Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

আছি | সুচিত্রা ভট্টাচার্য

বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি মতন এসে গিয়েছিল প্রিয়ব্রতর। চটকা ভাঙল উড়ে আসা কথোপকথনের শব্দে। টের পেলেন সরমার বাধা পুরুত বিমল হালদার এসেছে বাড়িতে। বাইরের ঘরে ফর্দ বানানো চলছে জোর। ঘাটকাজের। শ্রাদ্ধের। কোন কোন উপকরণ কতটা লাগবে বিমল তার মাপ বলছে, পিকলু লিখে নিচ্ছে প্রশ্ন করে করে।

চোখ থেকে চশমাটা নামালেন প্রিয়ব্রত। কাচ মুছছেন। ভুরুতে ভাজ। তেল ঘি মধু প্যাকাটি কুশ, শব্দগুলো ধাক্কা মারছে কানের পরদায়। এত চেচিয়ে চেচিয়ে না আওড়ালেই কী নয়! সকাল থেকে মাথাটা ধরে আছে, ওই চিৎকারে টিপটিপ ভাব বেড়ে যাচ্ছে আরও। এখন এক কাপ চা পেলে আরাম হত খানিক। কটা বাজে? সূর্যের হাল দেখে তো মনে হয় বেলা অনেকটাই গড়িয়েছে। এখনও কী চায়ের সময় হল না!

অভ্যেস মতোই প্রিয়ব্রত হেঁকে উঠছিলেন, সরমা, কেটলি চড়িয়েছ? প্রশ্নটা কণ্ঠনালিতেই থমকে রইল। ফ্যাকাশে হাসি ভেসে উঠেছে ঠোটে। কাঁপছে। ভুসোকালি মাখা হ্যারিকেনের আলোর মতো। আশ্চর্য, আট আটটা দিন হয়ে গেল সরমা নেই, এখনও কেন যে তার অনস্তিত্বটা ধাতস্থ হল না!

প্রিয়ব্রতর ক্ষোভটা ফের চাগিয়ে উঠল। একটা অক্ষম জ্বালা। সঙ্গে বোধহয় খানিকটা পোড়াও আছে। বলা নেই, কওয়া নেই, ড্যাং ড্যাং করে কেমন চলে গেল সরমা। একেবারে বিনা নোটিশে। এতটুকু প্রস্তুতির অবকাশ দিল না! অবশ্য মৃত্যু আসন্ন জানলেও কি মনকে পুরোপুরি তৈরি করা যায় ?

আটদিন আগের সন্ধেটাকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলেন প্রিয়ব্ৰত। রোজকার মতোই পুজোটুজো সারল সরমা, টিভিতে খান তিনেক সিরিয়াল গিলল, নটা নাগাদ খাওয়াদাওয়া, নাতনির জ্বর যাচ্ছিল বলে মেয়েকে ফোন করে তার খোঁজখবর নিল স্বভাবমতো। ফুলকপির ডালনায় ঝাল বেশি দেওয়া নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে মৃদু বিতণ্ডাও হয়েছিল, যেমন হয় নিত্য। তারপর রাতে বিছানা টিছনা করে মশারি পর্যন্ত টাঙাল নিজের হাতে। ঠাণ্ডা পড়ছে বলে জানলা বন্ধ করা, ঠাকুর প্রণাম, বাতিকগ্রস্তের মতো খাটের পাশে চেয়ার টেনে এনে তার ওপরে জল রাখা, কোনও নিয়মেরই ব্যত্যয় ঘটেনি। তখনও সরমা দিব্যি সুস্থ, দিব্যি স্বাভাবিক। মশারিতে ঢুকে কী যে হল, হঠাৎ এক মৃদু আর্তনাদ, পরক্ষণেই সংজ্ঞাহীন। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে কল, মেয়ে-জামাইকে ফোন...। ডাক্তার বাড়িতে পা রাখার আগেই সব শেয। চিকিৎসা করার সুযোগটা পর্যস্ত মিলল না। কোনও মানে হয় ?

নিৰ্ঘাৎ প্রেশার সুগারের রোগ বাধিয়ে বসেছিল সরমা। বোঝার তো জো নেই, কস্মিনকালেও চেক আপ ফেক আপের ধার ধারেনি। প্রিয়ব্রতকে ঠেলে ঠেলে ডাক্তারের কাছে পাঠাবে, অথচ নিজে তিনি স্টেথোআলাদের ছায়া মাড়াবেন না। বললেই বড় বড় লেকচার, আমি তোমার মতো হেপোকেশো রোগী নই। নিজেকে সামলাও, তাহলেই হবে। ইদানীং অবশ্য হাঁটুর ব্যথায় কাহিল হত মাঝেমধ্যে, নিজেই ওস্তাদি মেরে পেনকিলার খেত মুঠো মুঠো। উল্টোপাল্টা ওষুধেরই কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছে কিনা কে বলতে পারে! সেরিব্রাল অ্যাটাক কি অকারণে হয়?

—বাবা... ? বাবা... ?

বারান্দায় পিকলু। পরনে মাতৃবিয়োগের ধরাচুড়ো, গালময় খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ট্যাকে কুশাসন, হাতে মোবাইল। গায়ে একখানা হাফস্লিভ সোয়েটারও চড়িয়ে রেখেছে। এখনও তেমন একটা শীত পড়েনি, তবুও। সরমা বড্ড পুতুপুতু করে মানুষ করেছে ছেলেটাকে।

চশমাখানা পরে নিয়ে সোজা হলেন প্রিয়ব্রত। গত কদিন ধরেই গলায় একটা । ডেলা জমাট বেঁধে আছে সর্বক্ষণ, গলা ঝেড়ে ডেলাটাকে সরানোর চেষ্টা করলেন। কৃত্রিম সপ্রতিভ ভাব ফোটালেন স্বরে,—কিছু বলবি মনে হচ্ছে? '

—ঘাটকাজ নিয়ে তোমার সঙ্গে একটু আলোচনা ছিল।

—আমার তো কোনও কাজ ফাজ নেই! ।

—না,না, কাজটা কোথায় করা যায়, সেটাই ভাবছিলাম।

—সে আমি কী বলব ? ওটা তো তোমার আর বিমলের ব্যাপার।

—ঠাকুরমশাই তো বলছেন ঘোষপুকুরে সেরে নিতে। ওখানে নাকি আজকাল অনেকেই করে।

—ভাল। তাই করো। ঝঞ্জাট কম।

—কিন্তু আমার যে মন খুঁতখুঁত করছে বাবা। গঙ্গায় গেলেই কি ভাল হয় না? গড়িয়া থেকে বাবুঘাট কী এমন দূর; ট্যাক্সি নিয়ে নেব।

—তোমারই হ্যাপা বাড়বে। পুরুত, নাপিত, নতুন জামাকাপড়, জিনিসপত্র, যাবতীয় বোঝা টেনে টেনে নিয়ে যেতে হবে। তারপর ধরো তোমার বউও আছে।

—ওর যাওয়া তো অবলিগেটারি নয় বাবা। বাড়িতেই নাপিত ডেকে, নরুন ছুইয়ে... তবে আমি বলব সুপর্ণাও চলুক। যাওয়া উচিত।

—দ্যাখো, যা ভাল বোঝো। তবে গঙ্গায় গিয়ে কাজ করলেই কি তোমার মার অনন্ত স্বৰ্গবাস হবে? নাকি পুকুরে ক্রিয়াকর্মসারলে সে নরকে পচবে?

