Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি | সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়

কলকাতার এত কাছে যে এরকম ভয়ংকর সব অজ জায়গা আছে কে জানত!

কালীতলার মোড়ে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাসটা ঢিগ ঢিগ করে চলে গেল ডায়মন্ডহারবারের দিকে। জায়গাটা সত্যি কালীতলার মোড় কি না জানবার কোনও উপায় নেই। আশেপাশে জনমনিষ্যির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। তার ওপর সন্ধে হচ্ছে। ছুটির দিনে দুপুরে একটু আড্ডা মারবার লোভে বাদলের বাড়ি গিয়েছিলুম, তাতেই বিপত্তিটা হল। ক’দিন আগে কালীঘাট পার্কের সামনে ইন্দ্রনাথ সামন্তের ভাগনে রতনের সঙ্গে নাকি তার দেখা হয়েছিল, রতনই ঠিকানাটা তাকে দেয়। ঠিকানা বলতে এই কালীতলার মোড়। তারপর যে-কাউকে জিজ্ঞেস করলেই ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাগানবাড়ি দেখিয়ে দেবে। রতন সেরকমই বলেছিল।

আমি বাদলের মুখের দিকে তাকালাম। চারদিকটা পরখ করছিল সে। তার কৌতুহল খানিকটা মিইয়ে এসেছে মনে হল। দুপুরে কলকাতা থেকে দু’বন্ধুতে যখন বেরোই তখনই অসহ্য গুমোট ছিল। জষ্ঠি মাসের মাঝামাঝি, বিকেলের দিকে এ সময় প্রায়ই ঝড়বৃষ্টি হয়। দু’বার বাস পালটে এই কালীতলার মোড়ে এসে নামা হল, এখানেও সেই গুমোট, হাওয়া নেই। পশ্চিম আকাশের দিকে চোখ চলে গেল, সেখানে জমাট কালো একখণ্ড মেঘ স্থির হয়ে আছে। গতিক যে সুবিধের নয় তা দু’জনেই বেশ বুঝতে পারছি। সত্যি সত্যি ঝড়বৃষ্টি এলে কাছাকাছি কোথাও আশ্রয় পাওয়ার উপায় আছে কি না দেখছিলাম।

বাদল দেখলাম একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছে। ওর উৎসাহেই এখানে আসা। বেহালায় বিদ্যাসুন্দরী স্কুলে ইন্দ্রনাথদা আমাদের সহকর্মী ছিলেন, জীববিজ্ঞান পড়াতেন। বাদল গেমস টিচার, আমার বিষয় অঙ্ক। আমাদের থেকে বয়সে সামান্য বড় ছিলেন ইন্দ্রনাথ। বাদলের কাছেই শুনেছিলাম ইন্দ্রনাথদা পরলোকচর্চা করেন। ‘পরলোক রহস্য’ নামে একটা বইও নাকি তিনি লিখেছিলেন। বছরদশেক আগে এক পথদুর্ঘটনায় ওঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ইন্দ্রনাথদা নিঃসন্তান ছিলেন। হাজরায় ওঁর ভাড়াবাড়িতে বাদলের সঙ্গে আমি কয়েকবার গেছিও। পরলোকের ব্যাপারে বাদলের যে অপার কৌতূহল আছে তা আমি জানি। মনে আছে ইন্দ্রনাথদার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি আর বাদল যেদিন ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেদিনও পরলোক বিষয়ে দু’-চারটে কথা তিনি আমাদের বলেছিলেন। আসলে স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই ইন্দ্রনাথদা একটু একটু করে বদলে যেতে থাকেন। কিছুদিন ছুটিতে থাকার পর তিনি স্কুলের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর আর চাকরির দিকে মন ছিল না, ক্লাসটাসও বিশেষ নিতেন না। তারপর হঠাৎই একদিন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে উধাও হয়ে যান। রতনের সঙ্গে বাদলের দেখা না হলে ইন্দ্রনাথদার কথা হয়তো আমরা ভুলেই যেতাম। ইন্দ্রনাথদা একটা পোড়ো বাগানবাড়ি কিনে সেখানে বসবাস করছেন শুনে এখানে আসবার জন্য বাদল ক’দিন থেকেই খুব উশখুশ করছিল। আজকের এই আসাটার পেছনে ওর কোনও পরিকল্পনা ছিল বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য ইন্দ্রনাথ সামন্তের পরলোকচর্চা বিষয়ে বাদলের অপ্রতিরোধ্য কৌতূহলই একটা কারণ হতে পারে।

“রতন কি কালীতলার মোড়ের কথাই বলেছিল?” আমি বললাম।

“হ্যাঁ, সেরকমই তো বলেছিল মনে হয়।”

“মনে হয় কী রে? ভাল করে ডিরেকশনটা শুনে নিসনি?”

“নিয়েছিলুম। কিন্তু জিজ্ঞেস করবার মতো লোকজনও তো কাউকে দেখছি না!”

