Ticker

6/recent/ticker-posts

Header Widget

পেদ্রো হুয়ানের আজীব দাস্তান | রবিশংকর বল

পেদ্রো হুয়ানের আজীব দাস্তান
রবিশংকর বল

রবিশংকর বল

আমার নাম পেদ্রো হুয়ান। আমার আসল নাম পেদ্রো নয়, বাবা-মা দিয়েছিল প্রদীপ হালদার। কিন্তু পেদ্রো হুয়ানের মধ্যে আমি বাঁচতে ভালোবাসি; বা বলা যাক, পেদ্রো হুয়ান না হয়ে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব। নিজের উদ্দেশ্যেই আমি মাঝে-মাঝে বলে উঠি, ‘পেদ্রো হুয়ান দীর্ঘজীবী হোক'। দীর্ঘজীবী মানে কী? কতদিন বাঁচলে তাকে দীর্ঘজীবী বলা যায়? কচ্ছপেরা কয়েকশো বছর বেঁচে থাকে; সেক্ষেত্রে মানুষের জীবনকে কি দীর্ঘজীবী বলা যায়? আবার প্রজাপতি-জন্মের তুলনায় আমরা তো দীর্ঘজীবী বটেই।

পেদ্রো হুয়ান থাকে হাভানা শহরে । আপনারা নিশ্চয়ই আমকে পাগল-মাথায় ক্র্যাক আছে বলে ভাবছেন! এই সেদিন একটা সিনেমা দেখলাম টিভিতে। সেখানে একটি মেয়ে ঘুরেফিরে আসত; সবাই মনে করত, মেয়েটি মাথার স্ক্রু ঢিলে আছে। কেননা মেয়েটি ভাবত, তার স্বামী (না-থাকারই সম্ভাবনা) একজন মাফিয়া-ডন, যে হাঙর দিয়ে লোকজনকে খাওয়ায়। এখন কথা হল, মেয়েটির পক্ষে যেমন তার স্বামী একজন ডন, না-ভেবে বেঁচে থাক অসম্ভব, পেদ্রো হুয়ানও হাভানা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। অতএব, আমি, পেদ্রো হুয়ান হাভানাতে থাকি।

এ সেই হাভানা যখন খাদ্যের জন্য নারী ও পুরুষ বেশ্যাবৃত্তি করে, খুন জখম-রাহাজানি করে, যখন খাদ্যের বিকল্প হিসাবে তারা বেছে নেয় যৌন হিংসা। যখন ব্যাগে গোমাংস আছে, অভিযোগ তুলে একটি কিশোরকে পিটিয়ে মেরা ফেলা হয়, তার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় ট্রেন থেকে। যখন একটি মানুষ তার বোন ও প্রিয় কুকুদের মৃতদেহ নিয়ে মাসের পর মাস কাটিয়ে দিতে পারে বদ্ধ ঘরে।

পেদ্রো হুয়ান না-হয়ে এখানে বেঁচে থাকা অসম্ভব, থাকে আর কিছুই ছুঁতে পারে না, দরিদ্র নয়, বড়ো কোনো ঘটনা নয়, যার জীবন সম্পর্কে কোনো উচ্চাশা নেই । চূড়ান্ত এক নেতির চেতনা নিয়ে সে বেঁচে থাকে। এর মধ্যে একমাত্র সমুদ্রতীরে ঘুরতে গেলেই সে কখনোও কখনোও গান গেয়ে ওঠে। হ্যাঁ, সমুদ্র এখানে আছে। একেকদিন আকাশ জুড়ে মেঘেরা এমন ছন্নছাড়া হয়ে যায়, কোথাও দেখা যায় সূর্যাস্তের কমলা-লাল স্রোত, কোথাও হলুদ, কোথাও গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের টেউ-তখন সমুদ্রকে দেখা যায়, সারা আকাশ জুড়ে টেউ ভাঙছে। পেদ্রো হুয়ান তার চিলেকোঠায় বসে সেই সমুদ্র দেখতে-দেখতে রাস্তায় নেমে আসে, সমুদ্রতীরে বেড়াতে যায়।

এই শহরের অনেকেই পেদ্রো হুয়ানকে চেনে না। অনেক পুরোনো ফেঁসে যাওয়া একটা ডেনিম ট্রাউজার পরে সে, রং-চটা লাল ফুল স্লিভ শার্ট ট্রাউজারের ভিতরে গোঁজা, মাথায় পুরোনো হলিউড ছবিতে দেখা কাউবয়-মার্কা টুপি, ঈষৎ সামনের দিকে নামানো, ফলে তার মুখ দেখা যায় না। শুধু সস্তা সিগারেটের ধোঁয়া—যেন ওই ধোঁয়াই তার মুখ। হাভানাতে একদা যে ফ্যাতারুদের আমদানি করা হয়েছিল, পেদ্রো হুয়ান তেমন কোনো ফ্যাতারুও নয়। বড়োলোকদের বাড়ি-বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে, সমাবেশে-সভায় ফ্যাতারুরা যে-নাশকতা চালাত, তার পিছনেও একটা মতাদর্শ ছিল। যেমন ফ্যাতারু কবি পুরন্দর ভাট লিখেছিল; 

গাঁড় মারি তোর মোটরগাড়ির
গাঁড় মারি তোর শপিং মলের
বুঝবি যখন আসবে তেড়ে
ন্যাংটো মজুর সাবান কলের
পেটমোটাদের ফাটবে খুলি
ফাটবে মাইন চতুর্দিকে
গলায় ফিতে নেংটি বেড়াল
তার বরাতেই ছিঁড়বে শিকে