—ওফ, বাবা! পিকলু হেসে ফেলল,—আমিও কি এসব বিশ্বাস করি? তবে...

—তবে কী ? "

—মা তো মানত। তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে তো অনার দিতেই হয়। তাছাড়া সবই যখন করছি, এটুকুই বা ফাক রাখি কেন?

—আমি তো আপত্তি করিনি। তুমি তো সব ব্যাপারেই খুব প্র্যাকটিকাল, তাই বলছিলাম।

খোঁচাটা কি বেশি তীক্ষ শোনাল? প্রিয়ব্রত আড়চোখে লক্ষ করলেন ছেলেকে। তেমন একটা ভাবাস্তর তো চোখে পড়ে না। শোকার্ত পিতার মন্তব্য ভেবে খুব একটা আমল দিল না বোধহয়। সরমা শুনলে অবশ্য বেজায় চটে যেত। ছেলের সম্পর্কে সামান্যতম টিপ্পনীও পছন্দ করে না সরমা। ফের ভুল হল। করত না।

এই নিয়ে কত যে ধুন্ধুমার বেধেছে। এই তো, এবার পুজোয় পিকলু বউ বাচ্চা নিয়ে কলকাতায় এল, রাজা আর পুচকুন সহ সুপর্ণা উঠল লেক রোডে, সুপর্ণার বাপের বাড়িতে। ষষ্ঠী থেকে দশমী সেখানে কাটিয়ে তবে আসবে গড়িয়ায়। পিকলুও গোটা পুজো ওখানেই পড়ে রইল সারা দিন। রাতে শুধু বাড়ি ফিরে শয্যাগ্রহণ। তাও তো অষ্টমীর রাতে ফিরলই না। বছরকার দিনে বাচ্চা দুটোকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যা, বাবুর সে হুশও নেই। দুঃখ করে প্রিয়ব্রত বলেছিলেন, তোমার পুত্তুর এখন বালিগঞ্জ চিনে গেছে, গড়িয়ার বাপ মাকে তার আর মনে ধরছে না। শুনেই সরমা ঝনঝন, কী ছিরির কথা! এ বাড়িতে সারাক্ষণ পড়ে থেকে পিকলু করবেটা কী, অ্যা? তোমার হাড়িমুখ দেখবে বসে বসে ? ওখানে ঘরের দরজায় প্যান্ডেল, ভিড় আলো হইহল্লা, ও বাড়িতে অত লোকজন... চার বছর পর পুজোর সময়ে এল... কটা দিন মনের সুখে আনন্দ ফুর্তি করবে না সবাই! ছেলে বাঙ্গালোরে ফ্ল্যাট কিনছে শুনে প্রিয়ব্রত ঠাট্টার সুরেই বলেছিলেন, বুঝলে তো, পাছে এই গেয়ো পরিবেশে ফিরতে হয়, তাই তোমার পিকলুসোনা আগেভাগেই গোড়া মেরে রাখছে...। সঙ্গে সঙ্গে সরমার ওকালতি,তুমি কি চাও ছেলেটা ওখানে অনন্তকাল মাস মাস বারো হাজার করে ভাড়া গুনে যাক ? জানো না, লোন নিয়ে বাড়ি করলে ট্যাক্সে কত ছাড় হয় ? নিজের ছেলে একটা সম্পত্তি বানাচ্ছে, তাই দেখেও তোমার চোখ টাটায়?

প্র্যাকটিকাল হওয়ার দোহাই পেড়ে ছেলে উল্টোসিধে যা বোঝাত, তাতেই উদ্বাহু হয়ে নৃত্য জুড়ত সরমা। এখান থেকে বদলি নিয়ে বাঙ্গালোর চলে গেল পিকলু, সরমার কণ্ঠে পিকলুরই যুক্তি—হেডঅফিসে থাকলে উন্নতির সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। প্লাস, মাইনে বেশি, সুযোগও কত! নিজের কোম্পানির সঙ্গে না বনলে টুকুস করে বেটার কোথাও চলে যেতে পারবে। আর বাঙ্গালোর কীই বা এমন দূরদেশ, আকাশপথে তো মাত্র আড়াই ঘণ্টা।

পিকলুর আত্মকেন্দ্রিকতা বোঝার মতো বুদ্ধি সরমার ঘটে ছিল না। মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ছেলে তড়িঘড়ি উড়ে এসেছে, কাছা নিয়েছে, কঠোরভাবে অশৌচ পালন করছে, ঘটা করে শ্রাদ্ধশাস্তি করবে... সরমা নিশ্চয়ই ওপারে বসে আহ্লাদে আটখানা। অবশ্য আদৌ ওপার বলে যদি কিছু থাকে!

পিকলু ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। বিমল হালদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাকে গেট অবধি এগিয়ে দিয়ে এল। ফের ফিরেছে বারান্দায়। প্রিয়ত্রতর পাশের চেয়ারটায় বসল। কুশাসন পেতে। হাতে একখানা ফুলস্কেপ কাগজ, চোখ বোলাচ্ছে এক মনে। লাল কালির ডটপেনে টিক মারছে টকাটক। দেখতে না চেয়েও তাকিয়ে ফেললেন প্রিয়ব্রত—কী রে ওটা ?

—নেমন্তন্নর লিস্ট।

—কাকে কাকে বলা বাকি রইল ?

—অনেক। ভাবছি এবার টেলিফোনে কিছু সেরে দেব। মার সার্কল তো নেহাত ছোট ছিল না। কত জনকে আর গিয়ে গিয়ে বলা যায় ?

—সববাইকে বলার দরকারই বা কী ?

