন খষিদাসদের সঙ্গে বাঁশ আর বেতের ঝুড়ি বুনে কোনমতে নিজেদের পেট চালায়, চুরি ডাকাতি ক'রে বেড়ায় । সময়ে কি না হয়; মাটিতে পড়া ডুমুর, তার আবার গোমর কিসের ।

‘ঈশ্বর, ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও___' হৈরব নিজের কাছে কাঁদবে ব'লে পা বিছিয়ে বসে। কতো কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে সিরাজদিখাঁর সেই পাতক্ষীরের কথা, জীভে স্বাদ লেগে আছে এখনো । মনে পড়ে রামপালের কলামুলোর কথা, গাদিঘাটের কুমড়ো, আড়িয়লবিলের কই মাছ, কত কিছু। আতরপাড়ার সেই দই, আহারে, সব গেল কোথায় । গোটাগ্রাম জুড়ে ছিল কদমের বন, বর্ষার নদী ধীর মন্থর গতিতে ফেঁপে উঠে শেষে কদমের বনে গিয়ে ইচ্ছে ক'রে পথ হারিয়ে 'এআমারকিহলোগো’ ভান ধ'রে ছেলেমানুষিতে মেতে উঠতো । এখন গ্রাম কি গ্রাম উজাড়; দেশলায়ের কারখানা গিলে ফেলেছে সবকিছু । কদমের সে বনও নেই, নদীর সেই ছেলেমানুষিও নেই; এখন ইচ্ছে হলো তো একধারসে সব ভাসিয়ে দিলো, সবকিছু ধ্বংস করে দিলো, 'আমি তোমাদের কে, আমার যা ইচ্ছে তাই করবো’ ভাবখানা এমন। সবকিছু দেখে, সব কথা ভেবে, হৈরব এ সিদ্ধান্তেই পৌঁছায়, অনেক কিছু তার দেখা হয়ে গেছে, অনেক, অনেক, আর দরকার নেই তার দেখার, ‘চক্ষু তো এই দুইখান, আর কতো দেখাইবা, ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও-_' জীবনের কি খাই, কতো কিছু তার চাই, আজ আর তার কোথাও বাঁশপাতার কোনো গন্ধ লেগে নেই, উইঢিপির গন্ধ নেই, এ্যাওলাশ্যাওলার গন্ধেও কত আত্মীয়স্বজন, কতো পালপার্বণ, কতো জন্মমৃত্যুর স্মৃতি ভুরভুর করেছে একসময় । জীবনের এখন গণ্ডা গণ্ডা মাথা, গণ্ডা গণ্ডা চোখ, হাত, নখ, দাঁত, রাবণ কোন ছার; জীবনের এখন সবকিছু চাই, কেবল ভালোবাসা ছাড়া, যতো

কিছু আছে, সব-
 
‘ঈশ্বর আমারে তুইলা নাও---' গলায় আকন্দের মালা পরে 'হে বিরিক্ষ এ অধমের পেন্নাম লইবেননি, হে হনুমানসকল, আপনেরা খুশি থাকিলেই বিশ্ব সংসার লীলাময় হয়, ‘আহা সরলতার কিবা দিব্যকান্তি, মরি মরি' আপন মনে এইসব ব'লে আর কেউ একা একা কেঁদে ফিরবো না দেবদারু বনে, আর কেউ চৌতালে, একতালায়, টেওটে, ত্রিতালে, ঝাঁপতালে, ঠুমরি ঠেকায় ঢাকে

বর্ধাভর ডাহুকের ডাক বাজাবে না, ’ঈশ্বর হৈরবরে তুমি তুইলা নাও-_'
 
এক সময় দয়া আসে । বলে, ‘দাদা পাও বিছায়া বইলা যে, ঘরে আইবা না? বেইল যাইতাছে না বুঝি!’