হুয়ান পেদ্রো এই নৈরাজ্যবাদ থেকেও দূরে থেকে, তার চিলেকোঠায় বসে হাই তুলত। তার ফটো: ‘সাপ-মইয়ের দুনিয়ায় ঢুকো না। শুধু খেলে যাও।' কেননা চারপাশের সবাই তোমাকে সাইজ করার জন্য দর্জির দোকান খুলে বসে আছে। এঁরা সব দোআঁশলা, রংচটা, রোরিং, নিজেদের ভাষায় একেবারে ‘সুস্থ’। এই হাঙর-রা সুযোগ পেলেই তোমাকে গিলে খাবে, তোমাকে কপালে উল্কি দেগে দেবে। শালা, ওই লোকগুলোর চোখে ‘বিপ্লবী’ হওয়াও যা, ‘প্রতিবিপ্লবী' হওয়াও তা-ই। সুশীল সমাজ তোমার রক্ত-মজ্জা শুষে খাবে।

তা-ই বাবা-মা একে-একে চিতায় ওঠার পর প্রদীপ হালদার–আমাদের পেদ্রো হুয়ান তাদের পুরানো বাড়ি বিক্রি করে একটি চারতলার চিলেকোঠায় ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করে। বছর দুয়েকের মধ্যেই বাড়ি বিক্রির টাকা সে রাম খেয়ে, জুয়া খেলে অহেতুক বেশ্যাবাড়ি গিয়ে (কোনো বেশ্যার সঙ্গেই সে কিছু করতে পারেনি) ফুরিয়ে ফেলে। হ্যাঁ, এক্ষেত্রে পেদ্রো হুয়ানের মাথায় পরিকল্পনা ছিল। সম্পত্তি থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই মঙ্গল। সম্পত্তি মানেই তোমার চারপাশে নানা মাছির ভনভনানি। সব টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পেদ্রো হুয়ানের চলে কী করে? নানা রকম কাজ করে সে রোজকার খরচের টাকা রোজ জোগাড় করে নেয়। এসব কথা পরে হবে। দুবেলার খাওয়া-দাওয়া, সন্ধের পর রামের একটা পাঁইট মঝে-মধ্যে কাফেতে গিয়ে কালো কফি পান, কয়েকটা সিগারেট আর মাস গেলে চিলকোঠার ভাড়া। ওটুকু জোগাড় হয়ে যায়; সম্পত্তি যেহেতু নেই, কেউ তার ছায়াও মাড়ায় না। শুধু একজন আসে। দুপুরে বা সন্ধের পর। বিধবা বাড়িউলির অবিবাহিতা মোটা মেয়েটি। কৃষ্ণা উত্তুঙ্গ সেক্স করতে পারে। প্রেম-ভালোবাসার দাবি কৃষ্ণার নেই, শরীর যা চায়, তা দাও। ব্যস।

ও-ই, আমাদের পেদ্রো হুয়ান ট্রাউজারের দু-পকেটে হাত ঢুকিয়ে হেঁটে চলেছে। মুখ-ঢাকা কাউবয়-টুপির আড়াল থেকে ইতিউতি ঝারি মারছে। পেদ্রো হুয়ান দেখল, একটা মিছিল আসছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্লোগান শোনা যাচ্ছে। সে জোরে হাঁটতে শুরু করল। এইসব ঢপকীর্তন থেকে যত দূরে থাকা যায়!

॥ প্রেম ও গুয়ের গল্প ॥

দেওয়ালের ফ্ল্যাট স্ক্রিনে টম অ্যান্ড জেরির দৌড়োদৌড়ি।

পেদ্রো হুয়ান কার্টুনে একেবারে ডুবে গেছে। টম অ্যান্ড জেরির মতোই পেদ্রোরও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। ‘ডার্টি হাভানা ট্রিলজি' উপন্যাসে আমরা জন্ম, সে ভাবছিল। একদা সে টিভি রিপোর্টার ছিল; এখন হাভানার রাস্তায় রাস্তায় ডন জুয়ানের মতো ঘুরে বেড়ায়; তার বন্ধুরা প্রায় সকলেই সস্তা বেশ্যা, সেইসঙ্গে নারী-শিকারও করে সে এবং সকলের সঙ্গে বিছানা-সম্ভোগ উপভোগ করে। দুটি শব্দকে পেদ্রো হুয়ান আমর্ম ঘৃণা করে: অর্থপূর্ণ ও বাস্তবসম্ভত। এর চেয়ে বড়ো মিথ্যে আর হয় না। গোটা ইতিহাস, জীবন, প্রতিটি যুগকে তার অর্থহীন ও অবাস্তব মনে হয়। আমরা—আমাদের জীবন—পুরাটাই অর্থহীন; কিন্তু ইন্দ্রিয়ের অন্ধকারকে দমিয়ে রেখে সবাই ভেড়া হতে চাই।

টম অ্যান্ড জেরি দেখতে-দেখতে তার সেই গল্পটা মনে পড়ল। সে-ও এক ইঁদুর আর বেড়ালের গল্প। সেই গল্পের ইঁদুরটা বেড়ালকে বলছিল, ‘দুনিয়াটা যেন দিন-দিনে ছোটো হয়ে আসছে। প্রথমে এত বড়ো ছিল যে আমার ভয় করত, শুধু দৌড়োতাম আর দৌড়োতাম, তারপর ডাইনে-বাঁয়ে দেয়াল দেখতে পেলে খুশি হতাম। দেয়ালগুলো আস্তে-আস্তে এত কাছাকাছি চলে এল, মনে হয় আমি শেষ ঘরটায় আটকে পড়েছি। ঘরের কোণ একটা ফাঁদ পাতা, সেদিকে দৌড়োনো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সব শুনে বেড়ালটা গম্ভীর মুখে বলল, “তোকে শুধু দিক বদলাতে হবে।' তারপর ইঁদুরটাকে খেয়ে ফেলল।