—তা হয় না কি ? খবর পেয়েই সবাই ছুটে ছুটে এসেছে, ফোন করছে. কাজের দিন তাদের না ডাকলে চলে ?

—হুম। তো কত লোক হচ্ছে শেষ পর্যন্ত ? -

—তা ধরে প্রায় তিনশো। এরপর পাড়া আছে, তাদের লিস্ট আলাদা। মা'র সঙ্গে সবার যা টার্ম, আশপাশের কাউকেই তো বাদ দেওয়া যাবে না।

তা বটে। দুনিয়া সুদ্ধ সকলেই তো সরমার বন্ধু পরিজন। এক সময়ে ভবানীপুরের বাড়িতে ভয়ানক উৎপাত ছিল আত্মীয়স্বজনের, ওই সরমার কারণেই। ভাই দিদি ভাসুর ননদরা তো আছেই, কোথায় কোন রাঙামাসির খুড়তুতো দেওরের মেয়ে, কিংবা লাবুপিসির ননদের ভাসুরঝি, সব্বাই সরমার প্রাণের সখী দিনভর ক্রিং ক্রিং রিং, আর খুটুর খুটুর ডায়াল। ভিড়ভাট্টা হট্টগোল, লোকজনের সঙ্গে গলাগলি, মাখামাখি, কোনও কালেই প্রিয়ব্রতর বরদাস্ত হয় না, কিন্তু সরমার ওগুলোই প্রিয়। শেষ বয়সে নিরিবিলিতে থাকার লোভে গড়িয়াতে জমি কিনলেন, ছোটমোটো একখানা বাড়িও বানালেন, হা হতোস্মি, কোথায় নিরালা গড়িয়ায় এসে গোটা পাড়াটাকেই আত্মীয় বানিয়ে ফেলল সরমা। এ বাড়ির বউ, ও বাড়ির মেয়ে, সে বাড়ির নাতনি, সবাই সরমার ভক্ত। বাটি চালাচালি হচ্ছে অনবরত, টিফিনকৌটো ছুটছে— এবাড়ি থেকে ওবাড়ি, অমুকের নাতির সোয়েটার বুনে দিচ্ছে, তমুকের গিন্নিকে ডেকে নতুন ডিজাইন তুলছে দুপুরভর. আর এই বারান্দাটা তো ছিল খবরের কাগজের অফিস। কম্পিউটার টেলিপ্রিন্টার ছাড়াই প্রতিটি বাড়ির তথ্য এসে জমা হচ্ছে, কমপোজ হচ্ছে মুখে মুখে, ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসে বাতাসে। এ পাড়ায় তারা আছেন সতেরো বছর, সাকুল্যে সাড়ে আটজন মানুষও প্রিয়ব্রতকে চেনে কি না সন্দেহ।

অথচ সরমার নাম করলে বোধহয় আধ মাইল দূরের লোকেরাও একবাক্যে বলবে, সেই ফরসা মতন, হাসিখুশি চেহারার, ছোটোখাটো মহিলা তো...।

সরমার জনপ্রিয়তার খেসারত দিতে দিতে প্রিয়ব্রত নাজেহাল। শুধুশাস্তি বিঘ্নিত হওয়াই নয়, ছেলেমেয়ের বিয়েতে নেমস্তন্ন করতে হয়েছে গাদাগুচ্ছের। এতটুকু গজগজ করলেই পাল্টা ফোস, নিজে হুঁকোমুখো হয়ে ঘরে ঘাপটি মেরে থাকো বলে আমাকেও কি তাই হতে হবে? বিয়ে করে এমন কিছু মাথা কিনে নাওনি, তোমার ছাচে আমি চলব কেন ? বোঝে অবস্থা !

এবার অবশ্য পিকলুই ল্যাঠা সামলাচ্ছে। নেমস্তন্ন, খরচাপাতি, ডেকরেটার, কেটারার, সব। মাতৃদায় বলে কথা!

প্রিয়ব্রত চেয়ারে হেলান দিলেন। ভাববাচ্যে প্রশ্ন ছুড়লেন,—খাওয়াদাওয়া কী হচ্ছে? সববাইকে কি পাত পেড়ে?

অনেকেই শ্ৰাদ্ধবাড়িতে খায় না। তবে ব্যবস্থা তো সবার জন্যই রাখতে হবে।

—অনর্থক অপচয়। লটে প্যাকেট সিস্টেম করতে পারতে।

—মা যে প্যাকেট ম্যাকেট পছন্দ করত না বাবা। বলত, কাউকে ডাকলে পেট ভরে খাওয়াবি। অন্তত আমার কাজে লোকের হাতে রাধাবল্লভি আর মিষ্টির বাক্স ধরিয়ে দিস না।

শ্ৰাদ্ধ কি ফুর্তিফার্তার অনুষ্ঠান, যে গাণ্ডেপিণ্ডে গেলাতে হবে! লোকজন শ্রাদ্ধবাসর থেকে বেরিয়ে গাঁউ গাঁউ ঢেকুর তুলতে তুলতে রান্নাবান্না নিয়ে আলোচনা জুড়ছে, দৃশ্যটাই কী অশালীন। ভাবলেও প্রিয়ব্ৰতর বিবমিষা জাগে। কিন্তু কী আর করা, সরমার চিন্তা-ভাবনা চিরদিন উল্টো খাতে বইল যে। যত্তসব কুনিয়ম কু-আচারের ঠুলি পরে রইল চোখে। আর ছেলে তো এখন মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ। জীবৎকালে মাকে নিয়ে ভাবুক ছাইনা ভাবুক, এখন সে মার কোনও সাধ অপূর্ণ রাখবে না।

প্রিয়ব্রত চুপ করে রইলেন। কথা বাড়ানো মানেই তো মিছিমিছি অপ্রিয় হওয়া। সরমার মতো মিঠে মিঠে বুলি তো তার আসে না, দুর্মুখ বদনামের ধ্বজা নয় আর নাই ওড়ালেন।

রুনি চা এনেছে। এতক্ষণে। বারান্দায় বেতের চেয়ার দুটোর সঙ্গে একটা বেঁটে টেবিল রাখাই থাকে, তার ওপর ট্রে নামিয়ে কাপ তুলে দিল বাবা আর ভাইকে। নিজেও নিয়েছে। প্রিয়ব্রতকে জিজ্ঞেস করল,—তোমায় বিস্কুট দেব, বাবা ?