ভৈরবের অনুমানই ঠিক, বিকেল ধ'রে আসার পরপরই দূর থেকে হাতাইলের ওপর গনিমিয়াকে দেখা যায়, নিস্তেজ ইছামতির একটা মাথা তখন তীব্র আগুনলালে ঝলসে উঠছে।

গনিমিয়ার হাতে একটা চটের থলে, গায়ে বাবর বিড়ির বিজ্ঞাপন। থলেটা হাতে ঝুলিয়ে তিল খেত কাউন খেত এ খেত সে খেত নিরিখ করতে করতে হাতাইল ধ'রে আপন মনে সে এগিয়ে আসে। কলুবাড়ির চকের পাশে একবার দাঁড়ায় সে, পিঁয়াজের খেত বরাবর বেতঝোপের কোলে জলবোড়ার জট পাকানো মেলা ব'সে গেছে; মাছ গিলে গিলে একেবারে ট্যাপ হয়ে আছে সাপগুলো, নড়ার ক্ষমতা নেই । এরা আজ গর ছেঁচে মাছ ধরেছে, ভিটির ভাঙনে ভরট দিয়েছে। এক বয়সে গরু ছাগলের পাল ধরানো দেখতে কলুবাড়ির চারপাশে কতো ঘুরঘুর করেছে, মনে এইসব উঁকি মারে।

হৈরবের ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে ঝেড়ে একবার গলা খাঁকারি দেয় গনিমিয়া, ‘কইগো বুইরা, বাইরাও ; ট্যাকা না লয়া আমি কিন্তু আইজ আর নরতাছি না, কয়া রাখলাম, ঔষধ উঠাইতে হইবো, বাইরাও__’ দয়া একটা পিঁড়ি এনে বসতে দেয় তাকে উঠানের একপাশে। বলে, 'বুরা

মানুষ, তারে এ্যামুন কষ্ট দিয়েন না। আপনেরে আইতে দেইখা দাদায় খাঁথামুরি দিয়া হুয়া পড়ছে__’

চোটপাট চালানোর উদ্দেশ্যে আজ অসময় একটু নেশা ক'রে এসেছিল গনিমিয়া; এখন সবকিছু ভেস্তে যায় আর কি। গনিমিয়ার মাথার ভেতরে ঝিমঝিম ক'রে, আরো অনেকবার দয়া সামনে আসায় তার বজ্রআঁটুনির গেরো খামোকা ফসকে গেছে । খাটো গলায় সে বললে, 'গাঙ্গের ঘোলাপানি আর মাইয়া মাইনসের কালারঙ, শালার আইজ আমারে খাইছে, আমি নাই-’

দয়া হেসে বললে, ‘আপনে নাই ?'

'আছিলাম, অহনে নাই!’

'বহেন তাইলে, ভৈরবরে বুলায়া দেই, হ্যা আপনেরে খুঁইজা বাইর করবোনে, দেইখেন-'

আসার পথে শেষবেলার রূপের ছটায় গনিমিয়ার চোখ ঝলসে গিয়েছিল, ইছামতির গা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে চষাখেতের দিকে। এখন নতুন ক'রে আবার ধাঁধা লাগে। দয়ার কোমরের একটা ঢেউয়ের ওপর তার চোখ ভ্রু-ঝাপটানি দিয়ে ঝুপঝাপ ছোঁ মারে; কি মসৃণ, কি পেছল, রূপের ঢল সারা গতরে গড়ান দিয়ে শেষে কোমরে এসে ভাঁজ খেয়ে চিকচিক করছে। মাথার

ভেতরে সেই কবেকার দেখা এক হঠাৎ জাগা পদ্মার চর ভেসে ওঠে, সেখানে নিরুদ্বিগ্ন অপার জ্যোৎস্নায় নরোম ভিজেমাটির গায়ে ছিলবিল ছিলবিল ক'রে তড়পায় রাশি রাশি চকচকে সরপুটি, নরোম ব'লে নরোম, পায়ের পাতার নিচে দেবে যায় মাটি ।