অসহায় গলায় কথাটা বলে বাদল দূর আকাশের দিকে তাকাল, সেখানে কালো মেঘের খণ্ডটা একটু একটু করে ফুলেফেঁপে উঠছিল। মাঠের ভেতর থেকে উঠে এসে দু’জন চাষাভুষো টাইপের লোক কাঁচা রাস্তাটা ধরে জঙ্গলের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। শালিখের একটা ঝাঁক নেমে আসছিল সেখানে। কাছাকাছি যে কোনও লোকালয় আছে তা বোঝা গেল। লোকদুটোকে পিছু ডেকে ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ির ডিরেকশনটা জেনে নিলে হত, কিন্তু এখন আর তার উপায় নেই। ভূতপ্রেতে বাদলের অগাধ বিশ্বাস, একটু ঠাট্টার সুরেই তাকে বললাম, “কী হবে রে, বাদল, এবার? ইন্দ্রনাথদার পরলোকচর্চা দেখতে এসে নিজেদেরই পরলোকে চলে যেতে হবে না তো? আকাশের অবস্থা দেখেছিস? আশেপাশে বাড়িঘর তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইন্দ্রনাথদার ভাগনে বোধ হয় তার সঙ্গে ঠাট্টাই করেছিল।”

ঘাবড়ে গিয়ে বাদল বলল, “কী হবে এখন, সত্যদা?”

দুশ্চিন্তা গোপন করে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললাম, “দাঁড়া, এত ঘাবড়ে যাচ্ছিস কেন? এই তো সবে বাস থেকে নামলুম, জায়গাটা একটু সার্ভে করতে দে আগে! দেখি কোনও লোকালয়ের সন্ধান পাওয়া যায় কি না।”

“সার্ভে করে মানে? ঝড়বৃষ্টি শুরু হলে সারারাত গাছতলায় দাঁড়িয়ে কাটাতে হবে যে! তারচে বরং ফিরেই চলো।”

“ফিরে যাবি যে, বাস পাচ্ছিস কোথায়? এতক্ষণ একটাও বাস যেতে দেখেছিস? ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দিলে এ-সব রুটে বাসটাস চলে কি না কে জানে!”

এতক্ষণে দূর আকাশের প্রান্তে বিদ্যুতের ঝিলিক দেখা যাচ্ছে, মেঘের গুড়গুড় ডাকও শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। ভিজে একটা হাওয়া ছাড়ল হঠাৎ, সোঁদা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। দূরে কোথাও বৃষ্টি নামল বুঝি! আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ হবে না ভেবে বললাম, “টর্চ এনেছিস?”

বাদল দেখলাম ওই একটা দরকারি জিনিস আনতে ভোলেনি। পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট্ট দু’ ব্যাটারির টর্চ বার করে দিল সে নিঃশব্দে। টর্চ জ্বেলে ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে ছ’টা বাজে। এখন আবার কলকাতায় ফেরার চেষ্টা করে কোনও লাভ হবে না। টর্চটায় বোধ হয় নতুন ব্যাটারি ঢুকিয়েছে বাদল, উজ্জ্বল সাদা আলো ফেলে কাঁচা রাস্তাটা একবার দেখে নিলাম। রাস্তা না বলে ক্ষীণ একটা পথের রেখা বলাই ভাল। টর্চটা আনার জন্য মনে মনে বাদলকে ধন্যবাদ দিলাম, ভাগ্যিস এই একটা কাজের জিনিস আনবার কথা ভোলেনি সে! আমার আলো ফেলা দেখে ভয়ে ভয়ে বাদল বলল, “এই অন্ধকারে ওই জঙ্গলে ঢোকবার মতলব করেছ নাকি?”

কাঁচা রাস্তাটা যেখানে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে সেখানে এরই মধ্যে অজস্র জোনাকি জ্বলতে শুরু করেছে। শুকনো পাতায় সরসর শব্দ তুলে কী একটা প্রাণী রাস্তা পেরিয়ে বনতুলসীর ঝোপে ঢুকে পড়ছিল, আলো ফেলে দেখলাম একটা গোসাপ। টর্চের আলোয় তার চেরা জিভ ঝিকিয়ে উঠল যেন! বাদলের দিকে না তাকিয়েই বললাম, “এতদুর যখন এসেই পড়েছি, ইন্দ্রনাথ সামন্তের ডেরাটা না দেখে চলে যাওয়া কি ঠিক হবে?”

জামার হাতা ছেড়ে দিয়ে বাদল কাষ্ঠহাসি হাসল, “তা ঠিক। তবে এ-সব ঝোপ-জঙ্গলে আবার সাপখোপ নেই তো?”

গম্ভীরমুখে বললাম, “আছে শুধু নয়, প্রায় সবই বিষাক্ত।”

কাঁচা রাস্তাটা ধরে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেই বুঝলাম এটা আসলে জঙ্গল নয়, আম-কাঁঠালের বাগানই ছিল বোধ হয় এককালে, অযত্নে অবহেলায় জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে। টর্চের গোল আলো ফেলে গাছগুলো চেনবার চেষ্টা করছিলাম, আম-কাঁঠালই বেশি, মাঝে মাঝে পেয়ারাগাছও রয়েছে দেখলাম, ডাঁসা পেয়ারা ঝুলে আছে একটা গাছে।

বুনো ঝোপজঙ্গল আর লতাপাতার একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগছিল। হঠাৎ মাথার ওপরে অদ্ভুত একটা পত পত শব্দ শুনে বাদল প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “ও সত্যদা, দাঁড়াও!”