পেদ্রো হুয়ান জানে, দুনিয়াটা কখনই বড়ো ছিল না। শুধু নতুন আবিষ্কারের বিষ্ময় ইঁদুরকে আছন্ন করে রেখেছিল। তারপর চারপাশটা দেখতে দেখতে, অভিজ্ঞতা যত বাড়ল, ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে যখন সে শুয়োরের মাংস হয়ে গেল, তখন বুঝতে পারল, দেয়ালগুলো বড়ো কাছাকাছি আর তার জন্য অপেক্ষা করে আছে ইঁদুরকল।

সেই যখন মানুষ নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ আবিষ্কারের নেশায় সমুদ্রে ভেসে পড়ে ছিল, তখন থেকেই তো দুনিয়াটা ছোটো হয়ে আসছে। যতদিন একেক সাম্রাজ্যের নিশান ওড়েনি, ততদিন ‘অনন্ত' শব্দটার কোনো অর্থ ছিল; তারপর লুন্টন-হত্যা-হাজার হাজার বছরের একেকটি সভ্যতাকে মুছে দেওয়ার মধ্য দিয়ে দুনিয়াটা দুটো অংশ ভাগ হয়ে গেল : ওল্ড ওয়ার্ল্ড আর নিউ ওয়ার্ল্ড।

ট্রেতে সাজানো কালো কফি, কুকিজ এল।

অনেকদিন পর এই কফিশপে এল সে। তার ছোটোবেলার বন্ধু ঘনশ্যাম — ঘনার সঙ্গে দেখা করতে। একই স্কুলে পড়েছে তারা, এক সঙ্গে খেলাধুলা করেছে, রথের মেলায় গিয়ে পাঁপড়-জিলিপি ভাগ করে খেয়েছে। শহরে তার চিলেকোঠার ঠিকানা জোগাড় করে—কীভাবে কে জানে—অবশ্য আজকাল তো সবই সবার সবকিছু জানে— পেদ্রো হুয়ানের সঙ্গে দেখা করার জন্য চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে একটা লাইন ছিল, ‘আমি হেরে গেলাম রে।' পেদ্রো হুয়ান হেসে ফেলেছিল। কে কবে কোথায় জিতেছে! হেরে যাওয়া নিয়ে যারা কাঁদুনি গায়...। ঘনা অবশ্য একটুতেই কেঁদে ফেলত। যেন ছোটো ছেলের হাতের মোয়া বা লাট্টু কেউ কেড়ে নিয়েছে।

ঘনশ্যামকে দেখতে পেল পেদ্রো হুয়ান। তাকে খুঁজতে এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছে। কিছুক্ষণ টম অ্যান্ড জেরির খেলার দিকে তাকিয়ে আছে ঘনা। তারপর তোতলাতে -তোতলাতে বলে, ‘কে আপনি?’

-পেদ্রো হুয়ান।

এবার ঘনার চোখে ঔজ্জল্য দেখা যায়। -প্রদীপ – তুই-

-পেদ্রো হুয়ান।

—ঠাট্টা করিস না। পেদ্রো কে?

-আমি। পেদ্রো হুয়ান হয়ে গেছি।

-কেন? ঘনশ্যাম বসতে-বসতে বলে, ‘নাম বদলে ফেললি কেন?”

পেদ্রো হুয়ান উত্তর দিল না। কে জানে, ঘনাকে এসব কথা বলে লাভ নেই। হয়তো এই কফিশপে বসেই কাঁদতে শুরু করবে।

কাউকেই বোঝানো সম্ভব নয়, একটা নাম নিয়ে বেশিদিন বেঁচে থাকা যায় না। নামের সঙ্গে এমন ঘটনা জুড়ে যায় যে সেইসব ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। তারা গুয়ের পোকার মতো জীবনের সঙ্গে ঘেঁটে যায়। কিন্তু একবার নাম বদলে ফেলতে পারলে, তুমি একটা নতুন জীবনে ঢুকে পড়তে পারলে, তা সে যেমনই হোক । নিজের ইতিহাসকে বয়ে বেড়ানোর দায় আর তখন থাকে না। জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর তুমি যদি সব নিয়ম মেনে নাও, সব কথা বিশ্বাস করো, তাহলে আর কখনও ‘না’ শব্দটাই বলতে পারবে না; ‘আমাকে একা থাকতে দাও' বলা অসম্ভব হয়ে উঠবে। তাই চল্লিশ বছরের আগেই একবার সব নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে এসো, তুমি যেমনটা, তাকে কবর দিয়ে, নতুন জীবনে ঢুকে পড়তে পারো পেদ্রোকে পিছনে ফেলে। কিন্তু ঘনা তার ঠিকানা খুঁজে বের করায় পেদ্রো হুয়ান ভয়ও পেয়েছে; দুনিয়াটা আরও ছোটো হতে থাকবে; তোমাকে আর তখন প্রয়োজনও হবে না, কম্পিউটার প্রোফাইল-ই হয়ে উঠবে তুমি। সবই কে-ই ভার্চুয়াল নিয়তির দিকেই এগিয়ে চলেছে।

কী হয়েছে তোর? পেদ্রো হুয়ান জিগ্যেস করে।

ঘনশ্যামের চোখ ছলছল করে উঠে, ওপরের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বলে ‘আমি হেরে গেছি।'

—যে তো চিঠিতেই লিখেছিলি। ব্যবসায় লাল বাতি জ্বলেছে?

