বাসের মানুষজন শঙ্কিত মুখে বসে আছে। বাসটির এখানে থামার কথা নয়, কালো কাপড় পরা মিলিশিয়া ধরনের একজন এটিকে থামিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছে। রাস্তাঘাটে বাস থামিয়ে চেক করা কোন ব্যাপার নয়, তবু ব্যাপারটিতে কেউ অভ্যস্ত হতে পারছে না। মিলিটারির কেউ একজন ভেতরে ঢুকে বাসটি পরীক্ষা করে যেতে দেবে, যতক্ষণ সেটা না হচ্ছে চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।
আজাদ কাজলকে বুকে চেপে ধরে বাসের অন্য সবার সাথে চুপ করে বসে থাকে। কাজলের বয়স চার, যদিও তাকে দেখে আরো কম মনে হয়। গত কয়েক মাস দৌড়াদৌড়িতে তার চেহারার মাঝে আতঙ্কের একটা ছাপ পাকাপাকিভাবে পড়ে গেছে। ছেলেটার শরীর ভাল নয়। গত কয়েকদিন থেকে কেঁপে কেঁপে জ্বর উঠছে। রোগ শোক সম্পর্কে আজাদের ভাল ধারণা নেই, কিন্তু দেখেশুনে মনে হয় ম্যালেরিয়া। যে গ্রামে গত কয়েক মাস থেকে লুকিয়ে আছে সেখানে কোন ডাক্তার নেই। ডাক্তারের খোঁজে সে ময়মনসিংহ শহরে যাচ্ছে।
কাজল আজাদের বুক থেকে মুখ তুলে বলল, আব্বা আমরা কখন যাব?
এই তো একটু পরে।
মিলিটারি আমাদের থামিয়েছে?
হ্যাঁ।
কেন বাবা?
জানি না, মনে হয় চেক করবে।
কী চেক করবে?
জানি না বাবা।
জয় বাংলা আছে কি না দেখবে?
আজাদ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স, বলে না এখন।
কাজল চুপ করে গেল। কখন জয় বাংলার কথা বলা যাবে এবং কখন বলা যাবে না ব্যাপারটা সে এখনো পরিষ্কার ধরতে পারেনি।
আজাদ জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সামনে আরো কয়েকটি বাস থামানো হয়েছে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাসগুলো, ভেতরে শঙ্কিত মুখে যাত্রীরা নিঃশব্দে বসে আছে। বাসগুলোর কাছাকাছি কালো কাপড় পরা কিছু মিলিশিয়া। খানিকটা দূরে একটা বটগাছের নিচে বেশ কিছু মিলিটারি রাস্তার পাশে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। বাসের ভেতরে মানুষজন কেউ কোন কথা বলছে না। আজাদ চাপা স্বরে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, সব সময় কি এখানে থামায়?
ড্রাইভার দরদর করে ঘামছে, আজাদের প্রশ্নটা ঠিক শুনতে পেল না। আজাদ আবার জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার সাহেব, সব সময় কি এখানে থামায়?
না। কিছু একটা গোলমাল আছে আজ।
কী গোলমাল?
জানি না। আল্লাহরে ডাকেন।
ড্রাইভার এইমাত্র দেখতে পেয়েছে মিলিশিয়ারা সামনের একটা বাস থেকে সব যাত্রীদের সারি বেঁধে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে একটা ছোট ডোবা আছে সবাই হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে সেদিকে। কান খাড়া করে রাখবে সে, গুলির শব্দ শোনা গেলে বুঝতে হবে রোজ কেয়ামতো আজ।
আজাদ কাজলের মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটা দেখতে নাকি বাবার মতো হয়েছে। আজাদের অবশ্যি সেরকম মনে হয় না, তার ধারণা মায়ের মতোই হয়েছে। বিশেষ করে চোখ এবং ঠোঁটের অংশটুকু হুবহু শিরীনের মতোন। শিরীন এখন কী করছে কে জানে, ডাক্তারকে দেখিয়ে বাসায় ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত বেচারি স্বস্তি পাবে না। আজাদকে এসব ব্যাপারে একেবারে বিশ্বাস করে না। কিন্তু এখন যে অবস্থা শিরীনের ঘর থেকে বের হওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। ডাক্তারকে কী জিজ্ঞেস করতে হবে, কী বলতে হবে সবকিছু বারবার করে আজাদকে বলে দিয়েছে। আজাদ যে নিজের দায়িত্বে ডাক্তারকে দেখাতে পারে সেটা তার পক্ষে বিশ্বাস করাই সম্ভব নয়!
