ঢাকায় এসে আমি একেবারে বেকুব হয়ে গেলাম। কোথাও মিলিটারির কোন চিহ্ন নাই, দোকানপাট খোলা, গাড়ি চলছে, বাস চলছে, রাস্তাঘাটে মানুষজনের ভিড়। ছোট ছোট বাচ্চারা গল্প করতে করতে স্কুলে যাচ্ছে, দেখে কে বলবে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। অথচ ঢাকার বাইরে কী অবস্থা! ট্রেনে এসেছি আজ, ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসতে লেগেছে এগারো ঘণ্টা, গৌরীপুরে চার ঘণ্টা ট্রেন দাঁড় করিয়ে রাখল। শুধু কি তাই? মাঝখানে হঠাৎ এক জায়গায় থামিয়ে দুইজন মিলিটারি চারজন মানুষকে টেনে বাঁশঝাড়ের পিছনে নিয়ে গেল। গুলির শব্দ হলো কয়েকটা—তারপর মিলিটারিগুলো সিগারেট টানতে টানতে ফিরে এলো। সত্যি কথা বলতে কী সবার সামনে গুলি করে বসেনি বলে আমার মিলিটারিগুলোর প্রতি এক ধরনের কৃতজ্ঞতা বোধের জন্ম হয়ে গেল। ভয় যে হচ্ছিল না তা নয়। বেশি ভয় পেলে আমার আবার বাথরুম চেপে যায়, ট্রেনের বাথরুমের যা অবস্থা যাওয়ার উপায় নাই, চেপে বসে রইলাম। মনে হতে লাগল কেন খামাখা বের হতে গেলাম, বাড়িতে থাকাই তো ভাল ছিল।
কিন্তু বাড়িতে থাকি কেমন করে? প্রথম প্রথম এক দুইদিন একটু পিকনিক পিকনিক মনে হয়। তারপর মহা যন্ত্রণা। ভাল সিগারেট নাই। চা পাওয়া যায় না, যদি বা চা জোগাড় করা যায় খেতে হয় গুড় দিয়ে। টানা পায়খানায় পুকুর থেকে পিতলের বদনা ভরে নিয়ে যেতে হয়—মহা যন্ত্রণার ব্যাপার। আশপাশে যত মানুষ আছে সবাই দেখে অমুক পায়খানা করতে যাচ্ছে। গোদের উপর আবার বিষফোঁড়া, গ্রামের পাশে একদিন মিলিটারি ক্যাম্প করে ফেলল। তারপর যা একটা অবস্থা হলো সেটা আর বলার মতো নয়। দাড়ি শেভ না করে একটু চাপ দাড়ির মতো করে ফেললাম। হাজী সাহেবের সাথে বাবার খাতির আছে বলে রক্ষা, না হলে তো আমার অবস্থা গোপালের মতো হতো, মাথার পিছনে ফুটো নিয়ে নীল গাঙে ভেসে বেড়াতাম, শোল মাছ খাবলে খাবলে শরীরের গোস্ত খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলত। হাজী সাহেবই বাবাকে বললেন আমাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে। ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে এখন গ্রামে পড়ে থাকা ঠিক নয়। হাজী সাহেব শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, তার কথা ফেলা যায় না। যন্ত্রণার উপর যন্ত্রণা মুক্তিবাহিনীর একটা দল ক্যাম্পে এসে হামলা করে বসল। তারপর তো আমার গ্রামে থাকার আর কোন উপায় নাই। মিলিটারি বাড়িঘর জ্বালিয়ে মানুষ মেরে একটা বিশ্রী অবস্থা করে ফেলল। অবস্থা দেখে মনে হলো যখন সুযোগ ছিল তখন সাহস করে মুক্তিবাহিনীতে চলে গেলেই হতো। কোথায় থাকব, কী খাব, কী করব—এইসব ভেবে তখন গেলাম না। আবার ভয়ও লাগে যুদ্ধ-টুদ্ধ করে যদি মরেই গেলাম তাহলে দেশ স্বাধীন হলেই কী আর না হলেই কী?