ঘনশ্যাম কোনো কথা বলে না; জামার পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বার করে পেদ্রো হুয়ানের দিকে এগিয়ে দেয় ।

—এটা কী? - চিঠি ।

-কার?

শর্মির।

-ও। তোর বউ। তা তোর বউয়ের চিঠি আমি পড়তে যাব কেন? পেদ্রো হুয়ানের কন্ঠস্বরে বিরক্তি। ছেলেবেলার বন্ধু বা যে-ই হোক, কারোর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরার আপত্তি তার। এতে তোমার আখিল্লিশের গোড়ালি চিনে ফেলা সম্ভব। নিজের দুর্বলতার জায়গা কাউকেই দেখাতে নেই, এমনকি নিজেকেও নয়, এজন্যই একজন মানুষের ভিতরে তারই মতো আরও অনেক মানুষ সারা জীবন লড়াই চালিয়ে যায়।

ঘনার জোরাজোরিতে শর্মির চিঠি পড়তেই হল মাত্র তিনটির বাক্য, ‘তোমার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়। আমি নতুন জীবন শুরু করতে চাই। আমাকে ভুলে যেও।' জানা গেল, ঘনার দোকানের তরুণ কর্মচারীর সঙ্গেই নতুন জীবন শুরু করতে চলেছে শর্মি। -এতে হার জিতের কী হল? পেদ্রো হুয়ান বলে। –শর্মির পোষাচ্ছে না, চলে

গেছে।

—অথচ আমাকে কত কথা বলত। এই যেদিনও বলেছ।

—কী ?

–আমাকে ছাড়া কাউকে ও ভালোবাসতে পারবে না। বাচ্চা না হলেও আমরা সুখী হব। আর সবসময় বলত, আমি তোমাকে মিথ্যে বলি না।

পেদ্রো হুয়ান মিটি-মিটি হাসে।

তুই হাসছিস?

—এসব কথায় তুই বিশ্বাস করতিস ?

-কেন করব না? ঘনশ্যামের কন্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।

-তাহলে এক নারী এক শিশুর সঙ্গে যা করে থাকে, শর্মিও তা-ই করেছে।

-তার মানে?

—শিশুকে মেয়েরা যেভাবে ভোলায় ঠিক-

পেদ্রো হুয়ান চুপ করে যায়। একটা কবিতা মনে পড়ে তার:

অরেঞ্জ গামছাটা রয়েছে।

তারো এক কোণে ছিঁড়ে গিয়েছিল লোহার আংটায়—

যে দুটো গামছা এর আগে

বাঁকুড়া থেকে এনে তোমাকে উপহার দিয়েছিলুম

সেগুলো তুমি কি করেছো ?

মাদুর ও গামছা

এই আজ হয়ে গেছে তোমার-আমার সামগ্রী;

তুমি কলকাতায় থাকো,

হাড়কাটায়,

আমি দূর-দূরান্ত থেকে আজও তোমার জন্য গামছা বেছে এনে স্তূপ করে রাখি তোমার ।

তুমি আছো, না মরে গেছ!

এই, অঞ্জলি ?

—শর্মি তাহলে আর ফিরবে না? ঘনশ্যাম দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকে। যেন একটু পরেই তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে। পেদ্রো হুয়ানের হাসি পায়। সে টম অ্যান্ড জেরি শো-এর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, ‘একটা দেশে যেন খাবার পাওয়া যাচ্ছে না। সামান্য কিছু খাবারের জন্য লোকজন এখানে-ওখানে ছুটছে। গ্রামে এক চাষির বাড়িতে ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো জড়ো হয়েছে কিছু মানুষ। চাষির ঘোড়াটা মারা গেছে, পেট অর্ধেক ফুলে ঢোল। রুগ্ন ছেঁড়া জামাকাপড় পরা মানুষগুলো ঘোড়ার শরীর মাংস কেটে নিতে চায়। মরা ঘোড়ার শরীর ধীরে ধীরে পচে উঠছে। পুঁজ, পোকা বেরিয়ে আসছে। তবু মানুষগুলো পচা মাংস কেটে নেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। দুয়েকদিনের খাবারের তো ব্যবস্থা হবে।

থেকে

—কী বলতে চাস, তুই? ঘনশ্যাম মিন-মিন করে বলে।

-কিছু না। চল ওঠা যাক ।

তারা কাফে থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকে। হ্রদের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা অন্ধকার হয়ে আছে। পেদ্রো হুয়ান বড়ো এক ঠোঙা বাদাম কিনে খোসা ছাড়াতে-ছড়াতে হাঁটে, হাওয়ায় ভাসতে থাকে তার ভৌতিক কন্ঠস্বর, ‘ঘনা, সব কিছুর মতো আমাদের ভালোবাসাও একদিন ফুরোতে শুরু করে। সামান্য যেটুকু পড়ে থাকে তার একটা ভালো রেশনিং ব্যবস্থা দরকার। ট্যাঙ্কের জল যেন একেবারে ফুরিয়ে না যায়, তাহলে ইঞ্জিন চলবে না। কেউ কেউ ভাবে, ট্যাঙ্কটাকে নতুন ভাবে ভরে তোলা যায়। এসব গান্ডুমার্কা ভাবনার কোনো মানে হয় না ঘনা। অমিও একদিন ভাবতাম, আমার ভিতরে হয়তো কোনো ঝরনা খুঁজে পাব, যার জল আমার ট্যাঙ্কটাকে ভরে তুলবে। এইরকম মিরাকল কখনও ঘটে না, ঘনা।'

