অচেনা স্বান্তনা
আকদাস আরমান
আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে তুলি হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ে, দুইকানে দুই হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভয়ে কাপতে থাকে, এক্ষুনি মেঘের গর্জন সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে যাবে। তুলির বৃষ্টি অনেক ভালো লাগে, কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানো আর মেঘের গর্জন এই দুটিকেই সে অনেক ভয় পায়। যে বৃষ্টি তাঁকে সবসময় ডাকে, সে বৃষ্টি এ বৃষ্টি নয়। তবুও আজকে এ বৃষ্টিতেই বের হতে হলো, সব ভয়কে উপেক্ষা করে আজ সে বের হয়েছে। বৃষ্টির পানির সাথে তার চোখের পানি এক হয়ে গেছে।
বাড়িতে আবার মা-বাবার ঝগড়া—ঝগড়ার প্রতিটি কঠিন শব্দ তার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দেয়। বয়সের হিসেবে তার এই দশ বছরে সে সাক্ষী হয়েছে এমন হাজারো পারিবারিক সংঘাতের, যা কেবল তার মনকে বিষিয়ে তোলেনি, জীবনের বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে করে তুলেছে তিক্ত।
বাবা মায়ের ঝগড়া আজ সে কোনোভাবেই সইতে পারছে না। একেকটি কথা যেন তীরের মতো তার বুকে গিয়ে আঘাত হানছে। সে আর ঘরে থাকতে পারে না, বাইরে বেরিয়ে আসে। উদ্দেশ্য, এই অশান্ত কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে নিজেকে মুক্ত করা, তার বাবা মাকে মুক্তি দেয়া। কিন্তু বাইরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি। এর মধ্যে সে কোথায় যাবে। বাবা মায়ের ঝগড়াতে মনে হয় আকাশটাও খুশি নয়। বৃষ্টির সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি আর মেঘের গর্জন অন্তত তাই বুঝিয়ে দিচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ বারান্দায় দাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে তুলি। বাইরে বেরুতে সাহস পায়না। তবে আজ সে বের হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
মনের মধ্যে চেপে থাকা হাজারো কষ্টগুলো আজ তার সেই ভয়কে জয় করে। সে বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশে। কোথায় যাবে তা জানা নেই তবে অসহ্য এই কোলাহল ছেড়ে সে বাঁচতে চায়।
"তুমি কি হারিয়ে গেছ, মামনি?" মোলায়েম নরম কণ্ঠস্বর।
তুলি তার কাঁধে এক শীতল হাতের স্পর্শ অনুভব করে। মাথা ঘুরিয়ে দেখে খানিকটা উস্কু খুশকু চেহারার এক বৃদ্ধ, মোলায়েম দৃষ্টিতে তুলির দিকে তাকিয়ে আছে। তুলি তার বয়স আন্দাজ করতে পারে না, তবে বৃদ্ধ লোকটার শরীরের চামড়া আর সাদা চুল দাড়ি দেখে সহজেই অনুমান করতে পারে যে, লোকটার বয়স কম না। হাতে লাঠি থাকলেও সেটা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া শরীরের অক্ষমতা প্রমাণ করে না। তবে বৃদ্ধের নির্লিপ্ত চাহনিতে প্রজ্ঞার প্রমাণ পাওয়া যায়।
তুলি মাথা নাড়ল।
"আমার ছাতার নিচে আসবে?" বলেই বৃদ্ধ লোকটি তার ছাতাটা তুলির দিকে এগিয়ে ধরে। কি মধুর তার কণ্ঠস্বর।
তুলি মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
তারা পথ চলতে থাকে। বৃদ্ধ লোকটি হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তুমি কি জানো যে, একসময় আমিও তোমার মতো ছোট ছিলাম। এই মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে আমিও ভয় পেতাম।”
