Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

স্নব্ | সৈয়দ মুজতবা আলী

সমুচা হাজরা রোড হাওড়া প্ল্যাটফর্মে সমুপস্থিত। অর্থাৎ হাজরা রোডস্থ আমাদের রকফেলারগণ। অজনদা, মশাদা, ঘন্টু, মুকুলদি, —ইস্তক পাঁচ বছরের গুড়গুড়ি।

আলিঙ্গন, মস্তকাঘ্রাণ ইত্যাদি শেষ হওয়ার পূর্বেই মশাদা বললে, ‘ওঃ, কী গরমটাই না পড়েছে। ফোকাস ঢিলে করে দিলে।’

মশাদার ঐ একটা গুণ। কোনো নূতন টেকনিকাল কাজ আরম্ভ করলে তার প্রচলিত বুলিগুলো অন্য জিনিসে চট করে ট্রান্সফার করতে পারে। এই দুর্দিনে সবাই যখন ফটোগ্রাফি প্রায় ছাড়ে ছাড়ে সেই সময় মশাদা ঐ কর্মে মন দিয়েছে।

ইতিমধ্যে অ্যারকন্ডিশন কোচের স্টুয়ার্ড, মেট, রেস্তোরাঁকারের বাবুর্চী ইত্যাদি যাবতীয় চাকর-নফর, সরকারী ভাষায় ক্লাশ ফোর স্টাফ সারি বেঁধে আমায় গার্ড অব অনার দিলে।

আমার চোখে মুখে নিশ্চয়ই ভ্রুকুটি-কুটিল বিরক্তি ফুটে উঠেছিল।

রক চুপ। প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরুতেই দেখি ঘণ্টু হনহন করে পালাচ্ছে। মুকুলদি হেঁকে শুধালে, ‘ব্যাপার কি? ঘন্টুদা পালাচ্ছে কোথায়?’

বললে, ‘চাচা ক্ষেপেছে। নইলে অ্যারকন্ডিশনে আসার পয়সাই পায় কোথায়, কোং ওকে সেলাম ঠুকবেই বা কেন? দেদার টিপস্ দিয়েছে নির্ঘাত। এবারে টাকা ধার চাইবে।’

রক বললে, ‘সত্যি তো। কিন্তু ব্যাপারটা কি?’

আমি বিরস মুখে বললুম, ‘বাড়ি গিয়ে।’

চা-টা দেখেই জানটা তর-জল হয়ে গেল। চা আমরা বড় একটা খাই নে। কিন্তু সামনে না থাকলে আমরা আসামী খুনে। (আমি ‘অহমিয়া’ বলিনি, মনে থাকে যেন)। ওটা একটা সিম্‌ব্‌ল। মা কালী নৈবেদ্য ছোঁন না, কিন্তু না দিলে ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেন।

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললুম, ‘হালের বলদ বিক্রি করে রে, পালের গাই বিক্রি করে।’

সবাই শুধালে, ‘সে আবার কি?’ এরা শহুরে। ‘হালের বলদ’, ‘পালের গাই’বলতে কি বুকের পাঁজর, জিগরের খুন জানে না। বললুম, তাই দিয়ে অ্যারকোচের টিকিট কেটেছি—তোরা কলকাতায় একশ’তে হিমসিম খাচ্ছিস। আমি যখন দিল্লি ছাড়ি তখন সেখানে ১১৮°।

পদ্মায় যখন উজোন বাইতে হয় তখন পাল যদি বাতাস পায় তা হলে দেখবি—আকছারই দেখবি— একা একজন মাল্লা মাঝ পদ্মা দিয়ে যাচ্ছে তরতর করে। আর সে কী এফর্টলেস ব্যাপার। লোকটার ডান হাত মোলায়েমসে অতি আলগোছে হালের উপর রাখা—যেন কোনো মহারাজ দামী সিংহাসনের মখমল মোড়া হাতলের ওপর হাত রেখে পোট্রেট পেন্টিং করাচ্ছেন। আর বাঁ হাত দিয়ে ধরেছে পালের দড়ি। যেন প্রেমিক অলস রসে প্রিয়ার বিনুনিটি তুলে ধরেছেন। প্রিয়া, পালের বুক ফুলিয়ে উড়ে চলেছেন উজানে।