ঘনশ্যাম চলে যাওয়ার পর বাড়িটাতে ফিরে চিলেকোঠায় আলো দেখতে পেল পেদ্রো হুয়ান তারা মানে, কৃষ্ণা এসেছে। তার বিছানায় এখন কৃষ্ণা শুয়ে আছে। পেদ্রো হুয়ানকে দেখে কৃষ্ণা হুয়ান হাসল, স্লিভলেস ব্লাউস থেকে নগ্ন মোটা দুটি হাত আড়ামোড়া ভাঙল। পেদ্রো হুয়ান গ্লাসে রাম ঢেলে কৃষ্ণার পশে বসল। রামের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে কৃষ্ণার চর্বি-ভরা পেটে হাত বোলাতে লাগল। ‘শুড়শুড়ি লাগছে... শুড়শুড়ি লাগছে...' বলে হাসতে লাগল কৃষ্ণা; তার হলুদ দাঁত, বড়ো নাকের ফুটো প্রচীন এক কচ্ছপের মুখ দেখতে পাচ্ছিল পেদ্রো হুয়ান।

তারপর ঘাম, বীর্য, কৃষ্ণার শরীরের ভিতরের তরল, লালার গন্ধে ভার উঠল পেদ্রো হুয়ানের চিলেকোঠার ঘর।

॥ এই বেশ আছি ॥

সব খবরের কাগজেই একটা ‘মর্গ’ থাকে। মৃত্যুপথযাত্রী বিশিষ্ট, নামী মানুষদের অবিচুয়ারি এবং পরে মারা যাবে এমন বিশিষ্টদের জীবনের নানা তথ্য একটা ফাইলবন্দি করে রাখা হয়। এই ফাইল বা কম্পিউটার প্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে হার্ডডিক্সে রাখা অবিচুয়ারি এবং তথ্যকেই বলা হয় ‘মর্গ’। বিদেশে মর্গের একজন নির্দিষ্ট সম্পাদকও থাকেন। পেদ্রো হুয়ান কী করে তা একজন জানতে চাওয়ায় সে বলেছিল, ‘মর্গে কাজ করি।'

—মানে? মর্গে তো মৃতদেহ কাটাছেঁড়ার ডাক্তার আর ডোম থাকে শুনেছি। আপনি—। লোকটি থতোমতো খেয়ে কথা শেষ করতেই পারে না।

—আমি এর কোনোটাই নই।

পেদ্রো হুয়ান তাকে বুঝিয়ে বলার পর লোকটি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।

-একরকম শকুনের কাজও বলতে পারেন। পেদ্রো হুয়ান আরও খোলসা করে বলে, “বিশেষ কেউ মরলেই শুকুনের কান্না কাঁদতে হয়।’

‘বালিগঞ্জ বার্তা’ ট্যাবলয়েড দৈনিক রোজ দুপুরে বেরোয়। পেদ্রো কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিল তার কলেজ-জীবনের বন্ধু অতনু। একদিন ‘বলিগঞ্জ বার্তা'-র সম্পাদক রাধেশ্যাম ঘোষের কাছে পেদ্রোকে নিয়ে যায় সে। রাধেশ্যাম আমার কাগজের মালিকও। অতনু বলেছিল, 'ওর লেখার হাত আছে স্যার। কিছু একটা কাজ দেওয়া যায় ?’

—নাম কী?

পেদ্রো হুয়ান।

রাধেশ্যাম চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। —পেদ্রো হুয়ান? বাপ-মার দেওয়া নাম। —না স্যার। পেদ্রো হুয়ান বলেছিল, “নিজেই নিয়েছি।’

-কেন ?

‘অতনু হেসে বলে, 'ও এক নাম নিয়ে বেশিদিন থাকতে পারে না।'

বেশ। নামে আমার কী এসে যায়! রাধেশ্যাম বলে, ‘পেদ্রো হুয়ান নামে তো বালিগঞ্জ বার্তায় লেখা ছাপা যায় না। তা কী লিখতে পারেন ?

—গল্প টল্প রম্যরচনা যা বলবেন। পেদ্রো বলে।

—ওসব আমরা ছাপি না। গল্প-টল্প আজকাল কেউ পড়ে না। অবিচুয়ারি লিখতে পারবেন?

সে-ই শুরু। দুদিন পরেই পেদ্রো হুয়ান একজন বিশিষ্ট মৃতের অবিচুয়ারি লিখে নিয়ে যায়। রাধেশ্যাম লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। বলে, ‘বড়ো মায়াজড়ানো লেখা আপনার পেদ্রো। মর্গের ফাইল তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হল তাকে। সপ্তাহে একদিন যেতে হবে আর হঠাৎ কেউ মরলে তার অবিচুয়ারি লিখে দিয়ে আসতে হবে। ঝুটঝামেলা অনেক কম। তবে মাসমাইনেও বেশি নয়। যে-টাকায় চিলেকোটার ভাড়া খাড়াদাওয়া ও আনুষঙ্গিক খরচ চালানো সম্ভব নয়। অতএব কয়েকদিন ভেবে পেদ্রো হুয়ান একটা উপায় বার করে ফেলে।

