দশজনে মিলে যদি কেউ একটা লোকের পেছনে লাগে, তাহলে ফ্যাচাখেউ করে তার দফা রফা করে দিতে পারে৷ তাই একটা প্রবাদ বাক্য আছে, দশজন চক্রান্ত করে ভগবানকেও ভূত বানানো যায়৷ সত্যিই এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল৷
অনেকদিন আগের কথা৷ সুড়ুতপুর বলে একটি রাজ্য ছিল৷ সেখানে যে-কেউ যে-কোনো দেশ থেকে এসে ফুড়ুত ফুড়ুত করে ওই রাজ্যে ঢুকে পড়ত৷ ওখানকার সীমান্ত প্রদেশের পাহারাদাররা খুব নজর রাখত বটে কিন্তু টাকার জোর থাকলে, পাজি বদমায়েসরা দিব্যি গোঁফে চাড়া দিতে দিতে ফুড়ুত করে ঢুকে পড়ত৷
রাজ্যের যিনি রাজা ছিলেন তাঁর নাম ছিল গুণধর-কিন্তু সে নাম মুছে গিয়েছিল৷ প্রজারা তাঁর নাম দিয়েছিল গুড়ুকেশ্বর৷ তার কারণ, তিনি প্রকাণ্ড একটা গড়গড়ায় বিরাট একটা নল লাগিয়ে দিনরাত গুড়ুক গুড়ুক করে শুধু তামাক খেতেন, আর ঝিমুতেন৷ গড়গড়ার কলকেতে শুধু যে তামাক থাকত, তা নয়৷ তাতে থাকত আফিং, গাঁজা মেশানো৷ তার ফলে ঝিমোনোর ভাব থাকবেই৷
মুশকিল হত রাজা যখন প্রজাদের বিচার করতে বসতেন৷ একজন আর একজনের নামে নালিশ করতে এসেছে৷ রাজা খানিকটা শুনেই যে নালিশ করতে এসেছে, দারোয়ানদের বলতেন ওকে ঠ্যাঙাও আর যার বিরুদ্ধে নালিশ হয়েছে, তার জন্যে এক হাঁড়ি রসগোল্লা এনে খাইয়ে যাও, বলে হুকুম দিতেন৷
অবশ্য রাজার একজন বৃদ্ধ মন্ত্রী ছিলেন, তিনি আড়ালে আসল বদমায়েশ লোকটিকে প্রচণ্ড ঠেঙাতেন, আর যে লোক সত্যি নালিশ করেছিল, তাকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা দিয়ে বাড়ি যেতে বলতেন৷
রাজার আরও জন দশেক মন্ত্রী ছিলেন, তাঁরাও সবসময় রাজার কাছে বেশি যেতেন না, বৃদ্ধ মন্ত্রী রামেশ্বরের পরামর্শেই কাজকর্ম চালাতেন৷ রাজা সেসবের খোঁজ কিছু রাখতেন না, তাই তাঁর বিচার যে উলটে গেছে, সে খবরও তিনি পেতেন না৷ তবে যারা নালিশ করতে আসত, তাদের কাছ থেকে একশো টাকা, আর যাদের বিরুদ্ধে নালিশ, তাদেরও ওই টাকা দিতে হত৷ তবে সে যদি দুশো টাকা দিয়ে দিত, তাহলে রাজা সেটা পকেটে পুরেই অপর পক্ষকে ঠেঙাবার আদেশ দিতেন৷
রাজা গুড়ুকেশ্বর ঝিমোন, আর যাই করুন, টাকাটা খুব বুঝতেন৷ টাকা পেলেই একটা থলির মধ্যে ফেলে তাকিয়ার নীচে গুঁজে রাখতেন৷
রাজাও ঘুষ নিচ্ছেন দেখে, সবাই ঘুষ নিতে শুরু করলেন৷ কেবল বৃদ্ধ মন্ত্রী বা তাঁর সহকারীরা সেরকম ছিলেন না বলে, রাজ্যটা কোনো রকমে বেঁচে গিয়েছিল৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী অনেক সময় চলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গুড়ুকেশ্বরের বাবা বুড়ো মন্ত্রী-মশায়ের হাত ধরে নাকি বলেছিলেন, দেখো মন্ত্রী, আমার ছেলেটাকে একটু দেখো৷ ওকে ছেড়ে চলে যেয়ো না৷ তিনি সেকথা রেখেছিলেন৷ কিন্তু ক্রমশ রাজ্যের মধ্যে উৎপাত বাড়তে লাগল৷ রাজা মন্ত্রীর কথা গ্রাহ্য করতেন না৷