প্রিয়ব্রত যেন শুনতে পেলেন না। হঠাৎই ঈষৎ অন্যমনস্ক। একদৃষ্টে ট্রে-খানা দেখছেন। হাতলঅলা। বাঁশের তৈরি। বছর পাঁচেক আগে হ্যান্ডিক্রাফটসের মেলা থেকে কিনেছিল সরমা। কেনাই সার, প্রাণে ধরে এক দিনও ব্যবহার করেনি। এমন আরও যে কত শৌখিন জিনিস পড়ে আছে থরে থরে। আনকোরা। কী যে উদ্ভট শখ! যে জিনিস কাজেই লাগবে না, কেন যে তার পিছনে পয়সা নষ্ট! সরমা অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও তর্কে যেত না, হাসত মিটিমিটি। কেন যে হাসত? বাড়িতে এখন লোক আসছে হরদম,চাটা মিষ্টিটা দিতে হচ্ছে,তাই বুঝি কাচআলমারি থেকে গেছে কি ?

দেখে কি খারাপ লাগছে প্রিয়ৱতর ? কষ্ট হচ্ছে? প্রিয়ব্রত বুঝতে পারছিলেন না ঠিকঠাক। শুধু একটা চোরা অস্বস্তি টের পাচ্ছেন বুকে। সরমার জিনিসপত্রর ওপর মায়াটা কি তার মধ্যে সংক্রামিত হল?

রুনি ফের ডাকছে,—কী গো বাবা, দেব বিস্কুট?

ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললেন প্রিয়ব্রত, —নাহ। বিকেলের প্রথম চাটা আমরা তো শুধুই খাইরে।

আমরা খাই শব্দ দুটো যেন দোল খেয়ে গেল বারান্দায়। বাতাস যেন কেঁপে উঠল একটু। পিকলুর মুখে পলকা ছায়া, রুনির চোখে মেঘের আভাস।

ভারী গলায় রুনি বলল,—তোমায় চা দিতে বোধহয় একটু দেরি হয়ে যায় বাবা, তাই না?

—ঠিকই আছে। তোরা কাজকর্মে ব্যস্ত...

—বুঝতে পারছি ক’দিন ধরে তোমার খুব অনিয়ম হচ্ছে।

প্রিয়ব্রত এবার আর জবাব দিলেন না। কীই বা বলবেন? অনিয়মকেই তো নিয়ম করে নিতে হবে এখন থেকে। অনভ্যাসকে অভ্যাস।

পিকলুর মোবাইল বেজে উঠেছে। খুদে যন্ত্রটা কানে চেপে গ্রিলের ধারে উঠে গেল পিকলু। অফিসের ফোন, চোস্ত ইংরেজিতে কথা চলছে। এখানে আসা ইস্তক মাঝে মাঝেই ফোনাফুনি চলছে অফিসের সঙ্গে। আপনাআপনি ভুরু কুঁচকে গেল প্রিয়ব্রতর। কী চাকরি, মা মরলেও নিস্তার নেই!

ফোনালাপ শেষ করে পিকলু ফিরল চেয়ারে। ফুলস্কেপ কাগজটা ভাজ করে কোলের ওপর রাখল। সহজ সুরে জিজ্ঞেস করল,—আমার গেঁড়া দুটাে কোথায় গেল রে দিদি? অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ নেই?

চা শেষ করে কাপ ট্রে-তে রাখছিল রুনি। হেসে বলল,—পুচকুন তো এই সবে ঘুমোল। সারা দুপুর যা দস্যিপনা করল, বাপ্‌স।

—আর আমার বড়টি কি করছেন?

—সে যথারীতি টিভির সামনে। পোগো চ্যানেল।

—উফ, ছেলেটার বড্ড টিভির নেশা হয়েছে। স্কুল থেকে ফিরে জামাজুতো পর্যন্ত ছাড়ে না, রিমোট নিয়ে বসে যায়। সুপর্ণার সঙ্গে তো ওর রোজ এই নিয়ে লাগে।

—এই একটা ভাইস থেকে আমি কিন্তু বেঁচে গেছি। ঝুমুরটার কোনও কালেই টিভির নেশা ছিল না। এখন বড় জোর এক আধটা গানের প্রোগ্রাম দেখে, কিংবা কুইজ টুইজ, ব্যস।

—তার জন্যই ওর ব্রেনটা অত শার্প।

—সে আমাদের রাজাও খুব বুদ্ধিমান। পুচকুনকে সেদিন কী সুন্দর করে বোঝাচ্ছিল, ঠাম্মা আকাশে চলে গেছে ঠাম্মা আর ফিরবে না, ঠাম্মা এখন তারা হয়ে গেছে..

—হুম। মৃত্যু ব্যাপারটাকে ও নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে। পিকলুর মুখে আবার ছায়া। ধরা ধরা গলায় বলল, —একমাত্র আমারই মগজে ঢুকছে না মা কী করে হঠাৎ নেই হয়ে গেল! আনবিলিভেবল। সেদিন মাঝরাত্তিরে যখন জামাইবাবুর ফোনটা পেলাম, দিদি তুই ভাবতে পারবি না, উইওয়্যার সো স্টান্ড। সুপর্ণা তো সঙ্গে সঙ্গে সুটকেস গোছাতে শুরু করল, আর আমি থ্রু আউট দা নাইট ঠায় বসা। নিজেই নিজেকে বার বার বলছি, খবরটা ভুল, খবরটা ভুল।

—আমার তো এখনও বিশ্বাস হয় না। রুনি জোরে নাক টানল,—মা ছাড়া এ বাড়ি আমি কল্পনাই করতে পারি না। বাবা যে কী করে এখানে একা একা থাকবে।

—কী যে তুই বলিস। বাবা একা থাকবে কেন? বাবা আমার সঙ্গে যাবে। পিকলু ঝুঁকে প্রিয়ব্রতর কবজি ছুঁল,—কী, যাবে তো?

— উঁ?