বেশি দামে নেশার জিনিস বেচো পেদ্রো হুয়ান, সে নিজেকে বলে। বাড়ির পিছনে দিনটা ঝোপঝাড়ে ভরা। সেখানে যে দুটি গাঁজা গাছ পোঁতে, তাদের সযত্নে বড়ো করতে থাকে। এ-অঞ্চলে শনিবার ড্রাই ডে। আগের দিন নিপ-পাঁইট মিলিয়ে গোটা দশক রামের বোতল কিনে রাখে সে। ব্ল্যাকে বিক্রি করে শ-পাঁচেক টাকা উঠে আসে। কেউ কেউ আবার চিলেকোঠাতেই বসেই খেতে চায়। যে-সব শনিবার নিজের জন্য রামের ব্যবস্থাও হয়ে যায়। এরপর গাঁজাচাষ থেকেও লাভের কড়ির মুখ দেখতে পায় পেদ্রো হুয়ান।

কৃষ্ণা একদিন আদর করতে করতে বলেছিল, ‘তুমি হেবি চালু।’

-কেন ?

—কত লোককে টুপি পরাচ্ছো।

কৃষ্ণার পেটে মুখ ঘষতে ঘষতে পেদ্রো হুয়ান বলে, ‘আর আমাকে কে টুপি পরাচ্ছে বলো তো?

- কে?

—মিস্টার গড।

—ছিঃ ভগবানের নামে অমন কথা বলে না।

কৃষ্ণার চর্বি-ভরা শরীর দু-হাতে ছানতে ছানতে পোদ্রা হুয়ান বলে, ‘ন্যাকা! ভগবান যেন রোজ রাতে তোমার সঙ্গে শুতে আসে!'

—আসেই তো। কৃষ্ণা কপালে দু-হাত ঠেকিয়ে তিনবার নমস্কার করে।

-তার মানে?

—আমাকে রোজ রাতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

পেদ্রো হুয়ান মনে-মনে বলে, গাড়োল। আরও জোরে সে কৃষ্ণার ওপর চাপে যেন সে কৃতী এক অশ্বারোহী।

॥ ঝুলে পড়া জিভের বৃত্তান্ত ৷৷

একটা অবিচুয়ারি কাল রাতে শুরু করেছিল, অসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। আজ সেটা শেষ করে দিয়ে আসতে হবে। পেদ্রো হুয়ান সিগারেট টানতে-টানতে শেষটা কীভাবে করবে সে-কথাই ভাবছিল।

এমন সময় কৃষ্ণা এসে খবরটা দিল। পেদ্রো একটা জামা চড়িয়ে রাস্তার মোড়ের কাছে ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। ভিড় জমে গেছে। পুলিশের কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিন তলা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসা হল মৃতদেহ, ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

লোকটিকে পেদ্রো হুয়ান অনেকবারই দেখেছে, তারই বয়সি, ওপরের দিকে তাকিয়ে হাঁটত। নাম জানা ছিল না, এখন জানতে পারল—অমরেশ সরকার। প্রতিবেশীরা নাকী দুদিন ধরেই পচা গন্ধ পাচ্ছিল। আজ খবর পেয়ে পুলিশ এসে দরজা ভাঙে এবং সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলন্ত দেহটি নামায়। এতএব তিনদিনের মাথায় অমরেশের পচা, ফুলে ওঠা মৃতদেহটা পুলিশ একটু আগে মর্গে নিয়ে গেল।

পেদ্রো হুয়ান লোকটির ঝুলে পড়ার ছবি, তিনদিন বদ্ধ ফ্ল্যাট পচে ওঠার দৃশ্য কল্পনা করতে চাইছিল। অমরেশ নিশ্চই রাতের দিকেই সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিল। সাধারণত দিনের বেলা এমনটা ঘটে না। আলোর ভিতরে এই পৃথিবীতে থেকে যাওয়ার একটা টান আছে, পেদ্রো হুয়ানের মনে হয়। আর অন্ধকারে মানুষের বেঁচে থাকার বৃত্ত ছোটো হতে হতে তাকে কৃষ্ণগহ্বরের দিকে ঠেলে দেয়। সেই লোকটার ঘরের জানলার ধারেও তো উটের গ্রীবার মতো এক নিস্তব্ধতা এসেছিল রাতে। তখন থুরথুরে অন্ধ প্যাঁচা এসে কথা বলে। শরীর হৃদয় প্রেম-শিশু-গৃহ-সবই তো ছিল, তবু গভীর অন্ধকার তাকে টেনে নিয়ে গেল, একগাছা দড়ি হাতে সে অশ্বত্থের কাছে চলে গিয়েছিল। এসবই রাত্রি-অন্ধকারের ষড়যন্ত্র বলে মনে হয় পেদ্রো হুয়ানের।

অমরেশের ঘাড়ের হাড়টি ভেঙে যায়, জিভ বেরিয়ে পড়ে এবং পায়ুদ্বার থেকে গু পড়তে থাকে। নিজের প্রতিরোধহীন শরীর তো অমরেশ দেখেনি, যা শুধুই ক্লেদ হয়ে যায়, পোকা-মাকড়ের খাদ্য হয়ে ওঠে। অমরেশ সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে থাকে, তার শরীর ধীরে ধীরে ফুলে ওঠে, এখান-ওখান থেকে দুর্গন্ধভরা রস গড়ায়, কোথা থেকে পিঁপড়েরা এসে তার চোখ নাকের ভিতরে ঢুকে যেতে থাকে, শরীর আরও পচে, সেই-পচন থেকে জন্ম নেয় পোকারা, ভেতর থেকে তারা মাংস-মজ্জা খেতে থাকে, অমরেশ ঝুলতে থাকে।

