ধর্মদাস বলল, রত্নার বিয়ে ঠিক করে ফেললাম৷
সক্কালবেলায় একটি ডাহা মিথ্যে৷ কতবার যে ঠিক হল রত্নার বিয়ে৷ সরলভাবে মিথ্যে বলতে ধর্মদাসের সমকক্ষ কেউ নেই৷ ধর্মদাস রায় অরুণাভর প্রতিবেশী৷ এমন প্রতিবেশী ভাগ্যে জোটে৷ পরিবারের কর্তা যেমন, আর সকলেও তার অনুসারী৷ এমনকী ধর্মদাসের নয় বছরের ছেলেটিও ক্রমশ হয়ে উঠছে তার বাবার মতো৷ ব্যতিক্রম ছিল ওর বউ৷ এখন নাকি পালে মিশে গেছে৷ দেখে আর ধরার উপায় নেই যে হলুদপুখরিয়া থেকে ঘর করতে এসেছে বেলগাছিয়ার সবচেয়ে পুরনো এই ফ্ল্যাট বাড়িতে৷ আগের বছর লেকটাউন হাইস্কুল থেকে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে এনে এখানকার সাবেকী ভূতনাথ ইনস্টিটিউশনে যখন ভর্তি করল, অরুণাভর বউ অলকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, অত ভাল স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনলে কেন?
— ভূতনাথ ওর চেয়েও ভাল৷ ধর্মদাসের বউ-এর সাফ জবাব৷
— কিন্তু লেকটাউনের রেজাল্ট দ্যাখো৷
ভূতনাথের রেজাল্টই বা খারাপ কিসের, আগেরবার মাধ্যমিকে কুড়িটা স্টার, একজন ফরটিসিক্সথ হয়েছিল৷
অলকা বুঝেছিল তর্ক করা বৃথা৷ সে তো ভালই জানে ভূতনাথের অবস্থা এখন কী৷ মেরে কেটে গোটা পাঁচেক সেকেন্ড ডিভিশন৷ আর সব থার্ড...অগুনতি ফেল৷ আর পাঁচটা প্রাইভেট স্কুলের হাল যেমন হয়েছে আর কি৷ তাছাড়া অরুণাভ নিজে তো স্কুল টিচার৷ কোন স্কুলের হাল কেমন তা তার চেয়ে বেশি কে জানবে৷ ধর্মদাসের বউ যুক্তি তথ্য বুঝবে না, ধরা পড়ার উপক্রম হলেই ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ কথা বন্ধ৷ মুখোমুখি ফ্ল্যাট, তবু এরকম হয়েই থাকে৷ অরুণাভ অলকাকে থামিয়েছিল, কী দরকার এসব খোঁজে, ফেল করেছে হয়ত, বলতে পারছে না, তুমি খুঁচিয়ে ঘা করছ শুধু শুধু৷
ধর্মদাস বলল, পিয়ালি টাউনের ছেলে, এখন এম পি-তে সেটলড৷ খুব ভাল ফ্যামিলি পেয়েছি৷
পিয়ালি টাউন! অরুণাভর মাথা বোঁ বোঁ করে ওঠে৷ সে তো ভাবছিল দর্জিপাড়ার কথা৷ সেখানে অবশ্য বিয়ে হওয়া কঠিন৷ কিন্তু পিয়ালি টাউন কোথায়? কত আশ্চর্য জায়গার খোঁজই না রাখে ধর্মদাস৷ আর তার তিরিশোর্ধ্ব বোনের জন্য পাত্রও আসে ওইসব জায়গা থেকে৷ একবার সম্বন্ধ হল ইন্দ্রবিল-এ৷ পুরুলিয়ায় নাকি জায়গাটা৷ একবার বাদামপাহাড় থেকে দেখতে এল লোকজন৷ এই তো পুজোর আগে এল ন’পাহাড়ি নামে এক জায়গা থেকে৷ নিজেই তো বউ এনেছে হলুদপুখরিয়া গিয়ে৷ ধর্মদাসের বউ বলে পুখরিয়া৷ ধর্মদাস বলে পুকুরিয়া৷ এইসব জায়গাগুলোর নাম যেন স্বপ্নের ভিতরে শোনা৷ ন’পাহাড়ির নাম তো অরুণাভ শোনেইনি এর আগে৷ যেমন এই পিয়ালি টাউন! পারে বটে ধর্মদাস৷ খোঁজও রাখে৷ কলকাতায় যেন বিবাহযোগ্য পাত্রের অভাব৷
ধর্মদাস বলল, অবাক করলে, পিয়ালি টাউনের নাম জান না, এই তো বারুইপুরে৷
— পিয়ালি যেন কোন নদীর নাম! খুব আবছা গলায় বলল অরুণাভ৷
— নদী! না না নদী মদি নেই, বারুইপুর স্টেশনে নেমে অটোয় ওঠো, মিনিট পনেরো বাদে পৌঁছে যাবে পিয়ালি টাউনে, ওরা খাস মল্লিকের জমিদার ছিল, এখন এম পি-তে হোটেল বিজনেস, খাস মল্লিকের চৌধুরিদের নাম শোননি?
অরুণাভ জানে কথার অনেকটাই মিথ্যে৷ তবু শুনতে বেশ লাগে৷ বিচিত্র সব তথ্য এনে হাজির করে ধর্মদাস তার কথার ভিতরে৷ তাতে মিথ্যেটা ক্রমশ মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে৷ সে জিজ্ঞেস করে খাস মল্লিক মানে, পিয়ালি টাউনে মল্লিক, চৌধুরি, বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা৷
হা হা করে হাসে ধর্মদাস৷ এই বিদ্যে নিয়ে তুমি মাস্টারি কর, খাস মল্লিক হল একটা জায়গা, পিয়ালি টাউন যেমন, তবে দুটো জায়গা কাছাকাছি, সেখানকার জমিদারি কিনেছিল চৌধুরিরা, তাদেরই এক শরিক থাকে এম পি-তে৷
অরুণাভ অবাক হয় আবার৷ কত কিছু জানে ধর্মদাস৷ জমিদারির খোঁজও রাখে৷ পঁয়ত্রিশ বছর আগে তা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও৷ সে কী করে জানবে কে কোথাকার জমিদার ছিল৷ দেশভাগের পর থেকে তারা তো উত্তর কলকাতার প্রান্তে টালা পার্কের ধারে এই রঙহীন অনুজ্জ্বল ময়লা দরজা জানালার ফ্ল্যাটবাড়িতে বন্দী৷ ধর্মদাসরাও তাই, তবু সে খোঁজ রাখে৷ পঁয়ত্রিশ বছর আগে কে কোথাকার কত অংশের জমিদার ছিল তা বিয়াল্লিশ বছরের ধর্মদাস অক্লেশে বলে দিতে পারে৷ কোর্টে মুহুরিগিরি করে ধর্মদাস, লোক চরিয়ে জীবন ধারণ করে, তার পক্ষে কত কিছু জানাই না সম্ভব৷ বাদামপাহাড়, ইন্দ্রবিল, ন’পাহাড়ি, পিয়ালি টাউন৷
অরুণাভ জিজ্ঞেস করে, পিয়ালি টাউন নাম কেন?