বৃদ্ধ কিছুক্ষন থামে—তারপর আবার বলতে শুরু করে, “কিন্তু আমার ভয় কেবল মেঘের গর্জন আর বিদ্যুৎ চমকানোতে ছিলো না, ছিল আমার নিজের পরিবারের জন্যও।”
তুলি তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধের দিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মত বৃদ্ধের কথা গুলো শুনতে থাকে।
বৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো, যেন পুরনো দিনের কোনো গল্প মনে পড়েছে। “আমার বাবা-মা প্রায়ই ঝগড়া করতেন। প্রতিদিন, কখনো ছোটখাটো বিষয়ে, কখনো এমন সব কারণে যা আমার ছোট্ট মাথায় ঢুকত না। তখন আমি ভাবতাম, আমি যদি না থাকতাম, হয়তো তারা এত ঝগড়া করত না।”
তুলি নীরবে বৃদ্ধের সাথে সাথে হাঁটে আর তাঁর কথা শুনতে থাকে। বৃদ্ধের কথা বলার মধ্যে যেন এক জাদু আছে। গভীর আগ্রহ নিয়ে তুলি বৃদ্ধের কথা শুনতে থাকে।
“একদিন, আমিও তোমার মত চিন্তা করলাম—আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। এই ঝগড়া থেকে দূরে, বহুদুরে—একদম একা কোথাও গিয়ে থাকবো। তাই এমন এক ঝড়ের রাতে, আমি তোমার মতোই বেরিয়ে পড়লাম।” বৃদ্ধ হাসল, যেন নিজের বোকামির কথা মনে পড়েছে।
“তারপর?” তুলি স্বতস্ফুর্তভাবে জিজ্ঞাসা করে—চোখে মুখে তার জানার ব্যগ্রতা দৃশ্যমান।
“তারপর, পথের ধারে আমি এক বৃদ্ধাকে পেলাম। তার মুখে ছিল প্রশান্তি, আর চোখে ছিল অবিরাম ভালোবাসা। তিনি আমায় থামিয়ে বললেন, ‘কোথায় যাচ্ছ, বাবা?’
আমি বললাম, “এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। বাবা-মায়ের এমন নিত্যকার কলহ আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
বৃদ্ধা শুধু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি কি জানো, সম্পর্ক মানে কী?’ আমি মাথা নাড়লাম।
তিনি বললেন, "সম্পর্ক অনেকটা বাতাসের মতো। কখনো শান্ত, কখনো বা ঝড়ো। দেখবে শান্ত বাতাস কেমন গাছের পাতায় দোলা দেয়, তখন ডালে ডালে পাখিরা বসে গান গায়, এক চমৎকার পরিবেশ তৈরি করে, মানুষও তাতে আনন্দ পায়। আবার দেখবে ঠিক ঝড়ো বাতাসেও গাছের ডালপালা কেমন ছিটকে যায়, নুইয়ে পড়ে, সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়। তবুও গাছ সর্বোচ্চ সংগ্রাম করে দাঁড়িয়ে থাকার, টিকে থাকার। কারন গাছের প্রাপ্তি সেই নির্মল বাতাসে পাতার দুলুনি, আর ডালে ডালে পাখিদের কিচিরমিচির। তাই সে অপেক্ষা করে, ঝড় শেষে আবার সুর্য দেখার জন্য। সম্পর্কেও ঠিক তেমনই—কখনো শান্তি, কখনো ঝড়। কিন্তু ঝড় এলেই কি সম্পর্ক ছেড়ে চলে যেতে হয়? না, বরং ঝড়ের সময় সবাই একসাথে থেকে ঝড়কে মোকাবিলা করতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় ঝড় শেষ হওয়ার। ঝড়ের পর যেমন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়, তেমনি সম্পর্কও সময়ের সঙ্গে আরও মধুর হয়ে ওঠে, যদি তুমি তা টিকিয়ে রাখতে চাও।"
আমি বুঝতে পারলাম, আমি আমার ভয়কে এড়িয়ে চলতে চাইছিলাম কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি, বাবা-মায়ের জীবনের এই ঝড় শুধু ঝড় হয়েই থাকে না, ঝড় কেটে গেলে আবার রৌদ্রের দেখাও পাওয়া যায়। ভয় থেকে তুমি যত পালিয়ে বেড়াবে, সেই ভয়ও তোমার পিছু করতে থাকবে যতক্ষন না তুমি ভয়কে উল্টো ভয় দেখাবে। ”