চিলেকোঠায় ফিরে অসমাপ্ত অবিচুয়ারি আর লিখতে পারে না সে। কিন্তু অবিচুয়ারিটা আজই জমা দেওয়ার কথা, কেননা সেই রিয়েল এস্টেটের মালিকটি নার্সিংহোমে ভেল্টিলেশনে আছে। পেদ্রো হুয়ান আবাক হয়ে ভাবে, এ-রাজ্য প্রোমোটারদেরও ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলা হয়। ভেন্টিলেশন মানে, এসব ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যায়, পটল তুলেছে ইতিমধ্যেই, যে-কোনো সময় মৃত্যুর খবর ডিক্লেয়ার করা হবে। তবু পেদ্রো হুয়ান গ্লাসে রাম ঢেলে বসল।

দুপুরের দিকে রাধেশ্যাম ঘোষের ফোন এল, ‘অবিচুয়ারিটা কী হল ?'

– কেন ?

—মানে? মিঃ আগরওয়ালের মৃত্যুর খবর তো পরিবার থেকে ডিক্লেয়ার করে দিয়েছে। আমরা সেকেন্ড এডিশনে ছাপব। এক্ষুণি চাই।

—আমি আসছি।

—ট্যাক্সি ধরে চলে আসুন।

অফিসে বসে অবিচুয়ারির বাকি অংশটা লিখে রাধেশ্যাম ঘোষকে পাঠিয়ে দিল পেদ্রো হুয়ান। একটু পরেই সম্পাদকের ঘর থেকে তলব এল।

রাধেশ্যাম ঘোষ অসহায় স্বরে বলল, ‘আপনি এত ভালো অবিচুয়ারি লেখেন। কিন্তু মিঃ আগরওয়ালেরটা একেবারে জমেনি। প্যাথোস কোথায়, প্যাথোস?’

পেদ্রো হুয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আজ মনটা ভালো নেই রাধেশ্যামবাবু।”

– কেন ?

—আমাদের পাড়ায় একজন সুইসাইড করেছে। তিনদিন আগে। আজ পুলিশ এসে বড়ি নিয়ে গেল।

—আমারও তো সুইসাইড করতে ইচ্ছে করছে। আগরওয়ালের কোম্পানি আমাদের বছরে কত টাকার বিজ্ঞাপন দেয় জানেন? লেখাটা একটু ব্রাশ-আপ করুন।

–আমাকে দিয়ে আজ আর হবে না। পেদ্রো হুয়ান উঠে দাঁড়ায়। —সকালবেলা থেকে খেলে—। বিরক্তিতে কথা শেষ করতে পারে না রাধেশ্যাম ঘোষ ।

বাইরে বেরিয়ে পেদ্রো হুয়ান অনেকক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সকাল থেকেই একটা অন্ধকার তার ভিতরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে। একমাত্র কৃষ্ণার শরীর এখন তাকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু রাতের আগে কৃষ্ণাকে পাওয়া যাবে না। অমরেশ তার কে? লোকটাকে পথে যেতে আসতে দেখেছে মাত্র। তার সম্পর্কে কিছুই জানে না পেদ্রো হুয়ান। অথচ ইচ্ছে করছে, ব্লেড দিয়ে সারা শরীর চিরে চিরে দেখতে, অমরেশ লোকটা কোথায় ঘাপটি মেরে আছে; কেন তার আত্মহত্যা ও পরের মুহূর্তগুলো পেদ্রো হুয়ানের রক্তে, মাথার কোশে-কোশে ছড়িয়ে পড়ছে ?

অমরেশকে নিয়ে একটা অবিচুয়ারি সে লিখতে চায়।

কৃষ্ণার কাছে আর পাড়ার চায়ের দোকানে বসে, বাজারে ঘুরে-ঘুরে অনেকের মুখ থেকে অমরেশ সম্পর্কে অনেক কথা শোনা হল। পেদ্রো হুয়ান বুঝতে পারল, অমরেশকে সত্যিই কেউ চিনত না, শুধু তার সম্পর্কে কিছু খবরাখবর জানে। পেদ্রো হুয়ান অমরেশকে নিয়ে একটা গল্প লিখবে ভাবল। সে জানে, একমাত্র গল্পের মধ্যেই অমরেশকে হয়তো কিছু চেনা, জানা সম্ভব। অন্য কোনোভাবেই নয়। শুধু গল্পই পারে মানুষের আলো-অন্ধকারের ভিতরে ঢুকে যেতে।

কিন্তু দুয়েক পৃষ্ঠা লিখেই ছিঁড়ে ফেলে দিল পেদ্রো হুয়ান। অমরেশ আমি আপনাকে নিয়ে গল্প লিখব কীভাবে? আমি কখনও আমার জীবন দিয়ে আপনাকে ছুঁইনি, আত্মহত্যার মুহূর্তে আপনি কী ভাবছিলেন, আমি জানি না—কেউ কখনও জানতেও পারবে না। আমরা শুধু জানি, আপনার দাদাকে—তখন ১৯৭১-এক রাতে পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর রেল লাইনের কাছের মাঠে আপনার দাদার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিশি বয়ানে, এককাউন্টারে মৃত্যু। আপনি কি তখন থেকে শরীরের ভিতর থেকে উঠে আসা একটা পচা গন্ধ পেতেন, শকুনদের ওড়ার ডানার আওয়াজ কি আপনার ঘুমের মধ্যে ভেসে আসত? জেগে উঠে মনে হত, কেউ ঘরের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