তখন যদি সে দেখে আরেক নৌকায় তিনজন মাল্লা হাল বৈঠা মেরে মেরে নেয়ে-ভিজে কাঁই হয়ে যাচ্ছে, এক বিঘৎ এগুতে পারছে না, পাল নেই বলে, তখন সে চিৎকার করে তাদের বলে ‘হালের বলদ বিক্রি কর, পালের গাই বেচে দে’—বাকিটা আর বলে না। সবাই জানে। তার মানে, ঐ পয়সা দিয়ে পাল কেন।’

টেটেনদি উপস্থিত অর্থাভাবে। এটা সেটা বেচছে। নবীন হদিশের আশায় শুধালে, ‘আপনি কি বেচলেন?’ ইঙ্গিতটা বড় রূঢ়।

‘মর্নিং সুট, ঈভনিং জ্যাকেট—’

বড়দা পিচভরা মুখ আকাশ পানে তুলে বললে, ভালো করেননি। এই আমি কেদার-বদ্রী হয়ে এলুম। পথেই যত বাহার—দেবতা দেখতে এমন কিছু না, কিন্তু যখন সাঁধের ঝোঁকে ঈভনিং জ্যাকেটটি পরেন তখন দেখায় লাভলি।’

বিগ্রহের ঈভনিং জ্যাকেট! ওঃ, বুঝেছি। ঠাকুরকে যখন সন্ধ্যায় সিঁদূর চন্দন দিয়ে শৃংগার করানো হয়। সেইটে বড়দার ভাষায় ঈভনিং জ্যাকেট পরা। বুঝতে সময় লেগেছে। দিল্লিতে তিন বছর থেকে আক্কেল-বুদ্ধি ভোঁতা মেরে গিয়েছে।

টেটেনদি শুধলে, ‘আর গার্ড অব অনার পেলেন বুঝি সেই ঈভনিং জ্যাকেটের পয়সায় মর্গানেটিক টিপস দিয়ে?’ টেটেন ইংরেজিতে এম-এ। লাতিন শব্দের ইঁটের থান মারে।

অজনদা বললে, ‘সে সব দিন গেছে রে টেটেন, তুই জানিস নে। টিপস্ দিলে তোকে খাতির করলে করতেও পারে, কিন্তু না দিয়ে তুই যদি এমপি টেম-পি হবার ভাণ করতে পারিস অর্থাৎ ভি আই পি টি আই পি—’

মশাদা আলট্রা ডিমোক্রেট। বাধা দিয়ে বললে, ‘এই ভি আই পি কথাটা প্রথম কে ব্যবহার করেছিল জানেন, চাচা? লোকটা নিশ্চয়ই জন্মদাস ছিল। ভি আই পি যদি কেউ থাকে তবে সে মুটে, জুতো-বুরুশওলা—সরকারের এক পয়সা নেয় না, সরকারের গাড়ি মুফতে চড়ে না—’

আমি বললুম, ‘আমি টিপস দি নি। শোন।’

পালের বলদ বিক্রি করে তো অ্যারকোচে চাপলুম। দিল্লি চিরতরে ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে দিল্লির খানদানী ইয়াব-দোস্তরা গাড়িতে বিস্তর খাবার-দাবার তুলে দিলে। বিরয়ানী মুরগী মুসল্লম থেকে মিঠা টুকড়া মোরব্বা ইস্তেক। চাবটে টিফিন কেরিয়ার ভর্তি। দুজন তো এলেন কানপুর অবধি। তাঁরা আবার দোস্তী পাকাতে ওস্তাদ। কোচের প্রায় সবাই জড়ো হল আমাদের কুপেতে। শুরু হল মুশাইয়া, বয়েৎ-বাজি। তারপর নবাবী খানাপিনা। স্টুয়ার্ড সোডা সাপ্লাই করতে করতে কাহিল হয়ে গেল।