—উঁ ফুঁ নয়,তুমি আমার কাছে থাকবে। ফার্স্টলি, ফাকা বাড়িতে তোমার বাস করাটা আমরা অ্যালাওই করব না। সেকেন্ডলি, বাঙ্গালোরের ক্লাইমেট তোমার খুব সুট করে। তুমি নিজেই দেখেছ। না গরম, না ঠাণ্ডা। না ড্রাই, না ওয়েট। আইডিয়াল প্লেস ফর ইওর এজ অ্যান্ড হেলথ।

সরাসরি কথাটার প্রতিবাদ করতে পারলেন না প্রিয়ব্রত। গত আট বছরে তিনি বার কয়েক গেছেন বাঙ্গালোরে। প্রথমবার অবশ্য স্বেচ্ছায় নয়।সরমার জোরাজুরিতে। পিকলু তার আখের গোছাতে বাপ মাকে ফেলে কেটে পড়ল, সে ডাকলেই ওমনি ল্যাং ল্যাং করে ছুটতে হবে ? প্রিয়ব্রত অন্তত সেরকম বাবা নন। তবে যাই হোক, গিয়ে পড়ার পর কিন্তু মন্দ লাগেনি। চমৎকার শহর, সুন্দর সুন্দর বাড়ি, অজস্র পার্ক, এখনও অনেক সবুজ আছে, বাতাসও মোটামুটি নির্মল... । পুচকুন তখনও হয়নি, ছোট্ট রাজাকে নিয়ে সময় কেটেছে হুহু করে। তারপর থেকে তো মাঝেমধ্যেই ব্যাঙ্গালোর ভ্রমণ চলছে। গেলে সুপর্ণাও খুব যত্নআত্তি করে, নাতি দুটোও ফেরে পায়ে পায়ে।

কিন্তু সে তো স্রেফ বেড়ানো। মেয়াদ তিন হপ্তা, কী মেরেকেটে এক মাস। যাওয়ার জন্য যার বেশি উৎসাহ, দিন পনেরো কাটলেই তারই যে পালাই পালাই রব। গোবিন্দর মার হাতে বাড়ি ছেড়ে এসেছি, কী হাল করে রাখছে কে জানে!.. ইশ, গোবিন্দটা মনে করে জল না দিলে গাছগুলো সব মরেই যাবে গো!... না চালিয়ে চালিয়ে পাম্পটা আচলই হয়ে গেল বোধহয় ।

প্রিয়ব্রত তখন হাসতেন। ঠাট্টা জুড়তেন। বলতেন, স্বর্গে গিয়েও তুমি বাড়ির ভাবনায় দু’পা ছড়িয়ে কাঁদবে। কী আশ্চর্য, আজ সরমারই সেই উদ্বেগ বেজে উঠল তার গলায়;—তোর কাছে চলে গেলে আমার এই বাড়ির কী হবে?

—এটা কোনও প্রবলেমই নয় বাবা। আপাতত দিদি জামাইবাবুরা দেখাশুনো করুক, পরে ভেবেচিত্তে কিছু একটা করা যাবে।

—দেখি ।

—উহু, ওভাবে এড়িও না। আয়াম সিরিয়াস। সুপর্ণাও তোমাকে একা রেখে যেতে রাজি নয়। নিয়মভঙ্গের পরের পরের দিন ফিরছি আমরা,তোমারও প্লেনের টিকিট বুক করা হচ্ছে।

—সে কী? আমন হুট বলতে যাওয়া যায় নাকি ? একটা আস্ত সংসার ফেলে রেখে... পাকাপাকি..? প্রিয়ৱতর স্বরে খানিকটা অপ্রসন্নতা এসেই গেল। এমন চটজলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া তার ধাতে নেই,ভালও লাগছে না। তিনি কি এখন বোঁচকা, যে কাধে ফেলে দৌড়তে হবে ?

পিকলু কিন্তু হাসছে—তোমার আবার সংসার কী ? কিছু মনে কর না বাবা, সংসার তো ছিল মার। তুমি তো থাকতে পেয়িং গেস্টের মতো। বাজার করা ছাড়া কুটােটি পর্যন্ত তোমায় নাড়তে হয়নি। ওখানে তো তোমার সেই পরিশ্রমটুকুও থাকবে না। খাও দাও, ঘোরো, হাটো চলো ফেরো, বইপত্র নিয়ে ডুবে থাকো... একেবারে তোমার মনের মতো লাইফ।

দুদিকে মাথা নাড়লেন প্রিয়ব্রত। হয় না, হয় না। কারণটা ছেলেকে ঠিক বোঝাতেও পারছেন না। আরও যেন তাই অসহায় লাগছে নিজেকে। জাগতিক হিসেবে তার তো চলে যাওয়াই শ্রেয়। তার প্রেশার আছে, লাঙসের অবস্থাও ভালো নয়, রাতবিরেতে অসুস্থ হয়ে পড়লে বিচ্ছিরি পরিস্থিতি হবে, মেয়ে-জামাইয়েরও আতাত্তর, কাজের লোকের ভরসায় পড়ে থাকা...। তবু কোথায় যেন একটা বাধছে। কোথায় যে!

রুনি বাবাকে দেখছিল। বোধহয় অনুমান করতে পারল প্রিয়ব্রতর দোলাচল। পিকলুর দিকে ফিরে বলল,—শোন, অনৰ্থক তাড়াহুড়ো করিস না। বাবার মনটাকে একটু থিতু হতে দে। তোরা নিশ্চিন্তে চলে যা,আমি নয় ক'দিন এখন বাবার কাছে এসে থাকব। আর ঝুমুরের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে গেলে আমরা তো সবাই বাঙ্গালোর যাচ্ছি, তখন নয় বাবাও...।

—হুম। পিকলু মাথা দোলাল, সেটাও অবশ্য মন্দ নয়। ইন দামিন টাইম আমরা নতুন ফ্ল্যাটে শিফটও করে যাব, বাবাকেও মাল টানাটানির দক্ষযজ্ঞে থাকতে হবে না।

—তোরা পজেশান পাচ্ছিস কবে?

—অরিজিনালি তো নভেম্বরে ডেট ছিল। তা সে ডেট তো কবেই পেরিয়ে গেছে। এখন বলছে ফাস্ট জানুয়ারি, আমি ধরে নিচ্ছি ফিফটিনথ।

—দেরি করছে কেন ?

—করছে। কী সব কমপ্লিশান সার্টিফিকেট বাকি...।

—তোদের হাউসিং-এর লোকেশানটা ঠিক কোথায়? সাউথ বাঙ্গালোরেই তো?

—পুরো দক্ষিণ নয়, একটু পুব ঘেষা। আমাদের মেন অ্যাডভান্টেজ যেটা হবে, সুপর্ণার স্কুলটা খুব কাছে। সকালে অটো না পেলে হেঁটে মেরে দেবে। তবে আমার অফিস বা রাজার স্কুলের ডিসট্যান্স খুব কমছে না, সেই আটটা বাজতে না বাজতেই দৌড়।

—সেদিক দিয়ে বাবা আমরা বেশি আছি। তোর জামাইবাবুর অফিস, ঝুমুরের স্কুল সব কাছাকাছি। এখন ঈশ্বর করুন মেয়েটার মাধ্যমিকের রেজাল্টটা যেন ঠিকঠাক হয়, ওকে যেন স্কুল না পাল্টাতে হয়।

—ঝুমুরকে নিয়ে তোর চিত্তা নেই। ও দারুণ রেজাল্ট করবে। অঙ্কে যা মাথা!