বাদলের চোখ গোল গোল হয়ে গেছে, মুখে আর বাক্য ফুটছে না বোধ হয়, কম্পমান আঙুল আকাশের দিকে তুলে দেখাল সে। টর্চ জ্বেলে উড়ন্ত প্রাণীগুলোকে দেখে নিয়ে বললাম, “ভয়ের কিছু নেই, চলে আয়। ওগুলো বাদুড়।”

বাদলের ভয় কাটেনি, ফিসফিস করে বলল, “ভ্যাম্পায়ার নয়তো, সত্যদা?”

বাদলের কথা শুনে হাসিও পাচ্ছিল, ভ্যাম্পায়ার বলতে যাকে বোঝায় সেই প্রাণী যে আমাদের দেশে নেই, তা বোধ হয় এখন আর ওকে বোঝানো যাবে না। বাদুড়ের ঝাঁকটা পেয়ারাগাছের ওপরে নেমে আসছিল, বাদলকে অভয় দেওয়ার জন্য বললাম, “সারাদিন ঘুমের শেষে এখন বোধ হয় চরতে বেরোল ওরা। পেয়ারা খাবে বলে নেমে আসছে দেখছিস না? ডাঁসা পেয়ারা ওদের খুব প্রিয় খাদ্য।”

ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম। বাগান ছাড়িয়ে পথটা একটা বাঁশবাগানে ঢুকেছে। কাছাকাছি কোনও বড় বিলটিল আছে কি না কে জানে, অন্ধকারে অজস্র বকের কক কক ডাক শোনা যাচ্ছিল। জোর হাওয়া ছেড়েছে, বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে বিচিত্র একটা শব্দ উঠছিল। পেছনে শেয়ালগুলো আবার হুক্কাহুয়া করে উঠল। দ্রুত বাঁশবাগানটা পেরিয়ে একটা পুকুরপাড়ে উঠে এলাম দু’জনে। এতক্ষণ পর পুকুরের অপর পারে ক্ষীণ একটা আলো দেখতে পাওয়া গেল। এলোমেলো হাওয়া চলছে, আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুতের চমক। ক্ষণস্থায়ী বিদ্যুতের আলোতেই ও-পারে প্রকাণ্ড একটা বাড়ির আউটলাইন দেখা গেল, সম্ভবত ওই বাড়িরই কোনও একটা ঘরে আলোটা জ্বলছে। ইলেকট্রিক নয়, হ্যারিকেনেরই আলো। এই ঘোর জঙ্গলের ভেতরে ইলেকট্রিকের আলো না থাকাই স্বাভাবিক।

বাদল চুপ করে আছে। কাঁচা রাস্তাটা পুকুরঘাটে এসেই শেষ হয়ে গেছে। ইন্দ্রনাথ সামন্তের পরলোকচর্চা নিয়ে বাদলের বোধহয় আর কোনও কৌতূহল অবশিষ্ট নেই। পুকুরের জলে বড় কোনও মাছ ঘাই মেরে উঠল হঠাৎ, বাদল চমকে ফিরে তাকিয়েছে সেদিকে। হাওয়ার বেগ বাড়ছিল, বিকট শব্দে বাজ পড়ল কাছেই কোথায়। কালো স্লেটের মতো আকাশ মেঘে মেঘে ভারী হয়ে আছে, দু’-এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়তে শুরু করেছে। টর্চের আলোয় পুকুরঘাটে একটা পায়ে-চলা পথ দেখা গেল, বাদলকে বললাম, “তাড়াতাড়ি পা চালা, বাদল!”

পুকুরের পাড় ধরে প্রায় ছুটছি দু’জনে। বৃষ্টিটা জোরে আসবার আগেই বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। বাড়ি তো নয়, যেন এক ধ্বংসস্তূপ। আমার মন বলছিল এটাই ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাগানবাড়ি হবে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কাছাকাছি আর কোনও বাড়িঘর দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। অবশ্য এটা ইন্দ্রনাথ সামন্তের বাড়ি না হলেও এই দুর্যোগে আপাতত ওখানেই আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

বাদলের মুখে এখনও কথা ফোটেনি। এ বাড়ি ইন্দ্রনাথ সামন্তের কি না সে-বিষয়ে আমি এখনও নিশ্চিত নই, তবু চেঁচিয়ে ডাকলাম, “ইন্দ্রনাথদা! ইন্দ্রনাথদা বাড়ি আছ?”

কোনও সাড়া নেই। প্রকাণ্ড এই হলঘরে আমার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। ঘরটায় অনেক জানলা দরজা, কোণের দিকে একটি দরজা ছাড়া সবই বন্ধ। খোলা দরজাটার ওদিকেই বোধ হয় দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি। বাড়িটায় কতগুলো ঘর আছে কে জানে? একশো বছর আগে জমিদাররা কলকাতার উপকণ্ঠে এরকমই সব বাগানবাড়ি তৈরি করতেন বটে!