আপনার বাবা পাগল হয়ে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। আর সেই থেকে আপনার মা ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। দুজনের সংসারের সব কাজ নীরবে করে যেতেন। দাঁতে দাঁত চেপে একটা কথাই তো ভাবতেন, ১৯৭১-এর বৃত্ত থেকে আপনাকে বেরোতেই হবে। এমএ পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে আপনি অফিসারের চাকরি পেয়ে গেলেন। মায়ের কাছ থেকে আপনি পেয়েছিলেন এই পড়ার নেশা।

আপনার মা তাঁর নীরবতা নিয়ে চলে গেলেন আর আপনি এই শহরে এলেন একা-একা ।

পেদ্রো হুয়ান ছাদে এসে দাঁড়াল, বোতল থেকে নিট খেয়ে সিগারেট ধরাল। বোরিং, বোরিং। আমিও কতগুলো ইনফর্মেশনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। আর ততই, অমরেশ, মনে হচ্ছে, আপনি আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। পিউ কি আপনাকে চিনেছিল? যার প্রেমে পড়লেন, বিয়েও করলেন? দুটো বছর তো বেশ ভালোই কেটেছিল, ওই যে বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল ছিল, 'কেয়া স্বাদ হ্যায় জিন্দেগি কা' ঠিক সেইরকম। তারপর?

নিরুদ্দেশ বাবাকে কি পথে-পথে ঘুরতে দেখতেন? মায়ের নীরবতা কি আপনার দিকে তাকিয়ে থাকত? মৃত দাদার কাটা মুন্ডু কি শহরের আকাশে ঘুরপাক খেত? আপনারও আর কথা বলতে ভালো লাগত না। আবার ১৯৭১ আক্রমণ করছে। সবাই বলে, মাঝে-মাঝেই আপনার-পিউর ঝগড়া ও হাতাহাতির আওয়াজ পাওয়া যেত। তাই কি নানারকম নেশায় ডুবছিলেন? ঘুম—দীর্ঘ শীতঘুম—কথা বলা থেকে মুক্তি। তারপর একদিন টেনে হিঁচড়ে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হল সেন্টাল অ্যাসাইলামে। শক থেরাপি চলেছিল; অ্যাসাইলাম থেকে যখন বেরিয়ে এলেন, আপনার চুল ছোটো-ছোটো করে ছাঁটা, ঠোঁট ঈষৎ বেঁকে গেছে, দুই হাতে কাঁপুনি। মাঝে মধ্যে অফিসে যেতেন, বেশিরভাগ সময় ফ্ল্যাটেই স্বেচ্ছাবন্দি জীবন।

আপনার উন্মাদনার বীজ খুঁজতে কাউকেই খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি। বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, মা আর কথা বলতেন না—ওই তো উন্মাদনার বীজ। ১৯৭১-এর কথা কে মনে রেখেছে? যখন সময়েরই জোড় ভেঙে গিয়েছিল...। ১৯৭১ তো অতীত, মরা ইতিহাস। কিন্তু সে যে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কে তার খবর রাখে?

মাসখানেক আগে পিউও ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আপনার সঙ্গে আর থাকা যায় না। সে ডিভোর্স চায়। তারপর থেকে খুব কমই রাস্তায় দেখা গেছে আপনাকে। কী করতেন? ফ্ল্যাট একা-একা ঘুরে বেড়াতেন? কোনো বই পড়তেন কি? না, নিজের সঙ্গেই কথা বলে যেতেন? আত্মহত্যার কয়েকদিন আগে কেউ আপনাকে আর টেলিফোনেও পায়নি। বারবার নাকি একই কথা শোনা গেছে, দ্য নাম্বার ইজ সুইচড্ অফ।

শুনেছি, যে ঘরে আপনার ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায়, তার একদিকের দেওয়ালে, সম্ভবত লাল লিপস্টিক দিয়ে লেখা ছিল, ‘লং লিভ রেভলিউশন'। লিপস্টিকের জেল্লা তখনও নাকি হারিয়ে যায়নি। কবে লিখেছিলেন? সুইসাইড করার আগে?

আপনাকে নিয়ে গল্প লিখতে আমি পারব না। অবিচুয়ারিও না। উন্মাদনার কি কোনো অবিচুয়ারি লেখা যায়?

॥ বিদায় হাভানা ৷৷

মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল পেদ্রো হুয়ানের। তার মনে হল, ছাদে কেউ পায়চারি করছে। দরজা খুলে দীর্ঘকায় এক মানুষকে দেখতে পেল সে, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, পরনে অলিভ গ্রিন ট্রাউজার ও শার্ট, মুখে চুরুট জ্বলছে। পেদ্রো হুয়ানকে দেখে লোকটি বলল, 'চলো পেদ্রো।'

—কোথায় ?

—এখানকার কাজ তো শেষ। ডার্টি হাভানা পড়ে থাকুক। এবার আমাদের বলিভিয়া যেতে হবে।

—বলিভিয়া ?

—একটা মুক্তাঞ্চল তো আমাদের দরকার। সেখান থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে বিপ্লবের কথা।

—কিন্তু আপনি তো—

—মরে গেছি? লোকটি হাসে। —ছুঁয়ে দেখো, উত্তাপ টের পাবে। এখনও রক্ত বইছে শরীরে।

—চলুন।

—লং লিভ রেভলিউশন।

পরদিন থেকে পেদ্রো হুয়ানকে আর দেখা যায়নি। শুধু তার এই আজীব দাস্তানটুকুই পড়ে আছে।


- golpo.org -

নিয়মিত গল্প পড়ার জন্য ইমেলে সাবস্ক্রাইব করুন।
porua.net/subscribe


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