—ওটা বাপের ধারা পেয়েছে। লিটারেচারেও বাপ কা বেটি। একের নম্বরের ট্যাড়োশ। এবার ক্লাস টেনে উঠলে ভাবছি টিউটর বদলাব। অন্তত ইংরেজির।

—রাজাও ভাষা নিয়ে বেশ মার খাচ্ছেরে। স্পেশালি কন্নড়টা ও কবজ করতে পারছে না। পুচকুনটাও কী করবে কে জানে!

—ওদের কিন্ডার গার্ডেনে বুঝি কন্নড় নেই? —ওটাই তো বাচোয়া। সামনের বছর থেকে রাজার স্কুলে দেব, তখন হবে বাম্বু।

মায়ের মৃত্যু, বাবার একা থাকার সমস্যা ছেড়ে ভাইবোন ঢুকে পড়েছে নিজেদের বৃত্তে। প্রিয়ব্রত অখুশি হলেন না, বরং যেন স্বস্তি পেলেন মনে মনে। উঠে পড়েছেন চেয়ার ছেড়ে | —কোথায় চললে, বাবা ?

—অনেকক্ষণ বসে আছি, হাঁটি। কোমরটা ছাড়াই।

বাড়ির সামনেটায় ছোট্ট বাগান প্রিয়ব্ৰত-সরমার নন্দনকানন। গেট পর্যন্ত মোরাম ঢালা রাস্তার ডান দিকটা প্রিয়ব্রতর, বা দিক সরমার। ডাইনে ফুল, বায়ে সবজি। বাড়ি করার পর জায়গাটা বহুকাল অযত্নেই পড়েছিল। ঝোপ আগাছা গজাত, লোক ডেকে মাঝেমধ্যে কাটিয়ে ফেলা হত, ব্যাস। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রিয়ব্রতকেই প্রথম গাছগাছালিতে পেল। নাসরি থেকে ভালো জাতের গোলাপচারা এনে পুতলেন জমিতে, রথের মেলা থেকে এল বেলফুলের গাছ, এল তিন-চার জাতের জবা। শীতের মরশুমে ফুটল ডালিয়া গাদা চন্দ্রমল্লিকা। আহা, কী তাদের বাহার। সরমাও খুশি, পটাপট গাদা জবা ছিড়ছে আর ঠাকুরের পায়ে নিবেদন করছে।

পুষ্পচয়নে প্রিয়ব্রতর তীব্র বিরাগ, সরমার তাতে বয়েই গেল। দেবতার পুজোয় না লাগলে ফুল না কী মূল্যহীন। রাজা-সুপর্ণাকে নিয়ে পিকলু যেই বাঙ্গালোর পাড়ি দিল, ফাকা বাড়িতে সরমার হাতে হঠাৎ লাল ঝাণ্ডা— খালি ফুলে নেহি চলেগা, সবজি চাই, সবজি চাই। সরমা যা চাইবে তা না হয়ে রক্ষে আছে! গোলাপচারার ফাঁকে ফাঁকে বসে গেল লঙ্কার চারা, চন্দ্রমল্লিকার গায়ে বেগুনগাছ প্রিয়ব্রত কপাল কুঁচকোলে সরমাও রণং দেহি। অগত্যাশান্তি বজায় রাখতে বাগান হিন্দুস্থান পাকিস্তান। তোমার ভাগে তুমি যত খুশি উচ্ছেবেগুন পটলমুলো ফলাও, আমার বাগানে শুধু ফুলই ফুটবে। তুমি আমার ফুল ছোবে না, আমিও তোমার লেবু-লঙ্কায় জিভ ঠেকাব না। তা শেষ অবধি গো-টা অবশ্য ধরে রাখতে পারেননি প্রিয়ব্রত, খেয়েছেন সরমার লেবু, লঙ্কা, ধনেপাতা। সঙ্গে চাট্টি টিপ্পনীও গিলেছেন। প্রিয়ব্রতর ফুলও পুটপাট চলে গেছে দেবতার শ্রীচরণে। সরমা নাকি মোটেই ছেড়ে না, গাছের তলা থেকে কুড়িয়ে আনে!

বিভাজনরেখার মাঝ বরাবর দাড়িয়ে পুরনো কথাগুলো মনে পড়ছিল প্রিয়ব্রতর। প্রিয়ব্রতর মরশুমি ফুলের চারারাও ম্ৰিয়মাণ। বাগানের জন্য বাইরে একটা কল আছে লম্বা রবারের পাইপ আটকানোই থাকে মুখে, কল খুলে পাইপ হাতে প্রিয়ব্রত ঢুকলেন সরমার এলাকায়। অস্বচ্ছন্দ পায়ে। সিক্ত করছেন গাছগুলোকে। ঝুঁকে দেখলেন টোম্যাটাে গাছে ফল ধরেছে ছোট ছোট। ভিজে পাতা পড়ন্ত সূর্যের আলো মেখে চিকচিক করে উঠল। পাতা বেয়ে জল ঝরছে টুপটাপ। অশ্রুবিন্দুর মতো।

প্রিয়ব্রত বসে পড়লেন উবু হয়ে। আঙুল বুলিয়ে মুছে নিচ্ছেন জল। অচেনা স্পর্শে গাছটা কি চমকাল একটু ? অবাক হল?

সুপর্ণ বারান্দায়। ডাকছে। প্রিয়ব্রত ঘাড় ফেরালেন।

—জলখাবার খাবেন তো এখন? রাজা পুচকুনের জন্য সুজি বানাচ্ছি। দেব?

—সুজি ? —নোনতা সুজি। আপনি তো ভালবাসেন।

তা বাসেন বটে। তার এই নোনতা সুজি প্রীতি নিয়েও কম কথা শুনিয়েছে সরমা! বানিয়েও দিত, আবার গজগজও করত, আজব লোক বাপু ! ঝাল খাবার হলে চিল্লোবে, তেলমশলা ভাজাভুজিতে নাক সিটকোবে, মিষ্টিমাস্টা মুখে রোচে না... ওই ভ্যাস্তা ভ্যাস্তা মাদ্রাজি অখাদ্য গিলে কী সুখ যে পাও! প্রিয়ব্রত হয়তো মুখ ফসকে বলে ফেললেন, অত কথার দরকার কী, রেড়ির তেলে ভাজা চপ শিঙাড়াই খাইও রোজ, তাই খেয়ে পেট পচিয়ে মরব... সঙ্গে সঙ্গে সরমার পাটকেলটি উড়ে আসবে, আমি তো তোমায় বিষই খাওয়াই! একটা বাতিকগ্রস্ত লোকের ঘর করতে করতে আমার জিভেও বাত ধরে গেল!