দয়া সরে যেতেই উঠোনটা দপ ক'রে নিভে যায়। গোধূলিলগ্নের আচ্ছন্নতায় চতুর্দিকের দৃশ্যপট এমনিতেই নিম্প্রভ হয়ে ছিল এতক্ষণ, ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে এখন। 'ধাইদার বাঙ্গিখান যেমুন, ঈশ, ফাইটা পরতাছে অক্করে__' গনিমিয়ার মাথার ভেতরে তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়, ‘আয়া লউক মালাউনের বাচ্চা, হৈরবের পোলা ভৈরব, হ, হ্যারে আইজ আমি আস্তা থুইছি!'

ভৈরব আসে না, ভেতর থেকে শোনা যায় হৈরবের গলা, ‘প্যাটের ফাঁপ আমারে খাইলো বাবু__'

শেষে পা টেনে টেনে সামনে এসে দাঁড়ায়।

‘অক্করে কুঁইয়া গন্দ।'

'হ বাবু, পায়ের নখ পইচা উঠতাছে-__'

'অহনে কত কিছু হইবো, ট্যাকার কি করলা?’

প্রথমে অকারণে নাক ঝাড়ে, তারপর গরুর মতো বড় বড় চোখে তাকায় হৈরব ; রোগে রোগে আর বয়েসের ভারে দেহের কাঠ বেরিয়ে পড়েছে মানুষটার, গনিমিয়ার গুঁতুনে চোখেও এই নির্জলা সত্যটুকু বিশ্রীভাবে দাঁত বের করে থাকে।

হাত জোড় ক'রে হৈরব বলে, ‘আমারে সময় দ্যান বাবু-__' ‘ঘরে জোয়ান পোলা, খ্যাদায়া দাও হ্যারে, আকামের হাড্ডি__' 'হ্যায় কি করতারে, কামকাজ আছেনি বাবু দ্যাশে, পূজা-পার্বণ সব উইঠা যাইতাছে, দেখতাছেন তো ব্যাকই, ঢাকীগ জীবন ক্যামনে বাঁচে-' দয়া এসে দাঁড়ায়, ঝিরঝির ক'রে অদ্ভুতভাবে হাসে আর আঙুল মটকায়। জুলজুলে চোখে তাকায় গনিমিয়া ; দয়ার তেল জবজবে ভোমা খোঁপা মাথার গুঁতোয় ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে।

'বইনের জীবনটাও মাটি কইরা দিলা__'

'ঈশ্বরের ইচ্ছা, আমারে তো দেখতাছেনঅই ।'

একগাল তোষামুদে হাসি ছড়িয়ে গনিমিয়া বলে, ‘যাওনাগো, অট্টু তামুক সাইজাও খাওয়াইবা না!’

দয়া চলে গেলে চাপা স্বরে সে বলে, ‘ বেরজার লগে হ্যারে তুমি বিয়া দাও, আমাগো হাতের পোলা__'

হৈরব বলে, 'হ্যানি বিয়ায় বইবো ?'

'তোমরা দিবা, কও তো আমি করায়া দেই-__'

'বেরজারনি বউ রইছিলো, ভাইগা গেছিলগা বয়ড়াগাদির সীতানাথ পসারীর লগে ? যেমুন হুনতাছি ফিরা আইছে-_’ 'স্বভাব-চরিত্রি ঠিক আছিলো না হ্যার, বুঝলানা ? বেরজা হ্যারে ঘরে উটবার দেয় নাই, অহনে মোজামি খলিফারে রাইন্দা খাওয়াইতাছে!’