শিরীনের ধারণা, আজাদ একজন অপদার্থ বাবা। কেন তার এই ধারণাটি হয়েছে বলা মুশকিল। যে কোন ব্যাপারেই স্পষ্ট একটা ধারণা না হওয়া পর্যন্ত শিরীন স্বস্তি বোধ করে না। জীবনের নানা জটিল ব্যাপারে বড় বড় চিন্তাবিদেরাও যখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি সেখানেও শিরীন স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকে। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি এ ধরনের বড় বড় ব্যাপার থেকে শুরু করে নিউ মার্কেটের কোন দরজি সবচেয়ে কম খরচে নিখুঁত ব্লাউজ তৈরি করে দেয়—সব ব্যাপারে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। শিরীন এবং আজাদের একমাত্র ছেলে কাজলের বয়স মাত্র চার এবং বাবার দায়িত্ব পালন করার জন্যে আজাদের পুরো জীবনটাই পড়ে রয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আজাদ জীবনপণ করে যত চেষ্টাই করুক এই জন্মে শিরীন তার ধারণাটি পাল্টাতে রাজি নয়।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল কাজলের জন্মের সময়। ডাক্তার কাজলের জন্ম তারিখ দিয়েছিল মার্চের মাঝামাঝি। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আজাদের রাজশাহী যাওয়ার প্রয়োজন হলো। ঢাকা শহরে আজাদ এবং শিরীন দু’জনের পরিবারের সবাই থাকে। যে ডাক্তার শিরীনকে দেখছে সে কিভাবে কিভাবে শিরীনদের আত্মীয়া হয় হঠাৎ করে ক্লিনিকে যেতে হলেও কোন অসুবিধে নেই। সাত পাঁচ ভেবে আজাদ রাজশাহী চলে গেল। তার দু’দিনের ভেতর শিরীনকে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে হলো। প্রথমে সবাই ভেবেছিল সবকিছু বুঝি স্বাভাবিক। শেষ মুহূর্তে দেখা গেল সিজারিয়ান প্রয়োজন। শিরীনের এক মামা আজাদের হয়ে কাগজপত্র সই করল। আজাদ যখন ফিরে এসেছে কাজলের বয়স তখন আট দিন। যে বাবা তার সন্তানকে আট দিনের আগে দেখার সুযোগ পায়নি শিরীনের পক্ষে তাকে ক্ষমা করা সহজ নয়। এর থেকে আরো অনেক কম অপরাধের জন্য শিরীন তার এক খালাতো বোনের সাথে গত নয় বছর কোন কথা বলেনি!