রাত বারোটার সময় যখন যে যার কোঠে ফিরে গেছেন, আমি একা, তখন দেখি, স্টুয়ার্ড। পিছনে তারই দলের দু’তিনজন। ভাবলুম, লোকগুলো বিস্তর খেটেছে—এই বেলাই টিপসটা দিয়ে দি। কিন্তু তার পূর্বেই সে ডবল সেলাম করে শুধালে, “হুজুর, আপ তো ডক্টর হৈ?” গোয়ানজি টোয়ানীজ হবে—ডক্টরই বলেছিল। আমি না ভেবেই বললুম, “হ্যাঁ।” তখন বিস্তর কাঁচুমাচু হয়ে এন্তের ঢোক গিলে, ঘাড়ের চুল ছিঁড়ে প্রায় ক্লীন শেভ করে বললে, “হুজুর যদি কিছু না মনে করেন—”

আমি বললুম, “কী আপদ! বলেই ফেলো না!”।

বহু কষ্টে বোঝালে, তার মেটের ভয়ঙ্কর জ্বর, বেহদ্দ বেহুঁশ, এই যায় কি তেই যায়। হুজুরের যদি দয়া হয়, হুজুর মেহেরবান।

প্রথমটায় আমি বুঝতে পারিনি। বললুম, “বঢ়ী আফসোস কী বাত, কিন্তু আমি কি করবো?”

এবারে সে তার সর্বশরীর ব্যাং মাছের মতো মোচড়াতে আরম্ভ করলে। যেন জ্বরটা তারই। বললে, “আপনি তো স্যার, ডক্টর।”

তখন আমার কানে জল গেল। বিরক্ত হয়ে বললুম, “আমি জ্বর সারাই কে বললে?”

লোকটা ভয় পেয়েছে। অথচ আপন কাজ উদ্ধার করতে চায় বলে মেলা তর্ক করে আমাকে চটাতেও চায় না। বললে, “এই তো রিজার্ভেশন কার্ডে লেখা রয়েছে, হুজুর।”

এ দুনিয়ায় ‘আলী’ নামটা বাঙলা দেশে ‘কেষ্টা’ নামটার মতই বিরল। গুবলেট হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমার আপিস বার্থ রিজার্ভ করার সময় ডক্টরটি জুড়ে দিয়েছিলেন। সেইটেই এখন কাল হল।

আমি সবিনয় বললুম, “সে অন্য ডাক্তার।”

বোধ হয় ভুল করলুম। কারণ এর পর দেখি স্টুয়ার্ডের সাঙ্গোপাঙ্গরা তার পিছন থেকে মাসিকপত্রের উপন্যাসের মতো ‘ক্রমশ প্রকাশ্য’ হচ্ছে। সক্কলেরই হাত জোড় করা। হুবহু মোগল পেন্টিংয়ের দরবারের মতো। অবশ্য মুখের ভাব;—আসামীর সনাক্তকরণ সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়েছে, এইবারে সাক্ষীশাবুদ-দলিল-দস্তাবেজ আরম্ভ হবে।

আমি অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি অন্য ডক্টর। তারা তর্ক করতে চায় না, কিন্তু জানতে চায়, তবে কিসের? ডক্টর অব ফিলসফি এদের বোঝাই কি প্রকারে? শেষটায় বললুম, “দেমাগ সাফ করনেকা ডাক্টর—” অর্থাৎ মগজ সাফ করার ডাক্তার। শুনেছি, দর্শন অধ্যয়ন করলে মস্তিষ্ক পরিষ্কার হয়, অবশ্য আমার বিশ্বাস বিপরীত।

রাসা রোড থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত তাবৎ হাজরা রোড একথায় আনন্দে সায় দিলে। কথায় বলে ‘দশের মুখ খুদার তবলা’, কিন্তু তৎসত্ত্বেও মনে উল্লাস বোধ করলুম না। যাক গে।

এই ‘দেমাগ সাফ কবাটা’ গিলতে স্টুয়ার্ডগোষ্ঠীর সময় লেগেছিল। শেষটায় স্বয়ং স্টুয়ার্ডই হালে পানি পেল। ভয় পেয়ে বললে, “না, হুজুর মেটের মাথা খারাপ নয়।’

