Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

বিষে বিষক্ষয় | আশাপূর্ণা দেবী

কীসে থেকে যে কী হয়।

একথা কে কবে ভাবতে পেরেছিল জগদীশ উকিলের মতন একজন সভ্য, শিক্ষিত ভদ্র ব্যক্তি এমন ভয়ংকর একটা কাজ করে বসতে পারেন। অথচ করলেনও তাই। করালী কবরেজের টিয়াপাখির মতো টিকটিকে নাকটায় হঠাৎ খ্যাঁক করে এক কামড় বসিয়ে দিলেন জগদীশ।

অপরাধের মধ্যে করালী কবরেজ বলেছিলেন, ‘ব্যাধিটি আপনার সামান্য নয় জগদীশবাবু, আমাদের আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এরে কয় “অনিদ্রা ব্যাধি’’।’

ব্যস! বলতে যা দেরি!

হাতের নস্যি হাতেই থাকল, করালীর নাকে আর গুঁজতে হল না। তার আগেই নাকের আগা জগদীশের দাঁতের তলায়।

বহু চেষ্টায় আর বহুজনের হস্তক্ষেপে নাকটা এ যাত্রা উদ্ধার হল বটে করালীর, তবে পরে কী হবে কে জানে। আর এরপর জগদীশের কপালেও কী আছে কে জানে। নাকে রুমাল চেপে শাসিয়ে গেছেন করালী, ‘আচ্ছা আমিও কবরেজের পোলা! দেখি নিমু তোমারে! উকিল আছ তো মাথা কিনছঅ। লোকের নাক খাইবা? বিশ্ব বম্ভাণ্ডে আর খাইদ্য বস্তু নাই?’

কিন্তু জগদীশ এক ফোঁটাও ভয় খান না বরং আগের থেকে গলা চড়িয়েই বলেন, ‘যা বুড়ো, কী করবি করগে যা। তোর মতন কবরেজকে যে ডেকেছি, এই ঢের! বেয়াল্লিশ দিন পরে তুই আমায় রোগ চেনাতে এসেছিস? আমি জানি না এ ব্যাধিরে কী কয়।’

অথচ করালী জগদীশের দাবার আড্ডার বন্ধু।

তা জগদীশকেও দোষ দেওয়া যায় না, গুনে গুনে বেয়াল্লিশটি রাত ঘুম নেই জগদীশের। তার মানে পুরো একটি মাসের ওপর আরও বারো বারোটা দিন। শুধু ঘড়ির দিকে কটমট করে তাকিয়ে তাকিয়ে রাত কাটাচ্ছেন জগদীশ একটির পর একটি।

চিকিৎসার আর কিছু বাকি নেই। অ্যালোপ্যাথিতে হার মেনে হোমিয়োপ্যাথি করেছেন, হোমিয়োপ্যাথিতে ভরসা ছেড়ে টোটকা করেছেন, শুষনি শাকের ঝোল খেয়েছেন, থানকুনির পাতা বেটে গায়ে প্রলেপ দিয়েছেন, হুঁকোর জল মাথায় থাবড়েছেন, রাতে শোবার সময় গরমজলে পা আর বরফজলে কান ধুয়েছেন, বিছানায় শুয়ে শত শত বার এক থেকে একশো গুনেছেন, মাঝরাত্তিরে ডন বৈঠক করেছেন, নাকের মধ্যে শিশি শিশি সরষের তেল ঢেলেছেন, কিছুতেই কিছু না।…

এতেও যদি মানুষ খেঁকি না হয়ে ওঠে তো আর কীসে হবে? কবিরাজি চিকিৎসা দু’চক্ষে দেখতে পারেন না, তাও করাতে গেলেন, পরিণাম ওই।

খেঁকিত্ব বেড়েই গেল আরও।

সকাল থেকে বিকেল সারাবাড়ি তচনচ করে বেড়াচ্ছেন জগদীশ, একে বকছেন, ওকে ধমকাচ্ছেন, এটা ছুড়ে ফেলছেন, ওটা টান মেরে দূর করে দিচ্ছেন, খেতে নাইতে ডাকলে মারতে আসছেন, সাংঘাতিক কাণ্ডকারখানা!