বাইরে থেকে চোর-ডাকাত, ছিনতাই-পার্টি সবাই সুড়ুতপুরে ঢুকতে শুরু করলে৷ আর পাড়ায় পাড়ায় মস্তানরা জুলুমবাজি আরম্ভ করলে৷ আর তাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলেও বিপদ, না করলেও তাদের আশকারা বাড়তে থাকে৷
এই মস্তানদের মধ্যে সেরা মস্তান ছিল-ভগবান৷ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা, আর লম্বা লম্বা কথাবার্তা৷ সবাই তাকে দেখলে ভগবানের মতোই নমস্কার জানাত৷ বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াত সর্বত্র, আর তার স্যাঙাতগুলো ছিল আরও পাজি৷ গিরগিটির মতো দেখতে, ঝাঁকড়া চুল, লম্বা পায়জামা আর মুখে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে পাড়ার লোকের সঙ্গে ‘স' ‘স' করে যখন কথা কইত, তখনই মাতব্বরদের বিদ্যেবুদ্ধি যে কীরকম, তা বুঝলেও কেউ কিছু প্রতিবাদ করত না৷
ভগবানের আসল বন্ধুদের মধ্যে ডানহাত ছিল ব্যাঙা, ঢ্যাঙা আর ন্যাঙা৷ পাজির পাঝাড়া৷
পাড়ায় একটা পানওয়ালার দোকান থেকে হরদম প্রত্যেক দিন এরা গোছা গোছা পান নিয়ে খেত, বিড়ি ধরাত, কিন্তু মাসের পর মাস একটা পয়সা ঠেকাত না৷ একদিন পয়সা চাইতে, ভগবান এসে পানওয়ালাকে ডেকে বলে দিয়ে গেল, ফের যদি আমার সাকরেদদের কাছ থেকে পয়সা চাইবি, তাহলে একটি থাপ্পড়ে সামনের দিকের চাঁদমুখখানা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে যাব, বলে দিচ্ছি৷ কথাগুলো বলে ভগবান চলে গেল৷
পানওয়ালা তো তার কথা শুনে ‘থ’৷ ন্যাঙা ব্যাঙা আর ঢ্যাঙা মুচকি মুচকি হেসে পানওয়ালাকে বলে গেল, উনি কে জান? ভগবান৷ আমাদের ভগাদা৷ ওর কথা যদি না মানো তাহলে এয়সা একটা ঝাপ্পড় দেবে না, যে তোমার কষির কাপড় খুলে পড়ে যাবে৷ এ কথাটা মনে রেখো চাঁদু, বলে তারা সিটি দিতে দিতে চলে গেল৷
পানওয়ালা তার পরিচিত দু-চার জন ভালো খদ্দেরকে জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা বলুন তো ভগবান বলে এক বাবু আমাকে খুব শাসিয়ে গেল যে বিনা পয়সায় মুঠো মুঠো পান ওঁর দলকে খাওয়াতে হবে, কিন্তু তারা পয়সা দেবে না, তাহলে কি রাজার কাছে নালিশ করব?
সবাই বললে, রামঃ! ভগবানের পেছনে লেগো না বাপধন, ও সড়ুতপুরে সব মস্তানদের সর্দার৷ ওর বিরুদ্ধে নালিশ করতে গেলে সাক্ষী পাবে কোথায়? কেউ যাবে না৷ লক্ষ্মী ছেলে হয়ে দোকানে বসে থাকো৷ নাহলে দোকানপাঠ উঠিয়ে দিয়ে, হরিনাম করতে করতে অন্য কোথাও চলে যাও!
পানওয়ালা আরও দমে গেল৷
এর কিছুদিন পরেই এক ময়রা এসে, পানওয়ালার দোকানের পাশে একটি বড়ো সন্দেশ-রসগোল্লার দোকান খুললে৷ পানওয়ালা একটু জোর পেলে৷
প্রথম দিনই ভগবান ন্যাঙা, ব্যাঙা আর ঢ্যাঙাকে নিয়ে হাজির৷ দোকানি খুব খুশি৷ দোকান খুলতে না খুলতেই খদ্দের এসে গেছে৷ মুখে আর হাসি ধরে না৷
ভগবান বেঞ্চিতে সাঙ্গোপাঙ্গ সবাইকে বসিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলে, কী আছে?