ও হরি! এরা ভেবেছে, আমি পাগলের ডাক্তার।

টেটেনদি বললে, ‘সাইকায়াট্রিস্‌ট।’

আমি বললুম কচু। মেডসিন না পড়েও ঐ কর্ম করা যায়। সেটা ওরা বুঝলে তো আমি বেঁচে যেতুম। তা নয়। ওরা ফিসফিস করছে, আর সব মেলা ব্যামো সারানোর পর আমি পাগল সারাতে মন দিয়েছি—ঐ কর্ম সব চেয়ে কঠিন বলে! পাগল সারাতে পারে, আর জ্বর সারাতে পারে না! হুঃ! ‘হাতী’ বানান করতে পারে আর ‘পিপীলিকা’ পারে না—হাতী কত বিরাট আর পিপীলিকা কত ছোট—ঐ গোছ যুক্তি।

কিংবা বলতে পারো, ছোট বিপদ এড়াতে গিয়ে পড়লুম বড় বিপদে। সেই যে কোন্ সুবুদ্ধিমান বৃষ্টি এড়াবার জন্য ডুব দিয়েছিল পুকুরে।

তা সে যাকগে। ওরা আমাকে বিধান ডাক্তার, মানুষের ডাক্তার, পাগলের ডাক্তার, কুকুরের ডাক্তার, যা খুশি ভাবুক, আমার তাতে থোড়াই এসে যায়।

কিন্তু ঐ বিধান ডাক্তার নিয়েই লাগল গোলমাল। ওরা ভেবেছে আমি বিধানবাবুর চেয়েও বড় ডাক্তার। কিছুটা আমায় শুনিয়ে, কিছুটা নিজেদের ভিতর তাদের মধ্যে যেন নিলাম ডাকাডাকি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, আমার দক্ষিণা কত! চৌষট্টি না কত থেকে আরম্ভ হয়েছিল শুনতে পাইনি, কিন্তু আমার চোখের সামনেই দেখ তো না দেখ দশ বিশ হাজারে গিয়ে পৌঁচেছে! আর কত রকম যুক্তিই না একে অন্যকে দেখাচ্ছে। অ্যারকন্ডিশন চড়ি, সে তো ডাল-ভাত। কটা বাক্স, প্যাট—সব তাদের মুখস্থ। দামী দামী ডাক্তাবির মালপত্র ওদের ভিতরে। সব বিলায়তী, জর্মনি, আরো কত কি!

আমার চেহারা দেখে আমাকে উজবুক মনে হতে পারে, কিন্তু পাষণ্ডের মতো চেহারা আমার নয় সে কথা আমার মা আমাকে বলেছে। তবে কেন এরা ভাবছে, আমি একটা আস্ত কসাই, মোটা টাকা না পেলে বরঞ্চ একটা লোককে মরতে দেখব, তবু কড়ে আঙুলটি তুলব না।

আমি বহু কষ্টে ধৈর্য সম্বরণ করে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি ডাক্তারির কিছুই জানি নে, খামখা একটা লোককে কুচিকিৎসায় মারি কোন আক্কেলে?

ওরা চুপ করে যেভাবে আমার দিকে তাকালে তাতে মনে হল আমি যেন একটি পয়লা নম্বরে গোড়সে। তবে গোড়সে শুধু একটিমাত্র, গান্ধিকে খুন করেছিল, আমি করি গণ্ডায় গণ্ডায়।

আমিও চুপ।

শেষটায় তারা শ্লথ মস্থরে পা চালাতে আরম্ভ করলে।

আমার মনে করুণার উদ্রেক হল। আর ঐ করলুম ভুল। যুধিষ্ঠিরের মত খৃষ্ট কোন একটি পাপ করার ফলে যদি কখনো নরক দর্শনে আসেন তবে তাঁকে ঐ একটি উপদেশ দেব, ‘মহাশয়, আপনি করুণা করে আর ঐ করুণা করার উপদেশটি দেবেন না।’