বাবা তখন ঢাকা যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিলেন। পাশের গ্রামের ক্বারী সাহেব ঢাকা যাচ্ছেন তার সাথে চলে যাব। ক্বারী সাহেব সাতচল্লিশ সনে এ দেশে এসেছেন। আগে বিহারি ছিলেন এখন দুই দুইটা বাঙালি বিয়ে করে পুরোপুরি বাঙালি হয়ে গেছেন, তবে উর্দুটা মনে আছে। এখন হঠাৎ করে সেটা খুব কাজে আসছে। বাবাকে বললেন, কুই ডর নেহি, হাম লে যায়গা—আগে হলে বাংলায় বলতেন, আজকাল কথায় কথায় তার উর্দু বের হয়ে আসে।
ঢাকা আসতে অনেক যন্ত্রণা হলো, রাস্তাঘাট বন্ধ, অনেক হেঁটে এসে ট্রেনে উঠতে হলো। গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছাই। মানুষ মরছে। যখন তখন ট্রেন থামিয়ে রেখে দেয়। সবাইকে দিয়ে গুলির বাক্স টেনে নামাল একবার। মনে হচ্ছিল আর বুঝি ঢাকা পৌঁছাব না—কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছালাম।
পৌঁছে অবশ্য মনে হলো ব্যাপারটা খারাপ হলো না। আরামে থাকার জন্যে সারা দেশে এর থেকে ভাল আর কোন জায়গা নাই। ইদরিস সাহেবের বাসায় এক রাত থেকে আমি হলে চলে গেলাম। জিন্নাহ হল—মাঝখানে সূর্যসেন হল হয়েছিল, এখন আবার জিন্নাহ হল। ইদরিস সাহেব আরো কয়েকদিন থাকতে বলেছিলেন, কিন্তু আমি থাকলাম না। আমাকে দেখে এমনি ভাবভঙ্গি করতে লাগলেন যে আমার মেজাজটা খুব গরম হয়ে গেল। তার কথাবার্তা শুনে মনে হতে লাগল আমার বয়সী একজন মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিয়ে যেন মহা অন্যায় করে ফেলেছি। সবাই যদি মুক্তিবাহিনীতে যায় তাহলে দেশটা স্বাধীন করবে কাদের জন্যে?
প্রথম দিন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে অনেকের সাথে দেখা হলো। রাশেদ, আতাউর, জালাল, টিপু এমনকি দেখি কয়েকজন মেয়েও এসে হাজির। স্যারেরাও আছেন, ক্লাস নিবেন নিবেন করছেন এখনো শুরু করেননি। আমরা ক্যান্টিনে চা খেয়ে আড্ডা মারলাম, কথা বলার সময় অবশ্যি খুব সাবধান। এদিক সেদিক দেখে কথা বলি। কখন কার সামনে কী বলব তারপর মহা ঝামেলায় ফেঁসে যাব।
নূরুল হাজির হলো একদিন। আমাদের মাঝে নূরুল হচ্ছে সোজা ধরনের। ঢাকাতেই থাকে কিন্তু কথাবার্তা চালচলন মফস্বলের ছেলেদের মতো। জিজ্ঞেস করলাম, কি রে মুক্তিবাহিনীতে গেলি না?
খুব সহজেই সে বলতে পারত তুই গেলি না? কিন্তু তা না বলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, যেতে তো চাই। কিন্তু কেমন করে যাই বল দেখি? দেশের এই অবস্থায় আমরা যদি না যাই—
তাহলে বসে আছিস কেন?
কেমন করে যাব?
বর্ডার পার হয়ে চলে যাবি।
কেমন করে পার হব? কোন্ দিক দিয়ে?
আমি ঠিক উত্তর দিতে পারি না তাই দাঁত বের করে হেসে বললাম, যা পর্যটন অফিসে গিয়ে খোঁজ নে!
সারাদিন ইউনিভার্সিটিতে বসে থাকি, চা-সিগারেট খাই। সন্ধেবেলা হলে ফিরে গিয়ে আবার আড্ডা মারি। বড় বড় জিনিস নিয়ে কথা বলি। পড়াশোনা নাই, অফুরন্ত অবসর। বই পড়ার অভ্যাস নাই, ফুটপাত থেকে হালকা ম্যাগাজিন নিয়ে এসে বসে বসে পড়ি। যখন অল্প কয়েকজন থাকি তখন বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলি, আর তো থাকা যায় না। মুক্তিবাহিনীতে যেতেই হয়। সবাই ঘন ঘন মাথা নাড়ি, কিন্তু কেউ আসলে যাই না। একটু ভয় ভয় করে কোথায় যাব, কী খাব, কোথায় থাকব!
