আমি যেন ভিনদেশে বিনা পাসপোর্টে ঢুকে পড়েছি। শরীরে অজানা শিহরণ। বগলে রোল করা গোলাপি ইয়োগা ম্যাট, আরেক হাতে মামের বোতল। সালোয়ার-কামিজ পরনে রিকশা থেকে লাফিয়ে নামি। এখানে ভারতীয় হাইকমিশনের অফিস ছিল যখন, লোকে থিক থিক করত। ভোর থেকে ভিসার লম্বা লাইন। সে পাট চুকে যাওয়ার পর গেটের ডান হাতায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের তকমা ঝোলানো হয়েছে, তা-ও বছর দশেক হবে। গাড়িবারান্দা থেকে দুই ধাপ উঠতেই সামনের রোয়াকে বীণা হাতে সরস্বতী, দুই ধারে দুটি শুভ্র হংস ডানা মেলে ওড়ার ভঙ্গিতে গ্রীবা তুলে দিয়েছে। খুশিতে মনটা নেচে উঠল। আমারও যেন পালকে হাওয়া লেগেছে, সিঁড়ি বেয়ে উঠছি নেচে নেচে। দেয়ালজুড়ে ফ্রেমবন্দি ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ার নানা স্থিরচিত্র। মুখোশ পরা আর উদ্ভট সাজগোজের নানা রঙের মানুষ। আর কত কত মেলা আর জাঁকালো উত্সব! নৃত্যরতা নারী মাথার পেছনে হাত রেখে কদমফোটা বুক ঠেলে দিয়েছে সামনে। তাম্বুলরসে রাঙানো ওষ্ঠে মাপা হাসি। চোখে বিলোল কটাক্ষ। বালা, কে গো তুমি, এমন সুন্দর সাজে নাচ করো! নিচের হলঘর থেকে ভেসে আসে তবলার বোল, নূপুরের রিনিঝিনি, সঙ্গে গান—‘আমরা চঞ্চল আমরা অদ্ভুত/আ-ম-রা নতুন যৌবনেরই দূত।’ শিশুকণ্ঠের কোরাস সঙ্গীত।
দোতলার দুয়ার ঠেলে ঢুকতেই নাচ-গান হারিয়ে গেল। খানিকবাদেই ইয়োগা ক্লাস শুরু হবে। বন্ধ ঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমার মতো ভঙ্গুর, পোড় খাওয়া কজন নারী। শরীর সারাতে এসেছে বা মনের সংহতি দরকার হয়তো কারো কারো। অদূরে দাঁড়ানো টাকমাথা পুরুষ দুটির অবস্থা আরো বেহাল। সারা গায়ে যেন পানি নেমেছে, আর হাঁসফাঁস করছে গরমে। এসব আধমরার ছোঁয়া বাঁচিয়ে এক সদ্য তরুণী রোল করা ম্যাটে চিবুক ঠেকিয়ে করিডরের আরেক প্রান্তের রেলিংয়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ট্রাউজার, টি-শার্ট কালো রঙের—অবিকল ভুজুঙ্গা, ধনুরাসনের মডেলকন্যার গড়নের শরীর, পোশাক। আমি অচেনা ভঙ্গুর নারীদের ভিড়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরা যেন বাপের বাড়ি বেড়াতে আসা আপন মায়ের পেটের বোন, কেমন অকপটে সুখ-দুঃখের কথা কইছে। ‘ইউরিক এসিড বাড়ছে তো, আপনার আর্থ্রাইটিস হবেই হবে।’ যে কথা কইছে, তার চেহারাটা মনে হলো চেনা-চেনা। টিভিতে খবর পড়ে খুব সম্ভব। সে যার আর্থ্রাইটিস হবে তাকে ‘লাউ-পেঁপের ঝোল’ খেতে বলল। আমি মনে মনে টুকে নিলাম। কী পোশাক পরে ইয়োগা করা সমীচীন—সেই ভাবনা দূর হয়ে গেল সংবাদপাঠিকার ঢিলেঢালা সালোয়ার-কোর্তা দেখে। শরীরটাও তার আমার চেয়ে দ্বিগুণ। টিভিতে শুধু মুখ দেখা যায়, ধড়ের আন্দাজ করা যায় না। যাক, আয়রনম্যান শ্রীনীলমণি দাশের ‘ব্যায়াম স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য’ দেখে গোটা কয় আসন মকশ করে এসেছি। ইউরিক এসিড, আর্থ্রাইটিস, ব্লাডপ্রেসার নিয়ে আর সবাই পারলে আমি পিছিয়ে থাকব কেন।