ওদের বললুম, ‘তা ওকে এলাহাবাদে নামিয়ে দাও না’—মনে মনে বললুম, পণ্ডিতজীরও নিশ্চয়ই গণ্ডাকয়েক অনারারি ডক্টরেট আছে।

এক লক্ষে সবাই আবার আমার দোরের সামনে। এককণ্ঠে সবাই বললে, ‘এলাহাবাদ তো পিছনে ফেলে এসেছি।’

তখন মনে মনে চিন্তা করলুম, হাওড়া পর্যন্ত তা হলে তো এর কোনো গতি নেই। তখন আরো মনে পড়ল, বছর তিনেক পূর্বে আমার ফ্লু হওয়াতে এক সহৃদয় বন্ধু আমাকে এক শিশি ফ্লু টেবলেট দিয়ে যান; আমি ভালো করেই জানতুম, ফ্লু ওষুধে সারে না, তাই সে ওষুধ তেমনি পড়ে ছিল। দিল্লি ছাড়ার সময় আমার সময় ছিল না বলে চাকরকে বলেছিলুম, ঘরের তাবৎ মাল যেন প্যাক করে দেয়। সেই কারণেই দুনিয়ার যত আবর্জনায় ভর্তি দু’ গণ্ডা বাকসোপ্যাঁটরা। ঘাঁটবে কে, খুঁজে পাবেন কোন হনুমান?

তারই ইঙ্গিত দিয়ে করলুম দুই নম্বরের ভুল—যদিও আসলে সেইটেই পয়লানম্বরী ভুল। সঙ্গে সঙ্গে আমার আটটা বাক্স করিডোরে সারি বেঁধে সাজানো হল—আমি বাধা দিতে না দিতেই। তখন নাচার হয়ে সেই শিশিটার বর্ণনা দিলুম।

পুলিনবিহারী সেনের বাড়ি এক ভোরে সার্চ হয়েছিল। আমি সে রাত্রে তার সঙ্গে ছিলুম বলে স্বচক্ষে দেখেছি পুলিশ কি রকম চিরুনি চালায় টুথব্রাশের উপর—তার থেকে কিছু বেরোয় কি না, সেই আশায়। মায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এদের কাছ থেকে তালিম নিয়ে যেতে পারত কি করে সার্চ চালাতে হয়।

আড্ডার দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘বল দেখি ভাইরা সব, তিন বছরের প্রবাসে মানুষের কোন্ না দশ বিশটা ওষুধের শিশি জড় হয়। তারই এক-একটা বেরয় আর তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসে। ভাবখানা, —তবে না বলছিলেন চাঁদ তিনি ডাক্তার নন। আর ইংরিজি পড়তে জানে না বলে লাইটার ফ্লুইডকে ভাবে ওষুধ, ফেনসি গঁদের শিশিকে ভাবে ওষুধ, সেন্টের শিশিকে ভাবে ওষুধ— একমাত্র সসের শিশিকে ওষুধ ভাবে নি—রেস্তোরাঁ কারে কাজ করে বলে।

ওষুধের শিশি তো আর রাসবিহারী বোস নন যে জাপান পালিয়ে যাবেন। ধরা পড়লেন। বমালসুদ্ধ গ্রেফতার—’

অজন বললে, এই ‘বমালসুদ্ধ’ কথাটা কি ভুল নয়? ‘ব’ মানেই তো ‘সুদ্ধ’, ইংরিজিতে যাকে বলে ‘উইথ’। উইথ মাল গ্রেফতার। আবার সুদ্ধ কেন? হয় হবে বমাল গ্রেফতার’, না হয় হবে ‘মালসুদ্ধ গ্রেফতার’। যেমন বলি ‘বহাল তবিয়তে’ আছি, ‘বহাল সুস্থ তবিয়তে আছি’ তো বলিনে।’

মশাদা বললেন, ‘রবিঠাকুর ব্যবহার করেছেন।’

অজনদা চটে বললে, ‘তিনি তো দক্ষিণ আমেরিকায় বসে কবিতায় লিখলেন, আকাশে সপ্তর্ষি উঠলো। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কি সপ্তর্ষি দেখা যায়? আরও কি যেন আছে? হ্যাঁ—‘বেতসের বাঁশী’—বেতস মানে তো বেত। বেত দিয়ে বাঁশী হতে কখনো দেখেছিস?’