বৃদ্ধ থেমে যায়। তারপর তুলির দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম, মামনি। এবং আমি বুঝেছিলাম, বাবা-মায়ের ঝগড়া ভালোবাসারই একটা রূপ। তারা একে অপরকে যতটা কষ্ট দেয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসে। সময়ের সঙ্গে আমি দেখেছি, তারা কীভাবে একে অপরের পাশে থেকেছে, কীভাবে আগলে রেখেছে একে অপরকে।”
তুলি গভীরভাবে শোনে। বৃদ্ধ তার মাথায় হাত রাখে। “তুমি জানো, ঝড়ের রাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ একে অপরের পাশে থাকতে চায়। তোমার বাবা-মাও তাই চায়। তারা তোমাকে ভালোবাসে, মামনি। শুধু ঝড়ের শব্দে তোমার সেই ভালোবাসা হয়তো তুমি শুনতে পারছিলে না।”
তুলি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে হয়, এই বৃদ্ধ যেন তার জন্যই এখানে এসেছে, শুধু এই কথাগুলো বলার জন্য। তুলি তার চিন্তার জগতে চলে যায়। বৃদ্ধ জানত না, বৃদ্ধের বলা গল্পের প্রতিটা শব্দ তুলির ক্ষতবিক্ষত মনের জন্য মহা সান্ত্বনা যা তুলির মনে আশা জাগায়, তুলিকে বুঝায় পরিবারে ঘটে যাওয়া প্রতিটা মুহুর্ত যেন সোনালি স্মৃতি। তুলি উপলব্ধি করে জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিবারের অবদান কি। সকল ঝড় বাতাসেও এই সম্পর্ক টলে যাওয়ার নয়। এই পরিবারে কোন ক্ষত হতে পারে, তবে পরিবারের মায়া মমতা সেই ক্ষতকে বিনষ্ট করে দিতে পারে- পরিবার কখনও সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে না।
বৃদ্ধ বলল, “এখন বলো, তোমার কি মনে হয়, তোমার বাড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত?”
বৃদ্ধের কথায় তুলির চেতন আসে। চোখের জল তার গাল বেয়ে নেমে আসে, সে বুঝতে পারে তার মনের এই পরিবর্তনের জন্য বৃদ্ধ লোকটির অবদান। তুলি বৃদ্ধ লোকটিকে ধন্যবাদ দিতে ঘুরে দাঁড়ায়, সে বৃদ্ধের দিকে তাকায়, কিছু বলতে যাবে, কিন্তু…বৃদ্ধ লোকটি কোথায়? সে তো তার পাশেই ছিল, কিন্তু এখন নেই! যেন, বৃদ্ধি লোকটির যে উদ্দেশ্য ছিলো তা পূরণ করে নিমিষেই বৃষ্টির ধোঁয়ায় হারিয়ে গেল। তুলি আকাশের দিকে তাকায়, বিদ্যুতের ঝলকানি এখন আর ভয়ানক লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে, আকাশ যেন তার পথকে আরো আলোকিত করে দিচ্ছে। বাড়ি ফেরার তাগাদা তার মনের ভিতর থাকা বিদ্যুৎ চমকানো আর মেঘ গর্জনের ভয় এক নিমিষেই দূর করে দেয়।
তুলি বাড়ির দিকে পা ফেলে, বাবা মায়ের কোলে ফেরার আনন্দে তার চোখের পানি আবারও বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে যায়। তুলি দেখতে পায়, বাবা-মা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কাঁপছে, তাদের চোখ ভিজে গেছে—বৃষ্টিতে নয়, অপেক্ষার কষ্টে। বুকের ধনকে ফিরে পেতে একি আকুলতা। তাদের দিকে দৌড়ে যায় তুলি। বাবা-মা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে—সকল অনুভুতিগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। পরিবার এভাবেই ক্ষত সারায়, সম্পর্কগুলোকে এভাবেই আগলে রাখে জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
তুলি অনুভব করে, ঝড়ের পর সত্যিই ঝলমলে রোদ ওঠে।
0 মন্তব্যসমূহ