সেই নোনতা সুজি বানাচ্ছে আজ পিকলুর বউ। কে জানে কেন, তেমন একটা আসক্তি জাগল না প্রিয়ব্রতর। রুচি নেই? খিদে নেই? নাকি অন্য কিছু?

আলগাভাবে বললেন,—রাখা থাক। পরে খাব।

সুপর্ণা চলে যেতেই প্রিয়ব্ৰত আবার বাগানে মনোযোগী। জলসিঞ্চন সমাপ্ত করে ধুলেন হাত-পা। সন্ধে নামছে, এবার শুরু হবে লোকজন আসার পালা। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কারও না কারও পদধূলি পড়বেই।

বিশ্রী, বড্ড বিশ্ৰী কাটে এই সময়টা। সান্ধ্য রুটিনের ছকটা জানা হয়ে গেছে প্রিয়ব্রতর। যে বা যারাই আসুক, প্রথমে খানিকক্ষণ বিষন্নতা বিরাজ করবে ঘরে। চলবে মৃদুস্বরে এলোমেলো স্মৃতিচারণ,সরমার গুণকীর্তন।

তারপর এসে পড়বে দুটো-চারটে মজার ঘটনা, সেই সূত্র ধরে অজস্র হাবিজাবি গল্প। হাসি উচ্ছাসে ক্রমশ থই থই করবে গোটা বাড়ি। বাচ্চারা ছুটবে খেলবে, সুপর্ণা আর রুনি ব্যস্তসমস্ত ভাবে চা বানাবে বার বার, গোবিন্দর মাকে দিয়ে লুচি ফুচি ভাজাবে, প্লেটে মিষ্টি সাজাবে ঘন ঘন। শোক বদলে যাবে উৎসবে। আর সেই উৎসবের এক কোণে দুঃখী দুঃখী, বোকা বোকা মুখে বসে থাকবেন প্রিয়ব্রত। সঙের মতো ।

আজও ভিড় নেহাত মন্দ জমল না। চোখ মুছতে মুছতে উপস্থিত হল সরমার পিসতুতো বোন, ফল মিষ্টি হাতে অরুণাদির ছেলে, ছেলের বউ, কাচুমাচু মুখে রুনির জা ভাসুর, এক জোড়া খুনে বাচ্চা নিয়ে পিকলুর বন্ধু আর পিকলুর বন্ধুর স্ত্রী। রোজকার হাজিরাদার প্রিয়ব্রতর ভাইপো নানটু তো আছেই। একটু রাতের দিকে আবির্ভূত হল কেটারার। ছানার ডালনা, ফুলকপির সঙ্গে ধোঁকা তো হবেই, আরও কী একটা পদ রাখা যায় তা নিয়ে গবেষণা চলল কিছুক্ষণ। মৎস্যমুখে চার রকম মাছ খাওয়াবে পিকলু। রুই, পাবদা, চিংড়ি, আর ভেটকির ফ্রাই। রুনির বাসনা, মাচিতল মাছের মুইঠা বড় ভালবাসত, পাবদার বদলে সেটাই পড়ুক পাতে। ঝিরিঝিরি আলুভাজা বেশি উপাদেয় হবে, না সরমার প্রিয় গরম গরম বেগুনি, তাই নিয়েও আলোচনা চলল খানিক ।

বাড়ি ফাঁকা হতে হতে সাড়ে ন’টা। নৈশাহার চুকতে চুকতে সাড়ে দশ।

খাওয়া দাওয়ার পর বাড়ির সামনেটায় একটু পায়চারি করেন প্রিয়ব্রত। অভ্যাস। আজ আর বেরোলেন না। ঠাণ্ডা বাড়ছে। কানের কাছে খ্যাচর খ্যাচর করার মহিলাটি তো নেই, নিজে থেকে সাবধান হওয়া ভালো। ঘরে এসে বন্ধ করলেন জানলাগুলো। বসেছেন খাটে। সামনেই টেবিলে এলোমেলো বই ছড়ানো। শরদিন্দু অমনিবাসটার ওপর ছোট একটা ছবি। পোস্টকার্ড সাইজে সরমা। বছর সাতেক আগে তোলা। জামাইয়ের ক্যামেরায়। বারান্দায় চেয়ারে শাশুড়িঠাকুরন রাজেন্দ্রাণীর মতো বসে। না-বাঁধানো ছবি, অ্যালবামে ছিল বার করে এখন বই-এর ওপর দাঁড় করানো হয়েছে।

সামনে প্লেটে দুখানা কালাকাঁদ, ছোট গ্লাসে জল। সম্ভবত পুত্রবধু খেতে দিয়ে গেছে শাশুড়িকে। ধূপও জ্বলিয়েছিল পরশুরামের ওপরে। ছাই ঝরে ঝরে মলাটখানা ধূসর।

দৃশ্যটায় প্রিয়ব্রত বেশ মজা পেলেন। সারাটা জীবন সরমা গল্পের বইয়ের ছায়া মাড়ায়নি, প্রিয়ব্রতর পড়াশুনোর অভ্যেসটাকে ব্যঙ্গই করে গেছে শুধু। এখন আর বুলি ফুটছে না তো, তাই ছাই ছড়িয়ে ঝাল মেটাচ্ছে! ভাবছে এতেই যদি প্রিয়ব্রতকে চটানো যায়!

প্রিয়ত্ৰতর ঠোটের কোণে চিলতে হাসি ফুটল। কী বিচিত্র এক সম্পর্ক। বেয়াল্লিশটা বছর তারা একত্রে কাটালেন, অথচ কোথাও তাদের মিল ছিল না। না স্বভাবে, না চলনে বলনে, না রুচিতে, না বিশ্বাসে। তবু পাশাপাশি রয়ে গেলেন তো! তিনি কি অসুখী ছিলেন? কিংবা সরমা? এত অমিল, এত বিষাদ সত্ত্বেও একে অন্যের এত কাছাকাছি থাকা যায় কোন জাদুতে?