টেটেনদি অলঙ্কার শাস্ত্র পড়েছে। বললে ‘যত সব বেরসিক!’।

বড়দা সদুপদেশ দিলেন, ‘সে না হয় পণ্ডিত মশাইকে পরে শুধনো যাবে, কোনটা ঠিক। উপস্থিত তোদের বলে দিচ্ছি, রবিঠাকুরের সেন্টানারি আসছে। এখন বছর দুই এসব কথা বলেছিস কি পাড়ার ছেলেরা মারবে।’

মুকুলদি উঠে চলে যাচ্ছে দেখে সবাই হন্তদন্ত হয়ে বললে, ‘বলুন, চাচা তারপর কি হল।’মুকুলদিকে কে না সমীহ করে। ভাঁড়ারের চাবি তার হাতে। আমি বললুম, ওষুধটা বেরুলে পর আমি বললুম, এরই দুটি গুলি খাইয়ে দাও।’মনে মনে বললুম, ‘এতে তার ভালো-মন্দ কিসসুটি হবে না—হাওড়া গিয়ে যা হবার তাই হবে।’

‘নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুতে গেলুম। ভাবলুম, আপদ গেছে। ঐ করলুম আরেক ভুল।

পরদিন সকালে বর্ধমানে চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, আমার কুপের সামনে একপাল লোক একসারি কাপড়ে ঢাকা ট্রে নিয়ে হাজির। ভাই, তোরা যদি থাকতি—রুটি-মাখন-মমলেট।’

আমার ভ্রূকুটিকুটিল নয়ন তারা লক্ষ্যই করলে না। সমস্বরে চেঁচিয়ে বললে, “সেরে গেছে, হুজুর, একদম সেরে গেছে।”

আমি বেবাক ভুলে গিয়েছিলুম। বললুম, ‘কে?’

সবাই প্রথমটায় থ মেরে পরে বললে, “ঐ যে মেট।”

স্টুয়ার্ড সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘সকালে উঠেই তিনখানা ডবল রুটি খেয়েছে। দু পট চা। আমরা বারণ করিনি। আপনি তো রয়েছেন। আর ভাবনা কি।”

আমি মুখ ফিরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালুম।’

অজনটা পেটুক। বললে, ‘তা বেশ, তা বেশ। ব্রেকফাস্টটা ভালো করে খেয়ে নিলেই পারতেন।’

আমি বললুম, ‘দেখ অজন, আস্ত একটা বুজরুক পেলি নাকি আমাকে—পেশাদার গুরু-মুর্শীদরা ঐ রকম ধাপ্পা মেরে খায়। আমাকে কি তাই ঠাওরালি?”

টটেন বললে, ‘আপনি থামুন, মশাদা। চাচাকে আর চটাবেন না। বলুন, চাচা।’

আমি বললুম, ‘ব্রেকফাস্ট খেলুম না দেখে ওরা ভড়কে গেল—‘অবশ্য চা দু’কাপ খেয়েছিলুম। ওরা নিঃশব্দে চলে গেল।

হাওড়া পৌঁছবার পূর্বে চীফ স্টুয়ার্ডকে ডেকে বললুম, এই নাও চায়ের এক টাকা, আর তোমাদের টিপ্‌স্‌ চারটাকা।’

স্টুয়ার্ড ফেল ফেল করে তাকিয়ে রইল। তার পিছনে একটা অচেনা চেহারার লোক ভ্যাক করে কেঁদে ফেললে—পরে জানলুম ঐ লোকটাই মেট, আমাকে সেলাম জানাতে এসেছিল— তার পর ডুকরে বললে, ‘আমরা গরীব আপনার ফীজ দিতে পারলাম না, আর আপনি উল্টে দিচ্ছেন বখশিস।’

আমি বিরক্ত হয়ে সব কটাকে বের করে দিয়ে কুপের দরজা বন্ধ করে দিলুম। তারপর তোরা তো দেখলি আমাকে প্ল্যাটফর্মে গার্ড অব অনার দিলে।

ঘণ্টা একটু মুরুব্বি ঢঙে কথা কয়। বললে, ‘এতে আপনি অত চটছেন কেন? আপনার দাওয়াইতেই সারুক আর নিজের থেকেই সারুক, আপনার মন খামখা চঞ্চল করছেন কেন?’