পরে গনিমিয়া অন্তরঙ্গ সুরে বললে, 'বেরজার মতো পোলা হয় না, হ্যায় কি তালিবালি করবো, আমরা রইছি না!’ ‘বিয়ায় হ্যা বইবো না বাবু__' হৈরবের গলার ভেতর ঘড়ঘড় করে, ‘বাকি রাখি নাই বুঝান, হে চলে হ্যার নিজের বুঝ লয়া-_' একফাঁকে গনিমিয়ার হাতে হুঁকা ধরিয়ে দেয় দয়া, তারপর গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের সব কথা শোনে । গ্যাঁট হয়ে বসে ঝাড়া একঘন্টার চেয়েও

বেশি মুখে কথার তুবড়ি ছোটায় গনিমিয়া :

বছর বছর ইন্ডিয়ায় বেড়ানোর শখ পুরোদস্তুর মিটে গেছে, এখন তার হাতটান, অকালবৃষ্টিতে গুষ্টিনাশ হয়ে গেছে আলুর। অল্প-বিস্তর যাওবা কিছু তুলতে পেরেছিল ঘরে, তারও দফারফা ক'রে দিয়েছে ইঁদুর। পাট বুনেছে ঠিকই, কিন্তু অবস্থাগতিক সুবিধের নয় বিশেষ; আকাশের অবস্থা দেখে মনে হয় না দু'চার দিনের মধ্যে এক আধ পশলা বৃষ্টি নামবে। রাশি রাশি সমস্যার

কথা চারপাশ থেকে এনে স্তুপাকার করে গনি মিয়া এইভাবে। দয়া বলে,'অহনে বুইঝা দ্যাহেন দাদার অবস্থাখান তাহৈলে কেমুন__'

অনেক আগেই ভাঁজ ভেঙে গিয়েছিলো গনিমিয়ার। দয়া সামনে এসে দাঁড়ালে কোনোদিনই সে হৈরবকে এঁটে উঠতে পারে না, কোথায় একটু বাধে, কথার ধার ভোঁতা মেরে যায় ; দয়া যদি তাকে একটু সুনজরে দেখে আরো অনেক কিছুই সে নতুনভাবে বিবেচনা ক'রে দেখতে রাজি, আরো দু'কাঠি ভালোমানুষি দেখানো তখন তার পক্ষে নিছক হাততালি দেবার মতো একটা সহজ ব্যাপার হয়ে যায়।

মুশকিল তার পক্ষে এই যে, দয়াকে কখনোই সে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারে না। অবশ্য মেয়েমানুষের ব্যাপারে হাইফাই ক'রে সবকিছু বুঝতে চাওয়ার যতো তুমুল আগ্রহও তার নেই, সে জানে বুঝতে গেলেই শেষ পর্যস্ত সে আর সেই আগের মেয়েমানুষটি থাকবে না, হয়ে দাঁড়াবে কাঁধের বোঝা । ফাঁকতালে মোটামুটি ভাবগতিক সম্পর্কে একটা ধারণা ক'রে নেওয়া চাই, এ না হলে পা বাড়ানোর অনেক ল্যাঠা, কেবল এইটুকুই। সে তো সবকিছুই বুঝে ফেলেছিল দেবকীর, একেবারে আগাপাশতলা ; ফলে জলবোড়ার মতো হাতপায়ে জড়িয়ে গিয়েছিলো দেবকী, বেরজাকে সে লাথি মেরে ফেলে দিত বিছানা থেকে। তবু অনেক সহজ ছিলো দেবকীর ব্যাপারটা। সহজ ছিলো বলেই নিছক কাটাকুটি খেলার দাগ মুছে দেবার মতো ক'রে সামাল দিতে পেরেছিলো সবকিছুর ; দয়া গড়া ভিন্ন ধাতুতে, এটুকু বুঝবার মতো বুদ্ধি তার ঘটে আছে। এই মেয়েমানুষটিকে ট্যাপ খাওয়ানো হাতে হুঁকো ধরার মতো কোনো ব্যাপার নয়, হয়তো এতদিন পর সত্যি সত্যিই সে জাত খেলুড়ের পাল্লায় পড়েছে। গনিমিয়ার মনমেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।