কানের কাছে মুখ এনে বাদল বলল, “সত্যদা!”

“কী বলছিস?”

“এটা বোধ হয় ইন্দ্রনাথদার বাড়িই হবে!”

“কী করে বুঝলি?”

ফিসফিস করে বাদল বলল, “রতন এরকমই একটা বাড়ির কথা বলেছিল, এখন মনে পড়ছে! পুকুরটার কথাও বলেছিল!”

“আর কিছু বলেনি?”

“বলেছিল, ইন্দ্রনাথদা একাই থাকেন এখানে। একজন কাজের লোক আছে, সে-ই রান্নাবান্না, সেবাযত্ন সব করে।”

“পরলোকচর্চার কথা কিছু বলেছিল?”

“না, তা অবশ্য বলেনি।”

বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি চলছে। আর শোঁ শোঁ হাওয়া। হাওয়ার বেগ ক্রমে বাড়ছিল। খোলা দরজা দিয়ে দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে আসছিল। এখান থেকে চেঁচিয়ে কোনও লাভ নেই, এই প্রবল দুর্যোগে ওপর থেকে কিছুই শোনা যাচ্ছে না হয়তো। চুপ করে দাঁড়িয়ে কী করা যায় ভাবছিলাম। ছেলেবেলায় ভূতের গল্পে এ-ধরনের পোড়ো বাড়ির বর্ণনা অনেক পড়েছি, বাস্তবেও যে তার অস্তিত্ব থাকতে পারে, তা কখনও কল্পনা করিনি। ভূতপ্রেত নিয়ে কখনও ভাবিনি, তবু বলতে নেই, একটু যেন ভয় ভয়ই করছিল। টর্চটা জ্বালিয়েই রাখতে হচ্ছে। এভাবে জ্বালিয়ে রাখলে ব্যাটারির আয়ু ফুরোতে আর কতক্ষণ! বাইরে রীতিমতো ঝড় আরম্ভ হয়ে গেছে। শেষ চেষ্টা হিসেবে আর একবার ইন্দ্রনাথদার নাম ধরে ডাকবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই ভেতরের খোলা দরজাটায় একটা আলোর আভাস ফুটে উঠল। চাপা আর্তনাদের মতো একটা শব্দ করে বাদল আমার ডান বাহু খামচে ধরেছে। বাদলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমার বুকের ভেতরটাও যেন হঠাৎ ঢিপ ঢিপ করে উঠল। ফিসফিস করে বাদল বলল, “এখান থেকে পালিয়ে চলো, সত্যদা!”

“পাগল হয়েছিস? এই ঝড়জলে যাবি কোথায়?” বলে বাদলকে থামিয়ে দিলাম। হ্যাঁ, হ্যারিকেনেরই আলো! হ্যারিকেন হাতে একজন বুড়োমতো লোক এগিয়ে আসছিল। আদুল গা, পরনে খাটো ধুতি, কাঁধে গামছা। ইন্দ্রনাথ সামন্তের ভাগনে বোধ হয় এই কাজের লোকের কথাই বলেছিল। সত্যি বলতে কী, আজকাল এই চেহারার এবং এই পোশাকের কাজের লোক বড় একটা দেখা যায় না। কাছে এসে লোকটা হাতের হ্যারিকেন উঁচু করে ধরে আমার আর বাদলের মুখ দেখছিল। লোকটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, গাল তোবড়ানো, মাথায় কাঁচাপাকা চুল। হাতের চওড়া কবজি এবং পাকানো চেহারা দেখে বোঝা যায় এখনও শরীরে যথেষ্ট শক্তি ধরে। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মোটা ভুরুতেও পাক ধরেছে। লোকটার চোখে যেন মৃত মাছের দৃষ্টি। গা ছমছম করে উঠল। হ্যারিকেনের স্বল্প আলোয় লক্ষ করে দেখলাম চোখদুটিতে সাদা অংশের তুলনায় মণিদুটি ছোট।

লোকটার সম্মোহনের ক্ষমতা আছে কি না কে জানে, বাদল হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। আমারও চোখের পলক পড়ছে না। একটু উশখুশ করে ইন্দ্রনাথ সামন্তের কথা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, লোকটা কী করে যেন সেটা বুঝে ফেলল, চকিতে প্রিং-দেওয়া পুতুলের মতো ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলল। কান খাড়া করে কী যেন শোনবার চেষ্টা করল খানিক, তারপর ভাঙা খসখসে গলায় বলল, “আজ কৃষ্ণা দ্বাদশী! আজ রাতে এ-বাড়িতে জোরে কথা বলা বারণ!”