বাড়ির সবাই তটস্থ। কথাটি কইতে সাহস নেই কারওর। তবু আড়ালে-টাড়ালে কেউ কিছু বললে, জগদীশ-জননী নন্দরানি কেঁদে কেঁদে বলছেন, ‘আহা, তোমরা কেউ কিছু বোলো না ওকে। দেখছ না কী ছেলের কী হাল হয়েছে! জগুর আমার নাকের ডাকে গগন ফাটে, মায়ের কোলে ছেলে চমকায়, আচমকা কানে এলে ভয় হয় ধারেকাছে বাঘ গজরাচ্ছে, সেই নাক আজ মাসাধিককাল নিথর নিঃশব্দ। মায়া হয় না তোমাদের?’

বললে কী হবে! মাকেই কি ধমকাতে ছাড়ছেন জগদীশ?

এই তো আজই, যেমন না তিনি ওদের টোস্টে মাখানো মাখন টোস্ট থেকে চেঁছেপুছে তুলে নিয়ে একডালা করে চট করে এসে ছেলের মাথার তালুটিতে বুলিয়ে দিয়েছেন ব্যস! আর যায় কোথা। যেন বিছে কামড়ালো ছেলেকে।

চিৎকার করে উঠলেন ছেলে, ‘আবার মাখন? চুলগুলো বিলকুল উঠে যাওয়া ছাড়া মাখনে আর কিছু লাভ হচ্ছে?’

ছেলের মূর্তি দেখে মা তো দে ছুট।

চুলগুলো দাঁড়ানো আলপিনের মতো খাড়া, চোখ দুটো পাকা-টোম্যাটোর মতো টকটকে লাল, গলার শির তোলা, রগের শির ফোলা। চেঁচাচ্ছেন।

আর চেঁচিয়েই চলেছেন হরদম।

‘এখানে এটা কীসের জন্যে? পায়ের কাছে পাপোশ পড়ে কেন?… মাথার ওপর ফ্যান ঘুরে যাচ্ছে কার দরকারে?… রেডিযোটাকে গাঁক গাঁক করে খুলে না রাখলে গান শোনা যায় না?

…চায়ে এত চিনি চালানো হচ্ছে, মানে কি?’ ইত্যাদি প্রভৃতি।

এমনকী রাস্তায় গোলমাল হলে, ছাতে কাক ডাকলে, কি পাশের বাড়ির ঝি তাদের বামুন ঠাকুরের সঙ্গে চেঁচিয়ে ঝগড়া করলেও জগদীশ পা ঠুকে ঘুসি পাকিয়ে চিৎকার করেন, ‘ভেবেছে কী সব? ভেবেছে কী? দেশে আইন নেই? কোর্টটা একবার খুলুক না, একধার থেকে সব ক’টার নামে কেস ঠুকে দেব।… কোথায় সব? দেখি একবার।’

কেউ সাড়া দেয় না।

সাড়া দিলেই তো ডবল তাড়া খেতে হবে।

তা সাড়া সেও দেয় না, সারারাত ধরে জগদীশ যাকে চড়া গলায় গালমন্দ করে ডাকাডাকি করেন। রাত বারোটা বাজলেই জগদীশের গলার আওয়াজ সারা বাড়িতে গমগমিয়ে ওঠে, ‘ওরে ব্যাটা ঘুম! ঘুমের ছানা ঘুম। পাষণ্ড শয়তান পাজি বদমাশ! কোথায় গিয়ে বসে আছিস? বলি টিকিটি পর্যন্ত আর দেখাচ্ছিস না, এর মানে কী? মরে তো যাসনি! বিশ্বসুদ্ধু সবাইয়ের ঘরেই তো ডিউটি দিচ্ছিস, আমার কাছেই যত ফাঁকি? আমি তোর পূর্বজন্মের শত্রু? জানিস ডিউটি ফাঁকি দেওয়া একটা গুরুতর অপরাধ! আচ্ছা… আমিও দেখে নেব তোকে।’