দোকানি নিজে তাড়াতাড়ি এসে বিনীতভাবে বলে উঠল, আজ্ঞে, খাবার অনেক রকমের আছে বরফি সন্দেশ, কাঁচাগোল্লা, রসমাধুরি, গোলাপজাম, কালোজাম, আবার-খাব সন্দেশ, পান্তুয়া, জিভেগজা, রাজভোগ, ক্ষীরকদম্ব, পেঁড়া, দই সব আছে, যা খেতে চাইবেন তাই পাবেন এখানে
সব টাটকা তো?
আজ্ঞে, আজ তো সবে দোকান খুললুম৷ আমার ভাগ্যি, আপনারা বউনি করতে এসেছেন প্রথম, সব চেয়ে ভালো জিনিস দিচ্ছি৷ কী কী দেব বলুন!
ভগবান গম্ভীরভাবে বললে, সব মিষ্টি চারটে করে আমাদের দাও-চেখে দেখি৷
সঙ্গেসঙ্গে চারটে বড়ো শালপাতা পড়ে গেল৷ বড়ো বড়ো ভাঁড়ে গোলাপ জলের গন্ধ মেশানো জল একটা ছোকরা সকলকে দিয়ে গেল-তারপর সবরকম মিষ্টি নিয়ে আরও দু-তিনটি ছোকরা ওদের পাতে ঢালতে লাগল, আর ওরা গবাগব খেতে শুরু করে দিলে৷
দোকানি নিজেই হাত কচলাতে কচলাতে মাঝে মাঝে বলতে লাগল, কোনটা বেশি ভালো লাগছে বলুন৷ আরও চারটে করে, তাহলে দিই৷ ভগবান চালের ওপর বলে দিল, ওই রাজভোগ চারটে করে, আর আবার-খাব চারটে করে দিয়ে যাও!
যে আজ্ঞে, বলে দোকানি স্বয়ং সেগুলি পাতে দিয়ে গেল৷
দোকানির আনন্দ আর ধরে না৷ প্রথম বউনির দিন৷ তিরিশ চল্লিশ টাকার মাল বিক্রি হয়ে গেল, সোজা কথা!
খাওয়াদাওয়া শেষ করেই ভগবান আর তার স্যাঙাতরা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে অর্ডার দিলে, এই চারটে করে বেশ ভালো মশলাপাতি দিয়ে পান বানাও৷
পানওয়ালা এদের জানত৷ তাই নীরবে হুকুম তামিল করল৷ ওদিকে মিষ্টিওয়ালা একটা কাগজে চল্লিশ টাকার ফর্দ নিয়ে বাবুদের কাছে দাঁড়াতেই ভগবান ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলে উঠল, ধ্যেত, এটা আবার কী?
দোকানি হাত কচলাতে কচলাতে বলে উঠল, আজ্ঞে, মিষ্টির দামটা-
ভগবান চিৎকার করে বলে উঠল, মিষ্টির দাম! গলা কিটকিট করছে, গা গুলুচ্ছে-শুধু চিনির ডেলা পাকিয়ে মিষ্টি বানিয়ে আমাদের খাইয়েছ, চালাকি! ভাগো হিঁয়াসে! আর বেশি কথা কইলে, এমন একটি লাথি ঝাড়ব যে তুমি তার ঝাপটে কাত হয়ে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকবে৷ আমাকে চেন না৷ আমার নাম ভগবান!
মিষ্টিওয়ালা থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল৷
ওরা পান খেয়ে চলে যেতে, পানওয়ালা দোকানিকে পরামর্শ দিলে, তুমি ভরসা করে রাজার কাছে নালিশ করো, আমি সাক্ষী দেব৷
সন্দেশওয়ালা তখন মনে একটু জোর পেয়েই পরদিন মহারাজ গুড়ুকেশ্বরের কাছে সকাল বেলা গিয়ে নালিশ জানালে৷
গুড়ুকেশ্বর সকাল বেলা তখন সবে রাজদরবারে বসেছেন এমন সময় করজোড়ে সন্দেশওয়ালা জানালে যে পরশু দিন এক খদ্দের আমার দোকানে সন্দেশ রসগোল্লা খেয়ে একটি পয়সা না দিয়ে চলে গেছে৷
সন্দেশ খেয়ে চলে গেছে শুনে রাজামশাই হেহে করে হেসেই অস্থির৷
লোককে সন্দেশ খাইয়েছ, খুব ভালো কাজ করেছ৷ তার দাম দেবে কী৷ সন্দেশ ভালো ছিল, না খারাপ ছিল?