আমি আর বাদল মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম, লোকটার কথার অর্থ আমাদের বোধগম্য হল না। কৃষ্ণা দ্বাদশীর রাতে চাঁদ ওঠে অনেক দেরিতে, প্রায় শেষ রাতের দিকে—এটুকুই শুধু আমাদের জানা। যন্ত্রচালিতের মতো লোকটা হাতের হ্যারিকেন নামিয়ে ফেলল, একটু যেন চিন্তিতমুখে বলল, “আজ আপনারা না এলেই পারতেন! আজকের রাতটা বাবু বড় অস্থির অবস্থার মধ্যে থাকেন।”

আমরা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না, তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, “বাবু মানে কি ইন্দ্রনাথদা?” লোকটা মাথা নাড়ল।

বাইরে বৃষ্টির তেজ মরে আসছিল, তবে ঝোড়ো হাওয়ার দাপট টের পাওয়া যাচ্ছিল ঘরের ভেতর থেকেই। কোথায় যেন বিকট শব্দে একটা খোলা জানলা বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ এভাবে এখানে চলে আসাটা যে উচিত হয়নি তা বেশ বুঝতে পারছিলাম, ইন্দ্রনাথদা আমাদের আসাটাকে কীভাবে নেবেন কে জানে? বাদলের ওপর এখন রাগই হচ্ছে। ইন্দ্রনাথদা না চাইলেও আজকের রাতটা আমাদের এখানেই কাটাতে হবে। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস না করলেও বুকের ভেতরে অদ্ভুত অস্বস্তিকর একটা অনুভব টের পাচ্ছিলাম।

“আসুন আমার সঙ্গে। তবে বাবুর সঙ্গে বেশি কথা বলবার চেষ্টা করবেন না।”

আবার সেই খসখসে ভাঙা কণ্ঠস্বর, যেন অনেকটা ফিসফিস করেই লোকটা বলল। ভেতরের দিকের যে দরজাটা দিয়ে সে এ-ঘরে এসেছিল সেদিকেই আবার হাঁটতে শুরু করল। আমি কিছু ভেবে ওঠবার আগেই বাদল লোকটার পেছন পেছন যন্ত্রচালিতের মতোই হাঁটতে শুরু করে দিল। বোধ হয় সম্মোহিতই হয়ে গেছে সে, ভাবসাব সেরকমই। অগত্যা আমিও ওদের অনুসরণ করতে শুরু করলাম। লোকটা সবার আগে, তার পেছনে বাদল, সবার শেষে আমি। হ্যারিকেনের আলো দেখেই বোধ হয় একটা চামচিকে করিডোরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। আমাদের মাথা প্রায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে চামচিকেটা। অন্য সময় হলে বাদল ভয় পেয়ে আমার হাত টেনে ধরত নির্ঘাত, এখন যেন তার ভ্রূক্ষেপ নেই। কী জানি কেন, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বাদল আমার কানের কাছে মুখ এনে চাপাগলায় বলল, “তুমি তো ভূতে বিশ্বাস করো না সত্যদা, তাই না?”

হঠাৎ এ-কথা কেন বুঝলাম না, জোর করে একটু হেসে বললাম, “না!”

বললাম বটে, তবে কথাটায় খুব জোর ছিল না। আমি চিরকালই বিজ্ঞানের পক্ষে, ভূতপ্রেত দত্যিদানো এ-সবের বিপক্ষে। তবে কিনা এই প্রবল দুর্যোগে এরকম একটা পরিবেশে এসে পড়ায়, বলতে নেই, একটু গা ছমছম করছিল ঠিকই। কিন্তু এটাকে ঠিক বোধ হয় ভূতের ভয় বলা যাবে না। দেখলাম আমাদের দেখাদেখি লোকটাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। আমি ‘না’ টা বোধ হয় একটু জোরেই বলে ফেলেছি, সম্ভবত শুনতে পেয়েছে। স্থির হিমশীতল দৃষ্টিতে লোকটা কয়েক পলক আমাকে দেখল। এত অল্প আলোতেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার চোখের খুব গভীরে একটা কৌতুকের ঝিলিক উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল।

করিডোরের একেবারে শেষ প্রান্তে ভেজানো একটা দরজার সামনে এসে লোকটা দাঁড়াল। আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। একবার মাত্র কড়া নেড়ে লোকটা চুপ করে দাঁড়িয়েই রইল। কিছুক্ষণ আগে কৃষ্ণা দ্বাদশীর কথা বলেছিল সে, একটা অশুভ কিছুর আঁচ পাচ্ছিলাম। পালিয়ে যাও! এক্ষুনি পালাও এখান থেকে!

লোকটা কড়া নাড়ল আবার।

ভেতর থেকে গম্ভীর গলা ভেসে এল, “ভেতরে এসো!”