কিন্তু শেষ রাত্তিরের দিকে সুরটা একটু পালটায়, তখন করুণ গলায় বলতে থাকেন, ‘ও বাবা ঘুম, আমার নয়ন মানিক, চোখের মণি, একটিবারের জন্যে আয় বাবা! তোকে মোটা টাকা বখশিশ দেব—যা চাইবি তাই দেব—’

কিন্তু কোথায় সেই নির্লোভ নিষ্ঠুর ঘুমের ছানা ঘুমটি! নো পাত্তা!

সকাল হতেই আবার হতাশ গলায় তেজ আসে, আবার জগদীশ বাড়ির লোককে তুলো ধোনেন, ছুরি দিয়ে কুচিকুচি করেন, ধরে ধরে ধোপার কাপড়ের মতো আছাড় মারেন।… না না, বেশি ভয় খেয়ো না, এসবই করেন বটে, তবে সত্যি হাতে পায়ে নয়, শুধু কথা দিয়ে।

কিন্তু কথার ধারই কি কম?

কথার জ্বালাই কি সোজা?

তবু এতদিন পর্যন্ত এতটা হয়নি।

সত্যিকার কামড়!

হ্যাঁ, কাল না পরশু কবে যেন ছোকরা চাকর স্বপনকুমারকে কামড়াতে গিয়েছিলেন, তবে সত্যি কামড়াননি। এমনিতে জগদীশ ছোকরাকে খুব নেক নজরেই দেখতেন। ওই যে ছেলেটা সবসময় ফিটফাট ছিমছাম থাকে, কথা কয় সুরেলা গলায়, আর নাম জিজ্ঞেস করলে পুরো করে বলে ‘স্বপনকুমার—’ এটা বেশ পছন্দই করেন জগদীশ, কিন্তু কাল না পরশু হয়ে গেল একখানা। দোষের মধ্যে জগদীশ যখন ওকে সিগারেট আনতে দিচ্ছিলেন, তখন ও বলে ফেলেছিল, “বেশি সিগ্রেট খাবেন না বাবু! একে আপনার এই নিসুপ্তি অবস্থা—’

‘নিসুপ্তি! নিসুপ্তি মানে?’

তেড়ে এসেছিলেন জগদীশ, ‘বল মানে?’ প্রায় কামড়ানোর ভঙ্গিতে।

স্বপন প্রায় কেঁদে ফেলে স্বীকার করেছিল মানে জানে না।

‘তবে বললি যে—’

‘আজ্ঞে আমাদের গেরামে ঘুম না হলে তো ওই কথাই বলে—’ বলে পিটটান দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিল স্বপনকুমার।

কিন্তু করালী কবরেজ পারলেন না নাক বাঁচাতে। নাকটা খেঁদো হয়ে গেল।

যাবেই। সেই টিয়াপাখিটি কি আর থাকবে?

আজ নন্দরানি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন, আর তারপর যখন কাঠ থেকে মানুষ হলেন, তাড়াতাড়ি গুরুদেবকে চলে আসবার জন্যে চিঠি লিখলেন।

বিপদ যখন প্রবল হয়, তখন গুরুই ভরসা!

কিন্তু এ বিপদের কারণ কী?

কেন জগদীশের এ দুরবস্থা?

এ ব্যাধির মূল কোথায়?

তা তা হলে বলতে হয়, মূলে জগদীশের সেই ভুনিপিসি।।

হ্যাঁ, ভুনিপিসিই।

আজ থেকে বেয়াল্লিশ দিন আগে যিনি কালীঘাটে যাওয়ার পথে দু’ঘণ্টার জন্যে এসেছিলেন। কিন্তু তাতে কী? দু’ঘণ্টাই কি কম? আর আসল কাজটি সমাধা করতে তো দু’মিনিটও লাগেনি। ভাইপোকে কাছে ডেকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহঝরা গলায় বলেছিলেন, ‘তোর চেহারাটা তো ভাল দেখছিনে জগু! শরীর ভাল আছে তো?’