বিরক্ত হয় ধর্মদাস৷ হচ্ছে রত্নার বিয়ের কথা, তুমি জিজ্ঞেস করছ ভূগোলের কোশ্চেন৷ আচ্ছা আমার নাম ধম্মদাস হল কেন আর ওই মাঠের নাম টালা হল কেন, খোঁজ রাখো৷
অরুণাভ হাসে, না, না এমনি মনে হল তাই, এ তো খুব ভাল খবর?
ধর্মদাস বলে, এবারে কেস সেটলড৷
অরুণাভ কিছু বলে না৷ ধর্মদাসের কথায় ‘কেস সেটলড’ বহুবার শুনে পরিষ্কার বুঝতে পারে, না হলে বিশ্বাস নেই৷ বাদামপাহাড়, ইন্দ্রবিল, ন’পাহাড়ির মতো এ পাত্রকেও রত্নার না-পছন্দ হতে পারে৷ ক’দিন বাদে ধর্মদাসই তা বলবে৷ অথচ দিন দিন মেয়েটার বয়স বেড়ে যাচ্ছে৷ ও তো অরুণাভর বোন ঝুমুরের বয়সী৷ তার বিয়ে হয়েছে এগারো বছর আগে৷ এত বয়সের কোন মানুষ বিনা কাজে ঘরে বসে থাকতে পারে না৷ রত্নাও পারে না৷ সঙ্গী আছে৷ পুরুষ৷ বয়স্ক৷
অলকা বলে, কী যে হবে মেয়েটার, আচ্ছা ও নাকি বি এ পাস, চাকরি বাকরি না পাক, টিউশানি করতে পারে তো!
বি এ পাস! হ্যাঁ ধর্মদাস বলে৷ রত্নাও বলে৷ কিন্তু অরুণাভ জানে কথাটা ডাহা মিথ্যে৷ হায়ার সেকেন্ডারিতে কম্পার্টমেন্টাল৷ ও তো ঝুমুরের সঙ্গে পড়ত৷ ঝুমুর তো শুনে অবাক, দাদা ও তো কম্পার্টমেন্টাল পরীক্ষাই দেয়নি, বি এ পাস করল কবে, কোন কলেজ থেকে?
কে যাচাই করতে যাবে৷ যাচাই করতে গেলে কথা বন্ধ৷ দরজা বন্ধ সশব্দে৷ কিন্তু বি এ পাস হোক বা না হোক, একটি মেয়ের বিয়ে তো তাতে আটকানোর কথা নয়৷ বিয়ে না হওয়ার কোনও কারণ ছিল না৷ স্বাস্থ্যবতী, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, গৃহকর্মনিপুণা, এমন একটি যুবতী কোন ভারতবাসীর যোগ্য হবে না একথা বলবে কে? কত মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, কোলে বাচ্চা নিয়ে ছ’মাস অন্তর বাপের বাড়ি আসছে৷ এ ফ্ল্যাটবাড়ির মেয়েটি তেমন হবে না কেন? খারাপ লাগে অরুণাভর৷ চোখের সামনে একটি মেয়ে অবিবাহিতা থেকে ক্রমশ বুড়ি হয়ে যাবে, একথা ভাবতেই কেমন লাগে৷ ঝুমুরের মেয়ে তো আট বছরের, ক্লাস টু-তে পড়ছে৷
ধর্মদাস বলল, ফেব্রুয়ারির বারো তারিখে দিন ঠিক হল৷
— সে কী, এত তাড়াতাড়ি! অরুণাভ প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে ভাবল তাড়াতাড়িই বা কী৷ রত্নার তো বছর পঁয়ত্রিশ হয়ে গেল৷ কিন্তু কবে পাত্র দেখা হল, কবে ঠিক হল বিয়ের কিছুই যে জানতে পারেনি সে মুখোমুখি ফ্ল্যাটের বাসিন্দা হয়েও৷ ধরতে পারল ব্যাপারটা৷ গত দেড় মাস কথা বন্ধ আছে৷ এর ভিতরেই বোধহয় সব হয়ে গেছে৷ বিয়ের খবর দিয়েই মৌনতা ভাঙল ধর্মদাস৷
ধর্মদাস বলল, শুভস্য শীঘ্রম, রত্নারও পছন্দ হয়েছে পাত্র, বড় হোটেল ব্যবসা ওদের উজ্জয়িনীতে, অবস্থাপন্ন, বাদামপাহাড়, ইন্দ্রবিল, ন’পাহাড়ির ছেলের চেয়ে ভাল...
বলে যাচ্ছিল ধর্মদাস৷ সব কথা কানে যাচ্ছিল না অরুণাভর৷ সে ভাবছিল বাদামপাহাড় থেকে পিয়ালি টাউন হয়ে উজ্জয়িনী৷ ক্ষমতা আছে বটে ধর্মদাসের৷ অরুণাভ নিজে বিয়ে করেছে বেলঘরিয়ায়, ঝুমুরের বিয়ে দিয়েছে বর্ধমানে৷ তার অতদূর প্রসারিত হওয়ার ক্ষমতা নেই৷ ঈর্ষা হল যেন ধর্মদাসের দিকে তাকিয়ে৷ উজ্জয়িনী তো তার কাছে স্বপ্ন মাত্র৷ মহাকবির দেশ, মেঘদূতের দেশ৷ গল্পগাথার দেশ, ইতিহাসের সোনার বিন্দু...বিন্ধ্যাচল, মালওয়ার মালভূমি...৷ এমন নগরে বোনের বিয়ে ঠিক করেছে ধর্মদাস৷ বিশ্বাসই হয় না সেই প্রাচীন পৃথিবীতে বাস করতে যাবে তাদের ফ্ল্যাটবাড়ির মেয়ে৷
অরুণাভ জিজ্ঞেস করে, উজ্জয়িনীই তো প্রাচীন অবন্তিকা ছিল, তাই না?