‘জায়গাটা তোরে জাদু করছে!’ আলেয়া পর পর দুই দিন বাসায় না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘হপ্তায় তিন দিন ক্লাস, তুই কি রোজই যাস?’ ফোনের ওপর কী করে বলি, ‘যা ভাবছ তা নয়, আমি গানের ক্লাসেও ভর্তি হয়ে গেছি’, তা-ও এমন একজনকে, যে জানে আমার দৌড় ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ পর্যন্তই! আলেয়া আর আমি গলা ধরে মঞ্চের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে গানটি গেয়েছিলাম স্কুলের হেডস্যারের বদলি উপলক্ষে। সেদিন নেচেও ছিলাম দল বেঁধে। আমরাই নাচছি, আমরাই গাইছি—‘ওগো নাইয়্যা ধীরে চালাও তরণী’, হাতে রঙিন কাগজে মোড়ানো ছোট ছোট কঞ্চির দাঁড়, পায়ে ঘুঙুর। সবে সামনের দুধদাঁত দুটির জায়গায় বিস্তর ফাঁক রেখে কোদাল-মার্কা দন্ত গজিয়েছে। নাচ-গানের মধ্যিখানে আমার হাসি পেয়ে গেল। আমি কঞ্চির দাঁড় ফেলে দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম, যাতে বিকট দন্তযুগল বিকশিত হতে না পারে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুঙুরের বাজনা গেল থেমে। আমার একার জন্য গোটা দল নাজেহাল হলো। নাচ-গানেরও ইতি সেখানে। এরপর যদিও কোদাল-দন্ত মসৃণ হয়ে হাসিতে বকুল ফুল ফুটেছে, নাচ-গানের সুযোগ জিন্দেগিতে আর আসেনি। আমি আলেয়াকে হাসতে হাসতে বলি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একেই বলে গুরুমারা বিদ্যা। রোজ রোজ যোগব্যায়াম করে আমি যোগিনী হব—দেখি কে ঠেকায়!’
আসলে গান-টান কিছু নয়; বিকালটা আমার কাটতে চায় না বলে যোগব্যায়ামে যাই, গান শিখি। একই হাটে রথ দেখা কলা বেচার সুবিধা অনেক, জায়গাটা যদি মনের মতো আর অনাবিল হয়। শুক্রবার ছাড়া বাকি ছয় দিন কলেজ থেকে সটান ধানমণ্ডি দুই নম্বর। ঝড়বাদল, হরতাল-ধর্মঘট, কলিগের বাচ্চার জন্মদিন কী মরা আত্মীয়ের কুলখানি—কোনো কিছুই আমাকে রুখতে পারে না। এখন ইয়োগার দিন ব্যাগে থাকে সালোয়ার-কোর্তার বদলে কালচে মেরুন ট্র্যাকস্যুট, মাথায় বাঁধার রঙিন সিল্কের স্কার্ফ। ড্রেসিংরুমে ঝটপট কাপড় বদলে লম্বা করিডর ধরে অনভ্যস্ত পোশাকে পা টিপে টিপে চলি। হাতে বিস্তর সময়। আমার দু’ধারে অবিশ্বাস্য ভারত সিরিজের সারি সারি ছবি...