‘খুব!’

‘খিদে তেষ্টা হয়?’

‘দারুণ।’

‘রাতে ঘুম ভাল হয়?’

‘সাংঘাতিক।’

‘যাক তা হলেই মঙ্গল। তবে একটি বিষয় সাবধান করে দিই বাছা, রাতে ঘুমুতে গিয়ে কখনও কালো বেড়ালের কথা ভাবিসনে।’

জগদীশ আকাশ থেকে পড়েছিলেন, ‘কালো বেড়াল? খামোকা কালো বেড়ালের কথা ভাবতে যাব কেন?’

ভুনিপিসি দার্শনিকের গলায় বলেছিলেন ‘কেন কথার কি মানে আছে বাবা? ভাবনার কোনও খেই পাবে তুমি? বালিশে মাথা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তো তোমার মাথার মধ্যে নাগরদোলা ঘুরবে। কোথাকার কথা কোথায় চড়বে।… জগতে যত আবোল তাবোল কথা আছে, যত রাজ্যের চেনা অচেনা, না-চেনা নাম-না-জানা সব মানুষেরা এসে উঁকি মেরে মেরে যাবে। জানিনে আমি? তাই বলে রাখছি। কালো বেড়ালের চিন্তাটি বড় খারাপ। ওতে দেহ নষ্ট, মন নষ্ট।’

বোকাসোকা ভুনিপিসিকে জগদীশ চিরকালই একটু ক্ষ্যামাঘেন্নার সঙ্গে ভালবাসেন, তাই আর ওঁর কথায় বাদ-প্রতিবাদ করলেন না, শুধু মনে মনে হাসলেন।

‘আমার যেন আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাই বিছানায় শুয়ে কালো বেড়ালের ধ্যান করতে বসব। এত অদ্ভুত কথাও বলতে পারেন ভুনিপিসি!’

কিন্তু কে জানত, জগদীশের ‘সকল অহংকার ঘুচিবে চোখের জলে’!

ঠিক সেই রাত্তিরেই, বিছানায় শোওয়া মাত্রই সেই ঘটনাটি ঘটল।… জগদীশের চোখের সামনে একটি হৃষ্টপুষ্ট নিকষ পালিশ কালো বেড়ালের চেহারা ভেসে উঠল।

সেরেছে! এটা আবার কী? সত্যি কোনও বেড়াল-টেড়াল আসেনি তো? জগদীশ অবাক হয়ে উঠে বসলেন, এদিক সেদিক তাকালেন; কই কোথাও তো কিছু না।

জল খেয়ে চোখে জল দিয়ে ফের শুয়ে পড়লেন। কিন্তু আবার সেই!

‘ভাল বিপদ হল তো!’

মনে মনে বললেন জগদীশ, ‘কী মুশকিল!’ জোর করে তাড়াতে চেষ্টা করলেন সেই দৃশ্য, কিন্তু আবার, আবার সেই কামান গর্জন!

জগদীশ উঠে পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, আকাশভরা চন্দ্রতারা দেখলেন, ভগবানের নাম (রোজ তেমন না করলেও আজ) করলেন, আবার এসে বালিশ উলটে শুলেন।

কিন্তু কী অদ্ভুত আশ্চর্য কাণ্ড!

আবার সেই!