ধর্মদাস হা হা করে হাসে, তুমি মাস্টারি ছাড়া আর কিছুই কি জান না অরুণাভ, রত্নার বিয়ে হচ্ছে সেইটাই খবর, হ্যাঁ দিতে হচ্ছে অনেক, ছোট বোন আমার৷
কথাটা অরুণাভকে শুনিয়ে দিল ধর্মদাস৷ অরুণাভ আগে তো স্কুলের মাইনেই পেত না ঠিকমতো৷ সেই অনিশ্চিত সময়ে ঝুমুরের বিয়ে দিতে হয়েছিল তাকে৷ এগারো বছর আগের কথা৷ নূপুর রেজিস্ট্রি করেছিল শুধু শাড়িতে গিয়ে উঠেছিল স্বামীর ঘরে৷ ঝুমুরের বিয়ে সম্বন্ধ করে৷ নূপুরের খবরে ধর্মদাস গলাবাজি করেছিল খুব, আমার বোন হলে মেরেই ফেলতাম, তোমরা বামুন, কায়েতের ঘরে গিয়ে উঠল৷ ছিঃ ছিঃ ছিঃ, ফ্ল্যাটবাড়ির মান থাকল না আর৷ ঝুমুরের সময়ে বিয়ের দিন সকালে টাকার টান৷ বাজেটে আসল কয়েকটি খরচ বাদ চলে গিয়েছিল ভ্রান্তিবশত৷ তখন ধর্মদাসই এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, চল টাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি৷ কৃতজ্ঞ অরুণাভকে ধর্মদাস নিয়ে গেছে এক কাবুল দেশীয় লোকের কাছে৷ অবাক ব্যাপার! এখনও যে কলকাতা শহরে কাবুলিওয়ালা টাকা ধার দিয়ে বেড়ায় এ খবর ধর্মদাস ছাড়া জানবে কে? কাবুলির খবরটা বাড়িতে চেপে গিয়েছিল অরুণাভ৷ কিন্তু পরের মাসে ধর্মদাসই তাকে নিয়ে এসেছে দরজায়৷ কী অপমান! টাকা দিতে দু’দিন দেরি হয়েছিল মাত্র৷ বাবা তখন বেঁচে৷ মুখখানি অন্ধকার করে ছিলেন সারাদিন৷ একটি কথাও জিজ্ঞেস করেননি৷
পরে অরুণাভ জিজ্ঞেস করেছিল লোকটাকে বাড়ি নিয়ে এলে কেন ধর্মদাস?
— বাহ, চিনিয়ে দিলাম, আমাকে বিশ্বাস করেই তো টাকা দিয়েছিল, কী হয়েছে তাতে?
কী হয়েছে তা অরুণাভ বোঝাবে কীভাবে৷ ঘটনাটা এখনও বুকে বেঁধে৷
ধর্মদাস বলল, বাড়ি আছ তো?
হ্যাঁ, রোববারে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না৷
নেমন্তন্ন করতে যাব, কাল কার্ড পেলাম ছাপা৷ তোমাদের থেকেই আরম্ভ করি কাজটা৷
তাহলে কথা সত্যি! তাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে বিয়ে লাগছে৷ হ্যাঁ, তাই ধর্মদাস বলছে, একটু দাঁড়িয়ো পাশে, রত্না তো তোমার বোনেরই মতো...
হাঁটল ধর্মদাস কথাটা জনে জনে বলতে৷
দুই
— কোথায় হচ্ছে বিয়ে, দর্জিপাড়ায়? অলকার প্রথম জিজ্ঞাসা বিয়ের খবরে৷
— না, না উজ্জয়িনীতে৷ অরুণাভ বাজার রাখতে রাখতে বলল৷
— সত্যি, নাকি দর্জিপাড়ায়? অলকা আবার জিজ্ঞেস করেছে৷
— বলল তো পিয়ালি টাউন না কোথাকার জমিদার, উজ্জয়িনী থাকে৷ অরুণাভ সোফায় বসতে বসতে জবাব দেয়৷
অলকার সন্দেহ যেন যায় না৷ পিয়ালি টাউন, উজ্জয়িনী, ঠিক মিথ্যে বলেছে, ধর্মদাসদা৷ দুটো কথা বললে তার একটা মিথ্যে হবেই, দর্জিপাড়ার মৃণাল আচায্যির খবর তো ওরা জানে, এ নিয়ে গোলমালও হয়েছে বাড়িতে দু-একদিন৷
অরুণাভর চেয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির খবর বেশি রাখার কথা অলকার৷ সে সারাদিন এই ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দাদের নিয়েই থাকে৷ তবু অলকার সন্দেহটা অরুণাভর ভাল লাগে না যেন, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে হঠাৎই, ওসব কথা এখন তুলছ কেন, বিয়ে হচ্ছে, কোন কথা কার কানে যাবে এখন, অনর্থ বাধবে৷
অলকা বিড়বিড় করতে করতে সরে যায়, লোকটা যে ম্যারেড, কী করছে ধর্মদাসদা কে জানে, ওরা তো খুব জড়িয়ে গেছে৷
অলকা রান্নাঘরে৷ অলকার সন্দেহটা অরুণাভর ভিতরেও যেন প্রবেশ করতে আরম্ভ করল৷ হতেও তো পারে সেই লোকটার সঙ্গে৷ ধর্মদাস চাপা দেওয়ার জন্য বলছে পিয়ালি টাউন, উজ্জয়িনী৷ ধর্মদাস জানে মৃণাল আচায্যির খবর তাদের অজানা৷ অজানা তো নয়ই, বরং বেশি জানা অলকার, অরুণাভর৷ দর্জিপাড়ায় যে অলকার দিদি থাকে৷ সেই তো খবরটা দিয়েছিল লোকটা ম্যারেড, কিন্তু ওর বউ পাগল৷ অনেক চেষ্টা করেছিল, চিকিৎসার ত্রুটি রাখেনি, শেষে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ একটা বাচ্চা৷ অরুণাভ দেখেছে লোকটাকে৷ হাতিবাগানের থিয়েটার হল থেকে রত্নার হাত ধরে বেরিয়ে আসছে৷ মাথাভরা টাক, কেমন যেন হা-হুতাশে ভরা মুখ৷ ওর যে দর্জিপাড়ায় বাড়ি সে খবরের সূত্রও তো অলকার দিদি৷ এ বাড়িতে এসে হঠাৎ তাদের ফ্ল্যাটে রত্নাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল৷ রত্না চলে যেতে দিদি খোঁজ নিয়েছিল মেয়েটা কে? তারপর সব কথা৷
অলকা চা নিয়ে এলে অরুণাভ বলল, অত মিথ্যে হবে কি, দর্জিপাড়া আর উজ্জয়িনী কি এক হল, খামোকা ওসব বলতে যাবে কেন?
অলকা চিন্তিত, কী জানি, তবে ধর্মদা সব জেনে গিয়েছিল৷
সতর্ক করল অরুণাভ তার বউকে, ওসব কথা এখন তুলো না৷
— না, না আমি ভাবছি বিয়ে হয়ে গেলে লোকটার কী হবে?
— কিন্তু লোকটারও তো বিয়ে করার ক্ষমতা নেই...৷ অরুণাভর গলায় রাগ৷
এত কথার ভিতরে অরুণাভর মা এসে দাঁড়িয়েছেন৷ বিয়ের খবরে বললেন, এই তো রাজি হলি, তবে ওই বাদামপাহাড় ইন্দ্রবিলে রাজি হলি না কেন?
অরুণাভ চট করে বলেছে, তুমি কি জান রত্না রাজি হয়নি, সব তো ধর্মদাসের কথা৷
মা বললেন, আমি তো মেয়ের কথা বলছি না৷ বলছি ধর্মদাসের কথা, বয়সকালের মেয়ে, বিয়েয় রাজি না হয়ে পারে, পঁয়ত্রিশ বছরে কী অত বাছাবাছি করে কেউ?