জঙ্গল সাফারি ইন সানসেট। বাহ্ সূর্যাস্তের রং এমন বেদানার রসের মতো রাঙা হয়! যেন রক্তাক্ত প্রান্তরে হাতির পিঠে সওয়ার মানুষগুলো আবিরে চোবানো, অপার্থিব। কিংখাবের গদিতে বসে দুলতে দুলতে অস্তগামী সূর্যের পথ ধরে চলেছে। পদতলে কদলীবন মিসমার। পাশেই বরফের টোপর পরা লাদাঘের পর্বতগুহা। আমি রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছি। আমার আর আমার স্বামীর একবার কোরবানি ঈদের ছুটিতে কাশ্মীর যাওয়ার কথা ছিল। সে বছরই পাহাড়ের সুড়ঙ্গপথে বরফ-চাপা পড়ে এক ট্রেন বোঝাই যাত্রী নিকাশ হয়ে গেল। তা ছাড়া ভূ-স্বর্গ লাগাতার জঙ্গ-ফ্যাসাদে গুলজার। আমাদের আর যাওয়া হলো না। আমি হাত লম্বা করে কাচের ওপর দিয়ে তাজমহলের শুভ্র মর্মর একটুখানি ছুঁয়ে দেখি। এটি পতির পত্নীপ্রেমের সর্বকালের সেরা নজির। আগ্রার রেডফোর্টের যে কামরায় শাহজাহান নজরবন্দি ছিলেন, এর বাতায়ন থেকে তাজমহল পরিষ্কার দেখা যায়। মধ্যিখানে আলকাতরা-রঙা যমুনার ক্ষীণ ধারা। কুলভাঙা খরস্রোতা নদীর এ হাল কী করে হলো! সময় বড় সাংঘাতিক জিনিস। পেছনে প্রহরারত তাতারনিদের চোখরাঙানি নেই। নেই কোমরে ভোজালি গোঁজা খোজার দল। কতগুলি ছাইরঙা কবুতর আঙিনায় ওড়াউড়ি করছে। জায়গায় জায়গায় ট্যুরিস্ট গাইডদের তুখোড় চাপাবাজি ছাপিয়ে কানে আসে বাকবাকুম বাকবাকুম কবুতরের আহ্লাদী স্বগতোক্তি। কোথাও আমাদের গাইড ভাড়া করার জরুরত হতো না। সে রোল নিতাম আমি, ইতিহাসের মাস্টারনি। আমার স্বামী হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা করে বসে পড়েন সম্রাটের খোলা বাতায়নপাশে। যমুনার উদাসী হাওয়ায় ওর চুল ওড়ে। পত্নীহারা বাদশা শাহজাহানের মতো বিষণ্ন, তন্দ্রালু দৃষ্টি। আমি পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি খিঁচি। মানুষ নাই। তাজমহলে দৃষ্টি-নিবদ্ধ মূক ছবিটি টেবিলের স্ট্যান্ড থেকে আজ কত কথা বলে! ওর কেন, আগে চলে যাওয়ার কথা ছিল তো চিররুগ্ণ আমার—আমি ভাবি। হয়তো ওরও ভাবনা ছিল তা-ই।
সেদিন মুঘল সম্রাজ্ঞীর সমাধির গিলাফে পয়সা ছিটিয়ে আমরাও এক ভ্রাম্যমাণ ছবিওয়ালার ক্যামেরার সামনে নবদম্পতিদের মতো পোজ দিয়েছিলাম। যেন যুগল ছবি না ওঠালে এ প্রেমতীর্থে আসাটাই বৃথা। ‘বি ক্লোউজ, স্মাইল স্মাইল’, লোকটার হুকুম পুরোপুরি তামিল করা না গেলেও আমার স্বামী আমার কাঁধে হাত রেখে মাথাটা কাত করে দাঁড়িয়েছিল, তাজমহল আর সারবাঁধা সাইপ্রাস বৃক্ষ পেছনে রেখে। আমি ঘোমটা-মাথায় কালো চশমার ডাইনি বুড়ি। কড়া রোদে কপালে ভাঁজ ফেলে লেন্স-বরাবর তাকিয়ে আছি। ছবিটা অ্যালবামের অন্য ছবির তলায় বহুদিন চাপাই ছিল। তুলে দেখি, গায়ে সিপিয়া রঙ লেগে অ্যান্টিকের গরিমা লাভ করেছে।