মনের রাস্তার ডান দিক থেকে বাঁ দিকে চলে গেল। আস্তে আস্তে লেজটি বাঁকিয়ে।

জগদীশ কলঘরে গিয়ে মাথা ধুলেন, অনেকক্ষণ ধরে পায়ে জল ঢাললেন, ফ্যানটাকে জোর করে দিলেন, তারপর শুয়ে পড়ে চোখ বুজে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলেন, ‘চল কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই—’। এই একটা মাত্রই গান জানেন জগদীশ, ছেলেবেলায় ব্রতচারীতে শিখেছিলেন।

জগদীশ বিয়ে-ফিয়ে করেননি, কাজেই গান শুনে ঘরের মধ্যে কেউ হেসে উঠল না, জগদীশ আস্তে আস্তে গলাকে একটু চড়ালেন, ‘ছেড়ে অলস মেজাজ হবে শরীর ঝালাই! যত ব্যাধির বালাই, করবে—’ যাক বাবা, ঠিক ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলা গেছে, এই ঘুমটি এল বলে!…

কিন্তু এ কী! জগদীশের গান শোনবার জন্যে কে এসে সামনে বসে আছে, ল্যাজটি উঁচিয়ে, মুখটিতে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে?

এ তো আচ্ছা বিপদ হল!

হল! সেই থেকে চলল বিপদ! চলে আসছে এই বেয়াল্লিশটি রাত ধরে।… যেই চোখটি বোজার চেষ্টা করেন, সেই একটি কালো বেড়াল সামনে দিয়ে হেঁটে যায়।… তা ক্রমশ আর একটি নয়, দুটি চারটি দশটি। হাঁটছে, চলছে, ঘুরছে ফিরছে। জগদীশের ঘর কালো বেড়ালে ভরে উঠছে।

জগদীশ ওদের চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে দোহাতা হাতি, গন্ডার, বাঘ, সিংহ, ভালুক, বুনো মোষ, দোতলা বাস, সিমেন্ট বোঝাই লরি, বেপরোয়া আমদানি করতে থাকেন, কিন্তু কোথায় কী! ওইসব বিরাটেরা কোথায় উপে যায় কর্পূরের মতো, বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায় শুধু এরা।

এখন বুঝতে পারছেন জগদীশ, ভুনিপিসি কেন বলেছিলেন, কালো বেড়াল ভাবতে নেই, ভাবাটা খারাপ। সত্যি এর থেকে খারাপ আর কী হতে পারে। অথচ সেই ভাবছেনই। জগদীশ আজ জলজ্যান্ত একটা লোকের নাক কামড়ে দিয়েছেন। লোকটা আবার জগদীশের দাবার বন্ধু!

প্রতিকারের উপায় জানতে যে ভুনিপিসির কাছে যাবেন, তারও উপায় নেই। তিনি এখন কেদার বদরী, গঙ্গোত্রী যমুনোত্ৰী, কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঠিকানা জানার পথ নেই।

যাক ভুনিপিসি না এলেও গুরুদেব এলেন।

বললেন, ‘কী সংবাদ?’

নন্দরানি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, ‘সংবাদ আর কী বাবা! ওর মুখেই শুনুন। বল বাবা, তোর কী কষ্ট!’

জগদীশ মাথায় জলের হাত বুলিয়ে দাঁড়ানো চুলকে শুইয়ে, আর চোখে জলের ছাট দিয়ে দিয়ে টকটকে চোখকে গোলাপি করে এনে মায়ের গুরুদেবকে প্রণাম করে দাঁড়িয়েছিলেন, এখন মায়ের নির্দেশে গম্ভীরভাবে বলেন, ‘কষ্ট কিছুই না। শুধু গোটাকতক কালো বেড়াল!’

‘কালো বেড়াল!

মা শিউরে বলেন, ‘কোথায়?’

জগদীশ নিজের মাথাটা দেখিয়ে দেন।

গুরুদেব মৃদু হেসে বলেন, ‘বুঝেছি।’

‘বুঝেছেন? কী বুঝলেন?’

‘বুঝলাম, উৎপাত বাড়িয়েই চলেছে, তাড়ান দরকার।’

নন্দরানি কঁদো কাঁদো হয়ে বলেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা।’

গুরুদেব স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘পারবে মা পারবে। পরে সব বলছি, এখন তাড়াতাড়ি একটু হোমের ব্যবস্থা করে দাও। ও ক’টাকে আহুতি দিয়ে ফেলতে হবে।’

জগদীশ বসে পড়ে বলেন, ‘পারবেন প্রভু?’