— না, না, ধর্মদা তো চেষ্টা করছিল খুব৷ অলকা বলতে চেষ্টা করল৷
মা মাথা নাড়লেন, চেষ্টা করছিল বোধহয় বিনি পয়সায় পার করানোর৷ এবার বোধহয় তোমার দিদি যে লোকটার কথা বলেছিল তাকে ধরেছে৷
অলকা অরুণাভ পরস্পরের দিকে তাকায়৷ মা জানে সব৷ মায়ের সঙ্গে রত্নার কথা হয় বেশি৷ মায়ের কাছে রত্না বোধহয় মৃণাল আচার্যর কথা বললেও বলে থাকতে পারে৷
অলকার আগে মা ওদের ফ্ল্যাটের খবর জেনে ফেলে রত্নার মারফত৷ কারণটা অনুমান করতে পারে অরুণাভ৷ অলকা রত্নার চেয়ে বয়সে ছোট, বিবাহিতা৷ অলকার ওপর গোপন ঈর্ষা থাকতেই পারে মেয়েটার৷ ধর্মদাসের বউ-এর সঙ্গেও তো ওর বনে না৷
মা বিড়বিড় করতে করতে ও ঘরে চলে গেলেন৷ অলকা তখন আবার তার সন্দেহটা প্রকাশ করল, মা বলছেন পর্যন্ত দর্জিপাড়ার লোকটার কথা৷
অরুণাভ কথা বলল না৷ নিমন্ত্রণ পত্র পেলেই ধরা যাবে আসল ঘটনাটা কী৷ বলা তো যায় না৷ ধর্মদাসের পক্ষে কোনও কিছু করাই অসম্ভব নয়৷ যে হলুদপুকুর, বাদামপাহাড়, ইন্দ্রবিল, ন’পাহাড়ির খোঁজ রাখে, তার পক্ষে দর্জিপাড়ার লোকের পরিচয় বদলানো কঠিন নয়৷ অন্তত মুখে৷ কে জানে, ওই মৃণাল আচার্যর বাড়ি পিয়ালি টাউনে কিনা৷ ওরাই খাস মল্লিকের চৌধুরি কিনা, ওদের কেউ উজ্জয়িনী থাকে কিনা৷ তবে চৌধুরির মতো আচার্যও তো পাওয়া উপাধি৷ ভাবতে গিয়ে বিব্রত হয়ে পড়ল অরুণাভ৷ ওরা কি ‘আচার্য চৌধুরি’? বসুচৌধুরি, রায়চৌধুরি, পালচৌধুরির মতো আচার্য চৌধুরিও তো উপাধি পদবি হতে পারে৷ দর্জিপাড়ার লোকটা হয়ত ‘চৌধুরি’ ছেঁটে দিয়ে ‘আচার্য’ লেখে৷ ধর্মদাস আবার তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে চৌধুরির মহিমা৷
অলকা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি কি ওই সময় থাকবে?
— তাই তো! সম্বিত ফেরে যেন অরুণাভর৷ তার তো শিক্ষক সমিতির বার্ষিক সম্মেলন আছে বহরমপুরে ওই তারিখ থেকে৷ সে কলকাতার প্রতিনিধি স্থানীয় সদস্য৷ না গেলেই নয়৷ ষাট-পঁয়ষট্টি বছর নিয়ে এখন তর্কবিতর্ক তুঙ্গে৷ এবারের সম্মেলনটা খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রতিবেশীর বিয়ে বলে তা বাদ দিতে তো পারবে না৷ অরুণাভ ভাবল বেঁচে যাচ্ছে সে৷ ধর্মদাসের ব্যাপারে না জড়ানোই ভাল৷ মা থাকবে, অলকা থাকবে, সে না থাকলে ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না৷ থাকলে দায়িত্ব এসে পড়বেই ঘাড়ে৷ মুখোমুখি ফ্ল্যাট, এ বাড়িতে বিয়ে৷ অরুণাভ উঠে গিয়ে জানালায় দাঁড়ায়৷ তিনতলা এই বাড়িটিতে পাশাপাশি দুটি করে ছটি ফ্ল্যাট৷ তারা একদম মাথায়৷ বাড়িটির বয়স কম নয়৷ মা তাকে কোলে করে পঁয়ত্রিশ বছর আগে এখানে এসে উঠেছিলেন বাবার সঙ্গে৷ তখন ধর্মদাসরা এসে গেছে৷ তারা কেন, এই ফ্ল্যাটবাড়ির পুরনো বাসিন্দারা কেউ নড়েনি আর৷ শুধু একতলার দুটি ফ্ল্যাটে দুবার ভাড়াটে বদল হয়েছে৷ তাও তো অনেক দিন হল৷ বাড়িটি সকলের যেন নিজের মতো৷ প্রতিবেশীরা এখানে বড় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছে৷ খুব কাছাকাছি৷ এক ফ্ল্যাট অন্য ফ্ল্যাটের কাছে গোপন রাখতে পারে না অনেক কিছুই৷ দরজা খুললেই যে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাসিন্দাদের অন্দরমহল পর্যন্ত দেখা যায়৷
অরুণাভ দেখছিল মাঠ৷ টালা পার্ক এখন খণ্ড খণ্ড, তবুও সামনে এখনও বিস্তৃত সবুজ৷ অনেকটা আকাশ৷ অরুণাভ নিঝুম হয়ে পড়ে বাইরে তাকিয়ে৷ ফ্ল্যাট বাড়িটা ঠিক যেন আগের মতো নেই৷ লোকজনও কমে গেছে৷ মেয়েগুলি তো কেউ নেই৷ ঝুমুর, নূপুর, দোতলার নীলা, বেলা, করবী, একতলার শিউলি, সুজাতা— সবার শেষে যাচ্ছে রত্না৷ ধর্মদাসের ছোটভাই রামদাস চলে গেছে এ বাড়ি ছেড়ে৷ ছেলেটা জুটমিলে চাকরি করে৷ ধর্মদাস তাকে থাকতে দেয়নি এ বাড়িতে৷ একতলার নীলাঞ্জন খুব ভাল ফুটবলার, ফ্ল্যাট পেয়েছে কাঁকুড়গাছিতে৷ এ বাড়িটা ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে৷ ক্রমশ অন্ধকার৷
তিন
ক’দিন বাদে অরুণাভর সঙ্গে ধর্মদাসের আবার কথা হল বাজারে৷ মুখোমুখি ফ্ল্যাট হলেও বাড়ির বাইরেই কথা হয় বেশি৷
ধর্মদাস বলল, ক্যাটারার ঠিক করেছি, ষাট টাকা প্লেট৷
হাঁ হয়ে গেছে অরুণাভ, ষাট টাকা!
—হ্যাঁ, তাও মিষ্টি ছাড়া, মিষ্টি ধরলে পঁয়ষট্টি থেকে সাতষট্টি পড়ে যাবে৷
অরুণাভ বুঝল মিথ্যে বলতে আরম্ভ করেছে তার প্রতিবেশী৷ বড়লোকী দেখাচ্ছে৷ এত দাম হওয়ার তো কথা নয়৷
— পাঁচশো লোক হয়ে যাবে৷
— করছো কী, এত লোক আজকের দিনে কেউ বলে?