‘আপা লেগে থাকেন। মনে সংকল্প থাকলে গলা কোনো বাধাই না।’ তবলচি ছোড়া বড্ড বাচাল। আমি ওর কথায় পাত্তা দিই না। কোরাসে গলা মেলাই—‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদেরই বসুন্ধরা’ বা ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’। পুরনো কালের দেশাত্মবোধক গান। তাতে কি! বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়ের সারিতে বসে সারেগামা করতেও আমার লাজলজ্জার বালাই নেই। আমি তো জানি এখানে রোজ কেন আসি। মোটা পর্দার টিচার্স রুমের পর এ যেন চোরকাঁটাহীন খোলা প্রান্তর। সামনের দাঁতের ফাঁক দেখে কেউ বলতে আসে না, অকাল বৈধব্য আমার কপাললিখন ছিল। এখানে চেনা কেউ থাকলেই তো আমার নাকের বাম পাটায় হীরার ঝলকানিতে তার চোখ টাটাবে! আমি অচেনাদের ভিড়ে বিলি কেটে কেটে গাছের ঝরাপাতার মতো আলগাভাবে চলি। সময়টা কোন দিক দিয়ে কেটে যায়, নিজেও টের পাই না।
আমার শুক্রবারের দিনটা যেন উত্তর মেরুর গ্রীষ্মের দিনের মতো দীর্ঘ, ফুরাতেই চায় না। রাতটাও পাহাড়চাপা দিয়ে যায়। আজ এর ব্যত্যয় ঘটল। গত চার বছরে আমাদের সাদা টয়োটা মাত্র দুবার ওয়ার্কশপে গেছে। গ্যাসও খরচ হতো কম। আজ সকালে ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে চাচাতো ভাই ইমরান একে গাড়ির হাটে নিয়ে গেল। আমি বারান্দা থেকে সরে আসি। আমার কলেজ, ইয়োগা ক্লাস রিকশার দূরত্বে। এ দুটি জায়গা ছাড়া আমি তো আর কোথাও যাই না। এ ছাড়া গাড়ি রাখতে গেলে মাস মাস ড্রাইভারের যা বেতন, তা আমার আধেক মাইনের কাছাকাছি। জুমার আগ দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে ইমরান হাজির। জাপানি গাড়ির এ এক গুণ—কেনা দামেই বিকিয়েছে। লোকসান শুধু বড় বড় মানকচুর ঝাড়ের ধারে আমাদের গ্যারাজের বরাদ্দটুকু শূন্য হয়ে গেল।
তখনো অর্ধেক দিন, গোটা একটি রাত বাকি। ঘরে পরীক্ষার খাতার পাহাড় জমে গেছে। কেউ দাওয়াত দিতে এলে, আমি তাকে থরে থরে খাতার বান্ডিল দেখাই। বলি, ‘মরার টাইম নাই ভাই। একা মানুষ কত দিক সামলাব!’ তারা মনে মনে ভেংচি কাটলেও মুখের ওপর ঘাঁটায় না। কিন্তু আমার এ বেসাতি আর কত দিন! এ দণ্ডে ফলাফল না জানালে ছাত্রছাত্রীরা দেয়ালে পোস্টার মারবে আমার নামে। অগত্যা জানালার ধারে টেবিল টেনে খাতা কাটতে বসি। এ কাজে আমি যেন বেমানান, বারান্দার রেলিং থেকে তারস্বরে চেঁচায় একটি মিশমিশে দাঁড়কাক। কী সাহস, একদম চোখে চোখ রেখে লম্বা পুচ্ছ নামিয়ে! একে তাড়িয়ে ফ্রিজ থেকে কাঠি-আইসক্রিম বের করি। এ রকম হাফ ডজন লাগবেই এক বান্ডিল খতম করতে। কুড়মুড়িয়ে বরফ ভাঙতে ভাঙতে জিব যত অসাড় হবে, কলমের আগারও তত ধার বাড়বে। ফর্মুলাটা আমার স্বামীর।