অপদার্থ বাবা হিসেবে আজাদ দ্বিতীয়বার সুপ্রতিষ্ঠিত হলো যখন কাজলের বয়স সাত মাস। একদিন আজাদের উপর দায়িত্ব দিয়ে শিরীন কোন এক জায়গায় গিয়েছে। যাবার আগে কাজলকে নিয়ে কী করতে হবে আজাদকে সে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। আজাদের সদিচ্ছার কোন অভাব ছিল না, কিন্তু দুধ খাবার সময় কী কারণে কাজল কিছুতেই দুধের বোতল মুখে নিয়ে দুধ খেতে রাজি হলো না সে বুঝে উঠতে পারল না। মধ্যরাতে শিরীন ফিরে এসে আবিষ্কার করে কাজল চিৎকার করে কেঁদে ঘরবাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে—আজাদ তাকে নিয়ে সম্ভাব্য সব রকমভাবে শান্ত করে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। শিরীন দুধের বোতলের দিকে এক নজর তাকিয়েই সমস্যাটা বুঝে ফেলল, নিপলটিতে কোন ফুটো নেই। ফুটোবিহীন একটি নিপল কোন বাসায় তার জন্যে রাখা হবে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু তার সমস্ত অপরাধের গ্লানি এখনো আজাদকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
আজাদ বাবা হিসেবে মোটামুটি অপদার্থ—এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে যাবার পর যতই দিন যাচ্ছে ততই শিরীনের ধারণা আরো বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে। কাজলের অসুখের সময় আজাদ সারারাত জেগে তাকে বুকে নিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছে এই ঘটনাটি শিরীনের চোখে পড়ে না, কিন্তু একদিন গরম চা চলকে পড়ে হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। কেউ যদি কোন ব্যাপারে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে তাহলে তার স্বপক্ষে যুক্তি এবং উদাহরণ খুঁজে বের করা কঠিন কোন ব্যাপার নয়—বিশেষ করে এ ধরনের ব্যাপারে।
আজাদ প্রথম প্রথম শিরীনের এই ধারণা পাল্টানোর চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়েছে। প্রথমতো, শিরীন একবার কোন একটা জিনিস বিশ্বাস করে নিলে সে ব্যাপারে তার মতো পাল্টানো প্রায় অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, শিরীন তার জীবনে যতগুলো ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ধারণা করছে তার বেশিরভাগই ভুল বের হয়েছে।
যেমন তার ধারণা ছিল তাদের প্রথম বাচ্চা হবে মেয়ে। ব্যাপারটিতে সে প্রায় নিশ্চিত হয়ে মেয়ের জন্যে একটি নাম পর্যন্ত ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু দেখা গেল তাদের প্রথম বাচ্চাটি হলো ছেলে। শিরীনের ধারণা ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের চেহারা যত কুৎসিতই হোক মানুষটি নির্বাচনের রায়কে অক্ষুণ্ন রাখবে। মার্চ মাসে তার এই ধারণাটিও ভুল প্রমাণিত হলো। শিরীনের তৃতীয় ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হলো পঁচিশে মার্চের রাতে, সে মোটামুটি নিঃসন্দেহ ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর জুলফিকার আলী ভুট্টো একটা রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছে যাবেন, পাকিস্তানি মিলিটারিরা কিছুতেই বাঙালিদের গায়ে হাত তোলার সাহস পাবে না। পঁচিশে মার্চের রাতে গোলাগুলিতে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে তার সেই ধারণাটিও পুরোপুরি ভেস্তে গেল। শিরীনের শেষ ধারণাটি ভুল প্রমাণিত হলো এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। শিরীন একেবারে নিঃসন্দেহ ছিল বাইরের পৃথিবী যখন খবর পাবে পাকিস্তানি মিলিটারিরা কিভাবে এ দেশের মানুষকে মারছে তখন পৃথিবীর বড় বড় দেশ এসে হস্তক্ষেপ করবে। এপ্রিলের মাঝামাঝি শিরীন কাজলকে বুকে চেপে আজাদের পিছু পিছু এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বাইরের পৃথিবী ততদিনে খবর পেয়ে গেছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান নামে ছোট একটি দেশের জন্যে পৃথিবীর কোন দেশের এতটুকু মাথাব্যথা দেখা যায়নি।