ধর্মদাস নিঃশব্দে হাসতে লাগল৷ তারপর এগোতে এগোতে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, হ্যাঁ অরুণাভ, তুমি যেন কী বলছিলে সেদিন, কী জিজ্ঞেস করছিলে৷
অরুণাভ শঙ্কিত হয়ে ওঠে৷ তাদের সন্দেহের কথা কানে গেছে নাকি ওর৷ তাই বা কী করে হবে৷ আর সন্দেহ তো মিটেই গেছে, পাত্রের নাম মৃণাল নয়৷ পাত্র উজ্জয়িনী নিবাসী৷ দর্জিপাড়ার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই থাকতে পারে না৷
জবাবটা ধর্মদাসই দিল, পিয়ালি টাউনের নাম পিয়ালি নদী, তুমি ঠিকই বলেছিলে, ওখানে একটা নদী ছিল পিয়ালি নামে, এখন অবশ্য মাঠ, হ্যাঁ নামের কারণ থাকে বটে৷
অরুণাভর মুখে হাসি ফোটে, খোঁজ নিয়েছিলে?
কেন নিতে পারি না, জিজ্ঞেস করলাম পাত্রের কাকাকে, বলল ওই নদীর নামেই তো টাউন, তবে নদী মদি সব তো শুকিয়ে যাচ্ছে, তাই নাকি৷ ওর কাকা তোমার মতো বিদ্বান বটে৷
অরুণাভ বলল, হ্যাঁ, কাগজে পড়ো না৷
— কাগজ পড়ার আর সময় পাই কই, হ্যাঁ উজ্জয়িনীতেও একটা নদী আছে৷
— শিপ্রা, জানি, তুমি খুব ভাল জায়গায় বিয়ে দিচ্ছো রত্নার৷
হে হে করে হাসতে থাকে ধর্মদাস, তাহলে বলো বাদামপাহাড়, ইন্দ্রবিলের চেয়ে ভাল হল কিনা৷ দূরও অনেক, টু নাইট জার্নি৷
— চলে যাও, ঘুরে এস বিয়ের পর৷ অরুণাভ বলল৷
— পরে দেখা যাবে৷ আগে আমি গোয়ায় যাব৷ অনেক দিনের ইচ্ছে যাওয়ার, ও জায়গাটায় নাকি সাহেব-মেমরা সব জামাকাপড় খুলে রোদ পোহায়৷
অরুণাভ মাথা নাড়ে৷ এ নিয়ে তার কোনওরকম জানা তথ্য প্রকাশ করতে গেলেই বিপদ হয়ে যাবে৷ ধর্মদাস ছাড়বে না৷ সে গোয়ায় যাবে যাবে করছে বহুদিন৷ যার যেথা মজে মন৷ অরুণাভ ভাবছিল পিয়ালি নদী মরে গেছে৷ পিয়ালির চৌধুরিরা উজ্জয়িনীতে৷ সেখানে শিপ্রা এখনও বহমান৷ নদী মরে গেলে মানুষের খুব বিপদ হয়৷ সেই বিপদে পড়েই কি চৌধুরিরা অতদূর উজ্জয়িনীর অন্ধকারে পা বাড়িয়েছিল৷ এখন কী বিবাহ সূত্রে আবার ফিরতে চাইছে গঙ্গাতীরে৷
চার
কেমন বিয়ে হল?
অলকা গম্ভীর, তুমি ছিলে না ভালই হয়েছে৷
— কেন হল কী? ফ্ল্যাটবাড়িতে পা দেওয়ার সময়ই অরুণাভ কেমন থমথমে ভাব দেখেছে৷ তিন তলায় উঠে ধর্মদাসের ফ্ল্যাটে তালা দেখে কেমন যেন লেগেছে তার৷ বাড়িতে ওই হাওয়া ঢুকে পড়েছে বোধহয়৷
অলকা বলল, ধরে করে একটা পুরুষ মানুষ গছিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করল, শুধু মিথ্যে কথা৷
— কেন উজ্জয়িনী থেকে বর আসেনি?
— তা কেন আসবে না৷ অলকা ফোঁস করে ওঠে৷
অরুণাভর গলা শুনে মা চলে এসেছেন এ ঘরে৷ অলকাকে থামতে বললেন, বাদ দাও না, ওসব কথা তুলছ কেন?
— হল কী? অরুণাভ জিজ্ঞেস করল আবার৷
বলল অলকা৷ একটু চাপা গলায় গোপন খবর দিতে লাগল যেন৷ তার মনে হয়েছে বরের কঠিন অসুখ আছে৷ সুস্থ নয়৷ বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ হবে৷ বয়সে মানিয়ে গেছে, কিন্তু লোকটার চোখমুখ কী রকম যেন, পুরনো অসুখের কালোছায়া৷
— তুমি কী করে বুঝলে? অরুণাভ কেমন বিহ্বল হয়ে পড়েছে খবরটায়৷ বিস্বাদে মন ভরে গেল৷ ফ্ল্যাট বাড়িটা কেমন যেন নির্জন পুরীর মতো হয়ে গেছে৷ সব ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ৷ ধর্মদাসের ফ্ল্যাটে তালা৷ অথচ বিয়ে গেছে তো পাঁচ দিন আগে৷ এখনও বাঁশ নামাচ্ছে ডেকরেটরের লোক ছাদ থেকে৷ উৎসব হঠাৎ যেন ভেঙে গেছে৷
অরুণাভর মা বললেন, আমি তো বলে দিলাম স্বামীকে ডাক্তার দেখাতে ভাল করে৷
— সত্যিই অসুখ! অরুণাভ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না৷
অলকা মাথা দোলায়, হ্যাঁ, বিয়ের রাত্রে হঠাৎ ঘামতে আরম্ভ করল, অথচ সেদিন তো ঠান্ডা ছিল ভাল, ঘেমে যেন চান করে যেতে লাগল, ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে আমি বরকে এনে বসিয়েছি এ ঘরে, জামা গায়ে রাখতে পারে না, শেষে না পেরে ডাক্তার ডাকতে হল, এমন দেখিনি কোনওদিন৷
— ওরা কোথায়?
— মেয়ে জামাইকে উজ্জয়িনীর ট্রেনে তুলে দিয়ে ওরা বোম্বে গেল, গোয়া যাবে৷ অষ্টমঙ্গলা হল না, শোনা যাচ্ছে বরপক্ষই নাকি টাকা দিয়েছে, ও ছেলের বিয়ে হচ্ছিল না অসুস্থ বলে, রত্না তো আগে ছেলে দেখেনি৷
অরুণাভর মন খারাপ হয়ে গেল৷ জানালায় দাঁড়িয়েছে সে৷ মা আর অলকার কথার অংশ অংশ কানে আসছে৷ মা স্মৃতির ভিতরে ডুবে যাচ্ছেন ক্রমশ৷ এই ফ্ল্যাটে আসা, ওই মেয়েটাকে জন্মাতে দেখা, ওর বাবা মা দিদি.... মা ফিসফিস করছেন, ভাল হয়ে যাবে, ঠিক ভাল হয়ে... বিয়ের পর অনেক সময় পুরনো অসুখ সেরে যায়৷ শরীরের একটা ধর্ম আছে তো! মা চোখে আঁচল দিয়েছেন৷ মা কাঁদছেন৷ মায়ের মন খুব নরম৷ এ বাড়ির পুরনো মানুষ তিনি একমাত্র বেঁচে আছেন৷ সবাই তাঁর সন্তানের মতো৷ মা রত্না, ঝুমুর, নূপুর, করবী, শিউলির কথা বলছেন... বলতে... বলতে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে৷ বসন্ত এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল এই সিমেন্টবন্দী শহরে, টালা পার্কের কৃষ্ণচূড়ার মাথায়৷ তা মিশে গেল রৌদ্রময়তায়৷ কলকাতায় গ্রীষ্ম অতি দীর্ঘ, যায় যায় করেও যায় না৷ মা দুপুরে হাই তুলতে তুলতে বলেন, বৌমা মেয়েটার কোনও খোঁজ এল?