এর মাঝে নূরুল একদিন একটা ছোট নোট বই নিয়ে এলো। আমাকে বলল, দেখো।
কী?
মিলিটারি নিয়ে জোক।
মিলিটারি নিয়ে?
হ্যাঁ। ঠিক করেছি মিলিটারি নিয়ে যত জোক বের হয়েছে সেগুলোর একটা কালেকশন বের করব। নাম দেব মিলিটারি কৌতুক; না হয় পাকিস্তানি কৌতুক। কি বলিস?
আমি কিছু না বলে মাথা নাড়লাম।
ভাল না আইডিয়াটা?
ভাল। কয়টা হয়েছে এই পর্যন্ত?
সাঁইত্রিশটা। এই দেখো।
আমি দেখলাম, গোটা গোটা হাতের লেখায় সাঁইত্রিশটা জোক। প্রত্যেকের উপরে হেডিং। প্রথমটার “মিলিটারি ও দর্জি।” পড়তে গিয়ে আমি হোঁচট খেলাম, কারণ সাধু ভাষায় লেখা। আমি জানতাম সাধু ভাষায় লেখালেখি উঠে গেছে, কিন্তু নূরুলের লেখা পড়ে তা মনে হলো না। সে লিখেছে :
“একদিন জনৈক দর্জি কাপড় কাটিতেছিল। একজন পাঞ্জাবি মিলিটারি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, দর্জি, তুমি কি করিতেছ? দর্জি বলিল, আমি পাঞ্জাবি কাটিতেছি। পাঞ্জাবি মিলিটারি তখন তাহাকে বেদম উত্তম-মধ্যম প্রদান করিল। কারণ নির্বোধ পাঞ্জাবি মিলিটারি বুঝিতে পারে নাই যে পাঞ্জাবি বলিতে দর্জি পরিধান করিবার পাঞ্জাবি বা কুর্তা বুঝাইয়াছিল।”
বেশির ভাগ জোকেরই এই অবস্থা। শুধু যে সাধু ভাষায় লেখা তই নয়, জোকটা বোঝানোর জন্যে বাড়তি অনেক ধরনের ব্যাখ্যা। কৌতুক আর কৌতুক নেই, বিশাল গদ্যে পরিণত হয়েছে। গোপাল ভাঁড়, বীরবল, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা এবং শিখদের বোকামি নিয়ে যত গল্প আছে সবগুলোকে পাকিস্তানি মিলিটারি চরিত্রে রূপ দিয়ে সে কৌতুকগুলো লিখে রেখেছে। আমি যতক্ষণ নোট বইটা পড়ছিলাম নূরুল খুব আগ্রহ নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পড়া শেষ হবার পর বলল, কেমন হয়েছে?
ভাল।
তাহলে হাসলি না যে?
জানা জোক তাই।
ও। নূরুল সাবধানে নোট বইটা শার্টের নিচে প্যান্টের মাঝে গুঁজে রেখে বলল, কী মনে হয় তোর? দেশ যখন স্বাধীন হবে তখন এরকম একটা বই দারুণ হিট হবে না?
তা হবে।
তুই যদি আর কোন জোক শুনিস বলিস আমাকে।
বলব।
কিছুদিনের মাঝেই সবাই জেনে গেল নূরুল পাকিস্তানি মিলিটারি নিয়ে জোক সংগ্রহ করছে। আমাদের কারো কারো কাজ নেই, কাজেই সবাই এই কাজে বেশ মন দিলাম। বেশ আগ্রহ নিয়েই নূরুলের জন্যে কৌতুক খুঁজতে থাকি। এর মাঝে টিপু একটা ভাল জোক নিয়ে এলো। জোকটা এ রকম :
একজন মিলিটারি গিয়েছে মুরগি হাটে। মুরগিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, মুরগিকে তুমি কী খাওয়াও?