আস্তে ঠেলা দিতেই কর্কশ শব্দে দরজাটা খুলে গেল। এত বীভৎস শব্দ আগে কখনও শুনেছি বলে মনে পড়ল না। প্রকাণ্ড একটা হলঘর, এক কোণে একটা উঁচু কাঠের টেবিলে হ্যারিকেন জ্বলছে। এ বাড়ির সব ঘরই এরকম হলঘরের মতো কি না কে জানে? লোকটা করিডোরে হাতের হ্যারিকেন নামিয়ে রেখে ঘরে ঢুকেছে, আমরাও তার পেছন পেছন ঢুকলাম। ঘরটার আয়তনের তুলনায় আলো এত কম যে, প্রথমে কোনও কিছুই দৃষ্টিগোচর হল না। দূরে কাচের শার্সি দেওয়া জানলার কাছে খাটের ওপর বসে থাকা একটা আবছা মূর্তি দেখতে পাচ্ছিলাম। বাইরে আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি চলছে এখনও। সম্ভবত এই ঘরের আলোটাই আমরা পুকুরের ওপার থেকে দেখতে পেয়েছিলাম।

“এসো, সত্য! আজ ক’দিন থেকেই তোমাদের আশা করছিলাম।”

ইন্দ্রনাথদার গলা চিনতে আমার ভুল হল না, বললাম, “আমাদের চিনতে পেরেছ, ইন্দ্রনাথদা?”

ইন্দ্রনাথদা কথাটার উত্তর দিলেন না। ঘরের আলো-আঁধারি চোখে সয়ে আসছিল ধীরে, ইন্দ্রনাথদা হাত তুলে বললেন, “ওখানে বোসো।”

সামনেই দুটো বেতের মোড়া রাখা আছে, আমরা দু’জনেই বসে পড়লাম। ইন্দ্রনাথদা চোখ বুজে কী যেন খানিক ভাবলেন, তারপর বললেন, “ক’দিন আগে রতন এসেছিল একবার, ওর কাছেই তোদের খবর পেয়েছিলুম। বাদল বোধ হয় ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছিল, মন বলছিল তোরা একদিন আসবি। তবে আজকের দিনটায় এসে বোধ হয় ভাল করিসনি।”

উদাস গলায় কথা ক’টা বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ইন্দ্রনাথ সামন্ত। আমি খুঁটিয়ে তাঁর মুখখানা দেখছিলাম। চুল পড়ে গিয়ে মাথার সামনের দিকটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে, মুখে লম্বা দাড়ি, অধিকাংশই পাকা। রোগাও হয়ে গেছেন অনেক। গায়ে আধময়লা একটা গেঞ্জি, পরনে ধুতি।

বাদল বোধ হয় কৌতূহল চাপতে পারছিল না, বলল, “আজ কৃষ্ণা দ্বাদশী বলেই কি ও-কথা বললে ইন্দ্রনাথদা?”

ইন্দ্রনাথ চোখ সরু করে আমাদের দু’জনেরই মুখ একবার পরখ করে নিলেন, তারপর মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ।”

বাদল বলল, “আজ কি তোমার পরলোকচর্চার কোনও ব্যাপার আছে?”

“না, ঠিক তা নয়। আজ ও আসবে!”

প্রায় ফিসফিস করে কথাটা বলে ঘরের দক্ষিণ কোণে আঙুল তুলে দেখালেন ইন্দ্রনাথ। স্বল্প আলোর জন্যই ওদিকটায় এতক্ষণ চোখ পড়েনি। তা ছাড়া ওদিকটায় পেছন ফিরে বসেছি দু’জনে। ইন্দ্রনাথদার কথা শুনে একই সঙ্গে আমরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম সেদিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন মেরুদণ্ডের ভেতরে একটা কাঁপন অনুভব করলাম। প্রায় আটফুট উঁচু একটা কাঠের ফ্রেম থেকে একটা কঙ্কাল ঝুলছে। দু’জনের কেউই চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।

ইন্দ্রনাথদার কথাতেই আমাদের চমক ভাঙল। একটু গলাখাঁকারি দিয়ে ইন্দ্রনাথদা বললেন, “তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে খুব পরিশ্রান্ত। মুকুন্দ, যাও দক্ষিণের ঘরটা একটু ঝাড়পোঁছ করে এঁদের ডেকে নিয়ো।”

লোকটার নাম যে মুকুন্দ তা এতক্ষণে জানা গেল, অস্ফুট স্বরে কী একটা বলে চলে গেল সে। আমরা স্তব্ধ হয়ে বসেই রইলাম।

খাটের ওপর বসে থাকা মানুষটাকে ইন্দ্রনাথ সামন্ত বলে চিনতে কষ্ট হচ্ছিল। যেন অন্য কোনও গ্রহের মানুষ তিনি। কিছুক্ষণ ফাঁক দিয়ে বাইরে বোধ হয় তুমুল বৃষ্টি নামল আবার। ভাঙা কোনও কাচের শার্সি দিয়ে ঠান্ডা ভিজে হাওয়া ঘরে ঢুকছিল। উৎকর্ণ হয়ে কী যেন শোনবার চেষ্টা করছিলেন ইন্দ্রনাথদা, তারপর চাপা গলায় বললেন, “জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশী রাতেই ও আসে! রাত্তির ঠিক দ্বিতীয় প্রহরে। আজ থেকে আশি বছর আগে এই রাতেই ওর মৃত্যু হয়েছিল কিনা!”