— কী করে জানব মা, ওরা তো এখন কথা বলে না৷
হ্যাঁ তাই হয়েছে৷ তুচ্ছ জিজ্ঞাসায় ধর্মদাসের বউ সশব্দে দরজা বন্ধ করে মুখেও কুলুপ এঁটেছে৷ অলকা জিজ্ঞাসা করেছিল কাকে, জামাই-এর শরীর কেমন আছে বউদি?
সেই থেকে দরজা বন্ধ৷ দরজা খুললও বেশ কিছুদিন বাদে৷ প্রতিবেশী যখন, কতদিন বিনা আলাপে থাকতে পারে৷ যে জবাব চেয়েছিল অলকা ধর্মদাসের বউ-এর কাছে, তা পেল দেড় মাস বাদে, খুব ভাল আছে জামাইমেয়ে, তবে এখন ওখানে খুব গরম৷
অরুণাভ শুনে বলল, হতে পারে মালওয়া মালভূমি অঞ্চল, তবে নগরটা তো নদীর ধারে৷
অলকা চোখ উজ্জ্বল করে বলল, হ্যাঁ, শিপ্রানদী, তার তীরে তীরে নাকি শুধু মন্দির, সব দেবদেবী নাকি জাগ্রত, বহুকালের পুরনো৷
— তুমি এসব জানলে কী করে?
— কেন রত্নার চিঠি তো পড়লাম, ও প্রতি সোমবার মহাকাল মন্দিরে যায়৷
— মহাকাল মন্দির! মহাকাল এখনও আছে? অরুণাভ আচ্ছন্নের মতো জিজ্ঞেস করে৷
— তুমি চেনো? অলকা অবাক হয়ে গেছে অরুণাভর কথায়৷
অরুণাভ বাইরে অন্ধকার শূন্যতায় তাকিয়ে৷ ধোঁয়াধুলোয় আচ্ছন্ন আকাশে গ্রহনক্ষত্র এই শহরে স্পষ্ট নয়৷ উজ্জয়িনীর আকাশ নিশ্চয়ই ঝকঝকে, গ্রহনক্ষত্ররা চোখের জলের মতো মুক্তোবিন্দু৷ মেঘদূতেই তো রয়েছে মহাকালের কথা৷ মেঘ দাঁড়িয়েছে তার মাথায়, কবি উজ্জয়িনী নগরের রূপ বর্ণনা করছেন৷ মহাকাল— উজ্জয়িনীকে চেনে অরুণাভ৷ এ যেন তার পূর্বজন্মের স্মৃতি৷ অরুণাভ ফিসফিসিয়ে বলছিল সব অলকাকে, অলকা মাথা নাড়ছিল, সে তো জানে না, মেঘদূত পড়েনি৷
অরুণাভ বলল, এবার উজ্জয়িনী যেতে হয়৷
— তুমি তো শুধু বলেই খালাস, অলকা বালিকার মতো ঠোঁট ফুলায়, পিয়ালি টাউনেই তো নিয়ে গেলে না৷
অরুণাভ হাসে, সেখানে তো নদী নেই৷
অলকা বলে, রত্না লিখেছে শিপ্রার ঘাটে ঘাটে মন্দির৷ কাঁসর ঘণ্টা, ধূপের গন্ধ, নগর জুড়ে যেন উৎসব সব সময়...
এখনও! অলকা ফিসফিসিয়ে বলে, চিঠিটা আনো দেখি ওদের ঘর থেকে৷
এইভাবে দূর উজ্জয়িনীর সঙ্গে মনে মনে জুড়ে যায় এই ফ্ল্যাটবাড়িটি, এই শহর৷ দিন যায়, মাস যায়৷ বর্ষায় আবার কথা ওঠে রত্নার৷ অলকা অরুণাভকে বলল, শ্রাবণে মহাকাল মন্দিরে খুব ভিড়, কত দেশ থেকে লোক যায়, রত্না লিখেছে জামাই ভাল আছে, সে ভাল আছে, প্রতি সোমবারে সে মহাকালে যায়, পুজো দেয়, মহাকালে সে মানত করেছে স্বামীর জন্য, কী যে ভাল মেয়েটা, এখানে ধরা যেত না, ও নাকি সকলের জন্য পুজো দিয়ে বেড়াচ্ছে মন্দিরে মন্দিরে, প্রার্থনা করছে সকলের জন্য৷
— তার মানে? অরুণাভর ভিতরে যেন আশ্চর্য আনন্দ জেগে ওঠে৷
— তাই তো লিখেছে, এই দ্যাখো না৷ অলকা চিঠিটা বাড়িয়ে দিল৷
দুপাতা চিঠি৷ গোটা গোটা অক্ষরে৷ অরুণাভ পড়তে শুরু করল৷ পড়তে পড়তে তার বুকের ভিতরে যেন বর্ষণ শুরু হল৷ ভিজে যেতে লাগল এই কঠিন নগরের বুক৷ সব লিখেছে খুঁটিনাটি, শিপ্রার তীরে মঙ্গলনাথের মন্দির, সেখানে মানত করেছে, গণেশজির কাছে মানত করেছে, দুর্গামন্দিরে মানত করেছে, মহাকাল তো সবার মাথায় আছেন৷ শিপ্রানদী বর্ষায় ফুলে উঠেছে, সব দেবদেবীর চরণ ধুইয়ে নদী বহে যাচ্ছে অনন্ত উল্লাসে৷ সে নদীর কাছেও মানত করেছে, স্বামী যেন সুস্থ থাকে, দূর কলকাতার স্বজনপরিজন, ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষগুলি যেন সুখে থাকে, নীরোগ থাকে৷ অতদূরে বসে এ ছাড়া সে আর কিই-বা করতে পারে, সকলের মঙ্গল কামনা ছাড়া৷
পরের খবর এল নভেম্বরে৷ জানুয়ারিতে তারিখ৷ বাচ্চা হবে রত্নার৷ ও আসছে কলকাতায়৷ প্রথম সন্তান বাপের বাড়ি মানে ফ্ল্যাটবাড়িতেই হোক, এ তার ইচ্ছে৷ সন্তান কলকাতায় ভূমিষ্ঠ হোক স্বামী মত দিয়েছে৷ সে মানুষ ভাল আছে৷ আসুক রত্না৷ এসেও গেল৷ ফ্ল্যাটবাড়ির মেয়ে ফিরে এল পূর্ণগর্ভা স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হয়ে৷ সব খবর দেয় অলকা৷
অলকা বলল, জানুয়ারিতেই আসবে নিরঞ্জন, রত্নার স্বামী৷
অরুণাভ বলল, ও এলেই কথা বলে নিতে হবে উজ্জয়িনী ভ্রমণের, তবে বর্ষায় যাব, অন্য সময় নয়৷
শীত এল কলকাতায়৷ ডিসেম্বরে শীত পাথর হয়ে থাকল ক’দিন৷ তারপর তা কমতে শুরু করলেই অলকা ছুটেছে নার্সিংহোমে, রত্না ভর্তি হল৷ দুদিন বাদে সকালে এসে ধর্মদাস সোল্লাসে খবর দিল, রত্নার মেয়ে হয়েছে কাল রাত্তিরে, ওহে অরুণাভ শুনছ৷
মা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, জামাই এল না?