‘কইকি, বিষয়-সম্পত্তি বেইচ্চালাও-'

হৈরব বলে, 'রইছে তো যেমুন এই ভিটিবাড়িটুকুন আর দেড়কানি জমি-’

'লাগলে ট্যাকা লও-_’

‘ঘরবাড়ি বেইচ্যা দাঁরামু কই বাবু, আমাগো কি আর যাওনের কুনো জাগা

আছে।’

‘যাইতে লাগবো ক্যান, যতদিন ইচ্ছা থাকবা-'

হৈরব মাথা নাড়ে। বলে, ‘না বাবু, বাপদাদার মাটি, মনে লইলেও পাপ-'

গনিমিয়া তেড়ে উঠে বলে, ‘হইলো! অহনে আমার ট্যাকার কি করবা কয়ালাও!'

সুজানগরের নামকীর্তনটা হয়া লউক__' হৈরব চোরের মতো তার দিকে পিটপিট ক'রে তাকিয়ে বলে, ‘যতোটা পারি মিটায়া দিমু।' এই সময় ভৈরব এসে দাঁড়ায় উঠোনে, দাঁড়িয়ে মড়মড়ে বাশপাতার মতো একটা গামছা দিয়ে ডলে ডলে গায়ের ঘাম মোছে।

এতোক্ষণে অবেলার নেশা গনিমিয়ার ভেতরে গেঁজে ওঠে। তিরিক্ষি মেজাজে সে বলে, ‘এই খাসিটারে খেদায়া দাও, ঘরে এমুন জোয়ান পোলা থাইকাও ফায়দাটা হইতাছে কি-'

আঁধার ঘনিয়ে এসেছিলো অনেক আগেই, পষ্ট মুখ দেখা যায় না ভৈরবের; খুঁটিগাড়া হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে কেবল।

গনিমিয়ার মেজাজ এখন ঘনঘন ফের বদলায়।

ভৈরবের উদ্দেশে বলে,

'ঢাকে বারি দিবার পারবিনিরে ?'

ভৈরব বলে, ‘বুঝি না__’

'বুঝন লাগেনিরে বোদাই-’ প্রবল উৎসাহে দোল খেয়ে হৈরব বলে,

‘বাবু বাজনা শুনবো, বাজায়া শুনা!’

গনিমিয়া উঠে দাঁড়াতেই হৈরব ব্যাকুল হয়ে বললে, ‘উঠতাছেন যেমুন ?'

'গরমখান কি, শইল জ্বলতাছে, দেহি মাঠের মদে গিয়া বহা যায় কি না__’

শক্তমুখে গড়গড় ক'রে মাঠের দিকে নেমে যায় গনিমিয়া এইটুকু ব'লেই ;

কিছু না বুঝে হৈরব ফ্যালফ্যাল ক'রে তাকিয়ে থাকে ।

'আমারেনি হে কামলা ঠাউরাইছে-_’ ভৈরব আহত গলায় বলে,

'আমাগোর কুনো ইজ্জত নাই!’

‘ই-রে, কিনা ইজ্জতখান! আইছে একখান ইজ্জতের ব্যাপারী। কথা না বারায়া ঢাক লয়া ছুট- দয়া হাসতে হাসতে বলে, 'ডাকতররে খুশি করন চাই, নাহৈলে কইলাম দাদায় নতুন কইরা আবার খাঁথার ভেতরে গিয়া হানদাইবো!'

হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগে দয়ার ।

গনিমিয়া বলে, ‘গলাখান ভিজায়া লইবি নিকিরে ভৈরব?’

ভৈরব মাথা নাড়ে।

‘ভালো জিনিস-’

‘অভ্যাস নাই!’

'এসব লাগেনিরে বোদাই, চালাইলেই চলে! তগো দিয়া কিচ্ছ হইবো না, দুনিয়াই চিনলিনা অহনতরি!'