দূরের ঝুলন্ত কঙ্কালটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্দ্রনাথ সামন্ত, তাঁর পিচুটিভরা চোখের কোণদুটি বুঝি চিকচিক করে উঠল একবার। এখন যেন তাকে উন্মাদের মতোই দেখাচ্ছে। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব চলছে, হাজার ক্রুদ্ধ সাপের মতো হাওয়া এসে আছড়ে পড়ছে জানলার শার্সিতে। ভয়ে ভয়ে বাদল বলল, “তুমি কার কথা বলছ, ইন্দ্রনাথদা?”

একটু চুপ করে থেকে ইন্দ্রনাথ সামন্ত বললেন, “ওই কঙ্কালটা যার, তার কথাই বলছি। এ বাড়িরই বধূ ছিল সে।”

আমরা দু’জনেই আবার ঝুলন্ত কঙ্কালটার দিকে ফিরে তাকালাম, চোরা হাওয়ায় সেটা একটু একটু দুলছে এখন। কিন্তু সেটা যে কোনও মহিলার কঙ্কাল তা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদের জানা নেই। চোখ সরু করে ব্যাপারটা বুজরুকি কি না ভাবছিলাম।

একটা শ্বাস ফেলে ইন্দ্রনাথ সামন্ত বললেন, “এই বাগানবাড়িটা কেনবার পর পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় একটা কিচেনগার্ডেন করব ভেবেছিলাম। মুনিষ লাগিয়ে মাটি কোপানোর সময় একটা লোহার ট্রাঙ্ক বেরোয়, তার ভেতরেই ওই কঙ্কালটা ছিল। ট্রাঙ্কের ভেতরে গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল এ-সবও ছিল। মেডিকেল কলেজের একজন এক্সপার্ট ডোমকে দিয়ে হাড়গুলো জোড়া লাগিয়ে নিয়েছিলুম। কাঠের ফ্রেমটাও সে-ই কাঠের মিস্ত্রিকে দিয়ে করিয়ে দিয়েছিল। সে-বছরই জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশীর রাতে ও প্রথম এ ঘরে আসে।”

কথাটা শুনে বাদল যে শিউরে উঠল তা স্পষ্ট দেখা গেল। ভূতের গল্প বিশ্বাসযোগ্য করে তোলবার অসামান্য ক্ষমতা যে ইন্দ্রনাথ সামন্তের আছে, সেটা বাদলের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা গেল।

ফিসফিস করে ইন্দ্রনাথ বললেন, “আজ রাতেও ও আসবে। এসে ভর করবে ওই কঙ্কালটায়। তারপর এ-ঘর থেকে বেরিয়ে সমস্ত বাড়িতে ঘুরে বেড়াবে। কতবার ওকে জিজ্ঞেস করেছি, ওর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ, ও কোনওদিন বলেনি!”

বাদলের বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়েই কথাটা বললেন ইন্দ্রনাথ। তারপর চোখ বুজে রইলেন কিছুক্ষণ, বিড়বিড় করে যেন আপনমনেই বললেন, “স্থূল দেহ আর সূক্ষ্ম দেহ! স্থূল দেহের মৃত্যু আছে, সূক্ষ্ম দেহের নেই।”

বলে চুপ করে গেলেন আবার। সবই হেঁয়ালির মতো মনে হচ্ছে, কোনও কথারই অর্থ ধরতে পারছি না। বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার সেই অবিশ্রান্ত শোঁ শোঁ শব্দ আর বিদ্যুতের ঝলকানি। শার্সি দিয়ে আসা চকিত আলোয় ঘরের ভেতরটা উদ্ভাসিত হচ্ছে মাঝে মাঝে। একসময় চোখ মেলে ইন্দ্রনাথদা ডাকলেন, “মুকুন্দ! মুকুন্দ!”

ঘরের ভেতরেই কাছাকাছি কোথায় যেন ছিল মুকুন্দ, ডাক শুনে ধীরে সামনে এসে দাঁড়াল। দু’চোখে সেই মৃত মাছের হিমশীতল দৃষ্টি।

“এঁদের ঘরে নিয়ে যাও। আর শোনো, এঁদের রাতের খাবার ঘরেই দিয়ো।”

ইন্দ্রনাথদার গলায় কী যেন ছিল, আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমাদের এ-ঘরে থাকাটা উনি আর চাইছেন না। দু’জনেই উঠে দাঁড়ালাম।

করিডোরের একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরটা আমাদের খুলে দিল মুকুন্দ!

সেকেলে ভারী কাঠের টেবিলের ওপর হ্যারিকেন রাখা। কখন একফাঁকে এসে বিছানাপত্র গুছিয়ে রেখে গেছে মুকুন্দ। দু’দিকে দু’খানা প্রাচীন আমলের খাট, এক কোণে প্রকাণ্ড একটা মেহগিনি কাঠের আলমারি, দুই খাটের মাঝখানে দেওয়ালের দিকে একটা ইজিচেয়ার। শিয়রের পাশে নিচু টেবিলে জলের জাগ, গ্লাস। বড় বড় জানলায়, এ বাড়ির অন্যান্য ঘরের মতোই, কাচের শার্সি। বাইরে হাওয়া এবং বৃষ্টির তাণ্ডব এ-ঘর থেকেও বেশ বোঝা যাচ্ছে।

রাতে ফলাহারের ব্যবস্থা হল। আর দুধ। দু’জনেরই খিদে মরে গেছে, সামান্য খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি, মাঝরাতে মশারির ভেতরে বাদলের ঠেলাঠেলিতে ঘুম ভাঙল, চাপা গলায় বাদল বলল, “কিছু শুনতে পাচ্ছ, সত্যদা?”