গুরুদেব একটু অলৌকিক হাসি হাসলেন।

তারপর সারাদিন ধরে যাগযজ্ঞ হোম। নন্দরানি উপবাস করে আছেন, জগদীশও প্রায় তাই। শুধু সকালে একটু চা টোস্ট, দুপুরে একটু দুধ চিঁড়ে, আর বিকেলে একটু কেক বিস্কুট আর চা।

সন্ধ্যাবেলা গুরুদেব একটি মাদুলি হাতে নিয়ে বললেন, ‘হোমভস্ম-ভরা এই মাদুলিটি রাত্রি এক প্রহরের সময় ধারণ করবে, দেখবে অব্যর্থ!’

‘তারা আর আসবে না? ল্যাজ দুলিয়ে, গাল ফুলিয়ে?’

‘কোথা থেকে আসবে? আমি তো তাদের হোমাগ্নিতে আহুতি দিয়ে দিয়েছি।’

জগদীশ গুরুদেবকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে বলেন, ‘মাদুলির নিয়মটিয়ম?’

‘কিছুই না। শুধু—’

‘শুধু কী গুরুদেব?’

গুরুদেব একটুখানি রোমাঞ্চময় হাসি হেসে বলেন, ‘শুধু ধারণের পূর্বে অন্তত বিছানায় শোবে না, আর হাই তুলবে না। হাই তুললেই মাদুলি ধারণ নিষিদ্ধ।’

জগদীশ গম্ভীর হলেন, গুরুদেব বলেই একটু সাধুভাষা ব্যবহার করলেন। বললেন, ‘গুরুদেব কি আমার সঙ্গে পরিহাস করছেন?’

‘কী বলো বৎস! তোমার সঙ্গে কি আমার পরিহাসের সম্পর্ক?’

‘তবে ওই নিষেধটি কেন? জানেন আজ একমাস চোদ্দোদিন জগদীশ হতভাগা “হাই” কাকে বলে জানে না। “হাই”-এর মানে ভুলেছে, বানান ভুলে গেছে।’

মৃদু হাসি হাসেন গুরুদেব৷

বলেন,‘তা হলে তো ভালই।’

গুরুদেবের খাতিরে দেদার ক্ষীর রাবড়ি, ছানা মাখন, সন্দেশ রসগোল্লা, গুঁজিয়া প্যাঁড়ার আমদানি হয়েছিল, তার কিছুটা শেয়ার নিয়ে জগদীশ ঘড়ি হাতে বেঁধে বিছানায় বসলেন। এখন ন’টা। ঠিক দশটায় মাদুলিটি ধারণ করবেন।

মনে বড় আনন্দ।

একটা অব্যর্থ ওষুধ পেয়ে গেছেন।

দশটা বাজলেই লাল সুতোটা গলায় গলিয়ে শুয়ে পড়া।

কিন্তু কী সর্বনাশ!

এটা কী হল!

স্পষ্ট পরিষ্কার আস্ত সুস্থ একটি হাই উঠল না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই, সত্যিকার একটি গোলগাল হাই।

মাদুলি ধারণ হল না। জগদীশ অবাক হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর ভাবলেন, ঠিক আছে, আর-একটা ঘণ্টা পরেই পরা যাবে। দৈবাৎ একটা হয়ে গেছে, কী আর করা।

কিন্তু এ কী?

এটা কী সর্বনেশে ব্যাপার!