কলেজের চাকরির আর সব ভালো, আমার স্বামী বলত—এই খাতা কাটা ছাড়া। পাশের বাড়ির গাড়িবারান্দার ছাদে ডিশের লোক কাজ করছে। জড়ানো-মড়ানো গুচ্ছের তার। আমার দুই মাসের বিল বাকি। ওদিক থেকে কাকটা উড়ে এসে ফের রেলিংয়ে বসেছে। রাগী মানুষের মতো মাথার চুল কাঁটা কাঁটা। এবার আর চেঁচায় না। ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে গরগর আওয়াজ করে। ভূয়োদর্শন তো কম হলো না! আমি নাক থেকে চশমা নামাই। রেলিং ছেড়ে বারান্দায় লাফিয়ে নামেন মাননীয় ভূশণ্ডি। তারপর হেলে-দুলে ঘরে ঢোকেন। ছোটবেলায় গল্প শুনেছিলাম, এক দেশের এক মেয়ে সতিনের হাতে কাকের মাংস খেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিল। আমার খাপরা চালের বস্তিবাড়ির সেই মেয়েটির চেহারা কিছুতেই মনে পড়ে না।
ভাগ্যিস, আজ গানের ক্লাস ছিল। আমার পরনে টাঙ্গাইল তাঁতের সাদা-সবুজ ডুরে শাড়ি, লম্বা হাতার কালো ব্লাউজ। রিকশা থেকে দেখি, গেটের সামনে আমার ভাশুর সাবের আলম কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখছেন, গার্ডের লম্বা বেঞ্চিতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের লাইন করে বসিয়ে দিয়ে। আমি মনে মনে জিব কাটি। আজ যে আমার স্বামীর মৃত্যুদিন মনেই ছিল না। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী, সারা দিন কোন ঘোরে ছিলাম! ‘আমরা ধরেই নিছিলাম আজকের দিনে তুমি বাসায় থাকবা। যাক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নাই।’ ভাশুরের ফোন না করে আসার কৈফিয়তের কী জবাব দেব আমি, আমার ভাষা নেই। মুখ নামিয়ে তার ষোড়শী কন্যার চিবুক ছুঁয়ে চুমকুড়ি দিলাম। সবাই উঠে দাঁড়াল।
ওরা কে কী ভাবছে জানি না, তবে আমি যে স্বামীর মৃত্যুদিবস ভুলে গেছি, তা আশা করি ভাবছে না। শোকের দিন। ভাশুরের দুরন্ত বালকপুত্রটিও মুখ গম্ভীর করে ঘরে ঢুকল। আমি ত্রস্ত হাতে আগরবাতি জ্বালিয়ে স্বামীর ছবির নিচে রাখলাম। চিকন ধুমায় মুখটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কাকে কী খেতে দিই! মাথার ভেতরটা ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ থইথই, ফর্সা। রান্নাঘরে পা বাড়াতে দরজায় কলবেল বেজে ওঠে। দেওর নাফিস ঘরে ঢোকে হন্তদন্ত হয়ে। ‘ভাবী, মিলাদের আয়োজন করেন নাই?’ বলে ভাগ্যকূলের দুটি মিষ্টির প্যাকেট সশব্দে টেবিলের ওপর রাখল। সব দায়িত্ব কি আমার একার! আমার ওপর বন্ধ্যা নারীর দায়ভার চাপিয়ে ভাইকে তো ওরা বিয়ে করাতেও চাইছিল। এই নাফিস, ডিভোর্সি শ্যালিকাকে গছাতে হন্যে হয়ে উঠেছিল। এদিক থেকেও তালি বেজেছিল কি না জানি না। তবে এ নিয়ে জা কুসুমের সঙ্গে আমার একচোট হয়ে গেল একদিন। আজ অফিস থেকে একাই এসেছে নাফিস। কুসুম আসতে পারত আমার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত। ডিভোর্সি মেয়ের ফের বিধবা হওয়া—বোঝার ওপর শাকের আঁটি। ভাতারখাকি উপাধিও জুটে যেত। আমি রুখে দাঁড়িয়েছিলাম বলেই না আরেকটা ক্ষণস্থায়ী বিবাহের হাত থেকে রক্ষা পেল মেয়েটা!