সদ্য ঘুমভাঙা চোখে জানলার কাচের শার্সির দিকে তাকালাম। বাইরে ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে কখন। ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছি। আকাশ পাতলা মেঘে ঢাকা পড়ে আছে এখনও, চাঁদ নেই, তবে ফিকে একটা আলো ফুটেছে আকাশে। ঘরের আলো-আঁধারিতে বাদলের মুখের ভাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার হাতের কাঁপন বেশ টের পাচ্ছি। শিয়রের কাছে হাতড়ে টর্চটা খুঁজছিলাম, উত্তেজিতভাবে আমার হাত চেপে ধরে চাপা আতঙ্কিত গলায় বাদল বলল, “টর্চ জ্বেলো না, সত্যদা! ওই শোনো!”

এখন রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর কি না কে জানে? কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। ভেন্টিলেটরের ফোকরে কী একটা যেন ঝটপটিয়ে উঠল। বাদল শক্ত করে আমার হাত ধরে আছে। দূরে পুকুরের দিক থেকে একটা নিশাচর পাখি ককিয়ে উঠল হঠাৎ— টি…টি…টি…টি… ! তারপর আবার সেই গভীর নৈঃশব্দ্য। ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই চরাচরে।

বাদলকে অভয় দেওয়ার জন্যই বললাম, “কই, কিছু শুনতে পাচ্ছি না তো!”

“কান পাতো! শোনো!”

উৎকর্ণ হয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আর তখনই শুনতে পেলাম শব্দটা।

ঝুম্‌…ঝুম্‌… ঝুম্‌…ঝুম্‌ঝুম্‌…ঝুম্‌ঝুম্…।

যেন ঘুঙুরপরা পায়ে কেউ করিডোর ধরে এগিয়ে আসছে। অস্ফুটস্বরে বললাম, “শুনতে পাচ্ছি! এখন শুনতে পাচ্ছি!”

শব্দটা আমাদের দরজার সামনে এসে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াল যেন, তারপর আবার করিডোর ধরেই উত্তর দিকে মিলিয়ে গেল। মনে হল করিডোরের শেষ প্রান্তে ছাদের সিঁড়ি ধরে উঠে যাচ্ছে ওপরে।

বাদল তেমনি আমার হাত ধরে বসে আছে, বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি দরজার দিকে। ইন্দ্রনাথদা বলেছিলেন বটে আজ জ্যৈষ্ঠমাসের কৃষ্ণা দ্বাদশী, আজই তার আসবার কথা। কেন আসে সে? ইন্দ্রনাথদা কি জানেন? আসবার পর কী কী ঘটে, ইন্দ্রনাথ সামন্তকে জিজ্ঞেস করে আর জানা হয়নি।

কতক্ষণ আমরা দু’জনে কাঠ হয়ে বসে ছিলাম বলতে পারব না, হঠাৎ কী মনে হতে শিয়রের কাছ থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে বললাম, “আমার সঙ্গে চল তো, বাদল!”

দরজা খুলে বাইরের করিডোরে আলো ফেললাম। ছাদ চুঁইয়ে জল পড়েছে বোধ হয়, দরজার সামনেটা ভিজে। ইন্দ্রনাথদার ঘরের সামনে বসে মুকুন্দ ঘুমে ঢুলছিল, টর্চের আলো পড়তে মুখ তুলেছে সে, চোখে সেই ভয়ংকর দৃষ্টি, হাত তুলে আলো আড়াল করে আর্তনাদ করে উঠল সে, “আলো নেভান।”

আলো নিভিয়ে ঘরে ঢুকছি আমি আর বাদল। ঘরে আলো নেই। ফিকে অন্ধকারে স্পষ্ট দেখলাম, খোলা জানলার সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামুর্তি। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ডাকলাম, “ইন্দ্রনাথদা!”

কোনও জবাব নেই। পাতলা মেঘের আড়াল থেকে ঠিক তখনই উঁকি দিল কৃষ্ণা দ্বাদশীর ফালি চাঁদ। বাইরে ফিকে জ্যোৎস্নায় অচেনা এক পৃথিবী।

আবার ডাকলাম, “ইন্দ্রনাথদা!”

ইন্দ্রনাথ সামন্ত আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন না, গভীর বিষাদগ্রস্ত গলায় বললেন, “ও চলে গেল আজ। আজও ওর মৃত্যুকাহিনী বলে গেল না!”

আমরা দু’জনেই ঘরের কোণে কাঠের ফ্রেমে ঝুলন্ত কঙ্কালটার দিকে তাকালাম। ঘোর অন্ধকারে এতদূর থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না, তবু দু’জনেই অনুভব করছিলাম কঙ্কালটা সেখানে আর নেই এখন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