আজাদ এবং শিরীন আগে কখনো দীর্ঘ সময়ের জন্যে গ্রামে থাকেনি। ব্যাপারটি যত দুঃসহ হবে বলে ধারণা করেছিল কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সেটি তত খারাপ নয়। গ্রামের জীবনে নতুন এক ধরনের বৈচিত্র্য আছে এবং খুব তাড়াতাড়ি তারা সেটিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। আজাদ কখনো কল্পনা করেনি সে কোনদিন লুঙ্গির সাথে একটা বুশ শার্ট পরে জনসমক্ষে যাবে, কিন্তু দেখা গেল গ্রামের বাজারে চা খাবার জন্যে সে শুধু যে লুঙ্গির সাথে বুশ শার্ট পরে রওনা দিয়েছে তা নয়, সে পায়ে পরে নিয়েছে রবারের এক ধরনের ধূসর জুতো এবং সেই জুতো কাদায় আটকে গেলে সেগুলো হাতে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছে না। আজকেও সে এসেছে লুঙ্গি পরে, গায়ে ঢিলেঢালা একটা পাঞ্জাবি এবং পায়ে এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ছয় মাস আগেও সে কোন্ প্যান্টের সাথে কোন্ জুতো জোড়া পরবে সেটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছে। সেই সব দিনগুলো এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়।
আজাদ হঠাৎ বাসের মাঝে একটা উত্তেজনা অনুভব করে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে কালো পোশাক পরা একজন মিলিশিয়া উঠে এসেছে। অল্পবয়সী কিশোরের মতো চেহারা, কিন্তু তাকে দেখে হঠাৎ আজাদের পেটের মাঝে কেমন যেন পাক দিয়ে ওঠে। দেশে যদি যুদ্ধ না চলতে থাকত আর রাস্তায় হঠাৎ যদি অল্পবয়সী এই ছেলেটার সাথে কোথাও দেখা হত আজাদ কি তাকে দেখে এত ভয় পেত?
মিলিশিয়াটি তাদের বাস থেকে নেমে যেতে বলল, ভাষাটি উর্দু নয়, অন্য কোন ভাষা হবে। পাঞ্জাবি বা পশতু, কিন্তু তবু সে কী বলছে বুঝতে কোন অসুবিধা হলো না। বাস থেকে নামতে নামতে বুড়ো মতোন একজন মানুষ মিলিশিয়াটিকে বাবা ডেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করল, কিন্তু মিলিশিয়াটি তার দিকে কোন উৎসাহ দেখাল না, পুরোপুরি নিস্পৃহভাবে সে বুড়ো মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। বুড়োর কথা সে বোঝে না, বোঝার কোন কৌতূহলও নেই।
বাস থেকে নামার সময় আজাদ হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের আতঙ্ক। এই আতঙ্কের সাথে তার কোন পরিচয় নেই, সমস্ত শরীর হঠাৎ অবশ হয়ে আসে, মাথা কেমন ঝিম ঝিম করতে থাকে। কাজল হঠাৎ আজাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, এখন চেক করবে আব্বু?
আজাদ নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ বাবা।
কেমন করে চেক করে আব্বু?
এই তো এরকম করে।
কাজল কী বুঝল কে জানে, বলল, ও।
নিচে আরো কয়েকজন মিলিশিয়া দাঁড়িয়ে ছিল। তারা দুই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বাসের সবাইকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে বাঁশঝাড়ের পিছনে ডোবাটির কাছে নিয়ে যেতে থাকে। আজাদের সাথে হেঁটে যেতে যেতে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ শুকনো গলায় বলল, গুলির বাক্স টানাবে আমাদের দিয়ে।
গুলির বাক্স?
হ্যাঁ। যখন গুলির বাক্স টানার দরকার হয় তখন লোকজন জড়ো করে।
সত্যি?
হ্যাঁ। গত সপ্তাহে আমার ছোটভাই টেনেছে।
ও।
নিশ্চয়ই গুলির বাক্স। কী বলেন?