‘আপনেরাই চিনেন-_’

‘চিনতে তো হইবোই, না চিনলে চলবো ?'

একটু একটু ক'রে জ্যোৎস্না ফুটছে। সার্ট খুলে গায়ে ফুরফুরে হাওয়া লাগায় গনি মিয়া। কলুবাড়ির পুকুরের একটা পাড়ে রীতিমতো জঙ্গল, সেখানে বয়ড়াবাঁশের ঝাড়ে ঝিরঝির করে হাওয়া। তা বেশ, এইভাবেই যেন বাকি জীবনটা কেটে যায় ; চোখ বন্ধ ক'রে মনে মনে নিজের ইচ্ছেমতো কিছু দৃশ্য দেখে নেয় গনি মিয়া । মেরেকেটে এইভাবেই নিজের ভালোটুকুর,আনন্দটুকুর, জোগানদারি ক'রে যেতে হবে জীবনভর, তা না হলে কে কাকে দেয়, কে কাকে সাধে, কার এতো মাথাব্যথা! ভাগ্যিশ, থলের ভেতর পুরে অর্ধেক বোতলখানা সে এনেছিল, তরতরে হাওয়ায় সারা দেহ এখন একটা নৌকোর মতো যেদিকে ইচ্ছে ভেসে যেতে চায়। তা বেশ, আরো একটু ঝুল কাটাকাটি খেলুক দয়া। বড় মজার এ খেলা, সামনে কোনো একটা লোভ না থাকলে তার নিজেরই আজকাল রোজগারে মন বসে না; মনে হয় কি হবে এতোসব ক'রে, সব পণ্ডশ্রম, বেকার। জগতে এমন কিছু মেয়েমানুষ আছে বলেই ফুটফুটে জ্যোৎস্না সাবানের ফেনার মতো সারা গায়ে মেখে মাঠঘাটে ধপধপে হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।

ভৈরব বলে, ‘আরো বাজামু ?’

‘বাজা, তর ইচ্ছামতো চালায়া যা, আমারে কি জিগাছ, দেহছ না খুন হয়া

রইছি।'

মাঠঘাট চড়বড় ক'রে বাজতে থাকে । হাওয়ার গায়ে এতোক্ষণ যে ভ্যাপসা গরমের ঝাঁঝ লেগে ছিলো ধীরে ধীরে তা উবে যায়; ইছামতির বুকে যেনবা এইমাত্র তার আঁচল ভিজিয়ে নিয়েছে, কি মনোরম, দেহমন জুড়িয়ে যায় গনিমিয়ার।

ভৈরব আড়চোখে এক একবার দেখে নেয় গনিমিয়াকে, সবকিছু তার কাছে একটা দুঃস্বপ্নই মনে হয়। নাকে দড়ি দিয়ে এই লোকটি তাকে ইচ্ছেমতো নাচাচ্ছে, কেনা গোলাম সে, চারপাশে আগুনের বেড়; লোকটি কেবল নিজের আনন্দ চেনে। গা হাত পা টনটন করে ভৈরবের। শেষে অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা তার কাঁধে ভর করে ; ঢাকের ছানির গায়ে ছিট আর কাচার তুমুল ছটফটানি অবিকল বুড়ো হৈরবের গলার স্বর নকল ক'রে তাকে বলে: মনিষ্যি আছিল না, বাজনা আছিল, পর্বত বাইজা উঠছে, জল বাইজা উঠছে, মাটি বাইজা বাইজা উঠছে, ধরিত্রী বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে আকাশ, বাইজা উঠছে মনুষ্যজন্ম বাইজা উঠছে মনুষ্যধর্ম, বাইজা উঠছে মানবজীবন, বাইজা উঠছে, বাইজা উঠছে-

ভৈরব চিৎকার ক'রে বলে, ‘বাবু হুনতাছেন ?'