সন্দেশওয়ালা বললে, আজ্ঞে হুজুর, খুব ভালো ছিল, গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছে৷ দামি সন্দেশ খেয়েও পয়সা দেয়নি৷
রাজা বললেন, লোকটা কে?
দোকানি বললে, আজ্ঞে ভগবান৷
খেপে উঠে রাজামশাই বলে উঠলেন, এ্যাঁ! ভগবানের বিরুদ্ধে তুমি নালিশ করতে এসেছ? তোমার এত বড়ো আস্পর্ধা! তোমায় শূলে দেব৷
সন্দেশওয়ালা তো কেঁপে মরে৷ তখন বৃদ্ধ মন্ত্রী বলে উঠলেন, না মহারাজ, সে আসল ভগবান নয়, সে মানুষ ভগবান৷
মানুষ আবার ভগবান হয় নাকি? তাকে নিয়ে এসো কালকে আমার কাছে৷
পরের দিনই বৃদ্ধ মন্ত্রী তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এলেন৷ গুড়ুকেশ্বর ভগবানকে দেখে বলে উঠলেন, হ্যাঁ হে, তোমার নাম ভগবান হল কী করে?
ভগবান বললে, আজ্ঞে আমার বাবা-মা ভগবানকে রোজ ডাকতেন বলে আমি ওঁদের কাছে চলে এসেছি৷ অ্যাদ্দিন তো স্বগগে ছিলুম৷
রাজা একথা শুনে খুব খুশি৷ বললেন, ওঃ আমার কী ভাগ্য তোমার দেখা পেয়ে গেলুম! তুমি বাপু, আমার কাছে থেকো, কে কে ফাঁকি দিচ্ছে তুমি ধরবে৷ এই সন্দেশওয়ালাটা তাহলে মিছিমিছি তোমার নামে নালিশ করেছে, না?
আজ্ঞে না৷ নালিশ ঠিক করেছে৷ আমি পয়সা দিইনি কেন শুনুন৷ ও সমস্ত পচা ছানা দিয়ে সন্দেশ বানিয়েছিল-আমি আর আমার বন্ধুরা খেয়ে বমি করে ফেললুম, তাই দাম দিইনি৷
বটে! ভগবানকে বাজে সন্দেশ দেওয়া, ব্যাটাকে শূলে দাও!
সন্দেশওয়ালা তো ঠরঠর করে কাঁপছে৷
তখন ভগবান রাজাকে বললে, মহারাজ শূলে দেবার দরকার নেই, এখনই আমি চুলের মুঠি ধরে বার করে দিচ্ছি, তাহলেই ভবিষ্যতে আর পচা ছানা দিয়ে মিষ্টি করবে না৷ বলে সত্যি তাকে ওইভাবে বার করে দিলে৷
এরপর থেকে ভগবানের প্রতাপ ভীষণ বেড়ে গেল৷ বেয়ারা চাকরদের খুঁত বার করে সে যখন-তখন সবাইকে ঠেঙাতে লাগল৷
সকলে চটে অস্থির কিন্তু ভগবানের ওপর রাজামশাইয়ের গদগদ ভাব আছে বলে মন্ত্রীরা খুব সতর্ক হয়ে চলতেন৷ এমনকী বৃদ্ধ মন্ত্রীমশাই পর্যন্ত ভয়ে কম্পমান৷
ভগবান মন্ত্রিত্ব না পেয়েও সবার ওপরে৷ সে যা বলে রাজামশাই তখুনি বলে ওঠেন, ঠিক বলেছ৷ একদিন এক ব্যাপারে একজন মন্ত্রী তার অন্যায় কথার প্রতিবাদ করাতে, ভগবান রাজামশাইকে বলে তাকে তাড়ালেন৷
বৃদ্ধ মন্ত্রী মহা চটে গেলেন৷ কিন্তু কিছু বললেন না৷ ভগবান বুঝলে যে বৃদ্ধ মন্ত্রীটা তার ওপর চটেছেন, তাকে অপমান করে তাড়াতে হবে৷
একদিন রাজার সিংহাসনে ভগবান দুটো ছারপোকা চুপিচুপি ছেড়ে দিলে৷ রাজামশাই সিংহাসনে বসতেই, ওরেঃ বাপরে-কী কামড়াচ্ছে!
ভগবান দৌড়ে ছুটে এসে বললে, মহারাজ দাঁড়ান দেখছি, একবার উঠুন তো, কাঁকড়াবিছে কামড়ালে নাকি?