আমি উষ্মার সঙ্গে বললুম, ‘তোদের মতো আকাট নিরেট গবেট আমি ইহজন্মে পূর্বজন্মে, জন্মে-জন্মে কখনো দেখিনি। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলুম, ওদের মুখের উপর কৃতজ্ঞতা মাখা ছিল বটে—যার-উপর হক অবশ্য আমার নেই—তার পিছনে ছিল লেখা স্নব। অর্থাৎ আমি গরীব দুঃখীর চিকিৎসা করিনে, সেটা এড়াবার জন্য মিথ্যে কথা বলতেও তৈরী—অথচ আমি যে হাত উপুড় করলেই ওদেব পর্বত সেটা সপ্রমাণ হয়ে গেল। সোজা বাঙলায় স্নব, ক্যাডও বলতে পারিস—’

আমার কণ্ঠ তখন পর্দার পর পর্দা চড়েই যাচ্ছে, এমন সময় হঠাৎ দেখি জনা পাঁচেক লোকে আমার বাড়ির নেমপ্লেট পড়ছে। লীডার সেই ব্যাটা স্টুয়ার্ড! আমি আঁৎকে উঠলুম। কিন্তু ঠিকানা পেল কি করে? ওঃ! লাগেজগুলোর উপর নাম-ঠিকানা সাঁটা ছিল। অবশ্য বাড়ির নেমপ্লেটে আমার নাম নেই।

আমি বৈঠকখানায় গা ঢাকা দেবার পূর্বে বললুম, ‘ঐ সব মালরা আসছে! ওদের একটু বুঝিয়ে দে , না, ভাইরা সব, চাচা-জানরা আমার, যে আমি ডাক্তার নই। তোদের কথা তো বিশ্বাস করবে।’

আড়াল থেকে অনিচ্ছায় নিম্নলিখিত কথোপকথন কর্ণে প্রবেশ করল।

‘এটা ডাক্তার সাহেব অমুকের বাড়ি?’

অজনের গলা: ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’—ঐ ঢাউস বাড়ি আমার নয়।

‘নেমপ্লেটে নাম না দেখে ভাবলুম, কি জানি—’

বাধা দিয়ে মশার গলা: ‘আরে নাম থাকলে কি আর রক্ষে ছিল। ছিঁড়ে ফেলতে না দুনিয়ার যত সব রুগী টুকরো টুকরো করে।’

একাধিক গদগদ কণ্ঠস্বর: ‘তা হুজুর আর কি বলবেন, আমরা কি জানিনে? এই মোতীর জ্বরটা বড্ডই পাজী। একবার ধরলে দশদিনের কমে—’

অন্য কণ্ঠ: ‘বিশদিনের কমে ছাড়ে না। আর ডাক্তার সায়েবের দুটি গুলিতেই—’

আরেক কণ্ঠ—বোধহয় স্টুয়ার্ডের—‘কিছু যদি মনে করেন, ওঁর ফীজ কত?’

অজনের টেনে-টেনে বলা: ‘তা—তা—তা, দেড়, দুই—’

‘দুশ? বাপ্৷’

‘হাজার—হাজার, শ নয়।’

নিশ্চুপ।

মশার গলা: ‘অবশ্য যখন বাইরে যান, ঐ যে, মাসখানেক আগে রামপুরের নবাবের ছেলে এসে তাঁকে জোর করে নিয়ে গেল—স্পেশাল ট্রেনে—তখন ত্রিশ হাজার না কত—বল না ঘন্টু, তুই তো সঙ্গে ছিলি—’

ভাবছি এ রকটা ছাড়ব।

১৯ মার্চ, ১৯৬১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