রুনি ঘরে ঢুকেছে। বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে মার ছবিটাকে দেখল ঝলক। দু চোখ সহসা ভরে গেছে মায়ায়। কাছে এসে পিঠে হাত রাখল, —তুমি মার বড় ছবিটা দেখেছ? নানটু যেটা আজ বাধিয়ে দিয়ে গেল?

মেয়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে প্রিয়ব্রত অপ্রস্তুত। বিব্রত মুখে বললেন, —ফ্রেম ট্রেমগুলো তো বেশ ভালই হয়েছে।

—ওটাই বোধহয় মার লাস্ট ছবি, তাই না?

—হ্যা। পিকলু পুজোর সময়ে তুলেছিল।

—ছবিটা তোমার ঘরে রেখে যাই ?

—কেন ?

—বাইরের ঘরের টেবিলটা সেফ নয়। পুচকুনটা যা লাফালাফি করে... কখন হাত লেগে পড়ে ভেঙে যায়...

—পুচকুন কি এ ঘরে আসে না ? প্রিয়ব্রত হেসে ফেললেন, —শ্রাদ্ধের দিন অবধি টিকিয়ে রাখতে গেলে বরং কোনও আলমারির মাথায় তুলে রাখ।

রুনি আর পীড়াপীড়ি করল না। একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল, —ওষুধ খেয়েছ ?

–এই খাব !

—উহু, এক্ষুনি খাও।... ওঠো,বিছানাটা করে দিই।

খাট থেকে নেমে প্রিয়ব্রত টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। হাতড়ে হাতড়ে বার করলেন ট্যাবলেটের স্ট্রিপ। ধাতব ফয়েল ছিড়ে বড়ি পুরলেন মুখে। জল দিয়ে গিলছেন।

চাদর ঝাড়াবুড়ি করে মশারি টাঙাচ্ছিল রুনি। ছত্রিতে কোণটা লাগাতে লাগাতে বলল,—কাল সকালে কিন্তু আমায় একবার বাড়ি যেতে হবে বাবা।

—তুই যে এখন কদিন থাকবি বললি ?

—সে তো আছিই। কালও বিকেলেই চলে আসব। ঝুমুরকে নিয়ে।

-অ |

—আসলে কী জান তো, টানা তিন দিন ধরে আছি, আমার শাশুড়ি তো হ্যালহ্যাল ঝ্যালঝ্যাল... মার মতো শক্তপোক্ত তো নয়, যে একা হাতে সামাল দেবে... এদিকে কণাদের যা অফিসের চাপ, সে বেচারিও কোনও দিকে তাকাতে পারে না... গিয়ে সংসারটাকে আবার একটু সেট করে দিয়ে আসব প্লাস, ঝুমুরের স্কুলে কাল একটা পেরেন্টস মিটিংও আছে, ওটা অ্যাটেন্ড করতেই হবে।

—বুঝলাম।

—কী ?

—তুইও তোর পৃথিবীতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছিস। প্রিয়ব্রতকে ঈষৎ স্নান দেখাল,—পিকলুরা চলে যাওয়ার পর তুই এসে থাকবি কী করে ?

—পার্মানেন্টলি হয়তো সম্ভব নয়। রুনি ইতস্তত করে বলল,—তবে ঝুমুরের বড়দিনের ছুটিটা তো এখানে কাটাতেই পারি। ঝুমুরও খুব কান্নাকাটি করছে দিম্মার জন্যে, তোমার জন্যে...। তারপর তো রেগুলার আসা-যাওয়া করবই।

—হুম। সেই ভাল। দেখে-টেখে যাস।

রুনি চোখ কুঁচকে প্রিয়ব্রতর দিকে তাকিয়ে রইল একটুক্ষণ। বুঝি বা পড়তে চাইছে বাবার অভিমানটাকে। গলাটা একদম নরম করে বলল,—বুঝতে পারছি বাবা,তুমি অ্যাবসোলিউটলি একা হয়ে গেলে।

—তো কী আছে? অর্থব তো হইনি!

—বটেই তো। বড় জোর তো দু-আড়াই মাস, তারপর তো তুমি পিকলুর কাছেই...। ইচ্ছে হলে মাঝের কাটা দিন আমার কাছে গিয়েও কাটাতে পার।

প্রিয়ব্রত উত্তর দিলেন না। ভাল লাগছে না কথা বলতে।

আরও একটুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে চলে গেল রুনি। বাথরুম সেরে এসে প্রিয়ব্রত ঢুকে পড়লেন বিছানায়। সরমা চলে যাওয়ার পর পিকলু রুনি দুজনেই পাশে শুতে চেয়েছিল। প্রিয়ব্রত রাজি হননি। অস্বস্তি হয়।

মশারি গুজে বেডসুইচ টিপে প্রিয়ব্রত নিবিয়ে দিলেন টিউবলাইট। গায়ে চাদর টেনে চোখ বুজেছেন।

ঠিক তখনই কানের পাশে ফিসফিস, —কী গো, কি ঠিক করলে ? যাচ্ছ?

প্রিয়ব্রতর ঠোট নড়ল,—কোথায় ?

—ঢং! বোঝো না যেন! পিকলুর কাছে।

—প্রশ্নই আসে না। -

—কারণটা জানতে পারি?

—অন্য কারও সংসারে থাকা আমার পোষাবে না।

—পিকলু অন্য কেউ হল ?

—বললাম তো, কাউকে আমি ডিস্টার্ব করতে চাই না। তোমার পিকলু, তোমার রুনি, কাউকে না।

—একেই বলে গোঁয়ারগোবিন্দ। এখানে তোমার দেখাশুনো কে করবে শুনি ? ওই আবোদা গোবিন্দর মা ?

—তা নিয়ে তোমার তো মাথা ঘামানোর দরকার নেই। বেইমানি করে কেটে যখন পড়েছ, কেটেই পড়।

—ইশ রে, সে উপায়ও কী আছে আমার !

বাতাসের শব্দ পাক খেতে লাগল ঘরে। বাতাসের শব্দ? নাকি প্রিয়ব্রতর নিজেরই হৃদয়ের ধ্বনি? দেওয়াল দরজা জানলা ফুঁড়ে ঘুরছে এঘরে ওঘরে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে তিল তিল করে গড়ে ওঠা পুরনো সংসারটাকে। বারান্দার বেতের চেয়ারে গিয়ে বসল। দুলে দুলে নেমে যাচ্ছে বাগানে। ভাসছে। নাচছে।

শীত শীত করছিল প্রিয়ব্রতর। আশ্চর্য, একটা উষ্ণতাও যেন চারিয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে।

প্রিয়ব্রত সরমার দিকে ফিরে শুলেন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