এ্যাঁ! বিছে! সিংহাসনে এল কী করে?
ভগবান রাজামশাইকে উঠিয়ে বলে উঠল, না না বিছে নয় মহারাজ, দুটো ছারপোকা আপনাকে কামড়ে দিয়েছে এই দেখুন, বলে দুটো ছারপোকাকে টিপে মেরে ফেললে৷
রাজা খেপে অস্থির৷ এখানে ছারপোকা এল কী করে৷ যে ব্যাটা ঝাড়পোঁছ করে সে ব্যাটাকে আমি কোতল করব৷ এখানে ছারপোকা আজ এল কোত্থেকে?
ভগবান বললে, আমার মনে হয় আপনার বৃদ্ধ মন্ত্রীমশাই দাড়ি নেড়ে নেড়ে সিংহাসনের পাশ থেকে কথা কন তো, তাই ওঁর দাড়ি থেকে হয়তো কোন ফাঁকে ছারপোকা ঝরে পড়েছে, উনি তা বুঝতে পারেননি বোধ হয়৷
বৃদ্ধ মন্ত্রী এ কথা শুনে রেগে কাঁই৷ চিৎকার করে তিনি বলে উঠলেন, থামো! বড্ড বাড় বেড়েছে তোমার৷ আমার দাড়িতে ছারপোকারা বাসা বাঁধে?
ভগবান মহারাজকে করজোড়ে বলে উঠল, দেখুন মহারাজ, আপনার সামনে উনি চোপা করছেন৷ আমি অন্যায্য কথা বলিনি৷ উনি জন্মে দাড়ি আঁচড়ান না, ক্রমশ সেটা বেড়ে চলেছে৷ এর পরে মাটিতে ঠেকলে হয়তো নেংটি ইঁদুর ঢুকে পড়ে, হঠাৎ দাড়ির জঙ্গল থেকে লাফিয়ে উঠে, আপনার নাকটা খাবলিয়ে দিত৷ তাই আমি, ছারপোকা দাড়ি থেকেই ঝরেছে অনুমান করে আপনাকে জানিয়েছি, এতে দোষটা কী হয়েছে বলুন?
মহারাজ গুড়ুকেশ্বর তামাকের নলটা মুখ থেকে নামিয়ে, ঘাড় নেড়ে বলে উঠলেন, ঠিক বলেছ, অন্যায় বলনি৷ নাপতেকে ডেকে আগে ওই বুড়োটার দাড়ি কামিয়ে দাও তো৷
বৃদ্ধ মন্ত্রী অপমানিত হয়ে তখন একেবারে রাগে কথা কইতে পারলেন না, ইতিমধ্যে ভগবান নাপিত ডেকে বৃদ্ধ মন্ত্রীর দীর্ঘ দিনের দাড়ি কামিয়ে চেহারাই পালটে দিলে৷
মহারাজ হেসে বললেন, বাঁচলাম বাবা, ভগবান ঠিক কথা বলেছে৷ ওই দাড়ি আরও বাড়লে, হয়তো সত্যিই ওই দাড়ির ঝোপে ইঁদুর বাসা বাঁধত৷
বৃদ্ধ মন্ত্রীর এই লাঞ্ছনা হতে রাজবাড়ির সবাই খেপে গেল৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী কাজে ইস্তফা দিয়ে চলেও গেলেন৷ তখন গুড়ুকেশ্বর বললেন, ভগবান, তোমাকে আমি বড়ো মন্ত্রী করব৷ রাজ্য চালাতে পারবে তো?