আবার! আবার! মুহুর্মুহু! হাঁ না বুজতেই আবার হাই! যতবার ঠিক করছেন এবার একটা ঘণ্টা খুব অবহিত হয়ে বসে থেকে— ততবারই ওই একই ঘটনা। একঘণ্টা তো দূরের কথা, দশটা মিনিটও ফাঁকা পাচ্ছেন না।

এদিকে ঘড়ি এগিয়ে চলেছে।

জগদীশের চোখ জুড়ে আসছে, ঘন ঘন হাইয়ের দরুন শরীর বিছানায় গড়িয়ে পড়তে চাইছে, শুতে পাচ্ছেন না, মাদুলি ধারণ না করে শোবার হুকুম নেই।

জগদীশ উঠে পড়েন, পায়চারি করেন, জল খান, চোখে মুখে জল দিয়ে আলস্য তাড়ান, জোরে জোরে গাইতে থাকেন, ‘কোদাল চালাই, ভুলে মানের বালাই—’

কিন্তু কথা জড়িয়ে যায়।

গুরুদেবের ভোরে ব্রেকফাস্টের অভ্যাস!

নন্দরানি অন্ধকার থাকতে উঠে ফল কাটছেন, মাখন মিশ্রী গোছাচ্ছেন, হঠাৎ হাত থেকে রুপোর রেকাবিটা পড়ে গেল ঝনঝনিয়ে, নন্দরানি শিউরে উঠলেন। গুরুদেবও মালা জপতে জপতে থমকে গেলেন, কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘মা নন্দরানি, তো-তো-তোমাদের এদিকে কি বাঘটাঘ বেরোয়?’

ততক্ষণে নন্দরানি ধাতস্থ হয়েছেন, রেকাবি তুলে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুতে ধুতে বলেন, ‘দর্জিপাড়ার গলিতে আর বাঘ বেরোবে কোনখান থেকে বাবা? ও অন্য শব্দ।’

গুরুদেবের থালায় এককুড়ি সন্দেশ চাপালেন নন্দরানি, মিশ্রীর সঙ্গে হাফ কিলো মাখন।

এদিকে বাড়ির সকলেরও অনেক দিনের অনভ্যাস! আজকেরটা ধরলে দেড়টা মাস। সকলেই ওই “অন্য” শব্দের ধাক্কায় সুখসুপ্তি ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে এই ঘরেই এসে জড়ো হয়, আর অভয় সভক্তিতে একে একে গুরুদেবকে প্রণিপাত করে, সোজা সাষ্টাঙ্গে।

মায় স্বপনকুমারও।

তবে সে একটু ঘুমকাতুরে, তাই দাওয়ার ধারে বসে চোখ রগড়াতে থাকে, আর একটির পর একটি হাই তুলতে থাকে।

ওদিকে শব্দ বাড়তেই থাকে।

ভীম গর্জনে!

বিপুল পুলকে!

ধাপে ধাপে, ঝলকে ঝলকে।

জগদীশের ছোটভাই অবনীশ চাপা গলায় বলে, ‘অনেকখানি গ্যাপ দেওয়ার দরুন তেজটা যেন বেড়েছে মনে হচ্ছে।’

ছোটভাইয়ের বউ রেখা আরও আস্তে বলে, ‘আমাদের ঘুমের আবার বারোটা বাজল।’

‘বাজুক! কার কোথায় কীসে বারোটা বাজছে, তা দেখে আর কে সংসারে ঘুরছে?’

সে শব্দ থামল বিকেলের দিকে।

গুরুদেব যখন আহারাদি করে, বিশ্রামান্তে বাড়ি ফেরার তাল করছেন।

জগদীশ তাড়াতাড়ি নেমে এসে লজ্জিতভাবে প্রণাম করলেন।

গুরুদেব হাসিমুখে বললেন, ‘কী? তারা আর উৎপাত করতে এসেছিল?’

জগদীশ চমকে উঠে সারারাতের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে নিয়ে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কই? না তো।’

‘বেশ বেশ! বিষে বিষক্ষয়! তা মাদুলিটা ধারণ করেছ তো?’

জগদীশ মাথা চুলকে বললেন, ‘কই আর? এমন একখানা কড়া নিয়ম দিলেন!’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