লোকটি কেমন এক ধরনের ব্যাকুল চোখে আজাদের দিকে তাকাল। আজাদ বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই গুলির বাক্স।
ডোবার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আজাদ তাকাবে না তাকাবে না করেও ডোবাটার ভেতরে তাকাল। অনেক কয়েকজন মানুষ পাশাপাশি শুয়ে আছে। কারো পা পানিতে ডুবে আছে কারো হাত। এমনকি কারো মাথা—কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি করছে বলে মনে হলো না। আজাদ দ্বিতীয়বার তাকাল এবং বুঝতে পারল মানুষগুলো মৃত। গুলি করে মারা হয়েছে। তাদের আগের বাসের যাত্রীরা, একটু আগে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে আনা হয়েছে।
একেবারে ডান পাশে একটা শিশুও রয়েছে, এক হাত দিয়ে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে এখনো। টুকটুকে লাল শার্ট গায়ে। শার্টটা কী লাল ছিল নাকি রক্ত লাল হয়েছে?
কাজল জিজ্ঞেস করল, আব্বু এরা কারা?
আজাদ বলল, এদিকে তাকায় না বাবা।
কাজল চোখ সরিয়ে বলল, কেন আব্বু
পরে বলব। ঠিক আছে?
কাজল মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। তারপর হঠাৎ একটু হাসল তার দিকে তাকিয়ে। কেন হাসল কে জানে।
আজাদ কাজলের দিকে তাকিয়ে থাকে মাথার মাঝে তার সবকিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। কেন জানি সে আর কিছু চিন্তা করতে পারছে না। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে রয়েছে, আশপাশে মানুষজনেরা কি কাঁদছে? কেউ কি চিৎকার করছে? কেউ কি কিছু বলছে? সে কেন আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। কাজল ঘাড় উঁচিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে কিছু। কী দেখছে?
আজাদ ফিস ফিস করে বলল, কাজল।
কি আব্বু?
আমাকে শক্ত করে ধরবি। খুব শক্ত করে।
কাজল কী একটা বলল সে শুনতে পেল না। চারজন মিলিশিয়া তাদের দিকে রাইফেল উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে আরো একজন মিলিশিয়া হেঁটে হেঁটে আসছে। কাজল আবার ডাকল তাকে, আব্বু।
কী বাবা?
চেক কি করছে?
হ্যাঁ বাবা।
কখন শেষ হবে?
এই তো একটু পরে।
তখন আমরা যাব?
হ্যাঁ বাবা।
আম্মুর কাছে যাব?
আম্মুর কাছে যাব।
কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিটা কিছু একটা বলল, তারপর দাঁড়িয়ে গেল। কেমন যেন বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। চেহারায় কেমন যেন এক ধরনের দুঃখের ছাপ।
রাইফেল হাতে মিলিশিয়াগুলো হঠাৎ রাইফেলগুলো উপরে তুলে। আজাদ ফিসফিস করে বলল, কাজল—
কী আব্বু?
তুমি কি সেই বোকা রাজার গল্পটা শুনতে চাও? সেই যে একটা বোকা রাজা ছিল—
হ্যাঁ আব্বু হ্যাঁ। কাজল হঠাৎ আনন্দে ছটফট করে ওঠে।
তাহলে আমার দিকে তাকাও—
কাজল তার বাবাকে ধরে তার দিকে তাকাল।
এক ছিল রাজা। সে ছিল ভারি বোকা—
কাজলের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়। বোকা রাজার গল্প তার সবচেয়ে প্রিয় গল্প। অনেক বার শুনেছে সে, প্রতিবার হেসে কুটি কুটি হয়েছে। আশপাশের মানুষেরা কেন জানি কাঁদছে সে জানে না। সে জানতেও চায় না। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারিগুলোকে দেখতে কেমন যেন ভয় করে। সে সেদিকে তাকাবে না। আব্বুকে শক্ত করে ধরে রাখবে তার কোন ভয় নাই। ভয় থাকলে কি তার আব্বু কখনো বোকা রাজার গল্প বলত।
বলত না।
কাজল হাসিমুখে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, গল্পটা শোনার জন্যে। অনেকবার শুনেছে সে গল্পটি। আজাদ জানে, পুরোটা শুনতে না পারলেও ক্ষতি নেই।
0 মন্তব্যসমূহ