মুরগিওয়ালা বলল, চাউল খাওয়াই।
শুনে মিলিটারির কী রাগ। রাইফেলের বাঁট দিয়ে দুই ঘা দিয়ে বলল, শালা গাদ্দার। হামকো ইস্ট পাকিস্তানি ভাইয়েরা চাউল খায়—তার খাবার তুমি মুরগিকে দাও?
কয়দিন পর আরেক দল মিলিটারি এসে মুরগিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী খাওয়াও মুরগিকে?
মুরগিওয়ালা এবার চাউলের কথা মুখে আনল না। বলল, গম খাওয়াই।
শুনে মিলিটারির আবার কী রাগ। রাইফেলের বাঁট দিয়ে কয়েক ঘা মেরে বলল, শালা বেহেনচোত হাম লোগ কা খাবার তুমি মুরগি কা দেতা হায়। আমার খাবার তুমি মুরগিকে খাওয়াও, তোমার এত বড় সাহস?
তার কয়দিন পর আবার কিছু মিলিটারি এল মুরগি হাটে। মুরগিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, মুরগিকে কী খাওয়াও তুমি?
মুরগিওয়ালা এবারে সাবধানে বলল, আমি তো জানি না স্যার। সকালবেলা সবার হাতে একটা করে সিকি ধরিয়ে দিই। তারা বাজারে গিয়ে যার যেটা ইচ্ছা কিনে খায়।
শুনে পাকিস্তানি মিলিটারি মুরগিওয়ালার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, বহুত আচ্ছা! বহুত আচ্ছা! তোম সাঁচ্চা পাকিস্তানি।
টিপু বলল, খুব সুন্দর করে, শুনে আমরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খেলাম, নূরুল ছাড়া। সে গম্ভীর হয়ে জোকটা তার নোট বইয়ে টুকে রাখতে শুরু করল। সাধু ভাষায় টানা হাতে দুই পৃষ্ঠা, ব্যাপারটা বোঝানোর জন্যে নানা রকম ব্যাখ্যা, নানারকম পাদটীকা কার সাধ্যি আছে এটা পড়ে। নূরুলের হাতে পড়ে এই সুন্দর জোকটার এই অবস্থা হবে কে জানত।
কৌতুকের যে অবস্থাই হোক নূরুলের খাতা কিন্তু ভর্তি হতে শুরু করল। অক্টোবর মাসে তার খাতায় একশো এগারোটা জোক লেখা হয়েছে জানতে পারলাম। একদিন আমার সাথে দেখা হতেই জ্বলজ্বলে চোখে বলল, পুরান ঢাকায় নাকি দারুণ কিছু জোক বের হয়েছে।
কী জোক?
আমি তো জানি না। বিশ্বাসী লোক না হলে বলে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
ঢাকাইয়ারা খুব রসিক জানিস তো?
জানি।
তোর পরিচিত আছে কেউ ঢাকাইয়া?
আমি মাথা নাড়লাম, নাই। আর থাকলেই এখন আমার কাজ নাই তোকে নিযে পুরান ঢাকায় রওনা দেব? দেশে একটা যুদ্ধ চলছে জানিস?
তা তো বটেই। নূরুল মাথা নাড়ে।
গত রাত এগারোটার সময় কী একটা এক্সপ্লোশন হলো। তারপর কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিকে অন্ধকার। গেরিলা অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।
তা ঠিক।
তোর বয়সী মানুষেরা এখন হাতে স্টেনগান গ্রেনেড নিয়ে যুদ্ধ করছে আর তুই নোট বইয়ে জোক লিখে বেড়াচ্ছিস, লজ্জা করে না?