— আসবে, এখন তো ওখানে ট্যুরিস্ট সিজন, ব্যবসায়ে খুব চাপ, টেলিগ্রাম করে দিয়েছি, এসে নিয়ে যাবে৷
এসে নিয়ে যাবে৷ নিয়ে যাবে৷ নিয়ে ...৷ ফেব্রুয়ারির প্রথমে সন্তান কোলে রত্নাকে দেখল অরুণাভ৷ রত্না বলল, ওর বাবা আসত, তবে এখন লিখেছে একেবারে নিয়ে যাওয়ার সময় আসবে, সামনের মাসে৷
পুরনো বাড়িটি থরথর করছে উল্লাসে সুখে৷ অরুণাভ বলল, আলাপ হয়নি, এবার এমন আলাপ করব যে...
মুখ টিপে হাসতে লাগল রত্না, তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, সত্যি ওখানকার দেবদেবী খুব জাগ্রত, মঙ্গলনাথে ওর বাবা মানত করেছিল যেন মেয়ে হয়, মেয়ে হলে মঙ্গলনাথের কপালে সোনার চাঁদ দেবে বলেছিল৷ সত্যিই তাই হল, আপনার কী ইচ্ছে অরুদা?
অরুণাভ বলল, আমার জন্য, আমাদের জন্য তো তুমিই দিচ্ছো পুজো, আবার ফালতু খরচ করতে যাব কেন?
রত্না মাথা নামায়, হ্যাঁ দিই, প্রতি সপ্তা’য় তো যাই মহাকালে, আমার খুব মন খারাপ লাগে এক এক সময়, তখন আমি কী করব?
অরুণাভ চুপ করে যায়, রত্নাকে যেন এই শহরে আর মানায় না৷
পাঁচ
চলে গেছে রত্না৷ কবে, না আজ দুপুরে৷ মার্চের প্রথম৷ এর ভিতরেই বাতাস আগুন৷ আগে কলকাতা এমন ছিল না৷
— কেন, হঠাৎ চলে গেল যে? অরুণাভ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে৷
অলকা চাপা গলায় বলল, প্লেনে ইন্দোর, ওখান থেকে বাসে উজ্জয়িনী যাবে, এতক্ষণে বোধহয় পৌঁছে গেল, পিয়ালি টাউন থেকে ওর খুড়তুতো দেওর এসেছিল নিয়ে যেতে৷
— কিন্তু কেন সেটা বলবে তো৷ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে অরুণাভ৷
— বলছি, একটু আস্তে, ধর্মদাসরা আবার দরজা দিয়েছে, রত্নার স্বামী নিরঞ্জন খুব অসুস্থ৷
— ধর্মদাস যায়নি?
— না, খবর তো এসেছে কাল রাতে, এ নিয়ে কান্নাকাটি করেছে মেয়েটা খুব, কিন্তু ধর্মদাসের নাকি যাওয়ার উপায় নেই৷
— একা গেল?
অলকা চুপ করে থাকে৷ ঘরের বাতাস হঠাৎ খুব ভারী, বাইরের অন্ধকার কালিমালিপ্ত, তীব্র ঘন৷ মা এসে দাঁড়িয়েছেন এ ঘরে, ধরাগলায় বলছেন, মেয়েটাকে ঘাড় থেকে নামাতেই তো অতদূরে ওইরকম একটা রোগীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে, যাবে কেন, গেলে যদি খরচ হয়, কী যে হল অতদূরে?
অরুণাভ বলল, ভাল হয়ে যাবে ঠিক৷
— হ্যাঁ অত মন্দিরে পুজো দেয় যখন৷ বলতে বলতে অলকা মাথা নামিয়েছে, না, না কিছুই হবে না, আসলে আমার মনে হয় ওর স্বামী আসতে পারবে না, তাই এই বলে নিয়ে গেল তার বউকে, এ সময় তো সত্যিই প্রচুর ট্যুরিস্ট যায় ওদিকে৷
মা ধরাগলায় বললেন, যাওয়ার সময়ে বলে গেল মাসিমা আমার খুব বিপদ!
এরপর আর কোনও খবর নেই৷ শহর পুড়ে গেল পশ্চিমি হাওয়া রোদে, তবু কোনও খবর নেই৷ ধর্মদাসেরাও হঠাৎ কেমন গুটিয়ে গেছে৷ জিজ্ঞেস করলে, হাঁ হুঁ করে উত্তর দেয়, বলে, অত দূরের খবর কি রোজ রোজ রাখা যায়, তুমি তোমার বোনের খবর রাখ, কী দিয়ে ভাত খেয়েছে কাল?
ধর্মদাসের কুযুক্তির কাছে অরুণাভ হেরে যায়৷ নিজেকে সংবরণও করে৷ কথা বাড়িয়ে লাভ কী, শুধু শুধু ধর্মদাস রাগবে৷ রত্না তো তার কেউ নয়৷ কেউ নয় বটে তার, কিন্তু ফ্ল্যাটবাড়ির তো!
খবর নেই৷ চিঠিও না৷ কিন্তু খবর এল একদিন৷ কলকাতায় তখন বর্ষা নেমেছে৷ তাপিত শহর ভিজছে মেঘের নিচে দাঁড়িয়ে৷ অলকা গিয়েছিল দিদির বাড়ি দর্জিপাড়ায়৷ দুপুরেই ফিরে এসেছে হাঁপাতে হাঁপাতে৷ ক্ষোভে বেদনায় মুখখানি কালো৷ ফ্ল্যাটে ঢুকেই সশব্দে দরজা দিয়েছে, তার পর আছড়ে পড়েছে বিছানায়, ওগো খবর শুনেছ!
ছুটির দিন৷ অরুণাভ জানালার ধারে চেয়ার টেনে খবরের কাগজ মুখে নিয়ে বসেছিল৷ বাইরের আকাশ এখন ছাই ছাই, বাতাস উঠেছে এলোমেলো৷ অলকার কণ্ঠস্বরে হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, আশঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কী খবর, তুমি এর মধ্যে ফিরে এলে যে৷
পুত্রবধূর কণ্ঠস্বরে অরুণাভর মা-ও চলে এসেছেন এ ঘরে, কী হল বউমা?