‘তয়-’

‘ক হুনতাছেন ?’

'সধবার কেউ নয়, বিধবার বন্ধু!’

'দশখুশি, বাবু দশখুশি! ঢাকে ক্যামনে কথা কইতাছে হুইনা দ্যাহেন। দশখুশি, চৌদ্দমাত্রা, মানবজীবন কথা কইতাছে বাবু! দশখুশি বাবু, চৌদ্দমাত্রার মনুষ্যধর্ম বোল তুলতাছে, আখিজলে আখিজলে, টলমল টলমল, ধরাতল ধরাতল, রসাতল, হা---’

ধুপধাপ ক'রে নেচে ওঠে ভৈরব। পায়ের চাপে চাপড়া চাপড়া মাটি ব'সে যায়। ঢাকের গরগরে শব্দে চিড় খাওয়া জ্যোৎস্না জোনাকির মতো মাঠময় ঝুরঝুর ঝ'রে পড়ে। একটু একটু ক'রে ঘোমটামোড়া লোকালয় পিছু হটে, দূরে সরে যায়: সমগ্র বিশ্ব চরাচর এখন উপুড় হয়ে পেতে দিয়েছে তার পিঠ, ভৈরবের পায়ের তলায়, সমগ্র শোভা দিয়েছে তার তলপেট, ভৈরবের পায়ের

তলায়: বাবরি চুল ঝাকিয়ে, পেশি ফুলিয়ে, দুরমুশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে সে সেইসব কাদাছানা করে রুদ্ধশ্বাসে |

'করছ কি করছ কি, তর মাতা বিগরাইছেনি ভৈরব, চিল্লাস ক্যান ?’ ভৈরবের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়, ‘ফিরান দিয়া বহেন, ফিরান দয়া বহেন, দশখুশি বাজাই দ্যাহেন ক্যামনে, মাইনশের চামড়ার ছানিতে দ্যাহেন কেমুন বাজে…’

সরোষে সে বাঁশের কাচা চালায় ।
 
প্রাণভয়ে ভীত হতচকিত গনিমিয়া খেতের ওপর গড়ান খেয়ে খেয়ে ততোক্ষণে বেশ খানিকটা দূরে সরে গিয়েছে, তার কানের ভেতরে তখন তুবড়িবাঁশির চিৎকার ; দানবীয় উল্লাসে মূর্তিমান ভৈরব তখনো কাচার মাথায় আগুনের ফুলকি ছোটাচ্ছে।

গনিমিয়ার পিঠ নয়, পরিশ্রান্ত ভৈরব একসময় অবাক বিস্ময়ে দেখে এতোক্ষণ সে তার নিজের ঢাকের গায়েই সর্বশক্তি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে ; চামড়ার দেয়াল আর ছানি ফেঁসে গেছে, চুরচুর হয়ে ছিটকে পড়েছে টনটনে আমকাঠ, বেঘোরে নিজের ঢাকটাকেই চুরমার করেছে এতোক্ষণ। ‘ল, তর কাচা ল’, কালুবাড়ির বাঁশঝাড়ের দিকে সজোরে সেটাকে ছুঁড়ে দিয়ে

ভৈরব বলে. ‘ধর, তর ছিট তরে ফিরায়া দিলাম, তারপর সে শুরু করে দৌড়; মাথার ভেতরের বিদ্যুৎচমকে এক একবার ঝলসে ওঠে কয়কীর্তন গ্রাম, ঝলসে ওঠে ঋষিদাসদের জাফরিকাটা মুখ আর বর্শার ফলা, মশালের আলো।

ইছামতির পাড়ের মানুষগুলো এক একটা মাংসপিণ্ড মাত্র, আর কয়কীর্তনের মানুষজন পেয়েছে পদ্মার দুরন্ত স্বভাব; সে রীতিমত রোমাঞ্চিত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