ধমক খেয়ে নূরুল একটু মনমরা হয়ে গেল। ব্যাটার মাথায় ঘিলু বলে কোন পদার্থ নেই। মুক্তিযুদ্ধে যায়নি বলে তাকে আর যেই গালিগালাজ করুক, আমার করার কথা নয়। কিন্তু সেটাও সে ধরতে পারে না।
খুব আস্তে আস্তে ঢাকা শহর পাল্টাতে শুরু করেছে। রাস্তাঘাটে মিলিটারি অনেক বেশি। হঠাৎ হঠাৎ ভয়ংকর দর্শন ট্রাক বড় রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে, পিছনে পাথরের মতো মুখ করে মিলিটারিরা বসে আছে, হাতে চকচকে রাইফেল। কোন দূর দেশে নিজের ছেলে-মেয়ে ফেলে রেখে এসে এখানে কী অবলীলায় অন্যের ছেলেমেয়েকে মেরে ফেলছে। ইউনিভার্সিটি এলাকাতেও আর বেশি যাই না। ইসলামী ছাত্রসংঘের ছেলেরা নাকি বদর বাহিনী না কী একটা তৈরি করেছে। যখন খুশি তখন যাকে খুশি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। গুজব শোনা যাচ্ছে নাৎসিরা পোল্যান্ডে যেভাবে শিক্ষিত মানুষকে মেরে ফেলেছিল এরাও নাকি সেভাবে সব প্রফেসর ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তারদের মেরে ফেলবে। কত রকম গুজব যে বের হয়, তার সবগুলোতে কান দিলে তা আর বেঁচে থাকা যাবে না। আমি অবশ্যি আজকাল আর বেশি বের হই না, দরকার কী খামাখা ঝামেলার মাঝে গিয়ে?
এর মাঝে আবার একদিন নূরুলের সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে এক গাল হেসে বলল, একটা আইডিয়া হয়েছে।
কী আইডিয়া?
একটা বই পেয়েছি—ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছিল। ওয়ান থাউজেন্ট ডার্টি জোক।
ডার্টি জোক?
হ্যাঁ। নূরুল দুলে দুলে হাসে। সেখান থেকে বেছে বেছে কিছু মিলিটারি জোক হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছি? শুনবি?
অশ্লীল কৌতুকে আমার উৎসাহের কোন অভাব নেই। বললাম, শোনা দেখি।
নূরুল উৎসাহ নিয়ে তার নোট বই খুলে পড়তে শুরু করে। “জনৈক পাকিস্তানি মিলিটারি ব্যারাক হইতে ফিরিয়া খবর পাইল তাহার অনুপস্থিতির সুযোগে তাহার স্ত্রী অর্থের বিনিময়ে তাহার এক বন্ধুকে দেহদান করিয়াছে। শুনিয়া সে অট্টহাস্য করিয়া বলিল, আমার বন্ধু বাস্তবিকই স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন। ঐ কাজের জন্যে আমি তো কখনোই আমার স্ত্রীকে অর্থ প্রদান করি নাই।”
নূরুলের সাধু ভাষার অত্যাচারের পরও জোকটা শুনে আমি হাসি থামাতে পারি না, তাই দেখে নূরুলের উৎসাহ বেড়ে যায়। বলে এটা শোন তাহলে, এটা শোন।
অশ্লীল কৌতুক শুনতে আমার বেশ ভাল লাগে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে সব জোক শুনলাম। পড়া শেষ হলে বেশ বিজয়ীর মতো ভঙ্গি করে বললাম, কেমন হয়েছে?
ভাল।
বইটা যখন বের হবে একটা হিট হবে না?
যদি বের হয়।
নূরুল যত্ন করে তার নোট বইটা শার্ট তুলে পেটের কাছাকাছি প্যান্টের মাঝে গুঁজে রাখল। এটা নিয়ে সব সময়েই তার অতিরিক্ত সাবধানতা। আমি বললাম, আজকাল আর এই নোট বই নিয়ে বের হোস না।
না, বের হব না।
যদি মিলিটারি জানে নোট বইয়ে কী লিখেছিস তোর আর বেঁচে থাকতে হবে না।
তা ঠিক।
মরতেই যদি চাস ভাল একটা কিছু করে মর। মিলিটারির উপর জোক লিখে মরে গেলে ব্যাপারটা হাসির একটা ব্যাপার হয়ে যাবে।
তা ঠিক। নূরুল জোরে জোরে মাথা নাড়ে।
নূরুল বের হচ্ছিল, আমি বললাম, কোন্ দিকে যাবি?