ভগবান হেসে বললে, আজ্ঞে আমার নাম ভগবান-আসল ভগবানের চেয়ে আমার কায়দা উলটো৷ আপনি পরের মাসে সব মন্ত্রীগুলোকে ভাগান৷ আমার হাতে ভালো লোক আছে৷ তারা আপনার রাজ্যের আয় বাড়িয়ে দেবে৷ রাজা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কাল এনো তাদের৷
ভগবান ঠিক করে ফেললে, ন্যাঙা, ব্যাঙা আর ঢ্যাঙা এদের এনে একদিন এই বোকা রাজাটাকেও তাড়িয়ে আমি সিংহাসনে বসে যাব৷
কিন্তু ইতিমধ্যে ভগবান বুঝতে পারেনি যে সমস্ত মন্ত্রীরা, সেনাপতিরা, রাজবাড়ির প্রহরীরা ভগবানকে আর রাজবাড়িতে ঢুকতে দেবে না৷
পরের দিন ন্যাঙা, ব্যাঙা, ঢ্যাঙাকে নিয়ে পান চিবুতে চিবুতে রাজবাড়ির দরজায় ঢুকতে যাবে, এমন সময় পাহারাদাররা ন্যাঙা, ব্যাঙা আর ঢ্যাঙাকে এমন মার মারলে যে তিনটেই সঙ্গেসঙ্গে রাস্তায় শুয়ে গড়াতে গড়াতে প্রায় খানায় পড়ে মরে আর কি৷ কিন্তু মস্তান ভগবান ওই কাণ্ড দেখে পাঁই পাঁই করে কোথায় যে দৌড় দিলে তার ঠিকানা পাওয়া গেল না৷
ঠিক সেই সময় সেনাপতি মশাই আসছিলেন৷ হঠাৎ ভগবানকে ছুটতে দেখেই জুতোসুদ্ধু, ক্যাঁত করে তাকে একটি লাথি হাঁকড়ালেন৷ ভগবান সামারসল্ট খেতে খেতে একটা পুকুরে গিয়ে ছিটকে পড়ল৷ সেনাপতি চলে গেলেন৷ ভগবান ভয়ে পুকুরটা সাঁতরে একটা তালগাছের ওপর চড়ে বসে রইল তিন দিন৷ বুঝলে ব্যাপার বেগতিক৷
রাজবাড়িতে কান্না উঠল, তারস্বরে সবাই কাঁদতে শুরু করে দিলে৷ সবাই কাঁদতে কাঁদতে রাজামশায়ের কাছে গিয়ে বলতে শুরু করলে, হায়, হায়, ভগবান শেষে পুকুরে ডুবে অপঘাতে মারা গেল মহারাজ!
গুড়ুকেশ্বর তো এ কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলেন৷ কিছুক্ষণ পরে বললেন, কোন পুকুরে ডুবে গেল, চলো দেখে আসি৷
সবাই বললে, আজ্ঞে মহারাজ, কোন পুকুরে ঠিক বলতে পারছি না-তবে রাস্তায় সব বলাবলি করছিল, আহা ভগবান কাল রাত্তিরে ডুবে গেছল৷ তাকে তুলে ভোর রাতে শ্মশানে পুড়িয়ে ফেলেছে৷
রাজা বললেন, এ তো আশ্চর্য কথা, যখন সে ডুবে গেল তখন কেউ আমায় একটু জানাল না? চলো তো জায়গাটা দেখে আসি, বলে পাত্র, মিত্র, মন্ত্রীদের নিয়ে নিজে পালকিতে বসে সেই পুকুরের দিকে চললেন৷
হঠাৎ তালগাছের ওপর থেকে ভগবান রাজা আসছেন দেখে উল্লসিত হয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, মহারাজ, মহারাজ! আমি ভগবান৷ এখানে বসে আছি৷
মহারাজ মুখ তুলে চাইতেই পালকি-বেহারার, মন্ত্রীরা ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল, হুজুর, চলুন, ও মরে ভূত হয়ে এখন তালগাছে বসে আছে৷ আপনি কাছে এলেই হয়তো সড়সড় করে নেমে আপনার কাঁধে চেপে বসবে৷
বল কী! ভগবান শেষে ভূত হয়ে গেল!
মন্ত্রীরা চিৎকার করে বলে উঠল, আজ্ঞে হ্যাঁ, অপঘাতে মরেছে তো?
রাজা বললেন, সত্যিই তো! সন্ধ্যের অন্ধকারে আর এখানে থাকা সুবিধে নয়৷ তাড়াতাড়ি পালকি নিয়ে ছোটো৷
পালকিওয়ালারা ছুটে তাকে রাজবাড়িতে নিয়ে পৌঁছে দিলে৷ দেখা গেল রাজার জামাকাপড় সব ঘামে ভিজে গেছে, পালকির ওপরে চড়ে আর নামতে পাচ্ছেন না, ঠকঠক করে পা কাঁপছে৷ তাঁকে চ্যাংদোলা করে বাড়িতে সবাই নিয়ে গেল৷
রাজার এত ভয় জন্মে গেল যে ভগবানের নাম করলেই চোপরাও বলে তিনি চিৎকার করে উঠতেন৷
দশচক্রে পড়ে ভগবানও ভূত হয়ে গেল৷ ও দেশে তার আর টিকি দেখা গেল না৷
0 মন্তব্যসমূহ