আমার সামনেই মৃত্যুবার্ষিকীর মিলাদ নিয়ে দুই ভাইয়ে খিটিমিটি লেগে গেল। দুজনই চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যস্ত। অর্থেরও টানাটানি। আমার স্বামীই ছিল তুলনায় সচ্ছল। ভাগ্যিস, ফ্ল্যাটটা আমার নামে। না-হয় কবে কামড়াকামড়ি লেগে যেত! নাফিস তো ঘরে ঢুকে এখনো কুকুরের মতো দেয়ালের গন্ধ শোঁকে।
আমি চা নিয়ে ফিরে দেখি দুই ভাইয়ে রফাদফা হয়ে গেছে। দুজনের নজর আমার সদ্য কেনা হারমোনিয়ামটায়, যা ডিভানের তলা থেকে কে যেন টেনে বের করেছে। বাটিকছাপের ঢাকনাটাও উধাও। বাদ্যযন্ত্রটা না, যেন নাঙ্গা করা হয়েছে আমাকেই। আমি স্বরূপে ধরা পড়েছি। আর তামাশা দেখছে দুটি জোয়ান লোক। আমি নীরবে ফুঁসতে থাকি। আমি বাইরে গিয়ে গান শিখি, নাচি—তাতে কার কী! আমি কারো খাই না পরি! আমার ঠাণ্ডা মেজাজের বড় জা মনোযোগ দিয়ে জিটিভিতে সুবর্ণলতা দেখছেন। একজন শাশুড়ি বউ-ছেলের ওপর কাঁহাতক ছড়ি ঘোরাতে পারে! চেঁচাচ্ছে যে হারে, এত দিনে গলার তার ছিঁড়ে যাওয়ার কথা। জেহাদি পুত্রবধূ সুবর্ণলতার আধো-আধো বোল আরো অসহ্য।
বাদ এশা পাড়ার মসজিদেই মিলাদ পড়ানো হবে। সবে আজান দিয়েছে। আমি এক কাঁড়ি টুপি টেবিলের ওপর রাখলাম। একটা লক্ষ্ণৌ কাজের গোলটুপি নাফিসের মাথায় আঁটসাঁট বসে গেছে। মায়ের পেটের ভাই, অথচ আমার স্বামীর তুলনায় ভাশুরের প্রায় কেশহীন টাকমাথাটা ভয়ানক ছোট। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কায়দা করে মাথায় বাঁধলেন। এক নিমেষে বয়স দশ বছর নেমে গেল। বড় একটা কাচের গামলায় ভাগ্যকূলের প্যাকেট দুটি খালি করে জিলাপি ভরা হয়েছে। ওপরে কুশিকাঁটা কাজের সাদা ঢাকনা। নাফিস গামলা হাতে দরজার দিকে আগ বাড়ে। পেছনে ভাশুর ও ভাশুরপুত্র।
আমি দরজা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, ভাশুর-ঝি শারমিন ওড়নার তল থেকে একটি লালগোলাপ আমার হাতে দেয়। আহা বেচারা! এমন সরল-সোজা মেয়ে যে, বিয়েবার্ষিকী আর মৃত্যুবার্ষিকীর ফারাক বোঝে না। আমাদের আঠারোতম বিবাহবার্ষিকীতে ও এমনই একটা গোলাপ উপহার দিয়েছিল, ওদের ছাদের বাগানের। আর চৌদ্দ দিন বাদে কুড়িতম হবে। এর আগেই সব শেষ। আমার চোখ দুটি মরিচ-ফোঁটা দেওয়ার মতো জ্বালা করে ওঠে। শারমিনকে বুকে চেপে ধরলাম। ওর মাথার তালুতে আমার থুতনি রাখা। জায়ের দিকে পিঠ দিয়ে আমি কাঁদছি। কেউ যেন না দেখে—স্বামীর মৃত্যুদিনে আমার বিলম্বিত ক্রন্দন।
0 মন্তব্যসমূহ