টি.এন্ড.টি. থেকে একটা ফোন করব বাসায়।
দাঁড়া, আমিও যাব।
রিকশা করে টি.এন্ড.টি.-তে এসে ভেতরে ঢোকার সময় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম গেটে কালো কাপড় পরা দুজন মিলিশিয়া দাঁড়িয়ে আছে। দেখে আমাদের জান শুকিয়ে গেল—আগে জানলে কি আর এখানে পা দিই? ইচ্ছে হলো ফিরে যাই কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। হঠাৎ করে এখন ঘুরে গেলে আরো বেশি সন্দেহ করবে।
গলা নামিয়ে বললাম, অবস্থা কেরোসিন।
নূরুল শুকনো গলায় বলল, কী করি এখন?
কী আবার করবি ভেতরে ঢোক।
নূরুল কী একটা বলতে যাচ্ছিল ততক্ষণে একজন মিলিশিয়া এসে নূরুলকে সার্চ করতে শুরু করেছে। পেটে হাত দিতেই নোট বইটা লেগেছে, ভেবেছে রিভলবার, বোমা বা সেরকম কিছু সাথে সাথে ভয়ংকর একটা ব্যাপার ঘটল। মিলিশিয়াটি একটি চিৎকার করে হাতের অটোমেটিক রাইফেলটা নূরুলের গলায় ধরে এক ধাক্কায় তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। আমি দেখলাম রক্তশূন্য মুখে নূরুল খাবি খেয়ে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে—দুই হাত উঠে গেছে উপরে। ভয়ংকর মুখে মিলিশিয়াটি তাকিয়ে আছে নূরুলের দিকে, মনে হয় গুলি করে দেবে এখনই। ভয়ে আমার কাপড় নষ্ট হওয়ার মতো অবস্থা।
মিলিশিয়াটি নূরুলের শার্ট তুলে সাবধানে পেটে গুঁজে রাখা জিনিসটা দেখল। রিভলবার বোমা সেরকম কিছু নয় সাধারণ একটি নোট বই, মিলিশিয়াটি সহজ হলো একটু। নোট বইটা টেনে বের করে বলল, ইয়ে কেয়া হ্যায়? এটা কী?
নূরুল কথা বলতে পারছে না। প্রাণপণে চেষ্টা করে শুকনো গলায় বলল, নো-নো নোটবুক।
মিলিশিয়াটি নোট বইটি উল্টেপাল্টে দেখে। আমি দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকি, যদি কোনভাবে পড়তে পারে, তাহলে কী অবস্থা হবে আমাদের?
মিলিশিয়াটি আবার হড়বড় করে কী বলল, ভাল বুঝতে পারলাম না। মনে হয় জিজ্ঞেস করল, নোট বই পেটের মাঝে লুকিয়ে রেখেছ কেন?
নূরুল প্রাণপণে কিছু একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হয় না। আমার দিকে তাকাল নূরুল—আমি ঢোক গিলে বললাম, সাইজটা বড় পকেটে আটে না বলে ওখানে রাখা। বললাম উর্দুতে—অন্তত আমি যেটাকে উর্দু জানি সেই ভাষায়।
মিলিশিয়াটি তখন লেখাটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে, একসময় মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল কী লেখা আছে এখানে?
নূরুল ততক্ষণে খানিকটা জোর ফিরে পেয়েছে। তোতলাতে তোতলাতে বলল, ক্লাস নোট।
কিসের ক্লাস নোট?
ইসলামিক হিস্ট্রি। মোগল ডাইনাস্টি।
মিলিশিয়াটি নূরুলের হাতে নোট বইটা ফেরত দিতে গিয়ে হঠাৎ থেমে যায়। নূরুলের প্যান্টের দিকে তাকায়, তারপর হঠাৎ উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে তার সঙ্গীকে ডাকে। তার সঙ্গীটির সঙ্গে প্যান্টের দিক আমিও দেখলাম, ভয়ে নূরুল কাপড়ে পেশাব করে দিয়েছে। প্যান্ট ভিজে চুইয়ে সেই পেশাব আর পায়ের কাছে এসে জমা হচ্ছে।
আমি আর নূরুল রিকশা করে ফিরে যাচ্ছিলাম। কেউ কোন কথা বলছি না। নীলক্ষেতের মোড়ে রিকশাটা ঘুরে যাবার সময় পথে একটা ডাস্টবিন পড়ল, নূরুল নোট বইটি ছুঁড়ে ফেলে দিল ডাস্টবিনে।
আমি না দেখার ভান করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
0 মন্তব্যসমূহ