অলকা ফুঁপিয়ে উঠেছে, ওর সব ঘুচে গেছে৷
— কার কথা বলছ? আশঙ্কায় বুক কেঁপে গেছে অরুণাভর৷
অলকা বন্ধ দরজার দিকে আঙুল তুলেছে, ওই রত্নার, রত্নার সব ঘুচে গেছে, সাধ, আহ্লাদ, কী পাষণ্ড ওরা কথাটা চেপে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, উজ্জয়িনী যায়নি পর্যন্ত, খবরও নেয়নি৷ অরুণাভর মা কপাল চাপড়ালেন, তুমি এ কী খবর আনলে বউমা, কে বলল?
দর্জিপাড়ার মৃণাল আচায্যি, রত্নার স্বামী মারা গেছে, মৃত্যু সংবাদ নিয়েই এসেছিল ওর পিয়ালি টাউনের দেওর, ধর্মদা, ওর বউ জানত, রত্নাকে জানায়নি, নিয়ে গেল উজ্জয়িনী স্বামী অসুস্থ বলে৷ আহা রে একা একা পাঠাতে বুক কাঁপল না ওদের, ছোট বোনটা বিধবা হল...
মৃণাল আচায্যি অলকাকে ধরেছিল আজ তার দিদির বাড়িতে৷ রত্না তাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে খবরটা যেন কেউ না জানে৷ আর কেউ না৷ ওর দাদা বউদি, ফ্ল্যাটবাড়ির প্রতিবেশীরা যেন খবর না পায়৷ জানলে ওরা কষ্ট পাবে৷
ধর্মদাস জানে না? অরুণাভ জিজ্ঞেস করে৷
— বলছি তো জানে, সব জানে৷ পিয়ালি টাউনে গিয়েছিল মৃণাল আচায্যি রত্নার চিঠি পাওয়ার পর, সব শুনে এসেছে, কিন্তু রত্না জানে যে ধর্মদাসরা জানে না, মৃণালকে বার বার লিখেছে তার খবর কেউ যেন না শোনে৷
অরুণাভ ফিসফিস করল, বলল, কেন তাহলে?
অলকা বেদনায় ভেঙে পড়ে, বলবে না ভেবেছিল, কিন্তু না বলে পারছিল না৷ আমাকে দিয়েও প্রমিস করিয়েছে আমি কাউকে বলব না, মৃণাল আচায্যি যে রত্নাকে খুব ভালবাসে, কথা বলতে বলতে তার চোখে জল চলে এল গো...৷
অরুণাভ থরথর করে কাঁপল অলকার কথায়৷ মায়ের মুখ থমথমে, মেঘভারী৷ অলকাও হঠাৎ স্থির, ক্রমশ ধাতস্থ হচ্ছে, কথাগুলি আস্তে আস্তে কেটে কেটে বলছে৷ মেয়ে লিখেছে সবাই যেন জানে সে সুখে আছে, ভাল আছে৷ দাদা বউদিরা তো দেখেশুনে সুপাত্রর হাতে সমর্পণ করেছিল তাকে, ভাগ্যে সব সুখ সয় না৷
রত্না আরও লিখেছে কলকাতায় আর ফিরবে না৷ ফ্ল্যাটবাড়ির মানুষগুলির সামনে বৈধব্য নিয়ে সে দাঁড়াতে পারবে না৷ কলকাতার মানুষকে সে কষ্ট দিতে পারবে না৷ সন্তানকোলে সে একনও পুজো দিয়ে যাচ্ছে মহাকালে মঙ্গলনাথের মন্দিরে, শিপ্রার কূ লে কূ লে মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায়৷ সে খুঁজছে আরও প্রার্থনার জায়গা, আরও আরও৷ মসজিদ খুঁজে পেয়েছে, গির্জা পেয়েছে, আরও পেয়ে যাবে জগতে কত না প্রার্থনার জায়গা, গাছগাছালি, নদী, পাহাড়, জমি৷ তার প্রতিবেশীরা যেন ভাল থাকে, তার স্বজন পরিজনেরা যেন ভাল থাকে, তার সন্তান যেন ভাল থাকে...
দমকা ভিজে বাতাস অরুণাভর বুকে ঝাপটা মারে৷ সে মাথা তোলে৷ পশ্চিমে চিৎপুর রেল ইয়ার্ড পেরিয়ে গঙ্গার ওপার থেকে আসছে মেঘ পুঞ্জে পুঞ্জে, দলে দলে৷ উজ্জয়িনী, প্রাচীন অবন্তিকায় তার আর যাওয়া হবে না৷ এ জীবনে আর কখনও না৷ বৈধব্য সে সহ্য করতে পারবে না৷ বিধবা নগরনন্দিনীকে সে দেখতে পারবে না ওখানে গিয়ে৷ সে দেখল মেঘ এসে দাঁড়িয়েছে জানালার ওপারে৷ বাতাস আবার ঝাপটা মারে৷ বিছানার চাদর উড়ল, খসে পড়ল ক্যালেন্ডার৷ মেঘ যেন পুবদেশীয় এই নগর চিনে চিনে এখানে এসে থামল৷ মেঘ দেখছে নগরের জীর্ণ ফ্ল্যাটবাড়িটিকে, যেখানে মানুষ গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাঁচে, কেউ কাউকে ভুলতে পারে না কখনও৷ বৃষ্টি নামল অঝোরে৷ বৃষ্টির শব্দে শব্দে নগরময় উচ্চারিত হচ্ছে মেঘের খবর, কী খবর?
অরুণাভ কান পাতে৷ বৃষ্টির অক্ষরে অক্ষরে উজ্জয়িনীর খবর, সে ভাল আছে... খুব ভাল আছে, বিন্ধ্যাচলের মেঘ তার খবর নিয়ে এসেছে এত দূর৷ অরুণাভ দু’হাতে চেপে ধরেছে জানালার গরাদ৷ কানে আসছে আকুল কণ্ঠস্বর, বৃষ্টি বৃষ্টিতে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে নগরের আনাচে-কানাচে... মেঘ হে মেঘ, তুমি পুব দেশে গিয়ে হুগলি নদীর কূলে একটি নগর দেখতে পাবে, সেই নগরে খুঁজে খুঁজে পেয়ে যাবে আমার স্বজন-পরিজন প্রতিবেশীরা আছে যে জীর্ণ অট্টালিকায়, তা৷ অট্টালিকাটি দেখলেই চিনবে, বহুকাল তার গায়ে রঙ পড়েনি, বহুদিন তার বাসিন্দাদের বুকে আনন্দ জাগেনি, এক নিঝুম থমথমে পুরী যেন-বা— মেঘ, তুমি বোলো আমি সুখে আছি, তুমি আকুল ধারায় ভাসিয়ে দিয়ো ওই নগর, ওই নগর বড় তাপিত, শুষ্ক, মানুষ বড় কষ্টে আছে সেখানে৷
0 মন্তব্যসমূহ